একমুঠো বসন্ত পর্ব-১৭

0
758

#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৭

সাফাতকে আমান শেখ তলব করেছেন। রিহি এসে তা জানাতেই সাফাত রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মিলি এতক্ষন নিজের মতো করে মোবাইল দেখছিল কিন্তু রিহির কথা শুনে মনে হলো অনেক জরুরি কিছু জানাবেন। তাই সেও সাফাতের পিছু নিল।
সাফাত দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবছে কী বলতে পারে তার বাবা। রাতে তো সবাইকে একসাথে এভাবে ডাকে না। ব্যাবসা-সংক্রান্ত কোনো কথা থাকলে এভাবে পরিবারের সবাইকে রাখে না। তাহলে কী পারিবারিক কিছুই জানাবেন!

“বাবা?”
আমান শেখ মাথা নিচু করে বসে ছিল। সাফাত একটু এগিয়ে ডাকতেই তিনি চোখ তুলে তাকালেন।

“ডেকেছো যে!”

“তোর বউ কই?” আমান শেখ এদিক ওদিক তাকাতেই সিঁড়ির কাছে মিলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মলিন হাসলো।

“এদিকে আসো মা। ওখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো!”

মিলিকে নিয়ে বাবার এমন আদিক্ষেতা সাফাতের সহ্য হলো না। মেয়েটাকে সে এখন সহ্য করতে পারে না। পরিবারকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতেও পারছে না। কারণ অন্তত আরো কয়েকমাস সহ্য করা লাগবে নয়তো পরিবারে তার জায়গাটা সে একেবারের জন্য হারাবে। না পারছে এদিকে যেতে আর না পারছে ঐদিকে যেতে।

“সাফাত?”

“জি বাবা।” সাফাত এগিয়ে এলো। আমান শেখকে আজ এলোমেলো লাগছে। লাগবেই না বা কেন! একটা মাত্র ছেলের সম্পর্কে এমন সিদ্ধান্ত নিতে তার গা কাঁপছে কিন্তু ছেলেরও একটা নিজস্ব পরিবার আছে তাই না চাইতেও এই সিদ্ধান্তটা নিতে হলো।

“তুমি তোমার বউকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাও। ওখানে আলাদা করে সংসার করো।”

সাফাত থমকাল। তার দৃষ্টি এলোমেলো। বাবা কী বলছে এসব!

“সাফাত?”

“বাবা এসবের মানে কী! আমি তোমাদের ছাড়া থাকার কথা কোনোদিন মাথায়ও আনিনি।” বলেই আবারো অনুনয়ের সুরে বলে উঠল,
“বাবা এমন করো না প্লিজ।”

“আমি তো করছি না। চেয়েছিলাম আমার ছেলে সহ একসাথে থাকবে কিন্তু তুই বিয়ে করেছিস। এখন আমাদের চেয়ে ঐ পরিবারটা তোর উপরে থাকবে।” বলেই তিনি মিলির দিকে তাকালো,
“তুমি এটাই চাচ্ছ তো?”
মিলি তাকালো। এই বৃদ্ধ কেমনে তার পরিকল্পনা বুঝে নিল! পরক্ষনেই মিলির ভাবনা আসলো, যা হয়েছে ঠিকই হয়েছে।এখন এতকিছু ভাবতে হবে না। তার পরিকল্পনাটাতো পূর্ণ হচ্ছে।

“বাবা ওর চাওয়াতে কী এসে যায়!”

“সাফাত! বিয়ে তুমি করেছো। সেই অনুযায়ী মেয়েটার সবকিছুতে খেয়াল রাখার দায়িত্ব তোমার। তোমার স্ত্রী তো আমাদের থেকে আলাদা হতেই চাচ্ছে।”

“বাবা, ভুল আমি করে ফেলেছি। এইটা যদি করো তবে এটা আমার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।”

“তোমার স্ত্রী তো তাই চায়।”

“আমি তো চাইনা, আমি তোমাদের সাথে পরিবারের সাথে মিলে থাকতে চাই।”

“বিয়ের আগে তো পরিবারের কথা ভাবোনি তবে এখন আর বলেও লাভ নেই। তখন যখন ভাবোনি এখনও ভাবার দরকার নেই।” বলেই আমান শেখ বসা থেকে উঠে সিঁড়ির কাছে এগিয়ে যেতে গিয়ে থেমে গেলেন। তিনি সামনের দিকেই তাকিয়ে সাফাতের উদ্দেশ্যে বললো,

“তোমরা চাইলে কালই রওনা দিতে পারো। ভেবো না বের করে দিচ্ছি। তুমি এই বাড়ির একমাত্র ছেলে। তোমার জন্য দরজা সবসময় খোলা।” বলেই আমান শেখ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলে । কেউ ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখতো আমান শেখের চোখেও পানি টলমল করছে। তার একমাত্র ছেলে তার কাছে আর থাকবে না এটা সে ঘুনাক্ষরেও কোনোদিন ভাবেনি কিন্তু আজ হতে চলেছে। হয়ত আজকে ছেলে যেতে চাচ্ছে না কিন্তু বছর ঘুরতেই সে ছেলে আর এখানে আসতে চাইবে না। এটা ভাবতেই আমান শেখের মতো শক্ত মানুষের মন নরম হয়ে যাচ্ছে। না চাইতেও তার একমাত্র ছেলেকে হারাতে হচ্ছে।

———-

পরেরদিন ভার্সিটিতে নিহিলা একাই গেল। অরিনের জ্বর আসায় সে যায়নি কিন্তু পরীক্ষার আগে সবসময় ক্লাসে উপস্থিত হওয়া লাগে তাই বাধ্য হয়েই নিহিলা ভার্সিটিতে এসেছে। ক্লাস শেষ করে রাস্তায় দাঁড়ালো। ভাগ্য খারাপ আজকেই হলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে কিন্তু কোনো সুবিধা মতো গাড়ি পাচ্ছে না। নিহিলার অস্তির অস্তির লাগছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।

“গাড়িতে উঠো।”কণ্ঠস্বর পেতেই নিহিলা মাথা তুলে তাকালো। রাহানের গাড়ি। এই মানুষটা তার সব অস্তির সময়ে কোথ থেকে এসে হাজির হয়ে যায় সে ভেবে উঠে পায় না।

নিহিলা গাড়িতে উঠে বসতেই রাহান গাড়ি ছেড়ে দিল। সামনেই একটা কফিশপ পড়ায় রাহান গাড়ি থামালো। গাড়ি একপাশে রেখে রাহান নিহিলার দিকে তাকাতেই সেও তাকালো। নিহিলা কফিশপটির নাম পড়ে রাহানের দিকে তাকালো,

“আমি তো কফি খাবো বলিনি!”

“তোমাকে কে খেতে বলেছে?

“তো থামালেন যে?”
নিহিলার কথা শুনে রাহান ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
“তোমার জন্য তো থামায়নি। আমার ইচ্ছে করেছে তাই থামিয়েছি।”
মানুষটার এমন সরাসরি জবাবে নিহিলার অপমানবোধ হলো। সে বোকা বোকা প্রশ্ন করেছে তাই বলে এভাবে জবাব দিবে!

রাহান গাড়ি থেকে নেমে নিহিলার দিকে তাকাতেই নিহিলা চোখ ফিরিয়ে নিল।

“চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছ যে? এখানে তো শুভদৃষ্টি করছি না। তুমি যাবে কিনা সেজন্যই তাকিয়েছি। ”

রাহানের এমন কথায় দ্বিতীয়বারের মতো নিহিলার অপমানবোধ হলো। কী আশ্চর্য! এভাবে কথা বলার কী আছে!

