#একতরফা_ভালোবাসা
#পর্বঃ৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি
প্রান্তি পুনরায় রুমে আসতেই তুষার বিছানা থেকে উঠে বসল। বেশ নম্র গলায় বলল,
“প্রান্তি তুই বিছানায় শুয়ে পড় আমি সোফায় ঘুমাচ্ছি।”
“তার কোন দরকার নেই তুষার ভাই। এটা তোমার রুম, বিছনাটাও তোমার। তুমি কেন শুধু শুধু আমার জন্য সোফায় শুতে যাবে? আমি বরং সোফায় থাকি।”
“বেশি পাকনামি করিস না প্রান্তি। এই পাকনামি করতে গিয়েই তোর এই হাল। আমি যা বলছি তাই কর। তুই আমার বিছানায় এসে শুয়ে পড়। দেখ, আমি মানি বা না মানি এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে তুই আমার স্ত্রী। আমাদের বিয়ে টা তো হয়েছে। তাই তোর প্রতি তো আমার কিছু দায়িত্ব আছে। তোকে এখানে নিয়ে এসে তো আমি আর কষ্টে থাকতে দিতে পারি না।”
প্রান্তি ম্লান হাসল। মনে মনে বলল,
“আমি জানি তুমি কতটা দায়িত্ববোধ সম্পন্ন মানুষ তুষার ভাই। তুমি যে আমার প্রতি কেবল দায়িত্বের খাতিরের এমন বলছ সেটাও আমি জানি। কিন্তু দেখো তোমাকে এই দায়িত্ব আমি বেশিদিন পালন করতে দেব না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দায়িত্ব থেকে তোমায় মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করব।”
★★★
প্রেয়ার আজকের রাতটা চলে যাচ্ছে চোখের জল ফেলতে ফেলতে। এই বাড়িতে এসে গেস্ট রুমে পড়ে রয়েছে সে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সাথে রাগও। এভাবে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল সে টেরই পেল না। যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখল সকাল ৯ টা বাজে। তড়িঘড়ি করে গেস্ট রুম থেকে বের হয়ে আহিলদের বাড়ির ডাইনিং রুমে গেল সে। আহিলরা সপরিবারে ব্রেকফাস্ট করছিল। প্রেয়াকে দেখেই আহিল ব্রেকফাস্ট টেবিল থেকে উঠে চলে যায়। যা প্রেয়ার মনকে ব্যথিত করে তোলে। রাহেলা বেগম প্রেয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“এতক্ষণে তোমার ওঠার সময় হলো? যাইহোক এসো। খেয়ে আমায় উদ্ধার করো।”
প্রেয়ার ভীষণ খারাপ লাগল রাহেলা বেগমের এমন ব্যবহার। কিন্তু সে কিছু না বলে চুপচাপ বসে পড়ল ডাইনিং টেবিলে। রাহেলা বেগম প্রেয়ার দিকে খাবার বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“নিজে নিয়ে খাও।”
প্রেয়া চুপচাপ তাই করতে লাগল। খাওয়া শেষ করে প্রেয়া আবার গেস্টরুমের দিকে যেতে লাগল এমন সময় হঠাৎ আহিল পিছন থেকে তার নাম ধরে ডাকে। প্রেয়া তাকাতেই আহিল বলে,
“তোমাকে আমি একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই তুমি যদি এখানে থাকতে চাও থাকতে পারো তবে এখানে থাকতে চাইলে আমার সব কথা মেনে চলতে হবে।”
“হ্যাঁ বলো আমায় কি করতে হবে।”
“আমি যখন তোমাকে বিয়ে করে এনেছি তখন নিশ্চয়ই শোপিস করে সাজিয়ে রাখার জন্য আনিনি। এই বাড়ির বউ হিসেবে রান্না বান্না থেকে শুরু করে বাসন মাজা সব কাজ তোমাকে করতে হবে। আর হ্যাঁ, কাজের ব্যাপারে যেন কোন ত্রুটি বা অজুহাত না দেখতে পাই।”
প্রেয়া হালকা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রদান করে। আহিল একটু থেমে পুনরায় বলে,
“সবথেকে ইম্পোট্যান্ট কথাটা হলো আমার থেকে সবসময় যতটা সম্ভব দূরে থাকবে। তোমাকে দেখলেই আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় তোমার বোনের প্রতারণার কথা।”
এতক্ষণ সব চুপচাপ মেনে নিলেও এখন আর প্রেয়ার পক্ষে সম্ভব হয়না এই কথাটা সহ্য করার। তার চোখ ভড়ে যায় চলে। ছোটবেলা থেকেই স্বল্পভাষী বলে পরিচিত মেয়েটা। চাপা স্বভাবেরও। সবসময় নিজের মনের কথা সন্তপর্ণে লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু এখন আর পারছে না। এত কষ্ট আর মনের মধ্যে জমা রাখা সম্ভব নয়। প্রেয়ার আহিলকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হলো,
“আপির দো*ষের শাস্তি আপনি আমায় কেন দিচ্ছেন?”
