একটা পরীর গল্প পর্ব-০৭

0
2199

#একটা_পরীর_গল্প
#সাদিয়া_আহমেদ_রোজ
#পর্ব_০৭

পরদিন আম্মুকে সব বলতেই উনি ঠোট টিপে হাসতে শুরু করলেন। আরে, আমি কি কোনো কৌতুক বলেছি? আমি জোর করলাম কোনো বুদ্ধি দেওয়ার জন্য। কিন্তু উনি সরাসরি বললেন।

– ” সমস্যা কি? অভীক তো তোকে বউ বলে মানে না। এই তো দেড়মাস পরেই ও ফিরবে। তখন তোর সাথে ওর ডিভোর্স করিয়ে দিয়ে এই হামযার সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দিবো। সব খরচ আমার। এমনিতেও ছেলেটা দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ। তোকে খুব ভালো রাখবে দেখিস। ”

আম্মুর কথা শুনে আমার চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। শাশুড়ি হয়ে কি উপদেশ দিচ্ছেন? অন্য শাশুড়ি হলে নির্ঘাত বলতো ‘ পরপুরুষের সঙ্গে ঢুলাঢুলি করো? এই জন্য তোমার পেছনে টাকা খরচ করে তোমাকে পড়াচ্ছি? আমাদের মান সম্মান নষ্ট করার তালে মেতে উঠেছিস? ‘ আর ইনি কি বলে? ডিভোর্স করিয়ে নাকি বিয়েও দেবে। আমি নির্লিপ্ত চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলাম।আসলেই তো অভীক আমাকে পছন্দ করে না। যদি সামান্যটুকুও করতো তবে কি এই তিন বছরে একটা কল বা ম্যাসেজ দিতো না? একবার আমার সাথে কথা বলতে চাইতো না? আমি মলিন মুখে আম্মুকে প্রশ্ন করলাম,

– ” তাহলে হামযা’কে কি বলবো? ”

– ” বলবি আমি ওকে বাড়ি আসতে বলেছি। আর ও একা কেন? তোর সব বন্ধুদেরও আসতে বলিস। সবার সঙ্গে ঘটা করে পরিচয় হয়ে যাবে।”

– ” আচ্ছা। ”

আমি কলেজে এসে আম্মুর কথা বলতেই ও খুশিতে গদগদ হয়ে যায়। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় মাঠের মাঝখানে। সবার সামনে আমাকে টেনে নিলো নিজের আলিঙ্গনে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।সবকিছু এতো দ্রুততার সঙ্গে হলো যে আমি প্রতিক্রিয়া দিতেই ভুলে গিয়েছি। সবাই হাত উঁচু করে তালি দিচ্ছে। কয়েকজন শীসও দিয়ে ফেলেছে। আমিই শুধু বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি হামযার দিকে। হামযা বললো একমাস পর ওর বাবা ফিরবে সৌদি থেকে তখন ওরা একসাথেই আসবে আমাদের বাড়ি। আমি ওর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বাড়ি চলে আসলাম। দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। এমন পরিস্থিতিতে পরে ভীষন অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। তাছাড়া অভীক যদি ফিরে এসে এসব শোনে তাহলে ও কি ভাববে? আমি কি উত্তর দিবো ওকে? এমনিতেই ও আমাকে পছন্দ করে না তারওপর এই হামযা। বাথরুমে শাওয়ার নিলাম ঘন্টাখানেকের মতো। আব্বুকে বললাম আমায় কিছুদিনের জন্য বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। আমার মন খারাপ লাগছে। আব্বু আমার কথা শুনে, মিষ্টি আর আমাকে একসাথে গ্রামে পাঠিয়ে দিলো। গ্রামের মাটিতে পা রাখতেই একটা সতেজ অনুভূতিতে শিউরে উঠলাম আমি। চারিদিকে বকুলফুলের মোহময় ঘ্রাণ, শীতল স্নিগ্ধ নদীর তীর, সপসপে কাঁদামাটি, হয়তো মুষলধারায় বৃষ্টি হয়েছিলো। মিষ্টিকে নিয়ে বাড়ি ফিরেই লম্বা একটা ঘুম দিলাম।দীপ্তি স্কুলে।

বিকালে সবার সাথে আড্ডায় মেতে উঠি। ফোন বন্ধ করে রেখেছি গতকাল থেকেই। মিষ্টির ফোন দিয়ে কথা বলেছি সবার সাথে। রাস্তার ধার ঘেসে হেটে চলেছি এমন সময় রহমত সাহেব এসে আমার সামনে হাজির। আমি তাকে উপেক্ষা করে সামনের দিকে পা বাড়াতেই উনি আমার হাত ধরে বসলেন। পুরোনো অনুভূতিগুলো আবার ঝেঁকে ধরলো আমাকে। সারা শরীর এই বিশ্রী স্পর্শে ঘিনঘিন করছে। উনি বেশ শক্ত করেই চেপে ধরে আছেন আমার হাতটা। হাতটা মোচড়াতে মোচড়াতে দাঁত বের করে হেসে বললেন।

– ” আমারে রাইখ্যা ওই শহরের পোলারে বিয়া করছো পরী! আমার কম ছিলো কি? আমি কি কম সমত্ত ছিলাম? তোমারে সুখ দিবার পারতাম না? ওই পোলা কি দিসে তোমারে? বিয়া কইরা তো চইল্লায় গেছে! দুইরাত খালি কাটাইতে পারছো। আমি এখনও তোমারে বিয়া করবার চাই, ওরে ছাইড়া আসতে পারলে আইসো। ”

ওনার এমন বচনভঙ্গি আর হাতে ব্যাথার অনুভূতিতে আমার মাথা ঘুরে আসলো।দীপ্তি ততক্ষনে আব্বুকে ডেকে নিয়ে এসেছে। উনি আমার হাত ছাড়তেই আমি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ি। যখন জ্ঞান ফেরে তখন রাত দশটা প্রায়। টানা পাঁচ ঘন্টা অজ্ঞান ছিলাম আমি!ঘর অন্ধকার দেখে আমি আর উঠলাম না। শুধু শুধু সবাইকে এতো রাতে বিরক্ত করে কি লাভ?

মধ্যরাতে ঘুমের মধ্যে টের পেলাম কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। তার ভারি নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে আমার মুখের ওপর। ভয়ে আতংকে বিছানার চাঁদর চেপে ধরি আমি। চোখ খোলার সাহস হচ্ছে না। আমার পা যুগল তার পায়ে ভাজে পড়ে ব্যাথায় ছটফট করছে। সেই সঙ্গে নাকে ভেসে আসছে অভীকের গায়ের মধুর ঝাঝালো ঘ্রাণ। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? অভীক তো ইন্ডিয়াতে। আর এদেশে আসবে দেড়মাস পর। চোখ না খুলেই মনকে বোঝালাম যে আমি অভীককে স্বপ্নে দেখছি। কিন্তু হাত-পা নড়ছে না কেন? অস্বস্তিতে চোখ মেলে তাকাই আমি। অন্ধকারে ঠিক বোঝা না গেলেও কেউ যে আমাকে চেপে ধরে ঘুমাচ্ছে তা সজ্ঞানে টের পেলাম। মস্তিষ্কে ভীষন চাপ অনুভূত হতেই মুখ দিয়ে একপ্রকার গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসলো। সে তার মুখ আমার ঘাড়ের কাছে এনে গলার ভাজে গুজে দিলো। এইমুহূর্তে আমার গলা থেকে একটা শব্দও বের হচ্ছে না।অসার হয়ে আসছে সমস্ত শরীর। ঠিক তখনই অভীকের দরদমাখা কন্ঠ শুনতে পেলাম।

– ” উফ পরী ঘুমাতে দে আমাকে। আমি টায়ার্ড। ”

কন্ঠটি শুনতেই আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। তার মুখ দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো নয়নযুগল।ছটফট করছে ভেতরটা, কাছের মানুষটা এভাবে হুট করে ফিরে আসার আনন্দ বলে বোঝানো সম্ভব নয়, আমি পাশে হাতরে দেখলাম ফোন আছে কিনা। হাতে ফোনের ছোঁয়া লাগতেই বন্ধ ফোনটা চালু করলাম। ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে অভীকের মুখের দিকে তাকাতেই দেখি অভীক রাগি চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আচমকা এমন চাহুনি দেখে হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো।।ভয়ে রীতিমত কাঁপতে শুরু করেছি।অভীক আমাকে কাঁপতে দেখে উঠে গিয়ে লাইট জ্বালায়। এরপর আমার পাশে এসে বসে আমার কপালে হাত রাখে।

– ” জ্বর এসেছে দেখছি। তুই বস আমি ঔষধ আর খাবার নিয়ে আসছি। ”

অভীক খাবার এনে খাইয়ে দিলো আমাকে। আমি নির্নিমেষ চাহুনিতে তাকিয়ে আছি তার পানে। ঔষধ খাইয়ে আমাকে সযত্নে বিছানায় শুইয়ে দিলো অভীক।

– ” কষ্ট হচ্ছে? ”

আমি কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে আছি। চোখ দিয়ে গলগল করে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। অভীক তার হাতের দু আঙ্গুল দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিলো। আমি এই নতুন অভীককে দেখে বিষ্মিত। অভীক তো এমন ছিলো না। আমি যাকে চিনতাম সে তো কথায় কথায় আমাকে অপমান করতো, খোঁটা দিতো।কিন্তু এই অভীক!

– ” কেমন লাগছে বলছিস না কেন? এটা কোন ধরনের বেয়াদবি পরী? কিছু জিজ্ঞেস করেছি তো আমি। ”

আমি অস্ফুট কন্ঠে জবাব দিলাম।
– ” আপনি সত্যিই এসেছেন? ”

– ” না। আমার ভুত এসেছে। আগে তুই ভুত ছিলি একা, অভীক এসে আজ দিলো দেখা। ”

আমি ওনার ছন্দ দেখে ভড়কে গিয়ে ওনার দিকে তাকাই। উনি আমার গাল চেপে ধরলেন একহাতে। অন্যহাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরেছেন। ক্ষিপ্ত সুরে বললেন,

– ” এভাবেই হামযা তোকে ওর প্রণয় প্রস্তাব দিতো তাইনা? কবিতার সুরে, প্রেমের আলাপে? তোর সাহস হলো কিভাবে আমার অনুপস্থিতিতে ওর কাছে যাওয়ার? বল কি করে হলো এই সাহস? ”

– ” আমি। ”

– ” আমার কি দোষ ছিলো পরী? কি দোষ? যার জন্য, যাদের জন্য এতোকিছু করলাম তারাই আমাকে বুঝলো না, আমায় পর করে দিলো। ”

কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠলেন অভীক। আমার গাল থেকে হাত সড়িয়ে নিয়ে, পরক্ষনেই আবার হাত দিয়ে আলতো ছুঁয়ে দিলো। আমি তার স্পর্শে, আবেশে চোখ বুজে নিলাম। উনি লাইট বন্ধ করে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু বরাবরের মতো দূরত্ব রেখে। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম ওনার দিকে। কিন্তু অবশ হয়ে যাওয়া হাত কিছুতেই নড়ছে না।

– ” অভীক। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। ”

আমার কথা তার কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই উনি হুরমুরিয়ে ঘুরে তাকালেন আমার দিকে। হাতে, কপালে, হাত রেখে রেখে দেখছেন আর জিজ্ঞেস করছেন

– ” কোথায় কষ্ট হচ্ছে? বল আমাকে। মাথা ব্যাথা করছে? টিপে দিবো আমি? ”

– ” আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন? আলতো করে। আপনার হৃদয়ের খুব কাছে যেতে চাই আমি। ”

অভীক আমার দিকে এগিয়ে এসে সন্তর্পণে আমার মাথা নিজের বুকের ওপর রাখলেন। ওনার সারা শরীর ঘেমে ভিজে আছে, ওনার বুকে মাথা রাখতেই টের পেলাম ওনার হৃদস্পন্দন, স্পন্দনের গতি স্বাভাবিকের থেকে বেশি। ওনার হাতদুটো আমার পিঠে ঠেকানো থাকায় ওনার কম্পিত হাতের শিহরণ টের পাচ্ছি আমি।

– ” রহমত তোকে কি বলেছে পরী? ”

রহমতের নাম শুনতেই আমি মাথা তুলে ওনার দিকে তাকাই। জানালার ফাঁক দিয়ে যৎসামান্য আলো আসায় অস্পষ্টভাবে কিছুটা দেখা যাচ্ছে। উনি আমার চুলের মাঝে নিজের হাত ঢুকিয়ে বিলি কেটে দিতে লাগলেন।

– ” বল। ”

– ” আমাকে উনি এখনও ওনার বউ বানাতে চান। তাই বলছিলো। ”

– ” খারাপ লাগছে না তো আমার স্পর্শে? ”

আমি চমকে তাকালাম ওনার দিকে। উনি ঠিক কি বলতে বা বোঝাতে চাইলেন বোধগম্য হলো না আমার।উনিও কথা বাড়ালেন না। শুধু বললেন,

– ” হামযাকে মানা করে দিলেই পারতি। শুধু শুধু রাগ করে ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে বসেছিস। এখন ভুগছে কে? ”

– ” ঘুমাবো আমি। ”

– ” তো ঘুমা। আমি কি তোর ঘুমকে ধরে রেখেছি? নাকি কেড়ে নিয়েছি? তুই’ই তো আমার ঘুমের বারোটা বাজাচ্ছিস। হাতির বাচ্চা। ”

আমি ভাবলাম হয়তো ওনার কষ্ট হচ্ছে আমার মাথার ভারে। তাই সড়ে আসতে লাগলাম। কিন্তু উনি হ্যাচকা টানে, আবারও আমাকে জড়িয়ে নিলেন নিজের আলিঙ্গনে।

– ” সড়তে বলেছি আমি? বড্ড বেশি বুঝিস তুই পরী। একদম আমার কথা শুনিস না। ”

আমি ঠোট উল্টিয়ে বললাম।
– ” সব কথাই তো শুনি। সব অপমান, খোঁটাও সহ্য করি। শুধু আপনাকে.. কিন্তু আপনিই তো কখনও আমাকে ভালোইবাসেন নি। শুধু খোঁটা দিয়েই এসেছেন, আমি কালো ভুত, হাতি, ভাঙাচোরা । সবই শুনেছি, তাহলে বলুন আমি আপনার কোন কথাটা শুনিনি ? ”

– ” ওগো পরী, ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমাকে।
কখনও বলার সুযোগ দিয়েছো কি আমাকে?
আড়ালে আবডালে যখন চেয়েছি তোমার পানে,
লুকিয়েছো নিজেকে এক গোলকধাঁধার আবরণে।
শুনেছো কখনও এই হৃদয়ের ধুকধুকানি?
টের পেয়েছো আমার হাড়ে, হাড়ে কাঁপুনি?
তোমার জন্য আমার এই ছটফটানি?
জানতে চেয়েছো? আমার আনন্দ?
যেটা আজও তোমাতে সীমাবদ্ধ
কখনও শুনতে চেয়েছো আমার মনের কথা?
আসতে চেয়েছো আমার হৃদয়ের সংস্পর্শে?
চাওনি, আবার এখন বলছো,
‘ আমি আপনার কোন কথাটা শুনিনি? ‘

ওনার মু্খ থেকে কবিতা আবৃতি শুনে আমি হতভম্ব। উনি আমাকে ভালোবাসেন? এটা যেন নিজের কানকে নিজেই বিশ্বাস করাতে পারছি না। উনি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন? নাকি এখনও স্বপ্ন দেখছি আমি। আমার প্রশ্নের জবাবে উনি যে কবিতায় ছন্দে সেটা আমাকেই ফিরিয়ে দিবেন এটা আমার কল্পনাতীত। উনি আবারও আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলেন।

– ” আমার উত্তর কোথায় পরী? ”

– ” আমি আপনার হতে চাই, শুধু আপনার। একান্তই আপনার। ”

অভীক মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। আবদ্ধ করে নিলেন নিজের ভালোবাসার আবরণে, আজ বাঁধা নেই তাহাতে মিলিত হওয়ার।আজ ‘আমি’ এবং ‘ তুমি ‘ শব্দদুটির মিলনে সৃষ্টি হবে নতুন সম্পর্ক যেখানে সবকিছুই আমাদের, সবখানে থাকবে আমরা।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে