#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৮
#Saji_Afroz
আজরার পাশে স্টেজে বসে রয়েছে ইনতিসার। একে একে সকলে এসে তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। সাথে ছবিও তুলছে। চারদিকে এত মানুষ, পাশে রয়েছে হবু স্ত্রী। তবুও ইনতিসারের দু-চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে নাবীহা কে। সে এখানে কেন এটা নিয়েও ভাবনায় পড়ে গেছে ইনতিসার।
আচ্ছা, নাবীহাও কী তাকে দেখে অবাক হয়েছে? নাকি সে আগে থেকেই জানতো, এই বিয়ের বর ইনতিসার!
.
.
নীরবে একা একা একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে নাবীহা। চারপাশ চোখ বুলিয়ে দেখছে সে। আজরা ও তার পরিবার বেশ খুশি। হবেই তো! ইনতিসারের মতো ছেলে ও ভালো একটা পরিবারের সাথে আত্মীয়তা হতে যাচ্ছে তাদের। আজরার বাবা আয়োজনেও কোনো অংশে কমতি রাখেননি। মনে হচ্ছে তার সারা জীবনের উপার্জনের জমানো টাকা বিয়ের পেছনেই খরচা করেছেন।
নাবীহার সাথে যদি বিয়েটা ঠিক হত, এমন আয়োজন তার বাবা করতে পারতো না। এসব জানার পরেও কী ইনতিসার তাকে বিয়েটা করতে চাইতো?
-একা একা কী করছিস?
মানতাশার ডাকে ঘোর কাটে নাবীহার। সে বলল, কিছু না।
-চল।
-কোথায়?
-স্টেজে! মালা পরাবো বর কে। সাথে মিষ্টিমুখও করাতে হবে না? দ্বিতীয় দফা টাকা নিতে হবে তো।
-তোরা যা। গেইটে তো গেলামই।
-তুই না গেলে কীভাবে! আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড বলে কথা! আয় তো…
এই বলে নাবীহা কে টানাটানি করে নিয়ে আসে মানতাশা। স্টেজের সামনে আসতেই থমকে যায় সে। স্টেজের দিকে পা বাড়ানোর সাহস হয় না তার। কেমন যেন লাগছে তার।
এদিকে নাবীহার দিকে চোখ পড়তেই ইনতিসার তার দিকে মনোনিবেশ করলো। নাবীহাও যে অসস্থিবোধ করছে তা সে বুঝতে পারলো।
শ্যালিকারা সবাই স্টেজে আসে। সাথে আসে নাবীহাও। আজরা আড়চোখে ইনতিসারের দিকে তাকালো। সে নাবীহার দিকে চেয়ে রয়েছে। বিষয়টা কে হালকা ভাবেই নেওয়ার চেষ্টা করলো আজরা। কারণ ইনতিসার তাকে হঠাৎ এখানে দেখছে। হয়তো তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন। নাবীহার পরিচয় নিয়ে চিন্তিত হওয়াটা স্বাভাবিক।
মানতাশার কথাতে নাবীহা কে মালা ধরতে হলো। দু’জনে মিলে মালা পরালো ইনতিসার কে। এভাবে নাবীহার হাতে মালা পরে অশান্তিতে উশখুশ করতে লাগলো ইনতিসার। মালা তো সে পরতেই চেয়েছিল! তবে তার বর হিসেবে।
মিষ্টি খাওয়ানোর পর্ব শেষ হতেই সবাই ছবি তুলতে শুরু করে। মানতাশা ইনতিসারের দিকে তাকালো তার চেহারার অবস্থা দেখার জন্য। ফ্যাকাসে চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে, নাবীহা কে দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে সে।
আচ্ছা! দেখাটা আর কিছুদিন আগে হলে কী বিয়েটা হত?
ভাবতে ভাবতেই
স্টেজের সামনে থাকা এজাজের দিকে চোখ যায় তার। তাকে দেখে মানতাশা ইশারায় সরে যেতে বলল। কিন্তু সে সরলো না। হেসে তার ছবি তুলতে থাকে এজাজ। এজাজের এমন কাণ্ডে মেজাজ খারাপ হতে থাকে মানতাশার। ছেলের সাহস তো কম না!