“আমি যাবো না।” নিহিলা ফিরে গেল। সে ভেবেছিল রাহান হয়ত ডাকবে কিন্তু সে নিহিলার জবাবের কোনো পরুয়া না করে গাড়ির চাবি নিয়ে নিল।
“ঠিকাছে।”

রাহানকে এগিয়ে যেতে দেখে নিহিলা পিছু নিল। এভাবে একা গাড়িতে সে বসে থাকবে! নিহিলা রাহানের পিছু পিছু হেঁটে কফিশপে ঢুকলো। রাহান দেখেও কিছু বললো না।

রাহান গিয়ে কফির অর্ডার দিতেই কিছু সময় পরে কফি চলে আসলো। নিহিলা আড়চোখে রাহানের দিকে তাকালো। মানুষটা কফি খেতে খেতে মোবাইলে কী জানি দেখছে। তা দেখে নিহিলা মনে মনে গা’লি দিল। একটা মানুষ তার সামনে জীবন্ত বসে আছে তার সাথে একটু কথা বলবে তা না করে মানুষটা নিজের মতো আছে!

“আমাকে না দেখে কফি শেষ করো। উঠবো এখন।”

নিহিলা চোখ ফিরিয়ে নিল। এইবার তার নিজেকেই ধরে গা’লি দিতে ইচ্ছে করছে। আজকে কী হয়েছে কী জানি! একদিনে এতোসব অপমান নিহিলা নিতে পারছে না।

“হেই রাহান।”
নিহিলা তাকালো। একটি মেয়ে এসেই রাহানের পাশে দাঁড়ালো। সে ভ্রু কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরিহিতা এক মেয়ে।
মেয়েটির কথাবার্তার ধরণে বোঝা যাচ্ছে রাহানের অনেক পরিচিত। মেয়েটির এমন উৎফুল্ল সম্বোধনে নিহিলা রাহানের দিকে তাকালো। রাহানের মুখভঙ্গি বোঝা যাচ্ছে না। ভ্রু কুঁচকে মেয়েটির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। নিহিলা মনে মনে ভাবলো হয়ত সে এখানে আছে তাই রাহান বিরক্ত হয়েছে। এমন দুজন পরিচিতের মাঝে নিহিলার থাকতে ইচ্ছে করলো না। আর হয়ত মানুষগুলোরও অস্বস্তি হবে ভেবে নিহিলা টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। নিহিলার এমন করে উঠে সরে যাওয়াতে রাহান দেখেও কিছু বললো না। তা দেখে নিহিলার মনে মনে খারাপ লাগা কাজ করলো। আসলেই তো! সে তো আগাছার মতো ওখানে বসে ছিল।
নিহিলা একটু সরে রেলিং ধরে নদীর দিকে দৃষ্টি দিল। এই কফিশপটি নদীর পাশেই। মাঝে মাঝে হালকা বাতাস। পরিবেশটা অনেক সুন্দর। এজন্যই বোধহয় অনেক মানুষের আনাগোনা। আচ্ছা! রাহান ভাই সবসময় নদী টাইপ জায়গায় কেন যায়! মানুষটার কী নদী পছন্দ! নিহিলা ভাবনাটা সরিয়ে দিল। ঐ মানুষটার কথা সে কেন ভাবছে! যে প্রতি পদে পদে তাকে অপমান করতে এক চুল পরিমানও ছাড়ে না তার কথা কেন ভাববে! আজকের পরে থেকে মানুষটার কথা তার মাথায়ও আনার দরকার নেই।
নিহিলা তাকালো। আচ্ছা, মেয়েটা কে হতে পারে! এভাবে এতো উৎফুল্ল হয়েই বা কেন সম্বোধন করলো! হয়ত রাহান ভাইয়ের অতীব কাছের নয়তো নিহিলাকে উঠে যেতে দেখেও কেন আটকালো না! নিহিলা ভেবেছিল, মানুষটা বলবে।’তুমি উঠছো কেন? বসো।’ কিন্তু বলেনি। আচ্ছা মেয়েটা কী রাহান ভাইয়ের কাছের কেউ! আচ্ছা! তার থেকেও কী কাছের! পরক্ষনেই নিহিলা থমকালো। ছি ছি! সে এসব কেন ভাবছে! নিহিলা তো কয়েকদিনের অচেনা আত্মীয়। তার সাথে এসবের তুলনা সে করছে! নিহিলা তো অনেক নিচের।কোথায় আকাশ আর কোথায় পাতাল!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে