#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৬
সময় চলে যায় নিজস্ব গতিতে। যেটাই হোক না কেন সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না। নিজের মতোই বহমান। নিহিলার যাওয়ার সবকিছু ঠিকঠাক। দেখতে দেখতে যাওয়ার সময়টাও ঘনিয়ে এসেছে। এইতো আজকের রাতটাই তার শেষ রাত। উহু শেষ রাত বলতে আজকেই সাফাত ভাইয়ের সবকিছুর শেষ। বোধহয় পরেরবার যখন আসবে তখন এই স্মৃতিটা নিয়ে নিজের উপরেই হাসাহাসি করবে নিহিলা। দিনগুলো খুব তাড়াতাড়িই যেন চলে গিয়েছে। সাফাতের অনুপস্থিতিতে নিহিলা যাওয়ার আগের দিনগুলো নিজের বাড়িতে ভালোভাবেই কাটাতে পারলো। কিন্তু আসলেই কী ভালোভাবে কাটিয়েছে! রাত হলেই সব তিক্ত স্মৃতি হানা দেয়। এ কয়দিন ঘুমটাও পরিপূর্ণ হয়নি। যে নিহিলা সকাল হতেই ঘুম থেকে জেগে উঠতো সে নিহিলা এখন বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকে। গোছানো স্বভাবটা যেন হুট্ করে পাল্টে গিয়েছে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। রাত হলেই রুমের স্মৃতি থেকে পেরোতে ব্যালকনিতে গেলে আরো বেশি কান্না পায়।
গভীর রাত নেমে এসেছে।চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।নিহিলার চোখে আজ ঘুম নেই। এতদিনও ঘুমাতে পেরেছিল তা না কিন্তু আজকেরটা ভিন্ন। এতদিন রাতের শেষভাগে হলেও ঘুমিয়েছিল কিন্তু আজকে রাত পেরিয়ে যেতেও ঘুম যেন চোখে ধরা দিচ্ছে না। চোখের পানি বাঁধ মানছে না। কেন এতো চোখের পানি আসছে সে বুঝছে না। সে তো কিছু মনে করছে না তবে কেন এতো খারাপ লাগছে। নিহিলাও আর চোখের পানি মুছলো না। সে আজ কাঁদবে। খুব করে কাঁদবে। ব্যালকনিতে গিয়ে প্ৰিয় দোলনাতে হেলান দিয়ে বসে আছে। আস্তে আস্তে ভোর হতে শুরু করেছে কিন্তু নিহিলার হেলদোল নেই। চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছে। বোধহয় চোখও ক্লান্ত। নিহিলা হাসলো। আজকেই শেষ। সাফাত ভাইয়ের স্মৃতি এখানে আজকেই শেষবারের মতো মনে করলো। নিহিলা দূরের ঐ হালকা আলোর আকাশটার দিকে দৃষ্টি দিল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার কারণে দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে আসছে তবুও সে ফেরালো না। সে আপনমনেই বিড়বিড়িয়ে উঠলো,
“সাফাত ভাই!কেন করলেন এমন? খুব কী ক্ষতি হয়ে যেত যদি আপনি আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসতেন? একটু মনেও পড়ে না আমাকে?” শেষের কথাটা বলে সে নিজেই নিজের বোকামো দেখে হাসলো, কেন মনে করবে নিহিলাকে ? উনি তো ভালোই আছে হয়ত। ভালো থাকার জন্যই তো নিহিলাকে ছেড়েছে। ভালো তো থাকতেই হবে। পরমুহূর্তে আবারো ডুকরে কেঁদে উঠলো নিহিলা, “আমার সুন্দর জীবনটাতে কেন এতো বিশ্রী একটা অতীত দিয়ে গেলেন সাফাত ভাই! নিজের মানুষ ভেবেছিলাম আপনাকে! আপনার জন্য পরিবারটাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে। চাইলেও ঘৃণা আনতে পারছি না। তবুও মনে প্রাণে দোয়া করি, যেটার জন্য আমাকে ছেড়েছেন সেটা যেন পূরণ হয়। আপনি যেন আমার মতো ধোঁকা না খান। একজন শুভাকাঙ্খী হিসেবে এটাই চাই। দোয়া করি আপনি যেন সুখে থাকুন। শুধু মাঝখানে পড়ে আমাদের সুন্দর সম্পর্কটা হারিয়ে যাবে।”
নিহিলা কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেল। তবুও সে থামলো না। এই কান্নায় যেন সাফাত ভাইয়ের জন্য শেষ কান্না হয় সেটাই মনে প্রাণে চাচ্ছে। আজকের পরে থেকে আর কোনো স্মৃতি মনে আনবে না।
“চোখের পানি হয়েই জড়তে থাকুক হৃদয়ের গহীন ব্যথাগুলো। ভালোবাসার মানুষটার জন্য যত গহীন ভালোবাসা আছে সব আজ মুছে যাক। মুছে যাক বেপরোয়া মনের লোকায়িত দীর্ঘশ্বাস।”
নিহিলা আশেপাশে তাকালো। সকালের আলো ফুটে উঠছে। তার সুন্দর সুন্দর গাছগুলোতে ফুলের বাহার পড়েছে যেন। এতদিন যত্ন করে সব গাছই এখন ফুল দিতে শুরু করেছে। নিহিলা দোলনা থেকে উঠে গাছগুলোকে হাত বুলিয়ে দিল।
“তোরাও কী আমি চলে যাবো বলে খুশি? এতদিন তো এতো সুন্দর করে ছিলি না। আমি চলে যাওয়ার সময়ই তোদের এতো সুন্দর হতে হলো? আচ্ছা? আমাকে মনে পড়বে তোদের?” নিহিলা হাসলো। এখন ফুল গাছ থেকেও জবাব আশা করছে সে! এই গাছগুলোকেও মনে পড়বে ভীষণ করে। সে পেছনে ফিরে ব্যালকনির আশেপাশে তাকালো। এই প্ৰিয় জায়গাটাকে বড্ড মনে পড়বে কিন্তু কিছু ভালো সময়ের জন্য এই টুকু ত্যাগ তো দিতেই হবে।
———–
রেহেনা বেগম ক্ষনে ক্ষনে কান্নার সুর তুলছেন। পাশেই নিহিলা মাকে জড়িয়ে ধরে চুপটি করে বসে আছে। রেহেনা বেগমের এমন আচরণ দেখে আমান শেখ ধমকে উঠলো,
“আহঃ রেহেনা!তুই এমন করলে মেয়েটা যাবে কীভাবে?”
“ভাইজান, আমি এই মেয়েটাকে ছাড়া কিছু কল্পনাও করতে পারি না।”
“আহঃ, মা, তুমি এমন করিও না তো। মাত্র কয়েকটা বছরই তো। আমাকে তো সবসময় দেখবে।”
“দেখতে পারবো কিন্তু ছুঁতে তো পারবো না।” রেহেনা বেগমের এমন কথায় নিহিলা মাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরলো। আসলেই তো ভিডিও কল আর সামনাসামনিতে অনেক পার্থক্য। দেখা আর ছোঁয়া। এই মায়ের ঘ্রানটা সে পাবে না। সবসময় এটা ওটার বায়না ধরা হবে না। মন খারাপ হলে আর মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের আঁচলের ঘ্রানটা নিতে পারবে না। আর কিছুটা সময় পেরোলেই সে চাইলেও আর মাকে ছুঁতে পারবে না এটা ভাবতেই কান্না চলে আসছে কিন্তু নিহিলা যত সম্ভব নিজেকে উপরে শান্ত দেখানোর চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে সে ঠিক নেই। এখন মনে হচ্ছে কেন এতো দূরে এসব করতে গেল! কেন আগ বাড়িয়ে এতো সব করতে গেল! আবার পরবর্তীতে সাফাতের কথা মনে পড়তেই তার মনে হলো সে যা করেছে ভালোই করেছে। অন্তত এই তিক্ত স্মৃতিটা তো ভুলতে পারবে।
রাশিদা বেগম চোখ মুছে নাক টেনে উপদেশের সুরে বললেন,
“সবসময় কল করবি। খাবার ঠিকমতো খাবি মা।”
“হ্যাঁ, মা অবশ্যই করবো।”
রেহেনা বেগম মেয়ের কপালে পরম আদরে চুমু খেলেন। তার ভাবতেও খারাপ লাগছে এই মেয়েটাকে সে আর কিছুসময় পরে ছুঁতে পারবে না।
কিছুসময় পরে ডাক পড়তেই নিহিলা উঠে দাঁড়ালো। সে রিহিকে জড়িয়ে ধরতেই রিহি কানে কানে ফিসফিসিয়ে উঠলো, “পরেরবার অপেক্ষা করার সময় যেন দুজনের জন্য করি। একটা খুশির খবর যেন পাই।”
নিহিলা কান্নার মাঝে হেসে কান মলে দিতেই রিহি হেসে রেহেনা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো।
“আঃ, চাচী!কেন কান্না করছো। তোমার মেয়ে ওখানে কী যে খুশি থাকবে দেখবে দুদিন পরে আমাদের কথা মনেই পড়বে না।”
রিহির কথায় রেহেনা বেগম অভিমানী চোখে নিহিলার দিকে তাকালো,
“সত্যিই কী মনে পড়বে না?”
রেহেনা বেগমের কথা শুনে রিহি নিহি দুজনেই হেসে দিল। তার মা যে কত অবুঝ তা কিছু কিছু কর্মকান্ডে বুঝা যায়।
“আঃ!মা! রিহি তো মজা করে বলছে আর তা তুমি বিশ্বাস করে নিচ্ছ?”
রেহেনা বেগম আবারো মেয়েকে কাছে টেনে নিতেই ডাক ভেসে আসতেই আমান শেখ তাড়া দিল। নিহি আমান শেখের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেই তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
“নিজের খেয়াল রাখবে মা। যেকোনো পরিস্তিতিতে নিজেকে শক্ত রাখবে, নিজেকে দুর্বল দেখালে মানুষ আরো ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পছন্দ করে। তাই নিজের দুর্বলতা একদম প্রকাশ করবে না। ভালো থেকো মা।”
নিহি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়তেই চোখ থেকে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমান শেখ পানিটুকু মুছে আদেশের সুরে বলে উঠল, “একদম পানি নয়। এটাতো ভুলেও দেখাবে না।” বলেই তিনি তাড়া দিতেই নিহি আরেকবার রেহেনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে হাঁটা ধরলো।
উপরের মনিটর থেকে শেষ বারের মতো আওয়াজ আসলো বোর্ডিং আওয়ার শেষ, যাত্রীদেরকে উদ্দেশ্য করে স্পিকারে বলছে। নিহিলা সবাইকে সালাম দিয়ে হাঁটা ধরলো। যাওয়ার সময় মুখ থেকে কান্নার জন্য আর কোনো কথা বেরোলো না। এতক্ষন উপরে শক্ত দেখালেও এখন আর পারছে না।কান্নারা যেন গলার মাঝে আটকে আসছে। নিহিলা হাঁটতে হাটতেই পেছন ফিরে অস্বচ্ছ কাঁচের দরজা দিয়ে মাকে দেখলো। রেহেনা বেগম ঝাঁপসা চোখে নিহিলাকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে। তাকে রিহি জড়িয়ে ধরে আছে। কাঁচ দিয়ে ঝাপসা দৃশ্যটুকু নিজের মনের কুঠুরীর মাঝে আবদ্ধ করে নিল নিহিলা। যতটুকু পরিবারকে দেখা গেল নিহিলা বারবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে রইল। শেষবার তাকাতেই দেখলো আমান শেখ পেছনে ফিরে গিয়েছেন। নিহিলার মনে হলো বড়ো বাবা কাঁদছে কিন্তু তিনি কেন কাঁদবেন! তার কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না। এরপর চোখ মুছে পা বাড়ালো নতুন জীবনের সন্ধানে।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।