#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী
|৯|
প্রচন্ড জ্বরে কাবু জোনাকি। দুদিন হলো অফিস কামাই যাচ্ছে৷ জল আর স্বচ্ছ কালকেই এ বাসা থেকে ঘুরে গিয়েছে। আনিসুজ্জামান’কে নিয়ে হসপিটালে যাওয়ার ডেট আজকে। অথচ জোনাকি বিছানা থেকে উঠতে পারছে না ক্লান্ত শরীর নিয়ে। জ্বর এখন কিছুটা কম থাকলেও শরীর এখনো দূর্বল। জাহানারা বেশ কিছুক্ষণ বসে জোনাকির মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। জ্বর হালকা হয়ে এসেছে অনেকটা। জাহানারা বললো,
–“আজকে তো তোর বাবা’কে নিয়ে হসপিটালে যাওয়ার কথা ছিলো, তুই তো অসুস্থ আজ___”
–“তুমি বাবা’কে নিয়ে যাও। আমার সমস্যা হবে না।”
–“তোকে একা রেখে__”
–“জ্বর নেই তো, তুমি যাও।”
জাহানারা আর দ্বিমত করলো না। আনিসুজ্জামান’কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো হসপিটালের উদ্দেশ্যে। জোনাকি ভালো করে দরজা লক করে আবার বিছানায় গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। ঘন্টা তিনেক বাদে জাহানারা’র নাম্বারে ফোন করে খোঁজ নেয় জোনাকি। বারো নাম্বার সিরিয়ালে আছে, এখন দশ চলছে।
–
তীব্র রিংটোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় জোনাকি’র। মুখের উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একজন লোক বললো,
–“হ্যালো? হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছেন? আপনি কি জোনাকি বলছেন? একজন ভদ্রলোক, এবং মহিলা এক্সিডেন্ট করেছে হসপিটালে নেওয়া হচ্ছে, ফোন’টা উনাদের থেকে পেয়েছি, আপনি কি উনার পরিচিত? কাইন্ডলি উনাদের পরিবারকে খবরটা জানিয়ে দিবেন।”
মূহুর্তেই ঘুম ছুঁটে যায় জোনাকির। শোয়া থেকে উঠে বসে। দু’হাতে চোখ কচলে ভালো করে নাম্বার’টা দেখে৷ আনিসুজ্জামানের নাম্বার। সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করে জোনাকির। ততক্ষণে ফোনের ওপাশের ব্যক্তি হ্যালো হ্যালো করছেন। জোনাকি কাঁপা-কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
–“কোন হসপিটালে নেওয়া হচ্ছে?”
–“আপনি কে হোন উনাদের?”
জোনাকি কান্নারত স্বরে বললো,
–“মেয়ে।”
লোকটা সময় না নিয়ে দ্রুত হসপিটালের নাম বলে ফোন রেখে দেন। জোনাকির অবস্থা পাগলপ্রায়। কি করবে? কাকে বলবে? ভাবতে ভাবতেই কয়েক সেকেন্ড গড়ালো। বিছানার কাছ থেকে উড়নাটা গায়ে জড়িয়ে ফোন আর পার্স নিয়ে ফ্ল্যাট তালা মেরে নিচে নেমে যায় দ্রুত।
আধ ঘন্টার মাঝেই হসপিটালে পৌঁছে বাবার নাম্বারে ফোন দেয় জোনাকি। সেই লোকটা ফোন রিসিভ করে থার্ড ফ্লোরে অটি’র সামনে যেতে বললেন। জোনাকি লিফটের কথা বেমালুম ভুলে সিড়ি বেয়ে দৌড়ে উপরে উঠে। গায়ে তখনো হালকা জ্বর থাকায় কয়েক সিড়ি উঠতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু থেমে থাকে না ও। অটি’র সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একজন মধ্যবয়সী মহিলা এবং পুরুষ এগিয়ে আসে জোনাকির দিকে। মহিলাটা প্রশ্ন করেন,
–“তুমি জোনাকি?”
–“হ্যাঁ হ্যাঁ। আমার, আমার বাবা মা কোথায়? ওরা ঠিক আছে?”
পুরুষ’টি বলেন,
–“তোমার বাবার অপারেশন চলছে, আর___”
–“আর মা? মা কোথায় আমার?”
মহিলা’টা জোনাকি’কে একপাশ থেকে আগলে নিয়ে বলে,
–“শান্ত হও মা, তোমার মা বেঁচে নেই। স্পট ডেথ।”
পুরো দুনিয়া’টা অন্ধকার হয়ে এলো জোনাকির। জাহানারা নেই কথাটা মাথায় আসতেই মা বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। মহিলাটা বুকের সাথে আগলে নিলেন ওকে। প্রশ্ন করলেন,
–“তোমার বাড়িতে আর কেউ নেই মা? তুমি একাই?”
এই মূহুর্তে এসে জোনাকি’র জলের কথা মনে হলো। ফোন বের করে ডায়াল করে জলের নাম্বারে। একবার, দু’বার, তিনবার। জল ফোন তুললো না। এরপর ট্রাই করলো স্বচ্ছ’র নাম্বারে। স্বচ্ছ’র ফোন বন্ধ। জোনাকির এই মূহুর্তে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। আঁধারের কথা মাথায় আসতেই দ্রুত আঁধারের নাম্বারে ডায়াল করে। কয়েকবার রিং হতেই রিসিভ হয় ফোন। জোনাকি কেঁদেই যাচ্ছে। কাঁদার ফলে কথা বলতে পারছে না। আঁধার অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
–“জোনাকি আর ইউ ওকে? জ্বর সেরেছে তোমার? বেশি শরীর খারাপ লাগছে? কাঁদছো কেন?”
