একদিন কাঁদবে তুমিও পর্ব-৬+৭

0
769

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৬
#Saji_Afroz

এই সময়ে আজরা রেস্টুরেন্টে কী করছে? সাথে ইনতিসার নেই তো? মনের মাঝে ভাবনাটা আসতেই ব্যাগ থেকে ফোন বের করে নাবীহা। সাথে সাথেই ফোন করে আজরা কে। নাবীহার ফোন পেয়ে রিসিভ করলো আজরা। নাবীহা বলল, তুই কোথায়?
-বারকোডে।
-কার সাথে?
-উনার সাথে।
-ইনতিসার ভাই?
-হু। তোরা কোথায়? কতক্ষণে পৌঁছাবি?
-আমার একটা কাজ পড়ে গেছে রে। পরে দেখা করব। তুই তোর কাজ সেরে বাসায় চলে যাস। এটা বলার জন্যই ফোন দিলাম।

নাবীহার কথা শুনে মনে শান্তি পেল আজরা। নাবীহা কে এখানে আসতে সে নিষেধ করতে পারছিল না। নতুবা তাকে মেসেজ করবে ভেবেছিল। এতে যদি মনে কষ্ট পেত নাবীহা?
কিন্তু এখন তার কথা শুনে মনে হচ্ছে, নাবীহা জানতোই না সে ইনতিসারের সাথে আছে। জেনে নিজ থেকে আসতে নারাজ। এইজন্যই নাবীহা কে তার এত ভালো লাগে। ওদিকে মানতাশা! বুদ্ধি সুদ্ধি কবে হবে এই মেয়ের কে জানে! তার এটা বোঝা উচিত, বিয়ের আগে নাবীহা কে ইনতিসারের সামনে এনে বিব্রতবোধ করার কোনো মানেই হয় না।
মনে মনে নাবীহা কে ধন্যবাদ জানায় আজরা। আর সাথে ইনতিসার কে বলল, আসলে ওদের কাজ পড়ে গেছে। তাই আসতে পারছে না।
-ও আচ্ছা! পরে দেখা হবে তবে।
-আমিও আসি এখন? রাত হয়ে যাচ্ছে।
-চলুন আমি নামিয়ে দিই আপনাকে।
-তার প্রয়োজন নেই!
-খুব আছে।

এই বলে হাসলো ইনতিসার। তার হাসি দেখে হাসলো আজরাও।
.
.
মানতাশা কে থামিয়ে নাবীহা বলল, আমার এখুনি বাসায় যেতে হবে।

মানতাশা ভ্রু কুচকে বলল, আমি রিকশা ঠিক করেছি!
-তবে তুই একাই যা আজরার কাছে। আমার কাজ আছে।
-লাস্ট মুহুর্তে এসে এমন করছিস কেন?
-মানতাশা! তোর মাথা গেছে আসলেই।
-কেন?
-ওরা আলাদা সময় কাটাচ্ছে। এখন আমাদের যাওয়াটা ঠিক হবে? তাছাড়া আমার যাওয়া তো মোটেও উচিত হবে না। এটাও এখন তোকে আমার বোঝাতে হবে?
-আজরা ইনতিসারের সাথে আছে তুই জানলি কীভাবে?
-ফোন দিয়েছিলাম।
-ওহ!
-তুই আমাকে কেন সেটা বললি না?

আমতাআমতা করে মানতাশা বলল, আমি ওত কিছু ভেবেছি না কি! ভাবলাম বিয়ের আগে একবার ভাইয়ার সাথে সবাই পরিচিত হই!

খানিকটা রাগ নিয়েই নাবীহা বলল, বুঝে শুনে কাজ করিস।

রিকশাওয়ালা বিরক্ত হয়ে বলল, আপনারা কী যাইবেন?

নাবীহা বলল, যাব। কিন্তু উলটা পথে। যাবেন?
-উঠেন আপা তাড়াতাড়ি।

নাবীহা রিকশায় উঠে বসে ডাকলো মানতাশা কে। মানতাশাও উঠে বসে।
মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। আজকে দারুণ একটা ঘটনা ঘটতে পারতো, যেটি নাবীহার জন্য ভেস্তে গেল!
.
.
.
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো নাবীহা। আজ মানতাশার উপরে রাগ হচ্ছে তার। ইদানীং তার আচার-আচরণ ভালো লাগছে না নাবীহার কাছে। মানতাশা নিঃসন্দেহে চঞ্চল একটা মেয়ে। কিন্তু ওর আচরণে কখনো বুদ্ধিহীনতার পরিচয় পায়নি নাবীহা।
নাবীহার মতে সে সাহসী, মনে কিছু লুকিয়ে রাখে না, যখন যা মন চায় করে ফেলে। কিন্তু সে এই ক’টা দিন যা করছে তা কী তার স্বভাবের বশেই করছে নাকি কোনো কারণ রয়েছে?

এটা ভেবেও নিজের উপরে রাগ আরও বেড়ে যায় নাবীহার।
একে অপরের প্রিয় বান্ধবী তারা। অন্য কোনো কারণ কী থাকতে পারে! হয়তো মানতাশা বিষয় টাকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। কারণ তার সাথে তো ঘটেনি কিছু। ঘটেছে এবং ঘটছে আজরা ও নাবীহার সাথে। সে হয়তো সহজ ভাবেই দেখছে বিষয় টাকে।
এমনটা ভেবে মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেললো নাবীহা।
একবার বিয়েটা হয়ে গেলে সবটা ঠিক হয়ে যাবে। আর বন্ধ হয়ে যাবে এই লুকোচুরিও।
.
.
.
জমকালো ভাবে সাজানো হয়েছে আজরার বাড়ি। সাজাবেই তো! আজ তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। এই বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে হতে চলেছে, আয়োজনে কোনো কমতি রাখেননি তার পরিবার। বরং বড়ো ঘরে বিয়ে হওয়ার আনন্দে ভাবনার চেয়েও বেশি কিছু করা হয়েছে। যদিও ইনতিসারের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো চাহিদা ছিল না, তবুও আজহার শেখ তাদের খুশি রাখার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন সবকিছু ঠিকঠাক রাখতে।

পার্লার থেকে ফিরে আসে আজরা, নাবীহা, মানতাশা ও আজরার কিছু বোনেরা।
আজরা কে দেখে আজিজা বানুর চোখে পানি চলে এল। তার মেয়েটা কে হলুদ শাড়িতে ঠিক হলুদ পরীর মতোই লাগছে। মেয়ে কে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললেন তিনি। নাবীহা তাকে শান্তনা দিয়ে বললেন, আজকেই বিদায় নিচ্ছে না সে। আজ তো সবাই মজা করব। আপনি কেন ওর মন খারাপ করিয়ে দিচ্ছেন?
.
আজরার চোখও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। তা দেখে মানতাশা বলল, যাহ বাবা! ওর মেকআপ তো নষ্ট হবে।
.
নিজেকে সামলে নেন আজিজা বানু। আজরা কে বললেন, অনেক সুন্দর লাগছে আমার মা কে।

মানতাশার দিকে চোখ যেতেই ভ্রু কুচকালেন তিনি। মানতাশা ও নাবীহা একই রকমের পোশাক পরলেও দু’জনের সাজে রয়েছে ভিন্নতা। মানতাশা এমনভাবে সেজেছে, দেখে মনে হচ্ছে তারই বিয়ে! আজরার এই বিশেষ দিনে তার কেন এভাবে সাজতে হলো? এই নিয়ে মেজাজ খারাপ করলেন আজিজা বানু। কিন্তু কিছুই প্রকাশ করলেন না। তিনি বললেন, তোরা ডিনারটা সেরে নে। এরপর অনুষ্ঠান শুরু হবে।

টেবিলে এসে সবাই বসলেও নাবীহা বসলো না। এর কারণ জানতে চাইলে সে বলল, আমি আজরা কে আগে খাইয়ে দিই। আলগা নখ লাগিয়েছে সে, নিজ হাতে খেতে পারবে না।

মানতাশা বলল, চামচ দে তবে?
আজরাও বলল, হু আমি চামচ দিয়েই খাব। তুই পাশে বসে খেয়ে নে তো।

আজরার কথা শুনে নাবীহা তার পাশে বসলো। সবাই খাওয়া শুরু করলেও আজরা খেতে পারছে না। শুধু চামচটা নাড়তেই রয়েছে সে। তা দেখে নাবীহা বলল, খাচ্ছিস না যে?
-ইচ্ছে করছে না রে।
-কেন! খাবার অনেক মজা হয়েছে।
-কেন যে আমার গলা দিয়ে নামছে না!
-বুঝতে পেরেছি। এই সময়ে এমন একটু লাগেই। তবে কিছু না খেলে শরীর দূর্বল লাগবে। একটু হলেও ট্রাই কর।
-হু।

আজরার খাবারের প্রতি অনীহা দেখে নাবীহা নিজ হাতে তাকে জোর করে খাইয়ে দিতে শুরু করলো। সাথে বলল-
আমি আগেই বলেছিলাম, খাইয়ে দিই!

এই দৃশ্য দেখে আজিজা বানু বেশ খুশি হলেন। মেয়ের বান্ধবী হিসেবে তার স্বভাবের জন্য নাবীহা কে খুব বেশি পছন্দ করেন তিনি।
.
.
খাওয়া শেষে অনুষ্ঠান শুরু হয়। আজরা কে মানতাশা জিজ্ঞাসা করলো, ইনতিসার ভাই কী আসবেন না আজ?
-নাহ।
-কেন?
-ওদের ওখান থেকে কেউ আসবে না। আমাদের এখান থেকেও কেউ যাবে না আজ। এমনি কথা হয়েছে।

মানতাশা ভেবেছিল আজ ইনতিসারের বাড়ি যাবে। তারাও এখানে আসবে। নিশ্চয় ইনতিসারের বাড়িতে আসা মেহমানরাও তার মতোই ধনী হবে। কারো না কারো দৃষ্টি আকর্ষণ তো সে করতোই। আর তাই তো এত টাকা খরচ করে এভাবে সেজেছে সে!
এখন ও বাড়ি যাওয়া হবে না শুনে মনটায় খারাপ হয়ে গেল তার।

মানতাশা বলল, এমন কেন হলো? যাওয়া আসাতেই তো মজা। তাছাড়া বর আসলে কত আনন্দ হয়!
-আসলে ওরাই না আসতে চেয়েছে। বিশাল আয়োজন করেছে তারা। নিজেদের মতো সময় কাটাতে চায়। তবে এখান থেকে কেউ যেতে চাইলে যেতে বলেছিল। মা বলল, যাবে না কেউ। যার যার অনুষ্ঠান তারাই করুক। কাল তো সবার দেখা হচ্ছেই।
-আসলেই তাই? না কি ইনতিসারের কোনো ইচ্ছেই নেই? আরেহ বর কাউকে না জানিয়ে বউ এর কাছে এসে সারপ্রাইজ দেয়। ইনতিসারের দেখছি তোর প্রতি কোনো আগ্রহই নেই।
-ওমন কিছু নয়।
-এমন কিছুই। তাই তো পার্টে থাকছে। ধনী ধনী ভাব করছে। ভালোবাসলে এতসব কিছু করতো না।

এই বলে মানতাশা উঠে অন্যদিকে চলে যায়। আজরার ফ্যাকাসে মুখ দেখে তার কাছে আসলো নাবীহা। কী হয়েছে জানতে চাইলে বলল-
ইনতিসার আজ আসবে না শুনে মানতাশা বলছে ওর কাছে না কি আমার কোনো গুরুত্ব নেই। আসলেই কী তাই?

তার কথা শুনে হেসে নাবীহা বলল, সব অনুষ্টানেই কী বরেরা যায়? আর সে হলো বড়ো ব্যবসায়ী। তাদের ওখানে কত মানুষজন আসবেন! তাদের ওয়েট করিয়ে এখানে আসাটা কেমন না!

নাবীহার কথা শুনেও শান্ত হলো না আজরার মন।
নাবীহা তা বুঝতে পেরে বলল-
তুই কবে থেকে মানতাশার কথা কানে নিতে শুরু করলি? তুই তো বলতি মানতাশা কবে কী বলতে হয়, করতে হয় বোঝে না। ওর এসব সিরিয়াসলি নিয়ে লাভ নেই। সেই তুই এখন ওর কথাতেই আজকের দিনে মন খারাপ করছিস?

