‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~১৯||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
অঙ্কিতের কথা শুনে আমি আর কোয়েল পিছন ঘুরে তাকাতেই দেখলাম আদিত্য এক হাতে পকেটে গুঁজে আরেকহাতে ফোন ঘাটতে ঘাটতে আসছেন আর ওনার পকেটে গোঁজা হাতের বাহু জড়িয়ে জিয়া হাসতে হাসতে এদিকেই আসছে। জিয়া নিজের মতো কথা বলছে হেসে হেসে আর আদিত্য মাঝে মধ্যে হেসে ওর দিকে তাকাচ্ছেন। এসব দেখে আমি কোয়েলের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলাম অর্থাৎ একে মেনে নিতে বলছিলি তুই আমায়।
‘কি ব্যাপার তোরা এখানে কি করছিস কোয়েল?’
‘আমরা এখানে কি করছি না করছি জেনে তোর কি কোনো কাজ আছে?’
কোয়েলের কথায় জিয়া হেসে আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
‘একদমই না। আমি আমার পার্টনারকে এতদিন পর পেলাম আমার কাছে, আমার মতো করে। আমার আর কোনো কিছুর দরকারই নেই। মৌমিতা তো খুব কষ্ট পাচ্ছিলো আদিত্যের না আসায় তাই একটু দেখা করাতে এলাম ওর সাথে।’
আমি জিয়ার কথার কোনো উত্তর দিতে যাবো এমন সময় সৌভিকদা বললো,
‘বাট যাকে দেখা করাতে এনেছিস সে তো চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না মৌমিতার দিকে।’
জিয়া আর সৌভিকদার কথায় সবাই হাসতে থাকলো ওদের দলের। আমি শুধু একবার আদিত্যের দিকে একবার তাকালাম তিনি তখনও একভাবে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন। জিয়া আবার বললো,
‘আসলে কি বল তো? দেখতে ভালো লাগবে তারপর তো আদি ওকে দেখবে। আদি কেন, কোনো ছেলেই এমন বেহেনজিদের দেখতে চাইবে না। চল, চল।’
ওরা চলে যেতেই আমিও চলে এলাম ওই জায়গা থেকে। পিছন থেকে কোয়েল ডাকলেও সাড়া দিলাম না। তাই কোয়েল আমার সামনে এসে আমার পথ আটকে দাঁড়ালো।
‘কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাস না?’
‘ভালো লাগছে না। যেতে দে।’
‘এভাবে মাথা গরম করিস না মৌ। পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা কর, আদিত্যদা…
‘আমি আর কোনো কিছু শুনতে চাই না ওনার সম্পর্কে। প্লিজ।’
আমি কোয়েলের কাছে হাত জোড় করে কথাটা বলতেই কোয়েল চুপ করে গেলো।
‘ক্লাসে যাবি না?’
‘নাহ তুই যা। আমার একদম ইচ্ছা নেই।’
‘হস্টেল ফিরে যাবি নাকি তাহলে?’
‘নাহ, লাইব্রেরি যাচ্ছি। তোর ক্লাস শেষ হলে একসাথে যাবো। আমাকে একটু নোটসটা দিয়ে দিস। আমি আসলাম।’
কোয়েলকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে এলাম। সত্যি কিছুই ভালো লাগছে না। এভাবেও মানুষ পরিবর্তন হতে পারে? যেই আদিত্য কিছুদিন আগেও আমাকে জিয়ার থেকে আগলে রাখছিলো আজ সেই আদিত্যই মুখ বুজে সবটা মেনে নিলেন। মাঝে মাঝে হাসি পায় নিজের কপালের উপর, আমি জানো সবার হাসির খোরাক হয়ে উঠেছি। মনে মনে ঠিক করেছিলাম কোয়েলের কথাগুলো ভেবে দেখবো। উনি যদি সত্যি সবটা ঠিক করতে চায় তাহলে ওনাকে আর আমাদের এই সম্পর্কটাকে একবার সুযোগ দেবো। কিন্তু এখন তো আর এসবের প্রশ্নই আসে না।
৩৪.
কোয়েল ক্লাস শেষ করেই লাইব্রেরির দিকে আসছে তা মাথা তুলতেই দেখতে পেলাম। এদিক ওদিক তাকিয়েই বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছি বই পড়ার থেকে। মন বসছে না কিছুতেই। কোয়েল এসে আমার পাশে বসলে আমি বললাম,
‘হস্টেল যাবি তো?’
‘উমম…নাহ।’
‘তো? কোথায় যাবি?’
‘চল তো আগে তারপর বলবো।’
‘মানে টা কি..??
আমি কথা শেষ করার আগেই কোয়েল আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলতে শুরু করলো। না জানি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। বেশ অনেক্ষন হাঁটার পর দেখলাম কোয়েল শপিং মলে ঢুকছে।
‘এখন আবার কি কিনবি?’
‘ওই কিছু মেক-আপ আর ড্রেস কিনতে হবে। চল।’
আমিও আর বাঁধা দিলাম না এমনিতেও মন ভালো নেই। হস্টেলে গিয়ে শুধু বসে থাকলে সেই একই ভাবনাগুলো ঘোরাঘুরি করবে আর শান্তি পাবো না। তার থেকে কেনাকাটা করলে হয়তো একটু শান্তি পাওয়া যাবে। শপিং মলে ঢুকে ড্রেস যেখানে পাওয়া যায় সেই ফ্লোরে চলে গেলাম। ড্রেস দেখতে দেখতে হঠাৎ কোয়েল বলে উঠলো,
‘আচ্ছা অঙ্কিত কেন কিছু বললোনা তখন?’
আমি কোয়েলের কথা শুনে তাচ্ছিল্য হেসে বললাম,
‘যার বলা উচিত সেই যখন কিছু বলেনি তখন অঙ্কিত কি বলবে বল তো?’
‘সত্যি কি তাই? আগের দিন তো বললো।’
‘আগের দিনের ঘটনার সাথে আজকের দিনের ঘটনার অনেক তফাৎ আছে কোয়েল। বেকার আদিত্যকে ভালো ভাবার জন্য অন্য সত্যিগুলোর মধ্যে মিথ্যে খোঁজা বন্ধ কর।’
আমি অন্য পাশে চলে এলাম কথাটা বলে। বিষয়টা একটু হলেও ভাবাচ্ছে এখন আমাকে কিন্তু অঙ্কিত বলতোই বা কি?
‘কম সে কম জিয়াকে থামতে তো বলতে পারতো অঙ্কিত? ও আর আদিত্যদার পজিশন কিছু কম না একে অপরের থেকে। একটা মানুষ হুট করে কি করে এতটা বদলে যেতে পারে? কিছুদিন আগেই তোর এতটা খেয়াল রাখছিলো আর আজ পাত্তাই দিলো না? এটাই ভাবাচ্ছে আমাকে দ্যাট সেট।’
কোয়েল আমার পাশে এসে কথাটা বললে আমি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এই একই কথা তো আমাকেও ভাবাচ্ছে। এতটা বদল?
‘ছাড়, এসব নিয়ে ভেবে কাজ নেই। ওই দেখ ওদিকে কি সুন্দর একটা লেডিস জ্যাকেট। চল।’
আমি আর কোয়েল ড্রেস কিনে নিলাম অনেকগুলো। এতেই হাত ভর্তি হয়ে গেছে, এই মেয়ে নাকি এখনও জুতো, মেক-আপ কিনবে। এতকিছু নিয়ে বাড়ি ফিরবো কি করে এটা ভাবলেই আমার হাড়-হিম হয়ে যাচ্ছে।
‘এই কোয়েল, চল আজকে আর দরকার নেই আবার কালকে আসবো।’
‘চুপ করবি তুই?’
