#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৪
-‘ হেই হ্যান্ডসাম ওয়ান্না ড্যান্স ইউথ মি?’
নাঁচের তালে আবেদনময়ী ভঙ্গিতে কথাটি বলে উঠে একটি মেয়ে।অর্থ’র চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।রাগি চোখে তাকালো মেয়েটির দিকে।মেয়েটি ভয় পেয়ে তৎক্ষনাৎ স্থানটি ত্যাগ করলো।এদিকে আরাফ শব্দ করে হেঁসে দিলো।ওর এমন হাসি দেখে অর্থ বিরক্ত হয়ে বললো,
-‘ ডোন্ট লাফ লাইক আ ইডিয়ট।এইভাবে হাসার কি আছে?’
আরাফ হাসতে হাসতেই বলে,
-‘ যেভাবে তাকিয়েছিলি মেয়েটার দিকে।মেয়েটা দেখলি না কিভাবে হুরমুরিয়ে ভাগলো। তুই এমন কেন ইয়ার।লাইফে একটু এঞ্জয় কর।মেয়েদের এভাবে কাছে ঘেসতেও না দিলে।ভবিষ্যতে তোর লাইফ পার্টনার পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।’
অর্থ নিষ্প্রভ চোখে তাকালো।হাতের ওয়াইনের গ্লাসটায় একটা চুমুক দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-‘ আমার এমন মেয়েদের লাইফ পার্টনার বানানোর কোন ইচ্ছাও নেই।যারা সেচ্ছায় নিজেদের বিলিয়ে দিতে পারে।যাদের ইজ্জতের তাদের কাছে কোন দাম নেই।তারা আমাকে কতোটুকু ভালোবাসবে বল?আমি তো চাই এমন একজন মেয়েকে আমার লাইফ পার্টনার বানাতে যাকে দেখলে আমার চোখ জুড়িয়ে যাবে।যার স্নিগ্ধতা আমার হৃদয়কে শীতলতায় ভরিয়ে দিবে,যে আমার টাকা, পয়সা,আমার বাহিরের সৌন্দর্যকে না আমাকে আর আমার মনটাকে ভালোবাসবে যে আমার পরিবারকে আগলে রাখবে।তাকেই আমি আমার জীবনসঙ্গী বানাবো।’
আরাফ হা করে চেয়ে আছে অর্থ’র দিকে।এই রাগি,গম্ভীর ছেলেটার মনের ভীতরে যে এতোটা আবেগ লুকিয়ে আছে তা আজ জানতে পারলো ও।নেহাত নেশার ঘোরে অর্থ এইসব বলেছে নাহলে জীবনেও ওর মুখ দিয়ে এইসব বের হতো না।আরাফ চিন্তায় পরে গেলো।কোথায় পাবে ও এমন মেয়ে যে ওর বন্ধুর মনের মতো হবে? যদি ওর কোন চেনাজানা এমন মেয়ে থাকতো বন্ধুর সুখের জন্যে হলেও সেই মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে আসতো।
——————
নিস্তব্ধ কালো রাত।বাহিরে হিমেল বাতাস শীতলতা দিচ্ছে।থেকে থেকে জোনাকি পোকাগুলো জ্বলজ্বল করে উঠছে। শিউলিফুল গাছটা থেকে দমকা হাওয়ার তালে তালে কয়েকশতো ফুল ঝরে পরছে ধরনীতে।ছাদে দাঁড়িয়ে রাতের প্রকৃতি উপভোগ করছে প্রাহি।মনটা বড্ড আনচান করছে।তাই একা একটু সময় কাটাতে ছাদে চলে এসেছে ও।কতোটা রাত হয়েছে অথচ ওর চোখে বিন্দু মাত্র ঘুম নেই। মনটা যে বড্ড অস্থির হয়ে আছে।অপেক্ষা করছে শুধু একজনের আগমনের।শুধু আজকের রাতটা কাল আসবে ওর প্রিয় মানুষটি। অতী উত্তেজনায় প্রাহির সারা শরীর কেঁপেকেঁপে উঠছে। প্রাহি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘ আজ দীর্ঘ ৭ বছর পর আপনি আসছেন।জানেন এই সংবাদটা পাওয়ার পর থেকে আমার চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই।সারাটা দিন ছটফট করেছি।আচ্ছা আপনি কি আমাকে ভালোবাসবেন?আমি যদি আমার মনের কথা ব্যক্ত করি আপনার কাছে তাহলে কি আপনি আমায় গ্রহন করবেন?নাকি আর সবার মতো আমাকেও দূরে ঠেলে দিবেন?এমনটা যেন না হয় আমি মনে প্রানে প্রার্থনা করি।তাহলে যে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না।একেবারে ভেঙে গুড়িয়ে যাবো।’
গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রাহি।আজও মনে পড়ে অর্থকে প্রথমবার দেখা আর সেই এক দেখাতেই কিভাবে ভালোবেসে ফেলেছিলো সে অর্থকে।
৭ বছর আগে।প্রাহি তখন দশম শ্রেনিতে সবে এসে ভর্তি হয়েছে।নতুন স্কুল নতুন জায়গা সব মিলিয়ে বেশ নার্ভাস ছিলো সে।ক্লাসে বসে একা একা বই পরছিলো প্রাহি কারন তখন ওর কোন বন্ধু ছিলো না।হঠাৎ স্টুডেন্টদের হইচই দেখে প্রাহিও নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে স্কুল মাঠে যায়।দেখে একটা ছেলে কয়েকটা ছেলেকে উরাধুরা মারছে।ও নিজেও বেশ মার খেয়েছে।তাও যেন ছেলেটা একাই একশো।ছেলেটা ছিলো হেমন্ত।ইশিকে কয়েকটা ছেলে বাজেভাবে ট্রিট করার কারনে হেমন্ত ওই ছেলেগুলোকে রেগে ইচ্ছামতো মেরেছিলো।মারামারি শেষে হেমন্ত চলে যেতে নিবে তখন প্রাহির নজর যায় হেমন্ত’র হাত থেকে রক্ত ঝরছে।প্রাহির মায়া হয়।ও দৌড়ে গিয়ে হেমন্ত’র হাত চেপে ধরে।তারপর লাইব্রেরিতে নিয়ে গিয়ে সুন্দরভাবে হাতটা ব্যান্ডেজ করে দেয়।হেমন্ত’র নিজেরও প্রাহিকে অনেক ভালোলাগে তাই ও আর ইশি মিলে প্রাহির সাথে বন্ধুত্ব করে নেয়।এদিকে হেমন্ত’র বাড়িতে খবর চলে যায় যে হেমন্ত স্কুল মাঠে মারামারি করেছে।তার কয়েকঘন্টা পরেই স্কুলে আরাফকে নিয়ে হাজির হয় অর্থ।সেদিন অর্থ হেমন্ত’র থেকে ওর মারামারি করার কারনটা জেনে হেমন্ত’কে কিছুই বলে না উলটো ওকে আরো সাহসীকতা দেয় যে ও যা করেছে একদম ঠিক করেছে।স্কুলের টিচার্সরাও আর কিছু বলার সাহস পায়নি।কারন এই স্কুলে অর্থও স্টাডি করেছে।আর ওর সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই জানেন তারা।অন্যায় একদম সহ্য করতে পারেনা অর্থ।সম মিটমাট করে চলে যায় অর্থ আর আরাফ।কিন্তু সাথে করে নিয়ে যায় প্রাহির মন।সেই ছোট্ট প্রাহি সেদিন এক দেখায় ভালোবেসে ফেলে অর্থ।কতোশতো পাগলামি তার।হেমন্ত’র কাছ থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে নানানভাবে অর্থ’র কথা জিজ্ঞেস করতো।হেমন্ত বলতো ওর ভাইয়ের সমন্ধে।আর প্রাহি হেমন্ত’র বর্ননা সরূপ ওর কল্পনা রাজ্য সাজাতো।একদিন জানতে পারে অর্থ চলে গেছে বিদেশে।অর্থ নাকি সেখানেই পড়ালেখা করতো।দেশে এসেছিলো ছুটিতে।সেদিন অনেক ভঙ্গে পড়েছিলো প্রাহি।কান্নার ফলে জ্বর এসেছিলো মারাত্মকভাবে।পুরো তিনদিন জ্বরে বেহুশের মতো ছিলো।আস্তে আস্তে সময় যায় মেনে নিয়েছিলো ভাগ্যকে।অপেক্ষা করা শুরু করে দেয় প্রাহি তার ভালোবাসার মানুষটির জন্যে।ডায়রীতে অর্থকে নিয়ে ওর না বলা হাজারো ভালোবাসার কথা লিখে রাখতো।একদিন ওর মা ওর ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে সেই ডায়রী পায়। বুঝতে পারেন তার মেয়ে অল্প বয়সে আবেগে গা ভাসাচ্ছে।ভাগ্য ভালো ডায়রীতে প্রাহি অর্থ’র নাম উল্লেখ করেনি কোনদিন।রাবেয়া নিজের মেয়েকে বুঝান এইসব দুদিনের আবেগ।এই আবেগে গা ভাসিয়ে নিজের পড়ালেখার ক্ষতি হবে।প্রাহি সেদিন মায়ের কথার গুরুত্ব দেয়।হাজারো চেষ্টা করতে থাকে অর্থকে ভুলে যাওয়ার।পড়ালেখায় মন দেওয়ার। কিন্তু এতো সহজে কি সবটা হয়।দুটো বছর অনেক কষ্ট করে যুদ্ধ করেছে সে যেন অর্থকে ভুলে যায়।কিন্তু পারেনা।ভার্সিটিতে উঠে প্রাহি।প্রাপ্তবয়স্ক হয়।বুঝতে পারে এটা ওর আবেগ না।ও সত্যিই অর্থকে ভালোবাসে মন থেকে অনেক বেশি ভালোবাসে।তাই তো এতো চেষ্টা করেও পারেনা অর্থকে ভুলতে।এদিকে হেমন্ত বাড়ি থেকে জানতে পারে অর্থকে বিয়ে করাবে তাই ওর কাকিমা ওর ভার্সিটিতে ভালো কোন মেয়ের খোজখবর নিতে বলেছে।হেমন্ত কয়েকদিন খুজে কিন্তু কাউকেই মন মতো পায়না।অবশেষে হেমন্ত বুঝে প্রাহির মতো এতো ভালো একটা মেয়ে থাকতেও ও কেন অন্য মেয়েদের খুজছে।প্রাহিই হবে ওর ভাইয়ের জন্যে পার্ফেক্ট।সেখান থেকেই শুরু হেমন্ত উঠেপরে লেগে যায় প্রাহিকে মানাতে।এদিকে হেমন্ত তো আর জানেনা ওর যাকে বিয়ে করার জন্যে প্রাহির পিছনে এতো কাঠঘোর পুরাচ্ছে।সে বহু আগেই নিজের মনপ্রান উজাড় করে ওর ভাইকে ভালোবাসে। প্রাহি ভাবতো হেমন্ত ওর সাথে দুষ্টুমি করে ওকে ভাবি ডাকে।উপরে মিথ্যে রাগ দেখালেও মনে মনে ভীষন খুশি হতো প্রাহি।মনে মনে দোয়া করতো ও যেন সত্যি সত্যি হেমন্ত’র ভাবি হতে পারে।
অবশেষে প্রাহির এতো অপেক্ষার পালা শেষ হতে যাচ্ছে।দীর্ঘ সাতবছর পর ও কাঙ্খিত মানুষটিকে দেখতে পাবে।এইবার আসলেই নিজের মনের কথা আর লুকিয়ে রাখবে না।সবটা বলে দিবে ও অর্থকে।ঠিক কতোটা ভালোবাসে ও অর্থকে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রাহি।বুকের ভীতরটায় তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।ও পারছে না নিজের খুশি আনন্দটা কারো সাথে ভাগাভাগি করতে। চোখ বুজে অর্থ’র মুখটা কল্পনা করলো প্রাহি।এখনো যেন সবটা ওর চোখের সামনে বাস্তবভাবে ভেসে উঠে। তারপর চোখ খুলে রুমের দিকে অগ্রসর হয়।আজ আরও একটা রাত ওর নির্ঘুম কাটাতে হবে।জেগে জেগে শুধু প্রহর গুনবে প্রিয় মানুষটির আসার।
#চলবে_____