#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী
|১২|
জোনাকি অফিসে এসে বসতেই আঁধারের ডাক পড়লো। গুটিগুটি পায়ে আঁধারের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে জোনাকি। লোকটার দিকে তাকাবে কি করে ও? তেইশ বছরের জীবনে এই প্রথমই যে কাউকে ভালো লেগেছিলো ওর। ভালো লেগেছে বললে বোধহয় ভুল হবে, ভালো লাগার থেকেও বেশি কিছু অনুভব হয় লোকটার প্রতি। অজানা একটা টান অনুভব করে জোনাকি। আচ্ছা আঁধার যখন জানবে জোনাকি অন্য একজনের বাগদত্তা তখন কেমন রিয়্যাকশন দিবে আঁধার? ককংগ্রাচুলেশনস জানাবে? নাকি গোমড়ামুখো লোকটা শুভকামনা জানাতেও কার্পণ্য করবে? ভাবছে জোনাকি। সেই মূহুর্তে ভেতর থেকে রাশভারি কন্ঠে আঁধার বলে,
–“দরজার বাইরে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন মিস জোনাকি? কাজে ডেকেছি আপনাকে, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য না।”
জোনাকির ভাবুক মুখটা মূহুর্তেই রঙ বদলে ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। লোকটা এরকম কেন? নরম ভাবে কথা বললে কি জাত যায়? বিয়েটা হোক একবার তারপর আর এই অফিসে চাকরি করা তো দূরে থাক, লোকটা ছায়া’ও মারাবে না আর। মনে মনে ভেবে নিলো জোনাকি। বড়সড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে জোনাকি। আঁধার দরজার দিকেই তাকানো। জোনাকি ধীর পায়ে হেঁটে টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই আঁধার বসতে বলে। জোনাকি চেয়ার টেনে বসে। আঁধার প্রশ্ন ছুঁড়ে,
–“এতক্ষণ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কি ভাবছিলেন?”
–“উম___কিছু না।”
আঁধার আর ঘাটালো না। কয়েকটা ফাইল জোনাকির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“অফিস ছুটির আগে সবগুলো ফাইল ঠিকঠাক মতো চাই আমার।”
জোনাকি সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়াতেই আঁধার থমথমে গলায় বললো,
–“যেতে বলেছি আমি?”
–“নাহ।”
–“তাহলে চলে যাচ্ছেন কেন? বসুন।”
জোনাকি চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়লো। অযথাই বেশ কিছুক্ষণ জোনাকি’কে বসিয়ে রাখলো। ল্যাপটপে কাজ করলো, আবার মাঝে সাঝে আড়চোখে দেখলো জোনাকি’কে। তারপর বললো,
–“এবার আসতে পারেন আপনি।”
আঁধারের কথা’টা বলতে দেরী হলেও জোনাকির চট করে দাঁড়িয়ে আঁধারের কেবিন ছাড়তে মোটেও দেরী হলো না।
–
অফিসে কিছু ফাইল চেক করছিলো জোনাকি। ঘন্টা খানেক আগেই আঁধার তিনটা ফাইল ধরিয়ে দিয়েছে দেখার জন্য। অগ্যতা বসে বসে সেগুলো দেখতে হচ্ছে ওকে। সেসময়ে কেবিনে আসে নিলয়। জোনাকি ফাইল বন্ধ করে সৌজন্য হেসে বললো,
–“বসুন।”
নিলয় চেয়ার টেনে বসলো। বললো,
–“অনেক দিন পর তোমাকে স্বাভাবিক দেখে ভালো লাগছে।”
প্রত্যুত্তরে এবারেও হাসলো জোনাকি। নিলয় আমতা আমতা করে বললো,
–“তোমার অভিবাবক কে বর্তমানে?”
–“আমার আপুই আর স্বচ্ছ ভাইয়া।”
–“আমাদের স্বচ্ছ স্যার?”
–“জ্বি উনি আমার আপুই’র বর।”
–“আচ্ছা আচ্ছা।”
বেশ কিছুক্ষণ আবার দুজনেই চুপ। জোনাকি ফের ফাইল দেখায় মনোযোগ দেয়। নিলয় বলে,
–“আমি উনাদের সাথে কথা বলতে চাইছিলাম জোনাকি।”
জোনাকি প্রশ্ন চোখে তাকায়। নিলয় ফের বলে,
–“আসলে আমার তোমাকে পছন্দ হয়েছে, তাই বিয়ের____”
পুরো কথা বলতে দিলো না জোনাকি। তার আগেই থামিয়ে দিয়ে নিজের বা হাতের অনামিকা আঙুল দেখিয়ে দিয়ে বললো,
–“এই যে আংটি’টা দেখছেন? এটা আমার বাগদানের আংটি।”
কথাটা শুনেই নিলয়ের মুখ ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। কোনমতে প্রশ্ন করে,
–“কবে হলো?”
–“গত পরশু।”
নিলয় আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায়। কেবিন থেকে বের হতেই আঁধারকে দেখে সালাম দিয়ে দ্রুত নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে পড়ে। আঁধার সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আঁধার একটা ফাইল নিতে এসেছিলো জোনাকির কেবিনে। দরজার বাইরে থেকেই নিলয় আর জোনাকির সব কথা শুনতে পায় সে। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। জাস্ট তিনটে দিন কাজের জন্য ঢাকার বাইরে ছিলো আর এর মাঝেই এই ঘটনা ঘটে গেলো? তৈমুর আটকাতে পারেনি এনগেজমেন্ট’টা? সোজা নিজের কেবিনে চলে যায় আঁধার। সোহেলকে ফোন করে নিজের কেবিনে ডাকে আঁধার। সোহেল আসতেই আঁধার বললো,
–“অফিস ফাঁকা করো ইমিডিয়েটলি, অফিসে শুধুমাত্র আমি আর মিস জোনাকি ছাড়া যেন থার্ড পারসন না থাকে।”
–“স্যার হঠাৎ করে___”
–“আজকে হাফডে করে সবার ছুটি, আর কোনো সমস্যা?”
সোহেল মাথা নাড়িয়ে না জানায়। ঘড়িতে দেখে সাড়ে বারোটা। একটু পরই লাঞ্চ টাইম। সোহেল কেবিন থেকে বেরিয়ে সবাইকে কথাটা জানিয়ে দেয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পুরো অফিস ফাঁকা হয়ে যায়। জোনাকি নিজের ডেস্কে সবকিছু গোছগাছ করে বের হতে গেলেই আঁধার খপ করে জোনাকির হাত ধরে ফেলে। জোনাকি’কে টেনে নিজের কেবিনে নিয়ে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। জোনাকি ভ্রু কুঁচকে ফেলে। আঁধার জোনাকির সামনে দাঁড়িয়ে ওর বা হাতটা টেনে উপরে তুলে অনামিকা আঙুলের আংটি’টা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–“কিসের রিং এটা?”
–“এনগেজমেন্টের।”
আঁধার জোনাকির দুই বাহু চেপে ধরে চিৎকার করে বলে,
–“অন্যের পড়িয়ে দেওয়া রিং নিজের আঙুলে নেওয়ার আগে অন্তত আমাকে একবার বলতে পারতেন। আপনার এনগেজমেন্ট হয়েছে দুই দিন হলো, আর আপনি আমাকে এর মাঝে একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না?”
জোনাকির সহজ স্বীকারোক্তি,
–“নাহ।”
–“কেন?”
–“কে আপনি? আমার এনগেজমেন্ট এর কথা আমি আপনাকে জানাবো কেন?”
ক্ষানিক সময়ের জন্য চুপ হয়ে যায় আঁধার। তারপর জিজ্ঞেস করে,
–“আপনি এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছেন মিস জোনাকি?”
–“হ্যাঁ। খুব শীগ্রই বিয়ের আয়োজন___”
–“তবে শুনে রাখুন, হবে না এই বিয়ে।”
জোনাকি চকিত তাকায় আঁধারের দিকে। আঁধার জোনাকির দুই বাহু চেপে ধরে নিজের অনেকটা নিকটে নিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আমার আপনাকে লাগবে মিস জোনাকি। আমি ব্যাতীত অন্য কোনো পুরুষ আপনার হবে না। আমি ব্যাতীত অন্য কোনো পুরুষের জন্য আপনি কবুল বলবেন না, আপনি শুধু মাত্র আমার জন্য হালাল হবেন, অন্য কোনো পুরুষের জন্য আপনি কেবলই হারাম।”
কথাগুলো বলে হনহনিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে যায় আঁধার৷ জোনাকি সেদিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। লোকটা কি ওকে থ্রেট দিয়ে গেলো? সেটাই ভাবছে জোনাকি। এটা ভেবে খুব খুশি লাগছে যে লোকটা ওকে চায়। আবার পরমূহুর্তেই মুখটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো এটা ভেবে যে ও এখন মিহাদ নামের একজন পুরুষের বাগদত্তা।
–
ড্রয়িংরুমের সবকিছু ভাংচুর করছে আঁধার। বাসার সকলে এক জায়গায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক দিন পর আঁধারকে এভাবে রেগে যেতে দেখছে সকলে। আর এই রাগের কারণ সকলের কাছেই অজানা। এই মূহুর্তে নিশি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি আঁধারকে শান্ত করতে পারবে না। নিশি এগিয়ে গেলো সেদিকে। আঁধারের হাত থেকে ফুলদানি’টা ছাড়িয়ে নিয়ে টি-টেবিলের উপর রাখলো। তারপর প্রশ্ন করলো,
–“কি পাগলামি শুরু করেছিস ভাই? এত রেগে আছিস কেন সেটা তো বলবি আগে।”
আঁধার নিজের রাগ সামলে নিয়ে বললো,
–“জোনাকির এনগেজমেন্ট হয়েছে কথাটা সবাই জানে?”
–“হ্যাঁ সে তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু কেন ভাই?”
–“কবে থেকে জানিস তোরা?”
–“শুরু থেকেই তো সব জা____”
আঁধার রেগে সামনে থাকা টি-টেবিল টা লাথি মেরে উলটে দিয়ে চিৎকার করে বললো,
–“সবাই সবকিছু জানে, তাহলে আমাকে কেন জানানো হয়নি?”
নিশি মৃদু হেসে বললো,
–“আচ্ছা, তাহলে তুই সবার শেষে জেনেছিস বলে রাগ করছিস? আসলে তুই কাজের জন্য বাইরে ছিলি তো তাই আর ভেবেছিলাম তুই কাজ থেকে ফিরলেই গুড নিউজ’টা জানাবো তোকে।”
–“গুড নিউজ মাই ফুট।”
এবারেও হুংকার ছেড়ে কথাটা বললো আঁধার। বাসার সবাই ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আঁধারের দিকে। আমিনা বেগম এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার আর চুপ থাকতে পারলেন না। রাগান্বিত স্বরে বললেন,
–“তোমার সমস্যাটা ঠিক কোন জায়গায় আঁধার দাদুভাই? জোনাকির বিয়ের খবর সবার শেষে শুনেছো এখানে? নাকি অন্য কোনো কারণ?”
–“আমার ওকে লাগবে, অ্যাট অ্যানি কস্ট। কিভাবে ওকে এনে দিবে, বা ওই মিহাদের সঙ্গে কিভাবে ওর এনগেজমেন্ট ভাঙবে দ্যাট’স নান মাই কানসার্ন। আর যদি তোমরা এনগেজমেন্ট ভাঙতে না পারো, তাহলে হলুদের দিন রাতে হলেও ওকে তুলে এনে বিয়ে করবো আমি। সবাই ভালো করে মগজে ঢুকিয়ে রেখো।”
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে নিজের ঘরে গিয়ে শব্দ করে দরজা আটকে দেয়। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সকলে। জল একদম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনে।
চলবে~