#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৩
দরজা ধাক্কানোর শব্দে নিহিলার ঘুমের ব্যাঘাট ঘটতেই সে বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে নিল। চোখ খুলতেই নিজেকে ব্যালকনির মেঝেতে আবিষ্কার করলো। তাড়াতাড়ি মোবাইল হাতে নিতেই দেখল দুপুর দুইটা বাজে। সকালে বড়ো বাবা বের হতেই সে ব্যালকনিতে নিজের ফুল গাছগুলোর পাশে এসে বসেছিল। আজ নতুন দুইটা গোলাপ ফুটেছে। একটা কাঠগোলাপের কলি এসেছে। পাশেই নয়নতারাগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটে আছে। গোলাপগাছটা তাকে সাফাত ভাইই দিয়েছিলো। ভেবেছিল ভালোবেসেই দিয়েছে হয়ত তাই নিহিলা আজ অনেকগুলো দিন ধরে যত্ন করে যাচ্ছিলো। এতগুলো দিন পরে আজ ফুল ফুটলো কিন্তু তার কেন জানি তেমন খুশি লাগছে না। তবুও নিজের মনকে ভুলোবার জন্য দেয়ালে মাথা হেলিয়ে ফুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে স্মৃতিস্মরণ করতে করতে কখন যে চোখ গুলো লেগে এসেছে বুঝে উঠতে পারেনি।
দ্বিতীয়বার দরজা ধাক্কানোর শব্দে নিহিলা নিজেকে পরিপাটি করে রুমে এগিয়ে আসলো। দরজা খুলতেই মাকে দেখে নিহিলা ফিরে গেল।
“আসো মা।”
“কই ছিলিস? দিন দুপুরে দরজা বন্ধ করে আছিস ক্যান?”
“ঐ একটু ঘুমিয়েছিলাম।” বলেই নিহিলা আলমারির দিকে এগিয়ে গেল।
“তুই তো এই সময়ে কোনোদিনও ঘুমাস না!” রেহেনা বেগম সন্দেহ সূচক চাহনী দিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই নিজেই পরমুহূর্তে কী যেন একটা ভেবে খাটের দিকে এগিয়ে গেল।
মায়ের কথা শুনে নিহিলা নিজেও ভাবলো। তার তো এই সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস কোনো কালেই ছিল না। দুপুর সময়ে বাড়ির সবাই রেস্ট করলেও সে শুধু ঘুরঘুর করতো। তার ধারণা অনুযায়ী ঘুম হচ্ছে শুধুই রাতের জন্য। দিনের বেলা কিসের ঘুম! অথচ আজ নিজেই এমন সময়ে ঘুমালো!
“এখন তো প্রায় যায় মা। তুমি হয়ত রান্নায় ব্যস্ত থাকো তাই জানো না। জানো? এখন ঘুমটাও অনেক ভারী হয়ে গেছে। এ যে তুমি এতবার ডাকলে শুনতেই পেলাম না।”
রেহেনা বেগম মেয়ের দিকে তাকালো। তার ছোট বাচ্চা মেয়েটাও কথা লুকাতে শিখে গেছে। সে যাতে আর কোনো প্রশ্ন না করে তাই কী সুন্দর করে কথা ঘুরাচ্ছে! অথচ তিনি জানেন,নিহিলা অনেক নরম স্বভাবের মেয়ে। ছোটবেলা থেকে কিছু না হতেই কেঁদে কেটে পুরো বাড়ি মাথায় তুলতো । স্কুলে সামান্য কেউ বকা দিলেও সহ্য করতে পারতো না।আর এখন এতো বড়ো বড়ো ঘটনার পরেও কাউকে কিচ্ছুটি না বলে মনের ভেতর বিশাল বড়ো পাথর চাপা দিয়ে কী নিঃসঙ্কোচে কথা ঘুরাচ্ছে! যেন সব স্বাভাবিক অথচ মেয়েটা ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে সেটা রেহেনা বেগম নিজেও বুঝতে পারছেন কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না।
তিনি মেয়ের বিছানার দিকে তাকিয়ে একটা মলিন শ্বাস ফেললেন । তার এই মেয়েটা ছোট থেকেই অনেক গুছানো স্বভাবের। কোনোদিন উঠে তার বিছানা গুছাতে হয়নি, নিহিলাই গুছিয়ে ফেলতো উঠার সাথে সাথে। অথচ আজ বিছানাটা এলোমেলো। তিনি বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে মেয়েকে ফ্রেস হয়ে আসতে বলতেই নিহিলা বাধ্য মেয়ের মতো ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।
নিহিলা বেশ কিছুক্ষন পরে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। নিজেকে যথাসম্ভব উপরে পরিপাটি করে নিল।
ওয়াশরুম থেকে বের হতেই রেহেনা বেগমকে বিছানায় বসে থাকতে দেখলো। রেহেনা বেগম মিষ্টি হেসে মেয়েকে কাছে ডাকতেই নিহিলা এগিয়ে এসে মেঝেতে বসে মাকে জড়িয়ে ধরে কোলে মাথা লুকালো।
“খাবি না?”