কিন্তু বলতে পারল না। কোন একটা যায়গায় সে বাধা পড়ল। আহিল প্রেয়াকে পাশ কা*টিয়ে চলে গেল। আহিলকে কিছু বলতে না পারায় প্রেয়ার সব ক্ষোভ জমা হলো প্রান্তির উপর। প্রেয়া সিদ্ধান্ত নিলো প্রান্তির সাথে দেখা করবে। তার কাছে কৈফিয়ত চাইবে কেন সে বিয়ে ছেড়ে এভাবে পালিয়ে গেল?! কারণ প্রেয়ার মতে প্রান্তি বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণেই এত ঘটনা ঘটেছে।
যেই ভাবা সেই কাজ। প্রেয়া চটজলদি নিজের ফোন থেকে প্রান্তির নাম্বারে ফোন করে। প্রেয়া যখন ফোন করছিল তখন প্রান্তি ঘুম থেকে উঠে গোসল করে ছাদে নিজের কাপড় শুকাতে দিতে গিয়েছিল। এদিকে রুমে ফোন রিং হয়ে যাচ্ছিল। প্রান্তি নেই দেখে তুষার ফোনটা রিসিভ করে। ফোন রিসিভ হতেই প্রেয়া বলে,
“হ্যালো আপি…”
প্রেয়ার গলা শুনতেই তুষারের বুকটা ধ্বক করে উঠল। মনের গহীনে সূক্ষ্ম ব্যাথা অনুভূত হলো। কিছুক্ষণের জন্য সে পুরো স্তব্ধ হয়ে রইল। হালকা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“বল কি বলবি।”
“তুষার ভাই তুমি প্রান্তি আপিকে ফোনটা দাও। ওর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা বলার আছে।”
ততক্ষণে প্রান্তিও চলে এলো। তুষার প্রান্তির দিকে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এই নাও তোমার ফোন।”
প্রান্তি ফোনটা নিয়ে কানে দিতেই প্রেয়া বলল,
“আজ বিকেল ৫ টায় গ্লোবাল কফিহাউজে চলে আসবি। যা বলার সেখানে বলব।”
বলেই প্রেয়া ফোনটা রেখে দিলো। প্রান্তি বুঝতে পারল না প্রেয়া হঠাৎ কেন সাথে দেখা করতে চাইছে। প্রেয়ার ভাবনার মধ্যেই তার চোখ গেল তুষারের দিকে। নিস্তব্ধ, বিমূঢ় চেহারার দিকে তাকাতেই প্রান্তি উপলব্ধি করল তার মনের অনুভূতি। মনে মনে বলল,
“দুঃখিত তুষার ভাই। আমার জন্য হয়তো তুমি নিজের পছন্দের মানুষটাকে নিজের করে পেলে না। তবে একসময় তুমি ঠিক উপলব্ধি করতে পারবে যে প্রেয়ার সাথে তোমার বিয়েটা হওয়া ঠিক হতো না। কারণ প্রেয়ার মনে যে অন্য কেউ ছিল! তোমাদের বিয়েটা হলে যে দুজনের জীবনটাই ন*ষ্ট হয়ে যেত। এখনও যে সবার জীবন ভালো আছে সেটা না। কিন্তু আমি এটুকু কথা দিতে পারি তোমার জীবন আমি গুছিয়ে দিয়ে যাব।”
★★★
গ্লোবাল কফিহাউজে একে অপরের মুখোমুখি বসে আছে প্রান্তি ও প্রেয়া। প্রেয়া স্থির ভাবে তাকিয়ে আছে প্রান্তির দিকে। প্রান্তি কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
“তুই ঠিক আছিস তো প্রেয়া? হঠাৎ আমাকে এখানে কেন ডাকলি?”
“আমার ভাগ্য কি আর তোমার মতো ভালো যে আমি ঠিক থাকব!”
“মানে? যা বলবি একটু স্পষ্ট করে বল।”
“এতটা স্বার্থপর হতে পারলে তুমি আপি? নিজের স্বার্থের জন্য বিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলে। তোমার জন্য আজ আমার জীবনটা ন*রক হয়ে উঠছে।”
প্রান্তি বরাবরই স্পষ্টভাষী। ছোট বোন বলে যে প্রেয়ার এই ভিত্তিহীন অভিযোগ মেনে নেবে এমন গোছের মেয়ে সে নয়। তাই তো মুখের উপর স্পষ্ট করেই বলল,
“তুই কোনভাবেই আমাকে ব্লেইম করতে পারিস না প্রেয়া। আমি পালিয়ে গেছি ঠিকই কিন্তু আমি তো তোকে বলিনি আহিলকে বিয়ে করতে। বিয়েটা তুই নিজের মর্জিতেই করেছিস। আর যে বলছিস আমি নিজের স্বার্থে পালিয়ে গেছি তা তুই আমার কোন স্বার্থ দেখলি?”
“কেন? তুষার ভাইকে তো ভালোবাসো তুমি তাইনা? এইজন্যই তো পালিয়ে গিয়ে তার সাথে বিয়ে করেছ।”
“তুই না জেনে কোন কথা বলিস না প্রেয়া। যদিও এই কথাগুলো তোকে বলার আমার কোন ইচ্ছা ছিল না কিন্তু তুই বলতে বাধ্য করলি। শোন আমি পালিয়েছি ঠিকি কিন্তু নিজের স্বার্থে নয় তোর স্বার্থে। আমি সেদিন ছাদে তোর আর তুলির সব কথোপকথন শুনেছিলাম। তুই আহিল ভাইকে ভালোবেসে সু-সাইড করতে গেছিলি শুনে আমার মস্তিষ্ক ফাকা হয়ে যাচ্ছিল। আমি কিছুতেই তোর কোন ক্ষতির দায় নিতে চাইনি তাই পালিয়ে গেছিলাম। তবে এখন মনে হচ্ছে সত্যি আমি ভুল করেছিলাম। তোর ভালো করতে গিয়ে আজ আমি সবার চোখে এমনকি তোর নিজের চোখেও খারাপ হয়ে গেছি। আমার কি করা উচিৎ ছিল বল তো আব্বুকে বলা দরকার ছিল যে তুই আহিল ভাইকে ভালোবেসে কি কাণ্ডটাই না করতে গেছিলি।”
“আপি!”
“চুপ। আর কোন কথা বলিস না তুই। তোকে কে বলেছিল আহিল ভাইকে বিয়ে করতে আমি বলেছিলাম? তুই সম্পূর্ণ নিজের স্বার্থে বিয়েটা করেছিস আর এখন যদি তুই সুখী না হোস সেই দায় তোর। যাইহোক আমি আর কিছু বলব না। ছোটবোন হিসেবে শুধু এটুকুই চাইব যে তুই সুখী হবি। এর থেকে বেশি তোর কোন ফেভার করা আমার পক্ষে আর সম্ভব না। আমি চলি তাহলে।”
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে লাগলো প্রান্তি। প্রেয়া তার যাওয়ার পানেই তাকিয়ে রইল নিগূঢ় দৃষ্টিতে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ❤️