#একতরফা_ভালোবাসা
#পর্বঃ৯
#লেখিকাঃদিশা_মনি
প্রান্তি ও তুষার ফিরে এলো বাসায়। প্রান্তির কোন ইচ্ছা ছিল না ওখানে থেকে শুধু শুধু কথা শোনার। মানবিকতা দেখাতে গিয়ে সেধে অপমানিত হওয়ার কোন মানেই হয়না।
তবে আজ তুষার তার পক্ষে কথা বলায় প্রান্তির অনেক ভালো লেগেছে হাজার হোক, সে তো তুষারকে ভালোবাসে। তাই যখন ভালোবাসার মানুষটা সবার সামনে তার হয়ে কথা বলল তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রান্তির মনে অন্যরকম ভালো লাগা তৈরি হলো।
এতদিন তুষারের সাথে সম্পর্কটা নিয়ে যে ধোয়াশা ছিল সেটা এখন আর নেই৷ তুষারকে ভালোবেসে সে যে কোন ভুল করে নি তা বেশ স্পষ্ট করেই বোঝা যাচ্ছে। কারণ তুষার একজন ভালো মানুষ। সবথেকে বড় ব্যাপার যেটা একজন বিবেকসম্পন্ন, দায়িত্ববোধ সম্পন্ন মানুষ। তাদের বিয়েটা নিয়ে যা হয়েছে তাতে চাইলেই তুষার সব দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারত। কিন্তু সেটা না করে তুষার প্রান্তির প্রতি সব দায়িত্ব পালন করেছে। এমনকি অবিবেচকের মতো প্রান্তিকে দোষও দেয়নি৷ এসব ঘটনা তার মনে ভরসার সৃষ্টি করেছে তুষারের প্রতি।
প্রান্তি জানে তুষারের মনে যদি তাকে নিয়ে কোন সংশয় থাকে সেটা বিয়ের দিন পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়েই শুধু ধোয়াশা আছে। এইজন্য প্রান্তি সিদ্ধান্ত নিলো আর লুকোচুরি নয়৷ তুষারকে এবার সবটা বলবে সে। যেই ভাবা সেই কাজ। তুষারকে সবটা বলার সুযোগ পেতেই সে তাকে বলে,
“তোমার সাথে একটা কথা বলার ছিল তুষার ভাই।”
“হ্যাঁ, বল।”
“বিষয়টা খুব সেন্সিটিভ। আমি জানি, তোমাদের সবার মনে একটাই প্রশ্ন আমি কেন আমার আর আহিলের বিয়ের দিন বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তোমার মনেও নিশ্চয়ই এই নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমি আজ এর উত্তর তোমায় দিবো। ”
বলেই প্রান্তি তুষারকে সেদিন ঘটে যাওয়া সব ঘটনা বলে৷ সব শুনে হতবাক হয়ে যায় তুষার। প্রেয়া যে আহিলকে ভালোবাসে এই বিষয়টা তাকে হতবাক করে দেয়৷ সে তো প্রেয়াকে পছন্দ করতো। তবে এই মুহুর্তে আবেগকে পাশে সরিয়ে রেখে বিবেক দিয়ে চিন্তা করে তুষার। ঠান্ডা মাথায় সব শোনার পর প্রান্তির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“দোষটা তোরও কম ছিল না। আর যাই হোক এভাবে পালিয়ে যাওয়া তোর একদমই উচিৎ হয়নি। এরজন্য পরিবারকে কতটা অসম্মানের সম্মুখীন হতে পারে সেটা তোর ভাবা দরকার ছিল৷ তাছাড়া ব্যাপারটা তো অন্যভাবেও মিটমাট করা যেত। তুই তোর বাবার সাথেও বসে কথা বলতে পারি বিষয় নিয়ে।”
“আসলে তুষার ভাই সেই সময় আমার মাথাটাই কাজ করছিল না। আমি ভেবে উঠতে পারছিলাম না কি করব। বারবার শুধু এই কথাটাই মনে হচ্ছিল যে, আমার জন্য আমার বোন সু**সাইড এটেম্প করতে যাচ্ছিল।”
“তবুও তোর একটু ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হতো। শুধু নিজের বোনের জন্য পালিয়ে গিয়ে আজ তুই সবার কাছে খারাপ। না তুই ভালো আছিস আর না প্রেয়া। সবার জীবন কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। আমার মনে হয়, তোর সবাইকে সব সত্য বলা উচিৎ। তোর দিক থেকে সব ক্লিয়ার করা উচিৎ।”
“আমি এখনই সেটা করতে চাই না৷ এমনিতেই প্রেয়া আমাকে ভুল বুঝেছে। আমাকে নিজের এই অবস্থার জন্য ব্লেইম করছে। এখন যদি আমি আবার সব সত্য সামনে আনি তাহলে ও আমাকে আরো ভুল বুঝবে। আমি চাই না আমাদের দুই বোনের সম্পর্ক আরো খা*রাপ হোক। তবে আমি আমার বোনকে চিনি। প্রেয়া এখন এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে জন্যই ওর মধ্যে ফ্রাসটেশন কাজ করছে। ওকে একটু সময় দেওয়া উচিৎ। আমি আশাবাদী ও একসময় নিজে থেকে সবার সামনে সবটা ক্লিয়ার করবে।”
“আর ততদিন কি তুই সবার সামনে অপরাধী হয়েই থাকবি?”
“তোমার কাছেও কি আমি অপরাধী তুষার ভাই?”