এই পৃথিবীতে সত্যিকারের বন্ধু হলো মা। যার কাছে মন খুলে কাঁদা যায়। যার কাছে কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার আগেই বুঝে নেয়। মায়ের কথায় নিহিলা আরো ভালোভাবে মাকে জড়িয়ে নিলো।
“খাবো একটু পরে, একটু থাকো।”
রেহেনা বেগম কিছু না বলে মেয়ের মাথায় পরম আদরে হাত বুলাতে লাগলেন। সে জানে তার এই মেয়ে মন খারাপ হলেই তাকে কাছে চায়। যেমনটা ছোটবেলায় করতো। কেউ কিছু বললেই আগে এসে মায়ের কোলে এভাবে মুখ গুঁজে কান্না করতো। এরপর কান্না করে হাল্কা হয়েই সব বলতো। অথচ এইবার এতো বড়ো কষ্ট পেয়েও মেয়ে তার কাছে আসলো না। শুধুমাত্র মা কষ্ট পাবে বলে! সেটা রেহেনা বেগম বুঝতে পেরেছেন। তার মেয়েটা যখন থেকে বুঝতে শিখেছে একটু আধটু তখন থেকেই মায়ের কাছে এসে আর কষ্টগুলো বলে না। কিন্তু আনন্দগুলো ঠিকই সবার আগে মাকে এসে বলবে। রেহেনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার মেয়েটা এতো বুঝদার! মায়ের কষ্ট হবে ভেবে নিজের কষ্টগুলো আড়ালে ঢেকে রাখে যাতে তার কষ্টে মা যেন দুঃখ না পায়।
নিহিলার চোখ বেয়ে অশ্রু নির্গত হলো। কাঁদবে না কাঁদবে না করেও তার কান্না চলে আসে। সে বুঝতে পারলো এই বাসাতে তার আর থাকা হবে না। এই বাড়িতে থাকলে প্রতি পদে পদে তার অতীতের স্মৃতিগুলো হানা দিবে যেটা সে সহ্য করতে পারবে না। যেটার ফলে নিজের জীবনকে সে গুছিয়ে তুলতে পারবে না।
রেহেনা বেগম মেয়ের চোখের পানি দেখে মেয়ের মুখ তুলে পানিটুকু মুছে দিল।
“কাঁদে না মা। নিজেকে এমন ভাবে তৈরী করবি যাতে কেউ সহজে কাঁদাতে না পারে। এইটার মাধ্যমেই মনে কর আল্লাহ তোর জন্য ভালো কিছু রেখেছে। শুকরিয়া আদায় কর এই ভেবে যে এমন বদ ছায়া থেকে আল্লাহ তোরে আগে আগে সরিয়ে দিয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। যেটা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে। মাঝে মাঝে হোঁচট খাওয়া ভালো। জানি অনেক কষ্টকর কিন্তু এই হোঁচট খেয়েই মানুষ ভালোভাবে বাঁচতে পারে। যেমনটা এঘটনার পরে তুইও মানুষ চিনতে শিখেছিস। উপরে মানুষ ভালো দেখালেও প্রকৃতপক্ষে ভেতরের মুখোশটা যে ভিন্ন সেটা তো বুঝতে শিখেছিস। জীবনে চলতে গেলে এমন হাজারো কিছু হবে। কিছু কিছু স্মৃতি মাথা থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। নাহয় জীবনে চলা কঠিন। সামনে যে এখনো তোর সম্পূর্ণ জীবন রয়ে গেছে। আমি জানি আমার মেয়ে সব ভুলে জীবনকে গুছিয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।”
নিহিলা মাকে আরো গভীর করে জড়িয়ে ধরলো। এই মানুষটা তার মন ভালো করার ওষুধ। এতো সুন্দর করে কেমনে বুঝাতে পারে! সে চাই তার এ মানুষটা কোনোদিন কষ্ট না পাক। অথচ সেই মানুষটার কপালেই প্ৰিয় মানুষটা নেই। এমন কেন হয়!
“মা একটা জিনিস চাইবো। দিবে? আমি যদি তোমার থেকে দূরে গিয়ে থাকতে চাই? দিবে?”
“কী বলছিস মানে…” বলতে বলতেই থেমে গেল। কিছু একটা বুঝতে পেরে তার চেহারা মলিন হয়ে গেল।
তিনি নিহিলার দিকে তাকাতেই তার কান্নারত চোখ দেখে কিছু বলতে নিতেই নিহিলা থামিয়ে দিল।
“প্লিজ মা। আজকে বড়োবাবাকে এই কথাটাই বলবো। জানি তোমার অনেক কষ্ট হবে। এখানে আমি আমার স্বার্থ চাচ্ছি কিন্তু দেখো আমি এবাড়িতে থাকলে তুমিও ভালো থাকবে না। আমি ভালো থাকলে তুমিও ভালো থাকবে। আমার সাথে তুমি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছো।”
“না এটা হতে পারে না। দরকার হলে তোর বড়ো বাবাকে বলে তোকে নিয়ে আমি অনেকদূরে অন্য বাড়িতে উঠবো। তবুও তোকে আমি ছাড়বো না।”
“মা, এতবছর বড়ো বাবা আমাকে দেখেছে। তোমাকে নিজের বোনের মতো করে আগলে রেখেছে। উনি তো আমাদের পর ভাবেনি। তবে তুমি যদি অন্য জায়গায় চলে যাও উনারায় বেশিই কষ্ট পাবেন। অন্যজনের কষ্টের ফল উনারা কেন পাবেন?”
“তাহলে হোস্টেলে ?”
“হোস্টেলে থাকলে যেকোনো সময় এই বাড়িতে আমার আসতেই হবে। কিন্তু আমি কয়েকটা বছর একেবারে সব ভুলে নতুনভাবেই শুরু করে আসবো। এরকম আসলে আমার কোনো কষ্ট হবে না তখন কিন্তু ভুলতে গিয়ে আবারো কয়েকমাস পরে পরে যদি আসি তবে আমি আরো ভেঙে পড়বো। ভালো থাকতে পারবো না মা।”
রেহেনা বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়ের একটা কথাও ভুল মনে হলো না তার। নিজের জন্য কেন মেয়ের জীবনকে বঞ্চিত করবেন সেটা ভেবেই তিনি মেয়েকে কাছে টেনে নিলেন।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।