আজরার ফোন বেজে উঠে। ইনতিসারের ভিডিও কল এসেছে। তা দেখে নাবীহা বলল, দেখলি তো? আসতে না পারলেও তোকে দেখার জন্য ফোন দিচ্ছেন উনি। কথা বল।

এই বলে নাবীহা সরে আসে। আজরা ফোন রিসিভ করতেই তাকে দেখে ইনতিসার বলল, মাশাআল্লাহ!

আজরা খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলল, আপনাকেও ভালো দেখাচ্ছে।
-কিন্তু আপনাকে যে এমন ফুলের সাজে প্রকৃতির রানী মনে হচ্ছে। ভাবছি কাল আপনার পাশে আমাকে মানাবে তো!

আজরা কিছু বলার আগে তার থেকে ফোন কেড়ে নেয় মানতাশা। সে বলল, ফোন দিলে হবে? এখানে এসে দেখে যেতে হবে আমার বান্ধবী কে।

মানতাশা কে দেখে চমকে উঠে ইনতিসার। তাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় যেন দেখেছে!
ভাবতেই সেদিন নাবীহার সাথে থাকা মেয়েটির কথা মনে পড়ে। আজ সাজসজ্জার কারণে ভালো করে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে ইনতিসারের। কিন্তু এই মেয়েটিকে সেই মেয়েটির মতোই মনে হচ্ছে।
এমনটি হলে নাবীহার সাথেও কী আজরার কোনো সম্পর্ক আছে!
.
.
আজ গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে সাজির আসবে বলেছে। তাকেও দাওয়াত করা হয়েছে। কিন্তু এতক্ষণেও সে আসছে না কেন!
নাবীহা ফোন করে সাজির কে। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ করা হয়। কিন্তু ওপাশ থেকে শোনা যায় অন্য একটি কণ্ঠস্বর। যে নিজেকে সাজিরের বন্ধু বলে পরিচয় দেয়। সাজির কোথায় জানতে চাইলে সে এমন একটি সংবাদ শোনায়, যা শুনে পা এর তলা থেকে যেন মাটি সরে যায় নাবীহার।
অস্পষ্ট স্বরে নাবীহা বলল, এটা হতে পারে না! আমার সাজিরের কিছু হতে পারে না!
.

চলবে

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৭
#Saji_Afroz

আজিজা বানু এসে মানতাশার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলেন। তিনি আজরার হাতে ফোন দিয়ে বললেন, মানতাশার সাথে কাজ আছে আমার।

এই বলে মানতাশা কে নিয়ে সরে গেলেন তিনি। মানতাশা অবাক হয়ে বলল, কী হলো আন্টি? এমন হাত ধরে টানাটানি করছেন কেন?
-মা হয়ে যদি এসব আমায় বলতে হয়! ওরা কথা বলছে বলুক না। তুমি কেন বিরক্ত করছ বলো তো?
-বিরক্ত! আমি তো জাস্ট মজা করছিলাম।

আজিজা বানু পরমুহূর্তেই মাথা ঠান্ডা করলেন। কথা ঘুরিয়ে বললেন তিনি, আমিও তোমার সাথে মজা করছিলাম। আসলে একটা কাজে তোমার সাহায্য প্রয়োজন।
-কী কাজ?
-ঘরে আসো বলছি।

এই বলে মানতাশা কে নিয়ে তিনি ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন।
মূলত তিনি চাননি ইনতিসার মানতাশার সাথে কথা বলুক। কারণ আজ মানতাশা কে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। অনেকেই তো বলাবলি করছে, কনের চেয়েও মিষ্টি লাগছে তাকে। আর তাই তিনি মানতাশার কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়েছেন।
মেয়ের জন্য ক’দিন ধরে দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে অঘটন তো একটা ঘটবেই।
সেটা মানতাশার দ্বারাও ঘটতে পারে! বিয়ে না হওয়া অবধি তাকে চোখে চোখে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন আজিজা বানু।
.
.
.
-সাজিরের কী হয়েছে? কী হলো? কিছু বলছেন না কেন?
.
ওপাশ থেকে এইবার হাসির শব্দ শুনতে পায় নাবীহা। সে অনেকটা অবাক হয়ে যায়। হচ্ছে টা কী! রাগ নিয়েই সে বলল, আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন কী হচ্ছে?