“না।”
“আমার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। বাকি কে আমার প্রতি কি মনোভাব প্রকাশ করল তাতে আমার কিছু যায় আসেনা।”
বলেই মৃদু হাসল প্রান্তি। তুষার তার কথার মানে বুঝতে পারল না। তবুও সায় দিলো।
★★★
প্রেয়া সারাটা রাত হাসপাতালেই কা*টিয়ে দিলো। সারারাত ধরে আহিলের চিকিৎসা করল। ভোররাতের দিকে ডাক্তার এসে আশার বাণী দিয়ে বললেন,
“পেশেন্টের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। ওনার লাইফ রিস্ক নেই। তবে সুস্থ হলেও ওনাকে কিছুদিন সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে হবে। এইসময় ওনাকে একদম মানসিক স্ট্রেস দেওয়া চলবে না।”
রাহেলা বেগম প্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এই মেয়েটাকে দূর করলেই আমার ছেলের মানসিক স্ট্রেস দূর হবে।”
প্রেয়ার খারাপ লাগল অনেক। তবুও সে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল না।
কয়েকদিনের মধ্যেই আহিলকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে শিফট করা হলো। আহিল বর্তমানে রেস্ট নিচ্ছে। আহিল যখন ঘুমাচ্ছিল তখন চুপিচুপি তার রুমে প্রবেশ করে প্রেয়া। রুমে এসে এক ধ্যানে দেখতে থাকে আহিলকে৷ মানুষের চেহারাটা কতটা ফ্যাকাসে লাগছে। প্রেয়ার খুব কান্না পেল। এই মানুষটাকেই তো সে ভালোবাসে। মানুষটাকে এভাবে দেখে তার মোটেই ভালো লাগছে না।
এরমধ্যে আহিলের জ্ঞান ফিরলো। সে উঠেই বলতে লাগল,
“পানি…পানি”
প্রেয়া দ্রুত পানি আনতে গেল। পানি নিয়ে এসে আহিলকে দিলো। আহিল প্রেয়াকে দেখে রেগে গিয়ে বলল,
“তুমি এখানে কি করছ? তোমাকে বলেছি না আমার থেকে দূরে থাকতে।”
প্রেয়া অনেক কষ্টে কান্না আটকে জোরপূর্বক হেসে বলল,
“তুমি রাগ করো না আহিল ভাই। ডাক্তার তোমাকে স্ট্রেস নিতে মানা করেছে। তুমি কোন চিন্তা করো না। আমি তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যাব। এত দূরে চলে যাব যে তুমি আর আমাকে খুঁজেও পাবে না। শুধু তুমি সুস্থ হওয়া পর্যন্ত আমাকে নিজের পাশে থাকতে দাও। ব্যস, তাহলেই আমি খুশি।”
আহিল কিছু না বলে চুপ করে থাকে। প্রেয়া প্রেসকিপশন দেখে কিছু ওষুধ নিয়ে এসে আহিলকে বলে,
“নাও এই ওষুধগুলো খেয়ে নাও। তোমাকে কিন্তু এখন টাইম টু টাইম ওষুধ খেতে হবে। তাহলেই তুমি তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে। আর যত তাড়াতাড়ি তুমি সেরে উঠবে তত তাড়াতাড়ি আমি তোমার লাইফ থেকে বিদায় নেব। তাই তোমাকে জলদি সুস্থ হতে হবে।”
বুকে পাথর চেপে কথাগুলো বলে প্রেয়া। যা শুনে আহিল বলে,
“এসব নাটক করো না আমার সাথে। আমার একদম ভালো লাগে না। আর এখন যাও তো আমার সামনে থেকে আমি নিজে ওষুধ নিয়ে খেতে পারব।”
প্রেয়া কিছু শুনল না। জোরপূর্বক আহিলকে ওষুধ খাইয়ে দিলো। তারপর সামান্য হেসে বলল,
“আমি কোন নাটক করছি না আহিল ভাই। একবার শুধু আপনি সুস্থ হয়ে নিন। আমি আপনার থেকে দূরে চলে গিয়ে এটা প্রমাণ করে দেব যে আমি যা বলছি একদম ঠিক বলছি।”
★★★
যত দিন যাচ্ছে প্রান্তি ও তুষারের সম্পর্ক ততটাই মজবুত হচ্ছে। তুষার নিজের দায়িত্ব থেকে হোক বা প্রান্তির প্রতি তৈরি হওয়া অনুভূতির জন্যই হোক আজকাল তার অনেক কেয়ার করছে। যা প্রান্তিকে সবথেকে বেশি মুগ্ধ করছে।
প্রান্তির সব খুটিনাটি ব্যাপারে খেয়াল রাখছে তুষার। এই কেয়ারিং তুষারকেই তো নিজের জীবনে পেতে চেয়েছিল প্রান্তি। তাই তো সে এত খুশি।
এদিকে তুষার নিজেও নিজের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। মানুষের মন যে পরিবর্তনশীল সেটা তার বোঝা হয়ে গেল। সাথে এটাও বুঝল প্রেয়ার কথা মনে করে তার বুকে আর সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হয়না। বরং এখন প্রান্তিকে সে প্রেয়ার যায়গায় বসাতে পেরেছে। পারবে না-ই বা কেন। তারা যে হালাল সম্পর্কে বাধা পড়েছে। হালাল সম্পর্কে সবসময় সুন্দর।
তুষার আজ উপলব্ধি করতে পারছে প্রেয়া তার ভালো লাগা ছিল, ভালোবাসা নয়। আর এখন হয়তো সে প্রান্তি নামক রমণীর প্রেমে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে। যা তার মনে প্রশান্তির হাওয়া এনে দিচ্ছে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ❤️✨