#একতরফা_ভালোবাসা
#পর্বঃঅন্তিম
#লেখিকাঃদিশা_মনি
প্রেয়া আহিলের সাথে আজ অনেকদিন পর নিজের চেনা শহরে পা রাখলো। সিলেটের মায়া ত্যাগ করে সে এলো ঢাকায়। এতদিন পর নিজের চিরচেনা শহরে পা রেখে তার ভীষণ ভালো লাগল।
আহিল তাকে প্রথমে নিয়ে এলো প্রান্তিদের বাড়িতে। আসার পথে দীর্ঘক্ষণের নীরবতা ভেঙে প্রেয়া আহিলকে প্রশ্ন করেছিল,
“তোমাকে আমি কি শর্ত দিয়েছিলাম সেটা মনে আছে তো?”
আহিল বলে,
“হুম মনে আছে৷ বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে না।”
প্রেয়া সেই মুহুর্তে মৃদু হাসে। আহিলের হাত ধরেই তুষারদের বাড়িতে পা রাখে সে৷ প্রেয়ার আসার খবর শুনেই তুলি ছুটে ধরে তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে৷ দুজন বান্ধবী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে থাকে। তুলি বলে,
“এতদিন পর আমার কথা মনে পড়ল? কোথায় ছিলি এতদিন?”
“ছিলাম কোথাও একটা? তোর কি অবস্থা বল। আগের থেকে তো অনেক মোটা হয়েছিস দেখছি।”
“এতদিন পর এসেই আমাকে ইনসাল্ট করছিস!”
এবার দুজনে একটু হাসে। ততক্ষণে প্রান্তিও এসে উপস্থিত হয়েছে। প্রান্তিকে দেখেই প্রেয়া ছুটে যায় তার দিকে। প্রান্তি দূরে সরে এসে বলে,
“একদম আমার কাছে আসবি না। আমি কে হই তোর?”
“আপি আমি….”
“তুই কি হ্যাঁ? আমাকে যদি নিজের বোন ভাবতি তাহলে এতদিন আমার থেকে দূরে থাকতি না। আমার সাথে এভাবে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতি না। জানিস আমার বাবুটাকে জন্ম দেওয়ার সময় আমি মরে যেতে ধরেছিলাম!”
প্রেয়া অসহায় মুখ করে নেয়। প্রান্তর গাল ছুয়ে আদর করে দিয়ে বলে,
“ও তো অনেক সুন্দর হয়েছে।”
“হুম। একদম তোর মতো কিউট পুতুল হয়েছে।”
“আপি, তুমি আমায় কাছে টেনে নেবে না? মানছি আমি ভুল করেছি৷ কিন্তু তুমি বড় বোন হিসেবে আমায় মাফ করতে পারো না?”
প্রান্তি সাথে সাথে প্রেয়াকে নিজের বুকে টেনে নেয়। আবেগাক্রান্ত হয়ে বলে,
“তোর ভুল তো আমি সবসময় ক্ষমা করে দিয়েছি। আজও নাহয় আরেকবার তোকে ক্ষমা করলাম।”
প্রেয়া হাসে। সে জানতো প্রান্তি তার উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারবে না।
সবাইকে খুশি দেখে আহিলেরও ভালো লাগে। তার এতদিন নিজেকে দোষী মনে হতো যে তার জন্যই প্রেয়ার জীবনটা এমন হয়ে গেছে। আজ আবার প্রেয়ার জীবনটা গুছিয়ে দিতে পেরে তার অনেক ভালো লাগছে।
আহিল প্রেয়ার নাম ডাকে আলতো স্বরে ডাকে। প্রেয়া তার দিকে তাকাতেই সে বলে,
“আমি তাহলে এবার চলি। তুমি নিজের খেয়াল রেখো।”
আহিল যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তুষার সেখানে উপস্থিত হয়ে বলে,
“যাচ্ছ মানে টা কি? নিজের বউকে কি এখানেই রেখে যাবে?”
প্রেয়া বলে ওঠে,
“কেন তুষার ভাই? আমি এখানে থাকলে আমাকে খাওয়াতে কি তোমার খুব অসুবিধা হবে?”
“মোটেই না। কিন্তু তোমার নিজের বাড়ি থাকতে তুমি এখানে কেন থাকতে যাবে বল?”
প্রেয়া বলল,
“আমার নিজের কোন বাড়ি নেই তুষার ভাই। আমি আর আহিল আমাদের এই সম্পর্কের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
সবাই অবাক হয়ে যায় প্রেয়ার কথা শুনে। আহিল নিশ্চুপ থাকে। প্রান্তি বেশ রাগী স্বরে বলে,
“এটা কেমন কথা প্রেয়া? আহিল তোর জন্য এতদিন ধরে কত অপেক্ষা করেছে। কিভাবে তোকে খুঁজেছে ছেলেটা। তোর জন্য নিজের বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। আর তুই বলছিস ওকে ডিভোর্স দিবি?”
প্রেয়া ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“আমার ডিশিসন আমি নিয়ে নিয়েছি আপি। আমি এই সম্পর্কটা রাখতে চাইনা।”
এমন সময় হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হন রাহেলা বেগম। তাহেরা বেগম তাকে প্রেয়ার আসার খবর জানিয়েছিলেন। তাই তো তিনি ছুটে এসেছেন। নিজের করা ভুলগুলো যে এবার শোধরানোর পালা।
তিনি এসেই প্রেয়ার সামনে এসে হাতজোড় করে বলেন,
“আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি প্রেয়া। সেই অন্যায়ের যথাযথ শাস্তিও পেয়েছি। আমার স্বামী, ছেলে কেউ আমার সাথে ভালো ব্যবহার করে না। সবার দ্বারাই আমি অবহেলিত। আমি আজ তোমাকে অনুরোধ করে বলছি আমার ভুলের শাস্তি আমার ছেলেটাকে দিও না। এই ৩ বছর ও কি যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছে সেটা শুধু আমিই জানি। আমি চাই আমার ছেলেটা এবার একটু শান্তি পাক। যেটা শুধু তুমিই ওকে দিতে পারো৷ দয়া করে এই মায়ের অনুরোধ রাখো। প্রয়োজনে আমি তোমার পায়ে..”
প্রেয়া রাহেলা বেগমকে আটকে দিয়ে বলে,
“ছি ছি! এমন করবেন না। আমি আপনাকে অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি। তবে আপনার ছেলের জীবনে ফেরা আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি আমার জীবনটা নিজের মতো করে কা/টাতে চাই।”
“কিন্তু..”
“দয়া করে আমাকে আর রিকোয়েস্ট করবেন না। আমি আহিল ভাইকে বলে দেব ও যেন বাড়িতে ফিরে যায়। সাথে চাচা আর ওকে বলে দেব যেন আপনার সাথে আর খারাপ ব্যবহারও না করে।”
“তবুও তুমি ফিরবে না?”
“না, ফিরবো না। আমরা একে অপরের জন্য সঠিক নই।”
প্রান্তি কিছু বলতে যাবে এমন সময় আহিল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“থাক। আর কিছু বলতে হবে না৷ প্রেয়ার সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান জানাই। আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই বেটার হবে। আমি চাই, আমার জন্য যেন ওকে আর কোন বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে না হয়।”
সবাই অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। প্রান্তি শেষবারের মতো প্রান্তিকে বোঝানোর জন্য তার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“দেখ বোন, কোন সম্পর্ক ভাঙা যতোটা সহজ গড়া তার চেয়ে হাজার গুণ কঠিন। তাই যাই করিস না কেন একটু ভেবে চিন্তে করিস।”
“আমি না ভেবে কোন কাজ করি না আপি।”
প্রান্তি হতাশ হলো।
★★★
একে অপরের পাশাপাশি বসে আছে আহিল ও প্রেয়া। তাদের সামনে একটি পেপার। এই পেপারটাই হয়তো আজ তাদের ভাগ্য চিরতরে বদলে দিতে চলেছে। উকিল শেষবারের মতো তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন,
“তাহলে কি তোমরা আলাদা হয়ে যেতে চাও?”
আহিল বলে,
“হ্যাঁ। এটাই আমাদের ফাইনাল ডিশিসন।”
“কিন্তু আমি চাই না।”
সহসাই এমন একটি কথা বলে আহিলকে অবাক করে দেয় প্রেয়া। আহিল বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকাতেই প্রেয়া মৃদু হেসে বলে,
“আমি সেই কিশোর কাল থেকেই তোমাকে ভালো বেসে গেছি। আমার এই ভালোবাসা ঠুনকো নয়। সেই ভালোবাসা সর্বদা ছিল এখনো আছে। জানো আহিল ভাই আমি খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। আমি নিজের মনের কথা কাউকে মন খুলে বলতে পারি না৷ তোমাকেও পারিনি। তাই তো তোমাকে হারাতে বসেছিলাম। কিন্তু ভাগ্য আমায় সুযোগ দিয়েছে। আমার একতরফা ভালোবাসার জোড় ছিল জন্য এখন তুমিও আমার প্রতি তীব্র ভালোবাসা প্রকাশ করছ। এই ভালোবাসা আমি হারাতে চাই না আহিল ভাই। তোমাকে হারানোর কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারবো না। আমরা কি সবটা আবার নতুন ভাবে শুরু করতে পারি না?”
“অবশ্যই পারি।”
দুজনেই হাসে।
★★★★
“তারপর কি হলো?”
আকাশ মৃদু হাসে। তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“তারপর আর কি? ওরা দুজনে সুখে শান্তিতে বসবাস করলো।”
আকাশের মেয়ে ইরা তাকে শুধাল,
“তাহলে ঐ প্রেয়াই সেই মেয়ে যার কারণে তুমি আমার মাকে ভালোবাসতে পারো নি?”
“কে বলল পারিনি? আমি অবশ্যই পেরেছি। তোর মাকেও আমি ভালো বেসেছিলাম।”
“তাহলে আজও কেন তুমি ঐ প্রেয়াকে মনে রেখেছ? কেন তার কথা ভেবে কষ্ট পাও?”
আকাশ মৃদু হেসে বলে,
“সবাই তো আর প্রেয়া বা প্রান্তির মতো হয়না যাদের একতরফা ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। কারো ক্ষেত্রে পায়না। আর তাদের মনে এই না পাওয়ার কষ্ট সবসময়ই থেকে যায়। একতরফা ভালোবাসা হলো স্বেচ্ছায় পান করা বি’ষের মতো। যা আমাদের হৃদয়কে সবসময় ক্ষতবিক্ষত করে। আর তোর মা হলো আমার জীবনে এমন এক নারী যে আমাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল। আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল। তাই তো আমি প্রেয়াকে ভুলতে পেরেছিলাম। আমার হৃদয়জুড়ে শুধু তোর মায়ের বাস। প্রেয়া তো সেই হৃদয়ে থাকা শুধু একটা দীর্ঘশ্বাসের নাম। যেই দীর্ঘশ্বাসের নাম ❝একতরফা ভালোবাসা❞।”
❤️❤️❤️সমাপ্ত❤️❤️❤️