কোয়েল রেগে ধমক দিলে আমি আমতা আমতা করে বললাম,
‘এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি নাকি এতগুলো ব্যাগ নিয়ে? কতগুলো বল তো? দু-হাতে শুধু ব্যাগ আর ব্যাগ।’
__’আমি থাকতে ম্যাডামদের আর কোনো কষ্ট করতে হবে না।’
আমি পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম অঙ্কিত। ওকে দেখে আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তুমি এখানে কি করে?’
অঙ্কিত আমার কথার উত্তর দেবে তার আগেই কোয়েল নিজের হাতের জিনিসগুলো ওর হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললো,
‘আমি ডেকেছি। না এবার চটপট তোর ব্যাগগুলো দে ওকে।’
অঙ্কিতের কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে হাসি পেয়ে গেলো। কিন্তু কোয়েলের দিকে তাকাতেই ওর রাগী মুখ দেখে চুপচাপ অঙ্কিতের হাতে দিয়ে দিলাম ব্যাগগুলো।
‘বাপ রে, পুরো শপিংমলটা কিনে ফেলেছো তো?’
‘কি বললে?’
‘ককিছু না। আমি আসি হ্যাঁ।’
অঙ্কিত কোয়েলের ভয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়লো। আমি সেই দেখে কোয়েলের দিকে তাকাতেই হেসে দিলো কোয়েল। আমিও হেসে দিলাম ওর সাথে সাথে।
‘ইশ, বেচারাটার মুখটা দেখেছিলি?’
‘আজকে চুপ করে থাকার শাস্তি। ভালো হয়েছে। এখন চল, ভিতরে চল।’
আমি কোয়েলের কথা অনুযায়ী সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম স্পা পার্লর। আমি কোয়েলের হাত ধরে সঙ্গে সঙ্গে বাঁধা দিয়ে বললাম,
‘তুই পাগল হয়ে গেছিস? আমরা এখানে কেন যাবো?’
‘স্পা পার্লরে মেয়েরা কেন আসে বইন?’
‘আরে বাবা আমার কাছে এতো টাকা নেই। এখানে কত খরচ জানিস?’
‘চুপ করবি তুই? টাকা নিয়ে ভাবতে হবে না চল তুই।’
‘আরে না না। আমি একদম যাবো না।’
‘তুই যাবি না তোর ঘাড় যাবে, চল।’
কোয়েল আমাকে জোর করে, একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে ভিতরে নিয়ে গেলো আমাকে। কতবার পালানোর চেষ্টা করলাম পালাতে পারলাম না। কি যে নার্ভাস লাগছে আমার, কত টাকা বিল হবে এই ভেবেই আমার আত্মারাম খাঁচা হয়ে যাচ্ছে।
স্পা শেষে ওখান থেকে বেরিয়ে এলে কোয়েল আমাকে বললো,
‘চল, চুল কাটবো। খুব একটা দেরী হয়নি।’
আমি না বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে আছি কোয়েলের দিকে। স্পা পার্লরে দেখতেও পেলাম না কিভাবে পে করলো। এখন আবার বলছে চুল কাটবে?
‘কি রে? এরকম হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল।’
আমাকে টেনে টেনে কোয়েল নিয়ে গেলে আমি কিছুই বুঝলাম না। চুল কাটার পর, চুলে স্পা করে কোয়েল আমার সাথে বেরিয়ে এলো।
‘পে করলি না?’
কোয়েল হাসলো আমার প্রশ্নের উত্তরে আর হঠাৎ করে চোখের সামনে একটা ক্রেডিট কার্ড ধরলো। তারপর সেটা নামিয়ে নিয়ে বললো,
‘মেক-আপ আর জুতো কিনে ডিরেক্ট একটা রেস্টুরেন্টে যাবো দ্যান হস্টেল। ভাগ্যিস আজকে ভার্সিটি থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে ছিলাম লাঞ্চের পর পরই।’
‘কিন্তু এটা কার ক্রেডিট কার্ড?’
‘রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি, আর কিছু? আর একটা প্রশ্ন করলে এইখান থেকে ধাক্কা মাইরা ফেলায় দিমু। হুহ!’
কোয়েল আগে আগে হেঁটে গেলে আমি ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। কি আজব মেয়েরে বাবা! কিন্তু ও আমার জন্য এতো কিছু কেন করছে? যে কোনো দিন অন্য কাওর সাথে তেমন মেশেনি সে আজ আমার জন্য এতো করছে? কেন?
‘কি রে ব্যাঙ! চল না। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো?’
আমি আর কথা না বাড়িয়ে কোয়েলের সাথে এগোলাম। কোয়েলের কথা মতো মেক-আপ, কসমেটিকস, জুতো কিনে, মল থেকে বেরিয়ে রেস্টুরেন্টে চলে গেলাম। ডিনার সেরে হস্টেলে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ বই পড়ার পর হঠাৎ শাশুড়ি মায়ের ফোন এলো।
‘হ্যাঁ, মা বলুন।’
‘কেমন আছিস? সব ঠিক আছে তো?’
‘হ..হ্যাঁ সব ঠ..ঠিক আছে। আপনারা কেমন আছেন? শরীর ভালো আছে তো?’
‘আমরা ঠিক আছি। তা তুই তো ওখানে গিয়ে আমাদের ভুলেই গেছিস। একটুও কি মনে পরে না আমাদের বুড়ো-বুড়ির কথা?’
‘আরে না না। তেমন কিছু না মা।’
‘তেমন কিছু যখন না তাহলে প্রথম পরীক্ষার আগে আগে আমাদের এখানে একবার চলে এসো বউমা। আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না, কালকেই তুমি এখানে আসছো। রাখলাম, শুভ রাত্রি।’
মায়ের কাছ থেকে বাবা ফোন নিয়ে আমাকে এটুকু বলেই ফোন রেখে দিলেন। আর আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। কালকের মধ্যে কিভাবে যাবো কলকাতা? ব্যাগ ট্যাগ তো কিছুই গোছানো হয়নি।
‘ঘুমিয়ে পর এক্ষুনি। সকালে তাড়াতাড়ি উঠে বেরিয়ে পড়বি।’
কোয়েলের কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ব্যাগ গোছানো হয়নি তো।’
‘আমি গুছিয়ে দিচ্ছি তুই যা, ঘুমা।’
কোয়েলের কথা মতো ঘুমোতে চলে গেলাম। ও সবই জানে আমার কি জিনিস লাগবে না লাগবে যেমন আমি জানি ওর বিষয়ে। তাই আর চিন্তা না করে ঘুমোতে চলে গেলাম।
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~২০||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৩৫.
ইউনিভার্সিটির সামনে একটা সাদা ধবধবে মারসিডিস এসে দাঁড়ালে সবার চোখ সেটার দিকে পরে। কারণ ভার্সিটির প্রায় স্যার ম্যাডামরা এসে পড়েছেন ভার্সিটিতে আর বাদবাকি স্টুডেন্টসদের মধ্যে যারা গাড়ি নিয়ে আসে তারাও প্রায় এসে পড়েছে ইতিমধ্যে। তাহলে এটা কে? সবার মনে জাগা প্রশ্নের উত্তর কিছুক্ষনের মধ্যেই সবাই পেয়ে গেলো।
গাড়ি থেকে নামতেই দেখলাম সবার নজর আমার দিকে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন এই মারসিডিস গাড়ি করে আমিই এসেছি। শুধু এটুকুই নয় আজ আমি এসেছি ডেনিম জিন্স, একটা হুডি তার সাথে নরমাল মেক-আপ। চুলগুলো ছোটো করে কাটা, ঘাড় অবধি। নিজের লেডিস ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ড্রাইভারকে বললাম,
‘তুমি চলে যাও। আমি হস্টেলেই থাকবো তাই গাড়ির প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলে আমি ডেকে নেবো তোমাকে।’
‘ওকে ম্যাডাম।’
ড্রাইভার চলে গেলে আমি ভার্সিটিতে প্রবেশ করলাম। সবার রিয়াকশন দেখে হাসলাম হালকা। কিছুটা যেতেই কোয়েল এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। কোয়েলকে পাশ কাটিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখলাম অঙ্কিত হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর তাকানো দেখে আমি আর কোয়েল দুজনেই হেসে ফেললো।
‘চল গিয়ে ওর মুখটা বন্ধ করে নাহলে মশা ঢুকে যাবে।’
আমি আর কোয়েল হাসতে হাসতে অঙ্কিতের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে অঙ্কিতের হুঁশ তাও ফেরে না। আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে, দুজন দু-গালে থাপ্পড় দেই অঙ্কিতের গালে আর ও লাফ দিয়ে পিছনে সরে যায়।
‘এই, এই, এই মারলি কেন আমায়?’
‘অভাবে হাঁ করে কি দেখছিলে তুমি আমার দিকে।’
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলে অঙ্কিত আমতা আমতা করতে থাকে। পাশ দিয়ে কোয়েল বলে,
‘আমাদের অঙ্কিত দাদা কিরাশ থুক্কু ক্রাশ খেয়েছে তোর উপর। তাই তো দাদা?’
‘কে দাদা? কার দাদা? কোথাকার দাদা? কবেকার দাদা? আমি কাওর দাদা নই।’
আমরা অঙ্কিতের কথা সমানে হেসে যাচ্ছি সেই দেখে অঙ্কিত গাল ফুলালো। কোয়েল আমাকে কানে কানে বললো,
‘পিছে দেখো পিছে।’
আমি পিছন ফিরতেই দেখলাম জিয়া ওর পুরো দলবল নিয়ে আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আদিত্যের অবস্থাও এক। এটা দেখে হাসলাম আমি।
‘কোয়েল, চল।’
আমি ইচ্ছা করেই ওইদিকে এগিয়ে গেলাম যেখানে জিয়ার দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওদের সাথে কথা না বলে ওদের না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে জিয়া আমার নাম ধরে পিছন থেকে ডাকে,
‘মৌমিতা!’
আমি পিছন ফিরলে জিয়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে পা থেকে মাথা অবধি দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘তুই মৌমিতা তো?’
‘(হেসে) কেন বিশ্বাস হচ্ছে না? অবশ্য হবেই বা কি করে? যাকে এতদিন বেহেনজি ভাবতিস সে তোদের মতো মডার্ন ড্রেস পরে এসেছে। যাকে মিডিল ক্লাস মেয়ে ভাবতিস সে মারসিডিস নিয়ে ভার্সটি আসছে। চোখের সামনে এমন চেঞ্জস দেখলে যে কাওরই তোর মত অবস্থা হওয়ার কথা। আসলে তুই একটা কথা ভুলে গেছিলি, আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি ভবিষ্যতে আর ভুলিস না জানো। ডোন্ট জাজ আ বুক বাই ইটস কভার।’
আমরা চলে এলাম। পিছন ফিরে দেখার প্রয়োজন মনে করিনি আর। ক্লাস করার পর আমি, কোয়েল আর অঙ্কিত ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছি তখন দেখলাম জিয়া একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। কথা বলছে বললে ভুল হবে, বলা যায় ঢলে পড়ছে ছেলেটির গায়ে। আমরা তা পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরোতে গেলে ছেলেটির গলার আওয়াজ পাই।
‘এক্সকিউজ মি?’
‘ইয়েস?’
আমি দাঁড়ালে ছেলেটি জিয়ার সাথে কথা বলা বন্ধ করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
‘আমার একটু কথা ছিলো আপনার সাথে। একটু সাইডে আসবেন, ইটস পার্সোনাল।’
আমি কোয়েলের দিকে তাকালে ও যেতে বলে আমাকে ইশারায় কিন্তু অঙ্কিত অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। কি জানি এ ছেলের কি হয় মাঝে মাঝে। আমি দেরী না করে ছেলেটার সাথে কথা বলতে শুরু করি।
‘বলুন কি বলবেন?’
‘আপনি আমাকে চেনেন নিশ্চই? আমি ইংলিশ অনার্সের ডিপার্টমেন্ট এরই।’
‘উম, হ্যাঁ। মুখ চিনি, এটুকুই। এর চাইতে বেশি চেনার সুযোগ কোনোদিন হয়নি।’
‘সুযোগ পেয়ে গেলে কাজে লাগাবেন?’
‘মানে? ঠিক বুঝলাম না।’
‘মানে এটাই যে আমি আপনাকে আমাকে চিনে নেওয়ার একটা সুযোগ দিতে চাই। আমার ভাষায় বলতে গেলে, আমি আপনাকে চেনার একটা সুযোগ চাইছি। সেটা কি দেওয়া যাবে আমায়?’
ছেলেটার কথা বার্তা বেশ ভালো সঙ্গে দেখতেও সুন্দর। অবশ্য সুন্দর না হলে জিয়া কথা বলতো না। কথাটা ভাবতেই হেসে ফেললাম।
‘উমম, কিলার স্মাইল! তার মানে সুযোগটা পেলাম তো?’
‘হ্যাঁ, ফ্রেন্ডশিপ করতে নো প্রবলেম। আপনি ডাইরেক্ট বললেই পারতেন, এতটা এফর্ট দিয়ে ইমপ্রেস করার কিছুই ছিলো না।’
‘পেয়ে গেছি এটাই অনেক। বায় দ্য ওয়ে আই এম রণিত, রণিত সান্যাল।’
‘ইটস মৌমিতা, মৌমিতা ব্যানার্জী!’
আমি হাত বাড়িয়ে হেসে হ্যান্ডশেক করলাম। ঠিক তারপরেই চোখ গেলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আদিত্যের দিকে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ রেগে আছেন। রেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন তো সবে শুরু, এখনই রেগে গেলে কি করে হবে?
‘আচ্ছা, আমার ফ্রেন্ডরা আমার জন্য ওয়েট করছে আমাকে যেতে হবে।’
‘ইয়াহ, শিওর।’
আদিত্যকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলে আমি আমার হাত ছাড়িয়ে কোয়েলদের কাছে চলে এলাম। ক্যান্টিনে এসে বসতেই দেখলাম অঙ্কিতের মুখটা কেমন জানো ভার। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো তার আগেই কোয়েল আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি বললো রে রণিত?’
‘ফ্রেন্ডশিপ করতে চাইলো।’
‘ও এই ব্যাপার, বুঝলাম বুঝলাম।’
‘কি বুঝলি?’
‘ব্যাপার ইজ, প্যাহলে ফ্রেন্ডশিপ উসকে বাদ রিলেশনশিপ।’
‘ধ্যাৎ!’
‘কেন? তোর রণিতকে পছন্দ না? খুব তো হেসে হেসে কথা বলছিলি? আবার হ্যান্ডশেকও করলি। হাতটা জানো ছাড়তে মনই চাইছিলো না। আমি তো ভেবেছিলাম তুই বোধহয় হাতে ফেভিকল লাগিয়ে গেছিলি।’
অঙ্কিতের এরকম একনাগাড়ে তীক্ষ কটাক্ষ শুনে আমি আর কোয়েল দুজনেই একে অপরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। অঙ্কিত তা বুঝতে পেরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ওসব ছাড়। এটা বল, তোর এই হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ কি?’
আমি অঙ্কিতের কথা শুনে কোয়েলের দিকে তাকালাম। কোয়েল বললো,
‘মৌমিতা ওর বাড়িতে গেছিলো। ওর বাবা-মার কাছে।’
কোয়েল আমার হাতে জোরে চেপে কথাটা বললে আমি চোখের ইশারায় ওকে বোঝাই আমি বুঝেছি। আমি বলতে শুরু করি,
ফ্লাশব্যাক……………………………………………………….
আমি শ্বশুরবাড়িতে ঢুকতেই দেখলাম ড্রয়িংরুমে শাশুড়ি মা বসে আছেন। আমি নিজের ব্যাগটা রেখে ওনার কাছে গিয়ে ওনাকে প্রণাম করতেই উনি খুশি হয়ে আমায় আশীর্বাদ করে জড়িয়ে ধরলেন আর বললেন,
‘যাও, দেরি না করে চটপট ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর আমরা অনেক গল্প করবো।’
আমি শাশুড়িমার কথায় হেসে সায় দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে শাশুড়ি মায়ের পাশে বসে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘মা, বাবা কোথায়?’
‘উনি তো অফিসের কাজে বাইরে গেছেন আজকে সকালেই। যাওয়ার একটুও মন ছিলো না কিন্তু কি আর করবেন যেতে তো হবেই। আর কে বা যাবে ওনার হয়ে?’
‘মা একটা কথা বলবো? কিছু মনে করবেন না তো?’
‘হ্যাঁ বলো না।’
‘আদিত্য ব্যবসার কাজে সাহায্য করেন না কেন?’
আমার প্রশ্ন শুনে শাশুড়ি মা অনেকটাই হতাশ ভাবে বললেন,
‘ওর ইচ্ছা ও নিজে ব্যবসা করবে পড়াশোনা শেষ করে। তার আগে কোনো দায়িত্ব নিতে ও নারাজ। ওর মনে হয় পড়াশোনার মাঝে ব্যবসা এখনই চলে আসলে ওর পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আর তাছাড়া ওর বাবা চাইতো ও গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট করেই ব্যবসায় যোগ দিক। এই নিয়ে একটা অশান্তি শুরু হয়। পরে ওর বাবা ব্যবসা সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেলে আদিকে ব্যবসায় যোগ দিতে বললেই আদির মনে হয় ওর বাবা চায় না ও পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াক। এই নিয়ে তখন শুরু হয় আরেক ঝামেলা। এরপর থেকে আদি বাড়িতে বেশি আসতো না, কেমন একটা উচ্ছশৃঙ্খল জীবন কাটাতে শুরু করেছিল। সেই সময় আমরা তোমায় দেখতে পাই আর আমাদের মনে হয় তুমিই পারবে ওকে আবার ঠিক করতে। কথায় বাধ্য করতে। কারণ আদি কখনোই কাওর কথা শোনেনা আর নিজের আপন লোক ছাড়া কাওর কথা ভাবে না।’
শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে চুপ করে রইলাম। উনি এতোই যখন আপন লোকের কথা ভাবে তখন নিজের বাবার কথা কেন ভাবেন না? বয়স হয়েছে ওনার, এখন কি আর পারে ব্যবসার এতোদিক সামলাতে?
‘আমাকে আর তোমার বাবাকে ক্ষমা করো বউমা। (হাত জোড় করে) নিজের ছেলের কথা ভাবতে গিয়ে আমরা তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিলাম। আমরা জানি আদি তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করে না।’
‘না না মা। আমার কাছে কেন এভাবে হাত জোড় করছেন? বড়রা যা করে তা ভালোর জন্যই করে। আমার বাবা-মা হয়তো আমার ভালো ভাবেই বিয়ে দিয়েছেন তাছাড়া নিয়তির লেখা কে বা খণ্ডাতে পারে বলুন? আপনারা প্লিজ নিজেদেরকে অপরাধী মনে করবেন না।’
শাশুড়ি আমার কথা শুনে আমাকে বুকে টেনে নিলেন।
‘কেন যে আমার ছেলেটা এমন করছে কে জানে? ও নিজের ভালো টা বুঝলে তোমাকে কবেই মেনে নিতো।’
‘ম..মা। আমার মনে হয় আপনার ছেলে অন্যকাউকে পছন্দ করে। আমি তো খুব সাধারণ, আমাকে ওনার সাথে মানায়ও না।’
শাশুড়ি মা আমার কথা শুনে হাসলেন। আমি সেটা দেখে অবাক হয়ে তাকাতেই উনি বললেন,
‘তুমি কি জিয়ার কথা বলছো?’
‘(অবাক হয়ে) আপনি জানেন জিয়ার ব্যাপারে?’
‘অবশ্যই। জিয়া হলো গিয়ে তোমার শ্বশুরমশাইয়ের বিজনেস রাইভালের মেয়ে। আমার আদির পিছনে পাগল। আমার আদি শুধুমাত্র ওকে লাই দেয় যাতে ওর বাবা আমাদের বিজনেসের কোনো ক্ষতি না করে তাই। তাছাড়া উনি আবার ভার্সিটির ডাইরেক্টর। আগে থেকেই ছিলেন কিন্তু সেটা এখন অফিসিয়াল হলো।’
আমি শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে অবাকই হলাম প্রায়। জিয়ার বাবা, বাবার বিজনেস রাইভাল? শাশুড়ি মা আমার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিলে আমি ভাবনা থেকে বেরিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। উনি বললেন,
‘সব ঠিক আছে তো ওখানে?’
‘হ্যাঁ, মা। ঠিকই আছে।’
‘আমাকে মিথ্যে বলো না। কিছুক্ষণ আগে কেন বললে তোমাকে আদি পছন্দ করে না তুমি সাধারণ বলে?’
‘আ..আসলে…
‘একটুও দ্বিধাবোধ না করে আমাকে খুলে বলো। কি কি হয়েছে এতদিন? আগেরবার যখন হঠাৎ করে নিজের বাড়ি গেছিলে তখনই আন্দাজ করে ছিলাম।’
আমি শাশুড়ি মায়ের আশ্বাস পেয়ে ওনাকে জিয়ার ব্যবহারের কথা সব খুলে বললাম। কথা শেষ করে ওনার দিকে তাকালে দেখলাম উনি রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কিছু বলতে যাবো তখনই উনি আমার মাথায় আলতো একটা গাট্টা মেরে বললেন,
‘বোকা মেয়ে। তা তুমি কি ওখানে কোনো শপিং মল দেখোনি? এখনকার মেয়েরা যেমন ড্রেস পরে সেই ড্রেস কিনে নিতে, যা টাকা লাগতো তা আমাদের বলতে। আর কে বলেছে তোমাযে ট্রেনে করে যাতায়াত করতে? আমাদের এতগুলো গাড়ি আছে কি জন্য?’
আমি শাশুড়ি মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর বললাম,
‘আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে তাই আর কি…
‘আরে বোকা মেয়ে আমার। তোমার বিয়ে হতে পারে কিন্তু বয়স তো কম। এই বয়সে কি এখনকার মেয়েরা বিয়ে করে? তুমি বিয়ে করে নিয়েছো বলে কি কোনো শখবিলাস নেই?’
‘তাহলে আমি কি…
‘তোমার যেমন ড্রেস পড়তে ইচ্ছা করবে তেমন ড্রেস পড়বে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আর এইবার যখন ফিরবে তখন আমাদের একটা গাড়ি নিয়ে যাবে। ঠিক আছে?’
আমি হেসে শাশুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘরে গিয়ে নিজের লাগেজটা খুললাম।
‘একি! এগুলো তো সেই ড্রেস যেগুলো কোয়েল আমাকে নিয়ে কালকে পছন্দ করে কিনলো? এগুলোও আমাকে দিয়েছে কেন?’
লাগেজ খুলে কালকের কেনা ড্রেসগুলো দেখে কিছুক্ষণ ভাবতেই মনে হলো কোয়েল তারমানে আমার জন্যেই ড্রেসগুলো কিনেছিল। আমি এখানে আসবো সেই সুযোগের সৎ ব্যবহার করেছে নাহলে ও জানতো আমি নিতাম না। উফ, মেয়েটা পুরোই পাগল। যাই একটা ফোন করি ওকে। সামনা সামনি না ঝাড়তে পারি, ফোনে তো পারবো। হিহিহি।
প্রেসেন্ট………………………………………………………….
অঙ্কিতকে বলিনি আদিত্যের মায়ের কথা অর্থাৎ শাশুড়ি মায়ের কথা। ওকে বলেছি নিজের মায়ের কথা। যেমনটা কোয়েল আমাকে ইশারা করে বলতে বললো। অঙ্কিত সব শুনে বললো,
‘ওহ, তো এই ব্যাপার।’
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~২১||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৩৬.
ক্লাসে ম্যাডাম বোর্ডে লিখে পড়া বোঝানোর সময় হুট করেই কোয়েল আমাকে আলতো করে ধাক্কা মারলো। আমি ওর দিকে না তাকিয়ে বোর্ডের দিকে তাকিয়েই আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি হয়েছে?’
‘ডানদিকে একবার তাকিয়ে দেখ। রণিত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তোর দিকে।’
কোয়েলের কথা শুনে বোর্ডের থেকে চোখ সরিয়ে কোয়েলের দিকে তাকাতেই কোয়েল ইশারা করলো চোখ দিয়ে। আমি আস্তে আস্তে ওদিকে আড় চোখে তাকাতেই দেখি সত্যি রণিত আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। একটু পর ভালো ভাবে তাকাতেই দেখলাম ও গালে হাত দিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি তাকাতেই ও হাত নেড়ে হাসলো ফলে আমিও হালকা হেসে আবার বোর্ডের দিকে তাকালাম। কোয়েল কে কুনুই দিয়ে খোঁচা মারলে ও আমার দিকে কান এগালো আর আমি আস্তে করে বললাম,
‘সত্যি তো, আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে।’
‘হম। মনে হয় তোর প্রেমে পড়েছে।’
‘ধুর, বাজে কথা বলিস না তো।’
‘ওই দেখ, আবার তোকে ডাকতে বলছে। তাকা ওদিকে।’
কোয়েলের কথা শুনে যেই না রণিতের দিকে তাকাতে যাবো ওমনি ম্যাডাম রণিতের নাম ধরে ডাকলো। আমি সহ সবাই তাকালাম রণিতের দিকে কিন্তু রণিত তখনও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কোনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে কারণ ওর বন্ধুরা ডাকলেও ও সাড়া দিচ্ছে না। ম্যাডাম ওর চোখের সামনে এসে দাঁড়ালেই ও চমকে উঠে দাঁড়ালো।
‘কি ম্যাডাম? কিছু বলবেন?’
‘ক্লাসে মন না দিয়ে অন্যদিকে মন কেন তোমার? চুপচাপ ক্লাসে মন দাও, আমি জানো আর না দেখি এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকতে। পড়া ধরবো কিছুক্ষণ পর।’
আমি আর কোয়েল একটু অবাক হলাম ম্যাডামের বিহেভিয়ারে। ম্যাডাম যেমন রাগী তাতে এতক্ষনে দু-চারটে কড়া কথা শুনিয়ে রণিত কে ক্লাস থেকে বার করে দেওয়ার কথা ওনার। কিন্তু উনি তেমন কিছুই বললেন না, কেন?
‘এখনও তোর দিকে তাকিয়ে আছে।’
কোয়েল আমাকে কানে কানে বললে আমি ওকে রেগে বলি,
‘বাদ দে তো। ও ছাড় পেয়েছে বলে কি আমরাও পাবো নাকি? চুপচাপ পড়ায় মন দে নাহলে ক্লাস থেকে বার করে দেবে।’
আমার কথা শুনে কোয়েল চুপ করে ক্লাসে মন দিলো। এরপর রণিত কি করেছে না করেছে তা আমরা জানি না কারণ ওর দিকে আর আমি বা কোয়েল কেউই তাকাইনি। ক্লাস শেষ করে কমন রুমের দিকে যাচ্ছি এমন সময় আমি আর কোয়েল পিছন থেকে রণিতের গলা পেলাম, আমার নাম ধরেই ডাকছে। কোয়েল পিছন ফিরতে নিলেই আমি ওকে বাঁধা দিয়ে বললাম
‘একদম পিছন ফিরবি না। চল এখান থেকে জলদি।’
এই বলে পা চালিয়ে জোর পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকতেই হুট করে কিছু একটার সাথে পা বেজে আমি পরে গেলাম।
‘আহহ!’
_’উপস, স্যরি, স্যরি! ব্যাথা লাগলো বুঝি পায়ে?’
আমি পায়ে হাত দিয়ে মাথা তুলতেই দেখলাম জিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তারমানে ও ইচ্ছা করেই এটা করেছে। ও আবার বললো,
‘হিলস যখন ইউস করতে জানিস না তখন ইউস করিস কেন? এখন পা টা যদি ভেঙে গিয়ে থাকে কি হবে বল তো?’
__’কি আবার হবে? আমার কোলে করে ঘুরে বেড়াবে। আমি আছি কি জন্য?’
আমি পিছন ফিরবো তার আগেই দেখি রণিত এসে আমার পাশে বসলো। আমি রণিতের দিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনে তাকালাম কারণ জিয়ার পিছন দিয়ে আমি আদিত্যকে দেখেছি। উনি আমার দিকেই এগিয়ে আসছিলেন কিন্তু রণিতকে দেখে থেমে গেলেন।
‘কি ম্যাডাম? এভাবে আমার ডাকে সাড়া না দিয়ে হেঁটে আসছিলেন কেন? এখন হলো তো?’
আমাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উপস্থিত আমাকে সহ সকলকে অবাক করে দিয়ে রণিত আমাকে কোলে তুলে নিলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে জিয়ার দিকে তাকালাম আর তারপর ওর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আদিত্যের দিকে। ওনার হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছে আজকেই আমার আর রণিতের দুজনের শেষ দিন। ধ্বংস করে দেবে উনি আজকেই সব। আমি একটা শুকনো ঢোঁক গিলে কোয়েলের দিকে তাকালে কোয়েল ইশারায় দেখায় আজকে শেষ!
‘আ, আ! প্লিজ জিয়া সব বিষয়ে নিজের পা আগে বাড়ানোটা বন্ধ কর। কোনদিন দেখবি নিজের পা টাই ভেঙে গেছে এইচক্করে।’
রণিত আমাকে নিয়ে এগোতে গেলে জিয়া ওকে কিছু বলতে যায় আর তখনই রণিত এই কথাটা জিয়াকে থামিয়ে বলে দেয় আর হাঁটা শুরু করে।
৩৭.
কমন রুমে ঢুকে আমাকে বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে রণিত আমার পায়ে হাত দিতে গেলেই আমি বাঁধা দিয়ে বলি,
‘অনেক হয়েছে। এবার তুই যা এখান থেকে। আমি ঠিক আছি।’
‘আচ্ছা তাই নাকি? তাহলে হেঁটে দেখা তো আমাকে।’
রণিতের কথায় চুপ করে গেলাম কারণ হেঁটে দেখানো তো দূর। দাঁড়াতেও পারবো না আমি। সত্যি, সত্যি পা-টা ভেঙে গেলো না তো? এইবার তো আমারই ভয় লাগছে। আমি এসব ভাবছি সেসময় নিজের পায়ে কাওর হাতের স্পর্শ পেলাম।
‘রণিত প্লিজ…
‘চুপ। একদম চুপ। দেখতে দে আগে আমায়।’
রণিত আমার পা ধরে কিছুক্ষণ নাড়াচারা করে হুট করেই ঘুরিয়ে দেয় আর আমি ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে রণিতের কাঁধ খামচে ধরে চিৎকার দিয়ে উঠি।
‘আহহ! লাগছে ভীষণ।’
রণিতের কোনো উত্তর না আসায় আস্তে আস্তে চোখ খুলে ওর দিকে তাকাতেই ওর চোখে চোখ পড়ে গেলো। ও একভাবে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।
‘কি হচ্ছে এখানে?’
হঠাৎ কাওর গম্ভীর গলার স্বর শুনে পাশ ফিরে তাকালাম। তাকাতেই আমার ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আদিত্য গম্ভীর ভাবে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন।
‘রণিত, ওকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওয়াটা উচিত আমার মনে হয়।’
‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। মৌ, উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা কর তো একবার।’
রণিত আমার দিকে হাত বাড়ালে আমি আবার আদিত্যের দিকে তাকাই। আদিত্যের পিছনে দাঁড়িয়ে কোয়েল সমানে না বোধক মাথা নাড়ছে। আমিও তাই রণিতের হাত না ধরে নিজে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি আর তাল সামলাতে না পেরে পরে যেতে নিই। সঙ্গে সঙ্গে রণিত আমাকে ধরে নেয়।
‘বলেছিলাম হাতটা ধরতে? আবার কোলে নেবো?’
‘ন..না, না। তার আর দরকার নেই।’
‘তাহলে চুপচাপ হাত ধরে রাখ ছাড়বি না। নাহলে আরেকটা পা-ও যাবে।’
‘কোয়েল, হস্টেল যাওয়ার আগে একবার ডক্টর দেখিয়ে নিস।’
আদিত্য কথাটা বলে আমাদের দিকে একবার তাকালো। স্পেশালি রণিত যে আমার হাত ধরে রয়েছে সেদিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকালেন। কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। রণিত আস্তে আস্তে আমাকে নিয়ে এগোতে থাকলে কোয়েল বলে,
pপ
‘রণিত, আমি নিয়ে যাই ওকে? ও আর আমি তো একই হস্টেলে থাকি তাই।’
‘হ্যাঁ নো প্রবলেম বাট তুই একা পারবি নাকি আমিও যাবো?’
_’নাহ, তার আর দরকার পড়বে না। আমি আর কোয়েল ওকে নিয়ে যাবো তুই আসতে পারিস। থ্যাংক ইউ হেল্প করার জন্য।’
অঙ্কিতের রিয়াকশন দেখে আমি একটু অবাক হলাম। ও এসে আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বললো। উত্তরে রণিত বললো,
‘আরেহ, কি যে বলো অঙ্কিত দা। মৌ আমার ফ্রেন্ড, ওর জন্য করবো না তো কার জন্য করবো? আমি আসছি, ওকে সাবধানে নিয়ে যেও। সাবধানে থাকিস মৌ।’
‘হ্যাঁ।’
রণিত চলে গেলে কোয়েল বলে,
‘অঙ্কিত তুমি এগিয়ে যাও মৌকে নিয়ে। আমি ওর ব্যাগটা নিয়ে আসি, ওটা মনে হয় ওখানেই পরে আছে।’
কোয়েল চলে গেলে অঙ্কিত আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো। আমি একবার তাকাচ্ছি ওর দিকে আরেকবার আর একবার চোখ নামাচ্ছি। বুঝতে পারছি না আমার পড়ে যাওয়া নিয়েই কি ও এতো রেগে আছে? নাকি অন্য কারণে?
‘ক..কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’
‘একটু দেখে শুনে চলা যায় না? আর রণিত যখন কোলে নিলো তখন ওকে আটকাতে পারলি না? অন্য সময় তো খুব ফটোর ফটোর করিস রণিতের বেলায় কি হলো?’
‘আরে, তুই এতো রাগ করছিস কেন? ও হুট করেই আমাকে কোলে তুলে নিয়েছে।’
‘সেই, তুই তো বাচ্চা তাই।’
‘অঙ্কিত! আমার পায়ে ব্যাথা ছিলো তাই জন্যেই তো ও নিয়েছে। তুমি কোথায় ছিলে তখন? থাক, লাগবে না আমার কাওর সাহায্য।’
কথাটা বলে আমি অঙ্কিতের হাত ছাড়িয়ে নিলে অঙ্কিত আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমার একটা হাত শক্ত করে ধরলো। আমি কিছু বলতে নিলেই অঙ্কিত আমাকে বলতে না দিয়ে বললো,
‘রণিতের বেলায় যখন কোনো কথা বলিসনি আমার বেলায়ও বলবি না। আমি তোকে কোলে তুলিনি জাস্ট শক্ত করে ধরেছি যাতে পরে না যাস। কোয়েল আসলে ও ধরবে।’
অঙ্কিত আমাকে কথাটা বলে চুপ করে সামনের দিকে তাকালে আমিও সামনের দিকে তাকাই।
‘আদি তুই?’
আদিত্য কখন এলেন? আমি তো টেরও পাইনি ওনার আসার। এই রে, আজকে যে কি হচ্ছে আমার সাথে। প্রথমে রণিত আর এখন অঙ্কিত। কিন্তু এতটা শান্ত কেন আদিত্য? ঝড় ওঠার আগের পূর্বাভাস না তো? না না, আমি এসব কেন ভাবছি তখন থেকে? উনি তো আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানেন না তাহলে উনি কেন রাগ করতে যাবেন আমাকে অন্য কোনো পুরুষ স্পর্শ করলে। ওনার তো কোনো যায় আসার কথা নয়। কিন্তু ওনার চোখ তো সে কথা বলছে না। কম্পিটিশনের দিনের মতো আজকেও ওনার চোখে মুখে অভিমান আর একরাশ কষ্টের ছাঁপ।
‘কি হলো আদি? তুই তো চলে গেছিলি দেখলাম।’
‘হ..হ্যাঁ। আসলে আমার গাড়ির চাবি টা দিতে এসেছিলাম। তুই আছিস, ভালোই হলো। কোয়েল একা পারতো না। তুই মৌমিতা আর কোয়েলকে আমার গাড়িতে নিয়ে যা ডক্টরের কাছে।’
‘থ্যাংকস ভাই। ভালোই হবে।’
আদিত্য ম্লান হেসে অঙ্কিতের হাতে চাবিটা দিতে গেলে দেখতে পেলো অঙ্কিত আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে।
‘মৌ, তোর ওই হাত দিয়ে চাবিটা নে।’
আমি কিছু না বলে আদিত্যের দিকে হাত বাড়ালে আদিত্য আমার হাতে চাবিটা দেন আর একঝলক আমার কোমরে থাকা অঙ্কিতের হাতের দিকে তাকান।
‘সাবধানে থাকবে।’
‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন এখন?’
‘কোথাও না।’
আমার কেন জানো খারাপ লাগছে আদিত্যের কথা শুনে। কান্না আসছে কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম। ওনার হাতটা ধরে রেখেছি আমি, চাবি নেওয়ার বাহানায়। উনি আস্তে করে বললেন,
‘আমি বরং আসি। তোমাকে হেল্প করার অনেক লোক আছে।’
উনি কথাটা বলে আমার দিকে তাকিয়ে স্মিথ হাসলে আমার আর সেটা সহ্য হলো না। আমি ওনার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বললাম,
‘আপনি নিজের গাড়িটা দিতে পারছেন আর নিজে নিয়ে যেতে পারছেন না?’
উনি কিছু না বলে অঙ্কিতের দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকালে আমি সঙ্গে সঙ্গে অঙ্কিতের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। অঙ্কিতকে বললাম,
‘অঙ্কিত আমাকে একটু ছাড়ো আমার অসুবিধা হচ্ছে। আর আমি পঙ্গু হয়ে যাইনি যে আমাকে এভাবে কোমর জড়িয়ে ধরতে হবে তোমায়।’
অঙ্কিত আমার কথা শুনে আমায় ছেড়ে দিলে আমি ওকে আবার বলি,
‘তোমার আজকে এক্সট্রা ক্লাস আছে বলেছিলে না? তুমি বরং সেটা এটেন্ড করো। আদিত্য যখন গাড়ি দিতে পারছেন তখন নিজেও যেতে পারবেন। আর ইউনিয়ন লিডার হিসাবে ওনার তো এটা দায়িত্ব তাই না? তাই..
‘ঠিক আছে। আদি, তুইই নিয়ে যা। আমি আসলাম। আমার ক্লাস আছে।’
অঙ্কিত চলে গেলে আমি আদিত্যের দিকে তাকালাম। উনি চুপ করে মাথা নিচু করে রইলে আমি ধমক দিয়ে বললাম,
‘হাতটা ধরতে পারছেন না? আমার একা দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে তো নাকি?’
আমার ধমক শুনে উনি সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতটা ধরে আমার কোমরে হাত রাখলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেললাম। একটা আলাদাই অনুভূতি হলো আমার যা রণিত বা অঙ্কিতের স্পর্শে হয়নি। ওনার নিশ্বাস আমার ঘাড়ে পড়তেই আমি কেঁপে উঠে ওনার শার্ট খামচে ধরলাম।
‘কিভাবে পড়লে?’
‘আব, আমি আর কোয়েল তাড়াহুড়ো করে আসছিলাম তখনই কিছু একটার সাথে পা বেজে পরে যাই। পরে বুঝতে পারি জিয়ার পায়ের সাথে পা বেজেই পরে গেছি।’
‘রণিত একটু বেশিই আগে পিছে ঘুরছে না তোমার?’
আমি নিচের দিকেই তাকিয়ে উত্তর দিচ্ছিলাম এতক্ষন। কিন্তু এই প্রশ্নের আর কোনো উত্তর দিলাম না। আদিত্য আমাকে আরেকটু কাছে টানতেই সঙ্গে ওনার কাঁধে হাত দিয়ে ওনার দিকে তাকালে উনি বলেন,
‘দ্বিতীয় দিন থেকে জানো রণিতের সাথে সব সময় না দেখি। যতটুকু দরকার ততটুকুই কথা বলবে। বুঝেছো?’
আমি শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লাম। উনি আমার চোখের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকলেও আমি তাকিয়ে থাকলে পারলাম না চোখ নামিয়ে নিলাম আর উনি আমাকে হুট করেই কোলে তুলে নিলেন।
‘আরে কি ক..করছে….
আমি কথা শেষ করার আগেই উনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যে আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। ওনার গাড়ির সামনে এগোচ্ছেন এটুকু বুঝতে পেরে বললাম,
‘সবাই কি ভাববে?’
‘রণিত যখন কোলে নিয়ে এসেছিলো তখন যা ভেবেছে এখনও তাই ভাববে। যাতে আমার বা তোমার কাওর কোনো যায় আসে না।’
‘কোয়েল ব্যাগ আনতে গেছিলো। আসেনি তো এখনও, খুঁজবে আমাদের।’
‘দেখা যাবে।’
‘ইশ, কিছুক্ষণ আগেই ভিজে বিড়ালের মতো মিউ মিউ করছিলো। আর এখন দেখো? ভুতুম প্যাঁচা একটা।’
মনে মনে কথাগুলো বলে ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নিতেই দেখলাম জিয়া আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে আর রাগে কটমট করছে। এটা দেখে মনে মনে হাসলাম। ওর তো এটাই করার কথা কারণ ও যা চেয়েছে তার উল্টোটা হয়ে গেছে কি না। গাড়ির সামনে যেতেই দেখলাম কোয়েল আমার ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উনি আমাকে নামালে আমি কোয়েলকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তুই এখানে এলি কিভাবে? আই মিন জানলি কি করে?’
‘আমি তো গেছিলাম ওখানে। তারপর দেখলাম তোরা বর বউ প্রেম করছিস তাই ভাবলাম কাবাব মেইন হাড্ডি হয়ে কি লাভ? তোর অঙ্কিত কে বলা কথা শুনে নিয়ে এখানে চলে এলাম। চল, চল ওঠ গাড়িতে।’
আমি আর আদিত্য ওকে বকতে যাবো তার আগেই কোয়েল কানে হেডফোন লাগিয়ে নিলো আর গাড়িতে উঠে পড়লো। আদিত্য আমাকে গাড়িতে বসতে হেল্প করে ড্রাইভ করা শুরু করলেন। ডক্টরকে দেখিয়ে আমাদের হস্টেলে ড্রপ করে উনি চলে যান।
রাতে,
‘কি রে? কোলে চড়ে কেমন লাগলো? স্যরি, স্যরি কার কোলে চড়ে ভালো লাগলো?’
‘হয়ে গেছে? শেষ আমার লেগপুল করা?’
‘শেষ? কি বলিস এসব? সবে তো শুরু। এখনও তো অনেক কিছু হওয়া বাকি।’
কোয়েল আমাকে চোখ টিপ দিলে আমি ওর দিকে আমার হাতে থাকা বই ছুড়ে মারি। ও সেটা ক্যাচ করে বলে,
‘তোর ফ্যান ফলোয়িং বিশাল এখন। কি একটা বেশ নাম পোলাটার, আমার থেকে তোর নাম্বার চাইছিলো।’
‘দিয়ে দিয়েছিস নাকি?’
‘দেইনি কিন্তু দিয়ে দেবো আমাকে ট্রিট না দিলে।’
‘কুত্তি।’
‘হিহি। বায় দ্য ওয়ে, এই রণিতের কি ব্যাপার বল তো?’
‘খারাপ না ছেলেটা।’
‘উহুম, উহুম।’
‘তেমন কিছুই না। ঘুমা।’
কথাটা বলেই এপাশ ফিরে আমি শুয়ে পড়লাম নাহলে কোয়েল থামতো না।
৩৮.
বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। এখন আমার পা-ও পুরো ঠিকঠাক। এই কয়দিন রণিত আমার পিছন একদম ছাড়েনি বললেই চলে। নোটস দেওয়া থেকে শুরু করে হাজার একটা বাহানায় আমার কাছে এসে বসে থেকেছে আর আমাকে হাসানোর চেষ্টা করেছে। বন্ধুত্বটা তাই ভালোই হয়ে গেছে ওর সাথে। নাও, যার নাম করছিলাম সে এসে হাজির।
‘কি করছিস এখানে বসে? পা ঠিক আছে তো?’
‘উফ! আমার পা অনেক আগেই ঠিক হয়ে গেছে। সামান্য মচকে গেছে ভাই…
‘এই, এই, এই। একদম ভাই না। কতবার বলবো তোকে?’
রণিত বেশ রেগে কথাটা বললে আমি হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। এই কয়েকদিন বেশ কয়েকবার আমাকে বারণ করেছে ভাই বলে ডাকতে কিন্তু আমার অভ্যেস কি করে ছাড়ি?
‘সাইলেন্ট হয়ে গেলি কেন?’
‘নাহ, কিছু না। ম্যাডাম এর পড়া করেছিস?’
আমার এই প্রশ্নটাতেই রণিতের মুখ চুন হয়ে গেলো। আর আমি হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতে শুয়েই পড়েছি আমি বেঞ্চে।
‘ম্যাডাম কোনো পড়া দেয়নি। তুই আমাকে ভয় দেখালি তাই না?’
আমি উত্তর কি দেব, রণিতের রিয়াকশন দেখে হেসেই চলেছি। হাসতে হাসতে থেমে গেলাম রণিতের পিছনে এসে দাঁড়ানো একজোড়া পা দেখে। আদিত্য! উনি আবার এখানে এসেছেন কেন?
‘রণিত, আমার মৌমিতার সাথে কিছু কথা আছে প্রাইভেট।’
রণিত পিছনে তাকিয়ে আদিত্যের কথা শুনে একবার আমার দিকে তাকালো তারপর বেরিয়ে গেলো আমাকে বলে। রণিত বেরিয়ে গেল আমিও আমার বইপত্র গোছাতে থাকি কমন রুম থেকে বেরিয়ে ক্লাসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
‘এই কয়েকদিন আমার ফোন ধরনি কেন?’
আদিত্যের প্রশ্ন শুনেও আমি তার উত্তর দিলাম না। বলা যায় প্রয়োজন মনে করলাম না। উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,
‘ভার্সিটিতে কতবার কথা বলার চেষ্টা করেছি আমি তোমার সাথে?’
আমি এইবারও উত্তর না দেওয়ায় উনি আমার হাত ধরে বাঁধা দিয়ে বললেন,
‘আমাকে ইগনোর করার কারণটা কি? অন্য ছেলেদের সাথে তো খুব হেসে কথা বলা যায় তাহলে আমার সাথে কথা বলতে কোথায় বাঁধে?’
আমার মাথাটা চট করেই গরম হয়ে যাওয়ায় আমি ওনার হাতটা ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে বললাম,
‘কেন কথা বলবো আমি আপনার সাথে? কে হন আপনি আমার যে আপনার সাথে কথা বলবো আমি?’
‘আচ্ছা? রণিত, অঙ্কিত এরা তোমার কে হয় দ্যান?’
‘বন্ধু হয়। ওদের সাথে আমার একটা সম্পর্ক আছে কিন্তু আপনার সাথে তাও নেই। আপনি নিজেই সেটা রাখেননি, ভুলে যাবেন না।’
আমি কথাটা বলে আমার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই আদিত্য আমার দু-বাহু চেপে ধরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
‘আমি জানো দ্বিতীয় দিন থেকে রণিতের আশেপাশে তোমাকে না দেখি। এই নিয়ে সেকেন্ড টাইম বলছি। আমার কথার অবাধ্য হলে এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।’
আমি আদিত্যের চোখের দিকে তাকিয়েই ওনার বুকে দু-হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে ওনাকে সরিয়ে বললাম,
‘কোন অধিকারে আপনি আমাকে এই কথাগুলো বলছেন? স্বামীর অধিকারে? যা আপনি আমাদের ফুলশয্যার রাতে অস্বীকার করেছেন? আপনার জন্য, আপনার বিয়ে না মানার কনসেপ্টএর জন্য আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি সেদিন তার কোনো খোঁজ আপনি রেখেছেন? বরং পরেরদিনই নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চলে এসেছিলেন আমাকে একা ফেলে। একবারও ভাবেননি আমার কি হবে। আপনার জন্য যে আমার স্বপ্ন ভেঙেছে তার কি হবে। এইখানে আসার পর আমি প্রত্যেকটা মুহূর্তে আপনার গার্লফ্রেন্ডের থেকে নানানভাবে কথা শুনেছি, অপমানিত হয়েছি তখন কোথায় ছিলেন আপনি? তখন কোথায় ছিলো আপনার এই অধিকারবোধ? এই যে কিছুক্ষণ আগে বলছিলেন না, কিসে বাঁধে আপনার সাথে কথা বলতে? বিবেকে বাঁধে আমার। সেই মানুষটার সাথে কথা বলতে আমার বিবেকে বাঁধে যে কি না নিজের জন্য আমাদের বিয়ে অস্বীকার করেছে। বৌভাতের পরেরদিন নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য নিজের স্ত্রী কে ফেলে চলে আসে। দিনের পর দিন নিজের স্ত্রীর সামনে গার্লফ্রেন্ডের সাথে হাত ধরে ঘোরে। নিজের স্ত্রীর অপমান সহ্য করে। আপনি যেমন নিজের রাস্তা নিজে বেছে নিয়েছেন আমিও নিজের রাস্তা নিজে বেছে নিয়েছি। এক বছর হলেই ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবেন আপনি আর প্লিজ, আমার লাইফে একদম ইন্টারফেয়ার করবেন না।’
‘রণিত এখানকার নাম করা পলিটিশিয়ানের ছেলে। ও চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে ভার্সিটির স্যার ম্যাডামরাও তাতে কিছু করতে পারবে না। তাই ওর থেকে দূরে থাকাটাই বেটার। তোমার ব্যাপার এবার তুমি কি করবে। আর আমি, আমি সবটা নতুনভাবে শুরু করতে চেয়েছিলাম। অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে যেগুলো মিটাতে চেয়েছিলাম তাই কথা বলার জন্য বলছিলাম। স্যরি, স্যরি ফর এভরিথিং। জানি ক্ষমা করা সম্ভব নয় বাট আমি ইচ্ছা করে কিছুই করিনি। পারলে ক্ষমা করে দিও।’
আদিত্য আর একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলেন। আমি আমার কথা শেষ করে চলে যাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ করে উনি কথা বলা শুরু করেন আর তা শেষ করেই চলে যান। কিন্তু যাওয়ার সময় উনি চোখে হাত দিলেন, ওনার চোখে কি জল ছিলো? কথাগুলো বলার সময়ও কেমন গলাটা ধরে আসছিলো মনে হলো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আমি ওখানেই বসে পড়লাম।
‘সব কিছু নতুনভাবে শুরু করতে চেয়েছিলেন? আমাদের মধ্যে কি এমন ভুল বোঝাবুঝি আছে যা ক্লেয়ার করতে চেয়েছিলেন? আমি কি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললাম?’
‘কি রে? একা একা কি কথা বলছিস?’
‘কোয়েল তুই এখানে?’
‘তা কি করবো? ক্লাস শুরু হবে পাঁচ মিনিটের মধ্যে। কতবার ফোন করলাম, তুই তো রিসিভই করছিস না। কি হয়েছে?’
‘প..পরে বলবো সব। এখন চল।’
কোয়েলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি চলে গেলাম। মাথার মধ্যে আদিত্যের কথাগুলোই খালি ঘুরছে। আজকে মনে হয় না ক্লাসে মন বসবে। ক্লাস কোনোরকমে শেষ করে কাওর সাথে কথা না বলে সোজা হস্টেল চলে গেলাম।
সন্ধ্যায়,
আদিত্য বাংলোর বাগানে বসে আছে একা একা। মাঝেমধ্যেই গাল মুছছে হাত দিয়ে কারণ, কারণ আদিত্য কাঁদছে। হ্যাঁ, আজ মৌমিতার কথাগুলো তার একটু বেশিই খারাপ লেগেছে। মৌমিতার কিছু কথায় যেমন রাগ হচ্ছে তার থেকে বেশিরভাগ কথায় সে কষ্ট পাচ্ছে। আদিত্য কোনোদিনও খুব না কষ্ট পেলে কাঁদে না, আজ পর্যন্ত নিজের বাবার ব্যবহার ছাড়া কাওর ব্যবহারে সে কাঁদেনি। এমন সময় কেউ একজন আদিত্যের কাঁধে হাত দেয়। আদিত্য পাশ ফিরতেই অবাক হয়ে বলে ওঠে,
‘তুই এখানে?’
চলবে।