ছবি তোলা শেষে একে একে সবাই নেমে যেতে থাকলেও কারও ডাকে থেমে গেল নাবীহা। সাজির এসেছে। সে স্টেজে উঠতে উঠতে বলল, ওয়েট ওয়েট! আমরা একসাথে ফ্রেমবন্দী হয়ে নিই।
এই বলে নাবীহা কে নিয়ে আজরার পাশে এসে দাঁডায় সে। আজরাও সুযোগটা কাজে লাগায়। সে ইনতিসারের উদ্দেশ্যে বলল, ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নাবীহা। বলেছিলাম না দু’জন ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আছে আমার? একজন ও। আর ওর পাশের জন হলো সাজির ভাইয়া। নাবীহার ফুফাতো ভাই। তবে ওর হবু বরও। সামনেই ওদের বিয়ে।
সাজির ইনতিসারের সাথে পরিচিত হয়ে নেয়। এরপর নাবীহা কে নিয়ে স্টেজ থেকে নেমে পড়ে।
ইনতিসার বুঝতে পারলো, কেন নাবীহা তার বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। তবুও ধারণা কতটুক মিলেছে তা জানার জন্য আজরা কে জিজ্ঞাসা করলো, সম্পর্কের বিয়ে?
-পুরোপুরি তা নয়! একে অপরকে পছন্দ করতো।
-ওহ।
ইনতিসার খেয়াল করলো, সাজিরের সাথে নিচে বেশ হাসিখুশি ভাবেই কথা বলছে নাবীহা। সাজির তার কপালের সামনে চলে আসা চুলগুলো ঠিক করে দিচ্ছে। এসব দেখে নাবীহার দিক থেকে মনোযোগ সরানোর চেষ্টা শুরু করলো সে। দু’জন দুই পথের বাসিন্দা তবে কেন অন্যদিকে মনোনিবেশ করে নিজের সুন্দর মুহুর্ত টাকে নষ্ট করবে সে!
এই ভেবে সে আজরা কে বলল, আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে।
হঠাৎ একথা শুনে লজ্জা পায় আজরা। মাথা নিচু করে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল সে, আপনাকেও!
.
.
এদিকে নাবীহার পরিবার আগে থেকে জানতো, আজরার বর ইনতিসার। আজরার জন্য তারাও বেশ খুশি। মেয়েটার জীবনে এমন কেউই আসার কথা ছিল।
ইলারা জামান উপস্থিত মেহমানদের সাথে কথা বলছেন। হঠাৎ তার চোখ গিয়ে আঁটকায় দাঁড়িয়ে থাকা নাবীহার দিকে। পাশে সাজিরও রয়েছে। তাকে না চিনলেও নাবীহা কে চিনতে ভুল করলেন না তিনি। ইনতিসার ঘটকের কাছ থেকে ছবি দেখে ও তার সম্পর্কে জেনে বেশ পছন্দ করেছিল মেয়েটাকে। কিন্তু তাদের পরিবার আগ্রহ দেখায়নি বলে কথা আগায়নি। এই মেয়ে এখানে কী করছে?
ভাবতে ভাবতে আজিজা বানুর দেখা পান তিনি। আজিজা বানু বললেন, আপা সবাই কে চিনছি না। আপনিও একটু খেয়াল রাখবেন৷ সবাই খাচ্ছে কিনা দেখবেন। আর কিছু লাগলে বলবেন আমায়।
-সেসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। ভালোই আয়োজন করেছেন আপনারা।
-ধন্যবাদ আপা।
একটু থেমে তিনি নাবীহা কে দেখিয়ে বললেন, মেয়েটি আপনার কী হয়?
আজিজা বানু তার এমন প্রশ্নের কারণ বুঝতে পারলেন। কিন্তু তিনি সবটা জানেন তা বুঝতে না দিয়ে বললেন, আমার মেয়ের বান্ধবী। আর পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা তার হবু বর।
কেন আপা?
-নাহ এমনিই!
কথা না বাড়িয়ে তাড়া দেখিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন আজিজা বানু।
ঘটক বলেছিল তারা এই প্রস্তাবে রাজি নয়। কেন নয় এই বিষয়ে ঘটকও জানেনা বলেছিল। তবে এই কারণ!
যাক, আজরা নাবীহার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বরং আজরার মতো মেয়ে কে পুত্রবধূ হিসেবে পেতে চলে তিনি অনেক খুশি। তার উপর ভরসা আছে ইলারা জামানের। নিশ্চয় তার পরিবার কে আলোকিত করে রাখবে সে।
.
.
-তোমার খাওয়া হয়েছে?
মানতাশার কথা শুনে এজাজ বলল, চলো না একসাথে খাই?
-মাথা খারাপ? তোমার সাথে খেতে বসি এরপর মা দেখলে ঘটনা বাড়বে। এটা চাচ্ছ তো?
এজাজ তার কথা শুনে হাসলো। মানতাশা বলল, খেয়েদেয়ে চলে যাও তো। আমি চাচ্ছি না তুমি এখানে থাকো।
-আমি তো থাকবোই। আমার হবু বউ এর আশেপাশেই থাকব।
মানতাশা ভেবেছিল, আজ ইনতিসারের আত্মীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে সে। ইনতিসারের মতো যদি প্রস্তাব পাওয়া যায় এই ভেবে সে অনেক টাকা দিয়ে নামি দামি পার্লার থেকে সেজেও এসেছে। এখন এজাজ তার পেছনে ঘুরঘুর করাতে চরম বিরক্ত হচ্ছে সে। এমন করলে কোনো ছেলে কী তার দিকে দৃষ্টি দেবে? উফফ! কেন যে আজরা একে দাওয়াত দিতে গেল। এই ভেবে আজজার উপরে মেজাজ খারাপ করলো মানতাশা।
.
.
অবশেষে সেই বিশেষ মুহুর্তটা চলে আসলো! কবুল বলার মুহুর্ত …
কাজি সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছেন। আজরা ও ইনতিসারের পাশে রয়েছে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন। তাদের মধ্যে রয়েছে মানতাশা ও নাবীহাও।
কবুল বলতে বলা হলে না চাইতেও নাবীহার দিকে চোখ যায় ইনতিসারের।
আজ আজরার বদলে সে যদি তার পাশে থাকতো!
-কবুল বলুন?
কাজির ডাকে ঘোর কাটলো তার। আর সময় নিলো না সে। আজরার দিকে তাকিয়ে বলল, কবুল।
এরপর আজরার পালা আসে। সেও কবুল বললে কাজি সাহেব তাদের দিকে বিয়ের কাবিননামা এগিয়ে দিলেন। দু’জনে সাক্ষর করার মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়।
সকলে একে অপরকে মিষ্টিমুখ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
ইনতিসারের কিছু আত্মীয় এসে আজরা কে আদর দিয়ে নানারকম উপহার পরিয়ে দিতে লাগলেন। সবই ছিল ডায়মন্ড ও সোনার গয়না। যা দেখে নাবীহার উদ্দেশ্যে মানতাশা ফিসফিসিয়ে বলল, শরীরে কী কম আছে যে আরও পরাতে হচ্ছে?
নাবীহা বিরক্তির সুরে বলল, কেউ শুনবে!
এই বলে সে স্টেজ থেকে নেমে পড়ে৷ তার পিছু নেয় মানতাশা। তাকে থামিয়ে বলল, সত্যি করে বল তো? এতটুকুও তোর খারাপ লাগছে না?
-কেন লাগবে?
-ওকে বিয়ে করলে এসব গয়নাগাটি সব তোর হত।
নাবীহা কে দেখে তার কাছে আসছিল সাজির। এসেই সে মানতাশার বলা কথাটি শুনে ফেলে। যা বুঝতে পারে নাবীহা ও মানতাশা। কথা ঘুরানোর জন্য নাবীহা বলল, খেয়েছ তো তুমি?
-হু অনেক আগেই।
মানতাশা আর কিছু না বলে সেদিক থেকে সরে যায়। সাজির বলল, যে প্রস্তাবটা তোমার জন্য এসেছিল তা কী ইনতিসারের পক্ষ থেকে ছিল?
নাবীহা শান্তস্বরে জবাব দিলো-
হু।
-কেন নিষেধ করেছিলে?
কিছু না ভেবেই নাবীহা বলল, তোমার জন্যে। তোমাকে ভালোবেসে।
সাজিরের ইচ্ছে করছে খুব করে বুকের সাথে মিশিয়ে নিতে নাবীহা কে। কিন্তু ভরা মজলিশ এ তা সম্ভব না বলে ইচ্ছে টাকে দমিয়ে রাখলো। সে নাবীহার হাতটা ধরে বলল- এত ধন সম্পদ হয়তো আমার নেই। কিন্তু কথা দিচ্ছি, অনেক বেশি ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখব তোমাকে।
নাবীহাও তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, এটাই প্রয়োজন আমার।
দূর থেকে তাদের দেখছে ইনতিসার। কেন যেন নাবীহা কে সাজিরের পাশে দেখতে ভালো লাগছে না তার। বেহায়া মন কে মানাতে কষ্ট হচ্ছে, নাবীহা তার হয়নি!
আচ্ছা, এই সাজিরের এমন কী আছে যে তার মধ্যে নেই? যার কারণে নাবীহা তাকে প্রত্যাখ্যান করে সাজির কে জীবনে গ্রহণ করছে?
এদিকে তাকে লক্ষ্য করলেন ইলারা জামান। নাবীহার প্রতি ছেলের এই চাহনি দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি। ইনতিসারের মনে কী বিয়েটা নিয়ে দ্বিধার সৃষ্টি হয়ে গেল?
দূর থেকে সাজির ও নাবীহা কে দেখে মানতাশা আপনমনে বলল, তুই বোকা। তাই ইনতিসারের মতো কাউকে বাদ দিয়ে সাজির কে বেছে নিয়েছিস। কিন্তু আমি এমনটা করব না। আমার তো ইনতিসারের মতোই কাউকে চাই! তাতে করে কারও মন ভাঙতে হলে নাহয় ভাঙলাম!
.
চলবে
#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৯
Saji_Afroz
বাসর ঘরে বসে রয়েছে আজরা। তার চারদিকে ফুলে সাজানো। মজার কথা হলো, এখানের অনেক ফুলের নামই সে জানেনা! একথা ইনতিসার জানলে নিশ্চয় হাসবে। তাই না জানানোই শ্রেয়।
ইনতিসারের রুম দেখে বেশ ভালো লাগলো আজরার। বিশাল রুম তার। আজরাদের তিন রুমের সমান হবে হয়তো এই একটি রুমই। আর এক রুমেই কত ধরনের আসবাবপত্র! এমনটা সিনেমাতে দেখতো আজরা, বড়ো লোকের রুমের অবস্থা এমনই হয়। তার কপালেও যে এমন কিছু লেখা ছিল ভাবেনি সে।
এসব ভাবতে ভাবতে ইনতিসারের দেখা পেল। ভেতরে প্রবেশ করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো সে। তাকে দেখেই বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটাতে শুরু করলো আজরার। ইনতিসার
ধীরপায়ে আজরার দিকে এগিয়ে এসে তার পাশে বসলো। হালকা কেশে বলল, ফ্রেশ হয়ে আসতে পারেন আপনি ।
এমন কিছু আজরা আশা করেনি। তবে মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। কেননা তার আসলেই এমন ভারী পোশাকে অসহ্য লাগছিল। সে মাথা নেড়ে সাই জানিয়ে উঠে পড়লো। ব্যাগ থেকে একটি শাড়ি বের করে এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে।
ইনতিসার তার শেরওয়ানি বদলে নেয়। এরপর বারান্দায় আসে। বাসর রাত নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল তার! প্রতিটা মানুষেরই তাই থাকে।
ভেবেছিল প্রিয় মানুষটার হাতে হাত রেখে গল্প করবে, তার কোলে মাথা রেখে করবে ভালোবাসার প্রকাশ। আর এরপরে…
কিন্তু ইনতিসারের বাসর রাত নিয়ে কোনো উত্তেজনা নেই। নেই কোনো আগ্রহ! বরং শরীর অবসাদ হয়ে আসছে। এমনটা হওয়ার কারণ কী নাবীহা?
তার বিয়ে হয়েছে, নাবীহার হবে। তবুও ইনতিসারের মাথায় সে কেন ঘুরপাক খাচ্ছে?