ছেলেটি আর কথা বলতে পারলো না হাসির কারণে। সে কাউকে ফোন দিয়ে বলল, আর পারছি না। ধর ফোন নে।

এইবার সাজিরের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় নাবীহা। সাজির বলছে, হ্যালো নাবু?

নাবীহা তার কণ্ঠস্বর শুনে যেন প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই সেই ছেলের কথা মনে হতেই বলল, তোমার নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে?
-আরে না।
-তো এমন একটা জঘন্য কথা কেন বলেছে?
-দুষ্টুমি করেছে।
-কে সেই ফাযিলটা?
-আমার বন্ধু!
-এটা কোনো কথা সাজির! আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানো তুমি?
-আচ্ছা বাবা স্যরি! বন্ধু মানুষ একটু মজা নিয়েছে।

একটু থেমে নাবীহা বলল, ইটস ওকে! কবে আসবে?
-আমি আজ না আসি? আসলে আমার বন্ধুটি আজই কানাডা থেকে এসেছে। সব বন্ধুরা একত্রে হয়েছি তো। বেরুতে ইচ্ছে করছে না। কাল বিয়েতে আসব পাক্কা।
-আমি আরও ভেবেছিলাম তুমি আসবে!
-ওখানে গিয়ে কী করব বলো? তোমার ফ্যামিলিরও কেউ যায়নি আজ। একা একা লাগবে আমার। যদিও তুমি আছ। কিন্তু সবাইকে ছেড়ে আমার সাথে বসে থাকলেই হবে?

সাজিরের কথায় যুক্তি আছে ভেবে নাবীহা বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু কাল অবশ্যই আসবে।
-আচ্ছা।
.
.
.
চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায় ইনতিসার। তাকে নিশ্চুপ দেখে আজরা বলল, কী হলো?

ইনতিসার অনেকটা সংকোচ নিয়েই জানতে চাইলো, আপনার বান্ধবী কে কোথাও যেন দেখেছি আমি।
-কোথায় দেখেছেন?
-দেখেছি কোথাও। উনি আপনার কেমন বান্ধবী?

আজরার হঠাৎ মনে হলো সেদিনের কথা। মাথা থেকেই চলে গিয়েছিল, নাবীহার সাথে মানতাশা কে দেখেছিল ইনতিসার৷ মানতাশা কে কী সে চিনে ফেলেছে!
-কেমন বান্ধবী আপনার?

আবারও একই প্রশ্ন করলে আজরা জবাব দিলো, অনেক ভালো বান্ধবী।

নাবীহার কথা কীভাবে তুলবে বুঝতে পারছে না ইনতিসার। আর এই মেয়েটি সেই মেয়েটিই কী না এই বিষয়েও সঠিকভাবে বলতে পারছে না সে।
আজরা ইনতিসারের অবস্থা বুঝতে পারে। তাই সে কথা কাটানোর জন্য তাড়া দিয়ে বলল, আমার অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে। পরে কথা বলি?
-নিশ্চয়।

এই বলে ফোনের লাইন কেটে দেয় আজরা। আর আপনমনে বলল সে, ভাগ্যিস সেদিন রেস্টুরেন্টে মানতাশাও আসেনি।
.
এদিকে ইনতিসারের কপালে পড়ে চিন্তার ভাজ।
সবকিছু ভুলে নতুন জীবনে মনোনিবেশ করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু আবারও নাবীহা নামক মেয়েটির কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। আজরার সাথে কী আসলেই তার কোনো সম্পর্ক আছে?
.
.
.
গতকাল বেশ আনন্দে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে আজরার। আজ তার বিয়ে। সকাল থেকেই মনের ভেতরে অন্যরকম এক অনুভূতি অনুভব করছে সে।
নানারকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়।
সঠিক সময়ে সাজ শেষ হবে তো, তাকে দেখতে ভালো লাগবে তো, ইনতিসার কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত সঠিক কি না, শ্বশুরবাড়ির সদস্য়রা কেমন হবেন, বাড়ির সবাই কে ছেড়ে সে থাকবে কীভাবে!

এসব চিন্তার জন্য নিজের উপরেই বিরক্ত সে। কেন যে মাথায় এসব ঘুরছে!

তাকে এভাবে চিন্তিত দেখে নাবীহা বলল, কী হলো?
-জানি না! হাবিজাবি চিন্তা ঘুরছে রে মাথায়।
-এটা খুবই স্বাভাবিক। নতুন জীবন শুরু করতে চলেছিস তো। আমরা নতুন কিছু করার আগে কত চিন্তাই করি। আর এটা জীবনের নতুন এক অধ্যায়। এমন মনে হওয়াটা স্বাভাবিক।

-কনে কে এখানে?

আজরা কে সাজাতে চলে এসেছে। নামকরা পার্লারে আনা হয়েছে তাকে। নাবীহা তাকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, এই যে আমার বান্ধবী। এমনভাবে সাজাবেন যেন বর চোখ সরাতে না পারে!
.
.
.
সাজ শেষে ক্লাবে উপস্থিত হয় আজরা ও নাবীহা। মানতাশা অন্য পার্লারে গিয়েছিল। সে অনেক আগেই ক্লাবে চলে আসে।
আজ ক্লাবে উপস্থিত হয় নাবীহা ও মানতাশার পরিবারও।
আজরা কে স্টেজে তোলা হয়। ভারী মিষ্টি লাগছে তাকে দেখতে। সবাই তার বেশ প্রশংসা করতে থাকে। উপস্থিত অন্যান্য বান্ধবীরাও তার প্রশংসা করলে শুনলে মানতাশা বলল, লাখ টাকার শাড়ি-গয়না ও সাজ দিয়েছে। ভালো তো লাগবেই।

এক বান্ধবী বলল, ওর জামাই না কি কোটিপতি? কপাল নিয়ে এসেছে মেয়েটা। কখনো ভেবেছিস? আজরার মতো শান্তশিষ্ট মেয়ে ওমন ঘরের বউ হবে।

আরেকজন দুষ্টুমির ছলে বলল, আমি তো ভাবতাম মানতাশার এমন ঘরে বিয়ে হবে। ওকে দেখেই এমন হত। কিন্তু ভাগ্য দেখ! সুন্দর হলেই ধনীর বউ হতে পারে না। হ্যাঁ রে মানতাশা? তোর বফ এখনো জব পায়নি তাইনা?

এই বলে হেসে উঠলো সবাই।
এসব কথা শুনতে মানতাশার একেবারেই ভালো লাগছে না।
সে শুধু বলল, বফ সে। বর হয়নি এখনো। বর হলে তখন এসব গবেষণা করিস।

এই বলে সে সেখান থেকে সরে যায়। হঠাৎ চোখ পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এজাজের দিকে। এজাজ কে দেখে সে অবাক হয়ে সেদিকে যায়। তাকে বলল, তুমি এইখানে?

এজাজ বলল, সারপ্রাইজ!

মানতাশা বিরক্ত হয়ে বলল, কীসের সারপ্রাইজ? বিনা দাওয়াতে এভাবে কেউ আসে?
-দাওয়াত পেয়েছি বলেই এসেছি।
-কে করেছে দাওয়াত?
-আজরা।

আজরার উপরে চরম মাত্রায় মাথাটা খারাপ হলো মানতাশার। সে বলল, আমাকে না জানিয়ে ও এটা কেন করলো! আমার ফ্যামিলি আছে এখানে।
-ওহ তাই! চলো পরিচিত হয়ে নিই।
-ফাযলামো কম করো। আমি চাইনা এখুনি কেউ আমাদের সম্পর্ক টা নিয়ে জানুক। আর তুমি দূরেই থাকো আমার থেকে।

এই বলে মানতাশা হনহনিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। তাকে ডাকতে যাবে ঠিক তখনি কেউ এজাজের পথ আঁটকায়। পেছনে ফিরে একজন বয়স্ক মহিলা কে দেখলো সে। মরিয়ম বেগম কে চিনতে অসুবিধা হলো না তার। মানতাশার কাছে তার পরিবারের ছবি দেখেছিল সে। তাই সহজেই বুঝে গেছে, মহিলাটি তার মা৷
সর্বনাশ! কিছু শুনে ফেললেন না তো তিনি!
মরিয়ম বেগম গম্ভীরমুখে বললেন, একটু এদিকে এসো আমার সাথে। কথা আছে আমার।

