#একতরফা_ভালোবাসা
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃদিশা_মনি
আহিল প্রান্তির দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আজ এই মেয়েটা তাকে চরম ভাবে অপমানিত করেছে। ভাবতেই আহিলের চোখ মুখে রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সাথে সাথেই তুষারের দিকে তাকাতে তার রাগ আরো দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। আহিল তুষারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,
“তুই আমার সাথে খুব খারাপ করলি তুষার। আমার ভালোবাসার মানুষটাকে তুই কেড়ে নিলি তো! এবার দেখ তোর ভালোবাসার মানুষের আমি কি অবস্থা করি।”
এই ভাবনা থেকেই প্রেয়ার হাত ধরে টানতে টানতে তাকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে থাকে আহিল। প্রেয়া মৃদু আর্তনাদ করে। প্রান্তি তাদের পেছনে যেতে নিতেই তুষার তাকে আটকে দেয়। কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“চুপচাপ আমার সাথে ভেতরে চল৷ আজ যা হয়েছে সব কিছুর জন্য তুই দায়ী। তোর জন্য আজ আমাদের সবার জীবন এভাবে এলোমেলো হয়ে গেল।”
প্রান্তির চোখ জলে টলমল করতে লাগল৷ সে তো যা করেছিল নিজের বোনের ভালোর জন্যই করেছিল৷ অথচ সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। প্রান্তি বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই পিয়াল আহমেদ চেচিয়ে তাকে আটকে দিলেন। হুংকার দিয়ে বললেন,
“বেড়িয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। তুমি আমার কাছে মৃত। একদম এই বাড়িতে পা রাখার দুঃসাহস দেখাবে না।”
প্রান্তি এইপর্যায়ে কেঁদেই দিলো৷ তুষার তাকে ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ কর তুই। একদম কাঁদবি না। আমাকে আগে মামার কাছে সবটা ক্লিয়ার করতে দে।”
বলেই তুষার পিয়াল আহমেদ, তাহেরা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,
“আজ প্রান্তি যখন বিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন আমি ওকে দেখে ফেলি। সাথে সাথেই ওর পিছু নেই৷ কিন্তু ও এত চালাক যে সবটা ধরে ফেলে। পড়ে একটা মহল্লার দিকে যায়। সেখানে গিয়ে সিএনজি থেকে নামে। আমিও তখন নেমে পড়ি। প্রান্তির কাছে গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করি এসবের মানে কি। কিন্তু ও আমার কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজের মতো আবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমি ওকে আটকে শাসাতে থাকি। এরমধ্যে হঠাৎ করে আমি হোচট খেয়ে ওর উপর পড়ে যাই। এলাকার কিছু ছেলেপেলে সেখানে এসে জড়ো হয়। তারা আমাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে। সহসাই এলাকায় অনেক মানুষ জড়ো হয়। সবাই কোন কিছু না জেনেই প্রান্তি আর আমাকে জড়িয়েও অনেক খারাপ কথা বলে। কেউ কেউ ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়াতেও শেয়ার করে। আমি বুঝতে পারি যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।”
থেমে…
“এই সময় কিছু লোক পুলিশ ডাকতে চায়। সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যাপারটা ছড়িয়ে যাওয়ায় যে প্রান্তিকে নিয়ে কি পরিমাণ ট্রোল হবে সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। একজন মেয়ের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তার উপর পুলিশের ঝামেলাও জড়িয়ে যাচ্ছিল। তাই সব মিলিয়ে আমি দ্বিধায় পড়ে যায়। সেই মুহুর্তে এই বিপদ থেকে বাচার জন্য আমার সামনে একটাই পথ খোলা ছিল। আমি সবার সামনে বানিয়ে বলি, আমরা দুজন স্বামী স্ত্রী। আমরা পালিয়ে এসে বিয়ে করেছি। কিন্তু কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করে না। কিছু ছেলেপুলে বলে আমরা যে বিবাহিত তার প্রমাণ দিতে। এইজন্য তারা আবার আমাদের বিয়ে দিতে চায়। আমরা আপত্তি করলেও তারা শোনে না। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতেই আমি…..আমি প্রান্তিকে বিয়েটা করে নেই।”
পিয়াল আহমেদ সব কথা মনযোগ দিয়ে শোনেন। অতঃপর ভাবলেশহীন ভাবে বলেন,
“তোমার প্রতি আমার কোন ক্ষোভ নেই তুষার। কিন্তু এই মেয়েকে আমি নিজের মেয়ে বলে আর স্বীকার করি না। যার কারণে আমার বাড়িতে আমি ওকে ঠাই দেব না। এখন তুমি যদি চাও মহানুভতা দেখিয়ে নিজের বাড়িতে ওকে রাখতে পারব কিংবা ওকে ছু’ড়ে ফেলতেও পার। আমার তাতে কিছু যায় আসে না।”
প্রান্তি কাতর কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আব্বু..”
“চুপ। তোর ঐ মুখে আমাকে আব্বু বলবি না। দূর হ এখান থেকে।”
তাহেরা বেগম পিয়াল আহমেদকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন। অবশেষে নিজেই প্রান্তির মাথায় ভরসার হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
“তুই কিছু চিন্তা করিস না প্রান্তি। তুই আমার সাথে আমার বাড়িতে চল৷ যেভাবেই হোক বিয়েটা তো হয়েছেই। তুই এখন আমার ছেলের বউ। তাই তোর দায়িত্ব আমি নিলাম।”
★★★
আহিল প্রেয়াকে নিয়ে নিজের বাড়িতে আসে। বাড়িতে এসে প্রেয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
“তুমি শুনে রাখ, বিয়েটা করলেও আমি তোমাকে স্ত্রীর কোন অধিকার দেব না। তুমি চাইলে এই বাড়িতে থাকতে পার কিংবা চাইলে নিজের বাবার বাড়িতে ফিরে যেতে পারো। সবটাই তোমার ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে। কিন্তু এখানে থাকলে তুমি আমার স্ত্রীর কোন মর্যাদা পাবে না। তোমার কোন দায়িত্ব আমি নেব না। সব মেনে যদি এখানে থাকতে পারো তাহলে থাকো আর নাহলে চলে যেতে পারো।”
প্রেয়া বলে,
“যদি মেনেই না নাও তাহলে আমাকে বিয়ে কেন করলে আহিল ভাই?”
“আমি তোমাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। তাছাড়া তুমি নিজে থেকেই বিয়েটা করতে চেয়েছ। আমি তো তোমাকে জোর করিনি।”
“জোর করোনি ঠিক আছে কিন্তু আপত্তিও তো করো নি। বরঞ্চ বলা যায় তোমার জেদের কারণেই বিয়েটা হয়েছে।”
“আমি কোন কথা শুনতে চাই না। আমি যা বলছি তাই হবে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি সব মেনে নিলাম।”
বলেই প্রেয়া নিজের মতো আহিলের রুমের দিকে যেতে থাকে। আহিল প্রশ্ন করে,
“কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
“তোমার রুমে।”
“না, আমার রুমে না। তুমি গেস্ট রুমে গিয়ে থাক।”
“আচ্ছা।”
বলেই প্রেয়া গেস্টরুমের দিকে রওনা দেয়। গেস্টরুমে গিয়ে সর্বপ্রথম সব গহনাগাটি খুলে ছু’ড়ে ফেলে। অতঃপর বাথরুমে গিয়ে শাওয়ারের নিচে বসে ডুকরে কাঁদতে থাকে। কান্নারত অবস্থায় বলে,
“কেন কেন আমার সাথে এমন হলো? নিজের ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার থেকে তার থেকে পাওয়া অপমান যে আমাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। আমি পারছি না আহিল ভাইয়ের এই ব্যবহার মেনে নিতে। আমার হয়েও সে আমার নয়। আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছে এটা। এই সবের জন্য প্রান্তি আপি দায়ী। ও পালিয়ে যাওয়ার কারণেই এমন হয়েছে। আমি আপিকে কখনো ক্ষমা করবো না কখনো না।”
★★★
তুষারের সাথে সাথেই তার রুমে প্রবেশ করলো প্রান্তি। তুষার প্রান্তির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস নিলো। অতঃপর বলল,
“তুই তো সব জানিস এই বিয়েটা কেন হয়েছে আর কিভাবে হয়েছে। আমার এই বিয়েতে কোন মত ছিল, তোরও ছিল না। আমাদের মধ্যে..”
তুষার কিছু বলার আগেই প্রান্তি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“জানি আমি৷ আমাদের মধ্যে আর চার পাঁচটা দম্পত্তির মতো সম্পর্ক হতে পারে না। এটাই হয়তো স্বাভাবিক। আমি কিছুই মনে করিনি তুষার ভাই। তুমি নিজের জায়গায় একদম ঠিক। একদম চিন্তা করো না, আমি তোমার থেকে কোন প্রত্যাশা রাখব না। তুমি চাইলে এই মিথ্যা সম্পর্কটা শেষও করতে পারি।”
“আমার চাওয়া পাওয়া নিয়ে কেন কথা বলছিস? তুই কি চাস সেটাও বল।”
“সত্যি বলতে আমি কিছুই চাই না।”
“বিয়ে ছেড়ে পালিয়েছিলিস কেন তাহলে তুই? বাই এনি চান্স, তুই কি কাউকে ভালোবাসিস প্রান্তি?”
প্রান্তি স্লান হেসে উত্তর দেয়,
“বাসি তো। কিন্তু তার কাছে হয়তো আমার ভালোবাসার কোন মূল্য নেই।”
বলেই প্রান্তি তুষারদের ওয়াশরুমে চলে যায়। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আর যাই হোক, আমি আত্মসম্মানহীন হতে পারব না। যে আমাকে চায়না তার জীবনে জোর করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেও চাই না। সে যতোই আমি তাকে ভালোবাসি না কেন!”
চলবে ইনশাআল্লাহ ❤️✨