এসব ভেবে মাথাটা ধরে আসছে ইনতিসারের। এক কাপ কফি প্রয়োজন তার। তাই সে রুমের বাইরে বেরিয়ে আসে। চ্যাঁচিয়ে বুয়াকে ডেকে তার জন্যে কফি নিয়ে আসতে বলে স্টাডি রুমে। এই বলে সে এগিয়ে যায় স্টাডি রুমের দিকে। রুমে এসে এসি অন করে ইজি চেয়ারে বসে পড়লো সে।
এদিকে তার পিছু নিয়েছে ইলারা জামান। বিয়েতে নাবীহা কে দেখার পর থেকেই তিনি চিন্তিত ছিলেন। এখন ইনতিসারের আচরণে এটা স্পষ্ট যে, বিয়েতে নাবীহা কে দেখে তার জীবনে প্রভাব পড়েছে। এই প্রভাব যাতে দীর্ঘ দিন স্থায়ী না হয়, এই বিষয়ে ইনতিসারের সতর্ক হয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
এই ভেবে তিনি স্টাডি রুমে এলেন। মা কে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো ইনতিসার। তাকে বসতে বলে নিজেও তার পাশে চেয়ার টেনে বসলেন ইলারা জামান।
কোনো ভনিতা না করেই তিনি বললেন, এমন একটা বিশেষ মুহুর্তে এখানে একা এসে বসে আছিস?
-কফি খেতে ইচ্ছে করছিল।
-সেটা আজরার সাথে বসে একসাথে খাওয়া যেত না?
-সে তো ফ্রেশ হচ্ছে।
-অপেক্ষা করতি!
-আচ্ছা বুয়াকে বলছি দু’কাপ বানাতে কফি।
এই বলে ইনতিসার উঠতে চাইলে তাকে আটকালেন ইলারা জামান। তিনি বললেন, আজ নাবীহা কে দেখেছিলাম বিয়েতে।
ইনতিসার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ওহ!
-মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
-শুনেছি।
-সবই জানিস দেখছি।
-আজরা বলেছে।
– সে কী প্রস্তাবের বিষয়ে জানে?
-তা বলতে পারি না। পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিল।
-ওহ! এসব নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজন নেই।
-হুম।
-দেখ ইনতিসার, এমন প্রস্তাব দেওয়া এটা হয়েই থাকে। ওর পছন্দ আছে বলে তা গ্রহণ করেনি। এখন তো তোকে প্রত্যাখ্যান করার কারণও জেনে গিয়েছিস।
-হুম।
-তবে এসব নিয়ে আর ভাবিস না।
ইলারা জামান কী বলতে চাইছেন ইনতিসার বুঝতে পারে। এটা কী করছে সে! তার আচরণে প্রকাশ করছে সে দ্বিধায় আছে! আজরাও যদি প্রস্তাবের বিষয়ে অবগত হয়ে থাকে, তবে তার মনেও এমন ভাবনাটা আসবে। ইনতিসার কে নিয়ে তখন কী ভাববে সে!
এই ভেবে ইলারা জামানের উদ্দেশ্যে সে বলল, আজরা হয়তো বেরিয়েছে। আমি আসছি।
এই বলে দ্রুত সে স্টাডি রুম থেকে বেরুলো।
গোসল সেরে গোলাপি রঙের শাড়িটি পরে ওয়াশরুম থেকে বেরুলো আজরা। ইনতিসার কে দেখতে না পেয়ে আশেপাশে খুঁজতে লাগলো। গোসল সারতে কী খুব বেশি সময় নিয়ে ফেললো সে?
-হলো আপনার?
পেছনে ফিরে ট্রে হাতে ইনতিসার কে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেল আজরা। ইনতিসার এগিয়ে এসে বলল, কফি আনতে গিয়েছিলাম।
আজরা এক মগ কফি নিয়ে বলল, এটার প্রয়োজন ছিল। ধন্যবাদ।
-এখন থেকে কখন কী প্রয়োজন আমাকে জানাবেন। আর এটা তো আপনারই বাড়ি। নিজের ইচ্ছে মতোই সব করবেন।
এই বলে ট্রে টা টেবিলে রেখে কফি মগটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো ইনতিসার। খেয়াল করলো, আজরার খোলা চুল বেয়ে পড়ছে পানি। ইনতিসার বলল-
চুল বেয়ে পানি পড়ছে আপনার।
আজরা তার কথা শুনে মগ রেখে হাতে তোয়ালে নিলো। এরপর চুল মুছতে শুরু করলো সে। কিন্তু মুছতে গিয়ে ব্লাউজের ফিতের সঙ্গে তার চুল আঁটকে যায়। যা সরানোর চেষ্টায় লেগে পড়লো আজরা। আয়নার সামনে গেলেও সে পেছনের দিকে দেখতে না পারার কারণে চুল ছাড়াতে সক্ষম হয় না। কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। তা দেখে ইনতিসার এগিয়ে আসে। কিছু না বলে সে আজরার হাতটা সরিয়ে দেয়। এরপর ফিতা থেকে চুল ছাড়াতে চেষ্টা করে। ছাড়ানোর জন্য ব্লাউজের ফিতেটা খুলতে হয় তাকে। এবং খুব তাড়াতাড়ি চুল ছাড়াতে সফলও হয় সে।
নিজের পিঠে ইনতিসারের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো আজরা। সামান্য আঙুলের স্পর্শেই তার মনে অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করলো।
এদিকে আজরার খোলা পিঠে চোখ পড়তেই তা খুব করে ছুঁয়ে দেখার লোভ হলো ইনতিসারের। আচমকা সে আজরার পিঠে আসা সমস্ত চুল সামনের দিকে সরিয়ে সেখানে হাত বোলাতে শুরু করে।
কেঁপে কেঁপে উঠছে আজরা। তা দেখে ইনতিসার পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আয়নায় চোখ পড়তেই ইনতিসার খেয়াল করলো, নাবীহা পরম আবেশে দু’চোখ বন্ধ করে আছে। লজ্জার আভা ছেয়ে গেছে তার মুখমণ্ডল জুড়ে।
আয়নার দিকে তাকিয়েই নাবীহার ঘাড়ে মুখ ডুবালো ইনতিসার। সেখানে আলতো করে চুমু দিতেই নিঃশ্বাস বড়ো হয়ে এল নাবীহার। নাবীহার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে পাগলপ্রায় অবস্থা ইনতিসারের। অনবরত নাবীহার শরীর কাঁপছে দেখে তাকে কোলে তুলে নিলো ইনতিসার। এরপর নিয়ে এলো বিছানায়। তাকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শরীরের ভার তার উপরে দিলো। কিন্তু এ কী! এ তো আজরা! এতক্ষণ সে নাবীহার কল্পনায় বিভোর ছিল ভেবে নিজের উপরে রাগ হলো তার।
আজরা কে ওভাবে রেখেই দ্রুত উঠে পড়লো সে। আজরাও নিজের চোখ জোড়া খুললো। পাশে মাথা নিচু করে বসে থাকা ইনতিসার কে দেখে সেও বসে পড়লো। হঠাৎ তার কী হয়েছে বুঝতে পারলো না সে। শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে ক্ষীণস্বরে বলল, ঠিক আছেন আপনি?
“না আমি ঠিক নেই! এতক্ষণ যা করেছি সবটাই তোমার জায়গায় তোমার বান্ধবী কে কল্পনা করে। এটা শুনে কী তুমিও ঠিক থাকবে?”
কথাটি বলতে চেয়েও বলতে পারলো না ইনতিসার। শুধু বলল-
আসলে আজকে আমাদের একসাথে প্রথমদিন। আর আজই আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই ওভাবে…
এই বলে থামলো ইনতিসার। সে কী বলতে চাইছে বুঝে নিলো আজরা। সে মাথা নিচু করে মৃদু হেসে বলল, আমি কিছু মনে করিনি।
-তবুও! আজকের রাতে আমাদের উচিত একে অপর সম্পর্কে জানা, ফিউচার সম্পর্কে আলোচনা করা। তাছাড়া গত কয়েকদিন ধরে কত ধকল গেছে আপনার উপরে। রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন।
ইনতিসারের এমন ভাবনায় তার প্রতি সম্মান আরও বেড়ে গেল আজরার। সে তার স্ত্রী। তবুও অনুমতি না নিয়ে স্পর্শ করাতে সংকোচবোধ করছে সে।
আজরা বিষয়টাকে সহজ করতে বলল, আপনাকেও বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
-আসলেই ক্লান্ত অনুভব করছি।
-তবে ঘুমিয়ে পড়ুন?
আজরার দিকে তাকানোর সাহসও ইনতিসারের নেই। নিজেকে খুব বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে এসব মিথ্যে বলে। সে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। আজরা এখনো বসে রয়েছে।
ইনতিসার তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ঘুমোচ্ছেন না?
-ঘুমোবো।
এই বলে আজরাও শুয়ে পড়লো। ইনতিসার ওপাশ ফিরেই শুয়ে আছে। আজরা বলল, একটা কথা বলি?
-জি বলুন?
-আমাকে তুমি করে বলবেন প্লিজ।
কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হলো না ইনতিসারের। তাই শুধুমাত্র “হুম” বলেই থেমে গেল সে।
শোয়ার সথে সাথেই আজরার দুচোখ বন্ধ হয়ে আসলেও ইনতিসার এক করতে পারলো না তার দু-চোখ।
বুঝতেই পারছে, একটি নির্ঘুম রাত পার করতে চলেছে সে।
.
.
.
সকালে ঘুম থেকে উঠতে আজ দেরী হয়ে গেল মানতাশার। উঠেই সে ঘড়ির দিকে তাকালো। নাহ, এতটাও দেরী হয়নি। সবেমাত্র দিনের বারোটা বাজতে চলতে চলেছে। এই কয়েক দিন যা ধকল গেছে, একটানা রাত বারোটা অবধি ঘুমোলেও তার ঘুমের শেষ হবে না। কিন্তু এতক্ষণ সে ঘুমোতে পারবে না। সন্ধ্যায় আবারও ধকল যাবে। আজ আজরার শশুরবাড়িতে দাওয়াত আছে।
এই ভেবে আবারও শুয়ে পড়লো সে।
মরিয়ম বেগমের ডাকে তাকে শোয়া থেকে উঠে বসতে হলো। বিরক্তভরা কণ্ঠ নিয়ে সে বলল, ডাকছ কেন?
-ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে আয়। কথা আছে।
-কথা শোনার জন্যে ফ্রেশ হতে হবে?
-হুম হবে। তাড়াতাড়ি আয়।
একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে পড়লো মানতাশা। ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে আসলো সে। কিন্তু সোফার উপরে এমন একজন কে বসে থাকতে দেখে বিস্ময় এর শেষ পর্যায়ে চলে গেল সে।
এজাজ এখানে কী করছে!
মানতাশা দ্রুত তার কাছে আসলো। ধমকের সুরে বলল তাকে, তুমি এইখানে কী করছ?
এজাজ দাঁড়িয়ে বলল, ঘুম থেকে উঠার পর তো দারুণ লাগে দেখতে তোমাকে।
রাগে গিজগিজ করতে করতে মানতাশা বলল, এখুনি বেরিয়ে যাও। কেউ দেখার আগে যাও বলছি!
-এভাবে যাওয়ার জন্য তো আসিনি।
-তবে কেন এসেছ?
-ডেকেছে তাই এসেছি!
-ডেকেছে! কে ডেকেছে?
“আমি ডেকেছি”
মা এর কণ্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরে তাকায় মানতাশা। চোখ জোড়া বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলো সে মরিয়ম বেগমের দিকে। তিনি এজাজ কে ডেকেছে মানে! তবে কী এজাজের সম্পর্কে সব জেনে গেলেন তিনি! যেই সম্পর্ক টা সে শেষ করতে যাচ্ছিলো, তা কী সবার সামনে চলে এসেছে?
এসব ভেবে অস্থির হয়ে উঠে মানতাশার মন।
.
.
.
নাবীহার ছোটো ভাই একটি কালো রঙের শার্ট নিয়ে এসে তাকে দেখিয়ে বলল, আপু আপু? আজ আজরা আপুর বাসায় এটা পরে যাই?
নাবীহা তাকে দেখে হেসে বলল, এটা তোকে খুব মানিয়েছে। কিন্তু আজ আমরা যে ওখানে যাব না ভাই!
জহির মন খারাপ করে বলল, কেন আপু? আজরা আপু আমাকেও যেতে বলেছে তো। বলেছে আমি গেলে মনে হবে তার ছোটো ভাই গেছে।
আজরার কোনো ভাই-বোন নেই বলে সে যে জহির কে কত ভালোবাসে জানে নাবীহা। কিন্তু আজ আজরার বাড়িতে যেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না নাবীহার।
আবারও ইনতিসারের মুখোমুখি তাকে হতে হবে। তাছাড়া ও বাড়িতে যাওয়াটা কী পছন্দ করবে ইনতিসারের পরিবার?
এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লো নাবীহা।
চলবে