মরিয়ম বেগমের পিছু নেয় এজাজ। জানে না আজ কী হতে চলেছে!
.
.
বরযাত্রী চলে আসে। গেইটে ফিতা ধরার জন্যে আগে থেকেই তৈরী হয়ে ছিল আজরার কাজিন বোনেরা ও বান্ধবীরা। মানতাশাও তাদের সাথে যোগ দেয়। কিন্তু নাবীহা যেতে চায় না। তা দেখে মানতাশা বলল, কেন? গেলে কী সমস্যা?
-এমনেই। তোরা যা না!
-আজরার বিয়ে নিয়ে কত এক্সাইটেড ছিলি তুই! আর ওর বিয়ের গেইটেই যাবি না? এত মজার পার্ট মিস করবি?

নিশ্চুপ নাবীহা কে দেখে মানতাশা বলল, আমি বুঝতে পারছি কেন! কিন্তু তোকে দেখে কী ইনতিসার বিয়ে ভেঙে এমন ভাবছিস নাকি?
-কীসব বলিস!
-তবে যেতে কী সমস্যা?

কোনো জবাব না পেয়ে আজরার দিকে তাকায় মানতাশা। আজরা ইশারায় কী হয়েছে জানতে চায়। মানতাশা তার কাছে এসে বলল, নাবীহা গেইটে যেতে চায়ছে না। যদি তুই কিছু মনে করিস এই ভয়ে!

বান্ধবীর বিয়ে নিয়ে প্রতিটি বান্ধবীর-ই অনেক ইচ্ছে থাকে। নাবীহারও ছিল এবং আছে। সবাই গেইটে যাবে আর নাবীহা এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকবে। বেচারির নিশ্চয় মন খারাপ হবে।

একটু পরেই ইনতিসারের সাথে তার বিয়ে। এখন তাদের দেখা হওয়াই যায়। যেটা পরে হবে সেটা নাহয় একটু আগেই হোক।
আজরা নাবীহা কে ডেকে বলল, আরে যা যা! গিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করে নে!

আজরার কথা শুনে নাবীহাও যেতে রাজি হয়। মানতাশা নিচে নেমে এলে সকলে গেইটের দিকে পা বাড়ায়।

গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ইনতিসার ও তার সাথে আসা মেহমানরা। শ্যালিকারা এসেই লম্বা ফিতা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
এক লাখ টাকার দাবি করে তারা। তা শুনে বরপক্ষও হাসি তামাশা শুরু করে। তারা বলে, দশ টাকার ফিতে ধরে লাখ টাকা চাও?

একথা শুনে মানতাশা বলল, টাকা দিলে দাও! না দিলে তোমরা তোমাদের ছেলে কে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও!

মানতাশার কথা শুনে তার দিকে তাকালো ইনতিসার। এই তো সেই পরিচিত মুখটি! সামনাসামনি দেখে তার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, এই মেয়েটিই সেদিনের দেখা মেয়েটি। যার সাথে কি না নাবীহার কোনো সম্পর্ক রয়েছে। তবে কী নাবীহাও এখানে আছে? না কি সে কেবল এই মেয়েটিরই পরিচিত কেউ?
এই ভেবে আশেপাশে তাকাতে থাকলো ইনতিসার। ভিড়ের মাঝে হঠাৎ একটি মেয়ের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো সে। মেয়েটি আর কেউ নয়, নাবীহা! গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে সবার পেছনে।
ইনতিসার তাকে আরও ভালো করে লক্ষ্য করলো। হ্যাঁ, সেই নাবীহা! নাবীহা এখানে! তার মানে সে যেটা ভাবছিল সেটা সত্যি হয়ে গেল? কী সম্পর্ক নাবীহা ও আজরার?
নাবীহা ও সে একে অপরের চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে ফেললো নাবীহা।
কিন্তু নজর এড়াতে পারলো না ইনতিসার। এক দৃষ্টিতে নাবীহার দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়লো সে।
.
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে