#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১
“আমাকে এতবছরের স্বপ্ন দেখিয়ে আপনি বিয়ে করে ফেললেন?আপনার আমাকে একটিবারের জন্যও মনে পড়লো না সাফাত ভাই?দুইবছরের ভালোবাসা সব মিথ্যে ছিল?”
বলতে বলতেই নিহিলার চোখ থেকে টুপ্ করে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বুঁকের কোথাও জানি মনে হচ্ছে কলিজাটা কেউ যেন ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কেমনে পারলো মানুষটা এমন করতে!
‘”কিভাবে পারলেন কবুল বলতে!”
বলতে বলতেই কান্নারা যেন দলা ফাঁকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। নিহিলা আর কান্না আটকে রাখতে পারলো না। ডুকরে কেঁদে উঠে মেঝেতে বসে পড়লো।
রেহেনা বেগম মেয়ের এমন পাগলামী দেখে দৌড়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরতেই নিহিলা মাকে জড়িয়ে ধরে সাফাতের দিকে আঙ্গুল তাক করলো,
‘মা, সাফাত ভাই আমার বিশ্বাস ভেঙেছে। উনি তো এতটাও খারাপ না! মা আমার সাথেই কেন এমন হয় বলতে পারো? আমার কাছের মানুষরাই কেন আমার জীবন থেকে হারিয়ে যায়? আমি কী এতটাই অভাগা?’
নিহিলার কথা শুনে সাফাত মাথা তুলে তাকালো। অপরাধবোধে তাকে ঘিরে ধরছে। মেয়েটার কান্না সে সহ্য করতে কেন পারছে না? সে তো ভালোবাসেনি, শুধুই নাটক করেছিল তবু আজ কেন এতো খারাপ লাগছে! নিহিলার দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলো না সে। মাথা নিচু করে ফেলল।
রেহেনা বেগমের মেয়ের এমন আচরণ দেখে নিজের চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে লাগলো। ড্রয়ইং রুমে সবাই নিশ্চুপ হয়ে নিহিলার দিকেই তাকিয়ে রইল। হাসিখুশি নিহিলার এমন পাগলামী কেউই বিশ্বাস করতে পারছে না। নিহিলাকে নিয়ে রেহেনা বেগম রুমে চলে যেতেই ড্রয়ইং রুমে থাকা ঘরের প্রতিটা সদস্যের দৃষ্টি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য নবদম্পতির দিকে পড়লো।
সোফাতে আমান শেখ বাড়ির কর্তা মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল। এতক্ষন থম মেরেই ছিলেন। এইবার উঠে এসে নতুন দম্পতি তথা তার ছেলের দিকে এগিয়ে এলেন।
‘আমি নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না। শান্তভাবেই বলছি বেরিয়ে যা তুই। এ ঘরে তোর আর জায়গা হবে না।’
‘বাবা? এমন করতে পারো না। বাবা আমি…’
আমান শেখ ছেলের সামনে বরাবর এসেই তার গালে সজোরে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল।
সাফাত গালে হাত দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল।
“কিভাবে পারলি তুই এটা করতে! আমার ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতেও লজ্জা করবে। এই শিক্ষা দিলাম তোকে! এতো কষ্ট করে মানুষ করার ফল এটাই দিলি!”বলতে বলতে তিনি কেঁপে উঠলেন। বুঝাই যাচ্ছে, রাগ সংবরণ করার চেষ্টাই আছেন তিনি কিন্তু পারছেন না।
নববধূ আমান শেখের কথার ধরণ দেখে কেঁপে উঠলো। সে অপরাধী-দৃষ্টিতে তার স্বামী নামক ব্যক্তিটির দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।
সাফাত দমে গেল না। বাবাকে বুঝানোর জন্য এগিয়ে আসতেই আমান শেখ দু’কদম পিছিয়ে গেল।
‘খবরদার তোর ঐ মুখে আমাকে বাবা ডাকবি না। বেরিয়ে যা।’
সাফাত আবার কিছু বলতে নিবে তখনই আমান শেখ টেবিল থেকে ছু’রি হাতে নিয়ে তেড়ে এলো।
‘আরেকবার কিছু বলবি তো আমিই শেষ হবো। এই বাড়ির দরজা আজ থেকে তোর জন্য বন্ধ। আর এই এই মেয়েটা? নিহিলার কথা তোর একবারও মনে পড়লো না? কথা রাখতে না পারলে স্বপ্ন কেন দেখিয়েছিলি? আমার সামনে থেকে বেরিয়ে যা।’
‘আমার কথা চিন্তা করে ওকে বের করিও না। বিয়ে করে এসেছে। হোক না আরেকজন তবুও বিয়ের মতো একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তো ওরা বাড়িতে এসেছে। এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। বিশ্বাসঘাতক ওরা হতে পারে কিন্তু আমরা নই। বড়ো বাবা,আমার এই কথাটা রেখো।’ বলেই নিহিলা সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে এলো।
সবাই তাকাতেই দেখলো নিহিলা সিঁড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।
‘নিহি মা?’
আমান শেখ নিহিলার দিকে এগিয়ে গেল । নিহিলার মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিল।
‘যদি পারিস এই বাবাটাকে মাফ করে দিস। ছোটবেলা থেকে তুই আমার চোখের মণি কিন্তু দেখ সবচেয়ে প্ৰিয় মেয়ে হয়েও তোরেই আমি কষ্ট থেকে আগলে রাখতে পারি নি। দেখবি, তুই অনেক সুখী হবি মা। আর কোনো অসৎ মানুষের ছায়া যেন তোর জীবনে না পড়ে।’ শেষ কথাটা আমান শেখ নিজের ছেলেকেই ইঙ্গিত করে বলল।
নিহিলা চোখ মুছে মলিন হাসলো।
‘তাই যেন হয়।’ বলেই আবারো সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল।
রুমে গিয়েই নিহিলা দরজা বন্ধ করার আওয়াজ সবার কানে ভেসে এলো। কিন্তু আমান শেখের আদেশে কেউ এগিয়ে গেল না। মেয়েটা একটু একা থাকুক। নিজের কষ্টগুলো কমাক।
আমান শেখ সাফাত আর মিলির দিকে এগিয়ে এলো। বাকী সবাই চুপ। কারণ এই বাড়িতে আমান শেখ যা বলবে তাই হবে। কিন্তু তা বলে এটা না যে সাফাতের কার্যকলাপে সবাই রাজি।
“এই মেয়ে? তোমার লজ্জা নেই? কেমনে পেরেছো এই অস’ভ্য কাজটা করতে। আমার ছেলে নাহয় অস’ভ্য, তুমি কীভাবে পারলে নিজের পরিবার ছাড়া এভাবে বিয়ে করতে? পরিবারের কী হবে সেটা একবারও ভাবলে না?”বলেই তিনি সাফাতের দিকে তাকালেন,
“শুধুমাত্র নিহিলার জন্যই তোদের এই বাড়িতে জায়গা হয়েছে। মনে রাখবি, আজকের পরে থেকে তুই আমার কাছে থেকে আর কোনো সাহায্য পাবি না।”
“বাবা..!”
“অদ্ভুত না? যার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিলে সেইই তোমাদের থাকার জায়গা করে দিলো!”
আমান শেখ আর ছেলের জবাবের আশা না করে চলে যেতে নিতেই স্ত্রী আমেনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
”নিহিলাকে কিছুক্ষন পরে গিয়ে কিছু খাইয়ে দিও। আমি আর খাবো না। ডাকিও না।”
আমান শেখ দ্রুত প্রস্থান করতেই আমেনা বেগম এগিয়ে এলেন।
“এ জীবনে কোনোদিন তোর বিপরীতে যায়নি। পরিবারের সবাই বিপক্ষে থেকে তোরে শাসন করলেও আমি পারিনি। তোকে আগলে আগলে রাখতাম। সেটাই বোধহয় আমার বড়ো ভুল ছিল। এমন না যে তুই না বলে বিয়ে করেছিস বলে সবাই রেগে। তোর সবচেয়ে বড়ো ভুল হচ্ছে একটা মেয়েকে স্বপ্ন দেখিয়ে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসলি। একটা মেয়ের আবেগ নিয়ে খেললি? আচ্ছা? তুই আমারই ছেলে তো? আমরা তো মানুষ হিসেবে অতটা খারাপ না!” বলেই আমেনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন।
সবাই চলে যেতেই মিলি সাফাতের দিকে তাকালো। তারও মেয়েটার জন্য খারাপ লাগছে কিন্তু কিছুই করার নেই। সাফাত তাকে এই কথাটা বলেনি যে সেও নিহিলার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করেছে। সাফাত শুধু তাকে বলতো যে তার চাচাতো বোন তাকে পছন্দ করে। নিহিলার সাথে আসলেই সম্পর্কে ছিল সেটা মিলি ঘুনাক্ষরেও জানতো না।
সাফাতের কেন জানি বড্ড খারাপ লাগছে। এতদিন রাগের বশে এসব করলেও এখন কেন জানি তার খারাপ লাগছে। নিহিলার চোখের পানিতে তার কেন কষ্ট হচ্ছে! সে তো ভালোবাসেনি নিহিলাকে তবে কেন এমন লাগছে? সে কী বেশিই করে ফেলছে?
এই বাড়িতে আমান শেখ সব ছেলেমেয়েদের থেকে নিহিলাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। এমন কী নিজের ছেলে আমানের থেকেও। ছোট বেলায় নিহিলার চারবছর হওয়ার আগে থেকে আমানই ছিল পরিবারের প্ৰিয় পাত্র। কিন্তু নিহিলার বাবা মারা যাওয়ার পরে থেকে তখন নিহিলার বয়স চারবছর তখন থেকে নিহিলাকেই সবাই বেশি ভালোবাসে। এমন কী আমান শেখও। সাফাতের এখনো মনে পড়ে ওর সবচেয়ে প্ৰিয় একটা গাড়ি ছিল। সেটা ওর এতোই প্ৰিয় ছিল যে সে সেটা আলমারিতে তুলে রাখতো। খেলতোও না, শুধুমাত্র পুরোনো হয়ে যাবে তাই। কিন্তু নিহিলা এসে সেটারই বায়না ধরতেই আমান শেখ দিয়ে দিল। দাদা থাকাকালীনও নিহিলা সবচেয়ে প্ৰিয় মুখ ছিল। সেগুলো সাফাতের পছন্দ হতো না। কিন্তু আজ কেন খারাপ লাগছে সাফাতের! তারও কী মায়া জন্মে গিয়েছিল!
——
নিহিলা রুমে এসেই মেঝেতে হাটু মুড়ে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লো। তার সাথেই কেন এমনটা হয়! কতই না স্বপ্ন দেখিয়েছিল মানুষটা তবে এসব কী কিছুই না! একটা মানুষ এতগুলো দিন কিভাবে ঠকাতে পারে! আচ্ছা? সাফাত ভাই কী তাকে একটুও ভালোবাসতো না? অন্তত এতগুলো দিনে একটুও কী মায়া বসেনি? কেমনে পারলো মানুষটা!
নিহিলা চোখ মুছে ফেলল। আর কাঁদবে না সে। কেন কাঁদবে সেই মানুষটার জন্য যে তাকে এতো নির্মমভাবে ঠকিয়েছে তার জন্য কেন মনকে নরম করবে। তার শক্ত হওয়া উচিত। ভেঙে যাওয়া থেকে মানুষ ভালোভাবে উঠে দাঁড়াতে পারে। সেও পারবে। কিন্তু পরক্ষনে ভাবলো,প্রতিটা মুহূর্তে মানুষটার মুখোমুখি হলে সে কী ভালো থাকতে পারবে! যে স্বপ্নটা তাকে দেখিয়েছিল সে স্বপ্নটা অন্যজনের সাথে পূরণ করতে দেখে সে নিজেকে কী ঠিক রাখতে পারবে! মুখে যতই বলুক, সে তো পারবে না। ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাবে। অন্তত মানুষটার মুখোমুখি না হলেই আস্তে আস্তে ভুলতে পারবে কিন্তু এক বাড়িতে কীভাবে কয়দিন এভাবে রুমবন্দী হয়ে থাকতে পারবে! কীভাবে সহ্য করবে! কী করা উচিত তার!
#চলবে ইন শা আল্লাহ।