–“আমার মা___”
–“আন্টি? কি হয়েছে আন্টির? ঠিক আছে উনি?”
–“আর নেই।”
স্তব্ধ হয়ে যায় আঁধার। জোনাকির থেকে ঠিকানা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় অফিস থেকে। স্বচ্ছ’র ফোন বন্ধ আর জল ফোন তুলছে না দেখে বাসার নাম্বারে ফোন করে জানিয়ে দেয় ও।
–
আনিসুজ্জামান’ও মারা যায়। বাঁচানো যায়নি তাকে। একই সাথে বাবা মা দুজনকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে যায় জোনাকি। অতিরিক্ত কান্নার ফলে মাথা যন্ত্রণা করছে। শরীরে জ্বরটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। হসপিটালের করিডোরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে একধ্যানে তাকিয়ে আছে জোনাকি৷ কিছু মূহুর্ত বাদেই হাজির হলো আঁধার। দৌড়ে জোনাকির সামনে গিয়ে বসলো। জোনাকির দুই গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
–“আংকেলের কি অবস্থা জোনাকি? উনি ঠিক আছে? আর আন্টি___”
–“আমি অনাথ হয়ে গেলাম স্যার। একই সঙ্গে বাবা মা দুজনেই আমাকে চিরতরে একা করে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলো।”
কথাটা বলেই ডুকরে কেঁদে উঠে জোনাকি। আঁধারের বুক ভারী হয়ে আসলো। বাবা মা না থাকার যন্ত্রণা আঁধার খুব ভালো করেই জানে। কাঁদতে কাঁদতে আঁধারের বুকে ঢলে পড়ে জ্ঞান হারায় জোনাকি।
মৃতদেহ বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। হসপিটালের সব ফর্মালিটি আঁধার নিজেই ফিল আপ করেছে। পাড়া প্রতিবেশী, আত্নীয় স্বজনে জোনাকিদের ছোট্ট বাসা’টা গিজগিজ করছে। জোনাকির সকল আত্নীয় স্বজন ঢাকাতেই থাকে। তাই আর আনিসুজ্জামান এবং জাহানারার মৃতদেহ গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়নি। কান্নাকাটির রোল পড়েছে। জোনাকির চাচা ফুপু, মামা খালারা প্রলাপ করে কাঁদছে।
জলের পাগলামি বাড়ছে। ওকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। বারবার মৃতদেহ ধরে কাঁদতে যায়। নিশি আর রাজিয়া ধরে রেখেছে ওকে। রাজিয়া বুকের সাথে আগলে রেখে বোঝানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এ সময়ে কি কোনো বোঝ আসে? যার বাবা-মা না থাকে সে-ই তো বোঝে বাবা মা না থাকার কি কষ্ট।
দাফন করার জন্য মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে এলো। যাওয়ার আগে জল আর জোনাকির কান্নায় কেঁদেছে সেখানকার প্রতিটি মানুষ। দুই বোন যেন বাবা-মাকে কিছুতেই যেতে দিবে না। ওভাবেই রেখে দিবে নিজের কাছে। চাইলেই কি আর তাদের রাখা যায়? নিয়মানুসারে আল্লাহ তা’আলার ডাকে সাড়া দিয়েছেন দুজন। তাদের ধরে রাখার সাধ্যি যে আর কারো নাই। আনিসুজ্জামান এবং জাহানারার লাশ নিয়ে যায় দাফন করার জন্য।
জলকে সামলাচ্ছে রাজিয়া আর নাহার। ওদিকে জোনাকি বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে। শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। মুখটা ফ্যাঁকাসে হয়ে একটুখানি হয়ে আছে। জোনাকির পাশে রিমু আর মিতু আছে।
–
জোনাকির বাবা মায়ের মৃত্যুর আজ চারদিন। তিনদিনের দিনই মিলাদ পড়িয়ে গরীব অসহায়দের খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। মাদ্রাসা এতিমখানায়ও খাবার পাঠানো হয়েছে। জোনাকি ওর বাবা-মায়ের ঘরে বসে তাদের ছবি বুকে জড়িয়ে কাঁদছে৷ বাবা মাকে ভীষণ মিস করছে ও। জল এসে পাশে বসলো। ও এখন নিজেকে সামলে নিয়েছে ক্ষানিকটা। জোনাকির জন্য’ই। জল যদি এখন জোনাকির সামনে কান্নাকাটি করে তাহলে জোনাকি’কে কে সামলাবে? জোনাকির যে এই দুনিয়াতে এখন ও ছাড়া আর কেউ নেই। এই চিন্তা করেই নিজেকে শক্ত করেছে জল। তবুও আড়ালে আবডালে ঠিকই কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে বাবা মায়ের জন্য। জোনাকি ছবি’টা বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জল কাঁধে হাত রেখে বললো,
–“কাঁদিস না জোনাকি। কত বোঝাবো বল? এভাবে কাঁদলে যে বাবা মা’ও কষ্ট পাবে৷ ওরা তো আমাদের সবসময় হাসিখুশি দেখতে চেয়েছে এখন আমরা যদি কেঁদে বুক ভাসাই তাহলে ওরা শান্তি পাবে? হয়তো শারীরিক ভাবে আমাদের কাছে নেই কিন্তু আত্নীক ভাবে তো আমাদের কাছেই আছে বল? মিশে আছে তো আমাদের আত্নার সাথে৷”
–“আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আপুই, আমাকে একা করে কেন চলে গেলো বাবা মা? আমাকেও তো সাথে নিতে পারতো বল? আমি কিভাবে থাকবো ওদের ছাড়া?”
জল বোন’কে বুকে জাপ্টে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। নিশি আর রাজিয়া ঘরে আসে সে সময়ে দুই বোনকে কাঁদতে দেখে কাছে এগিয়ে যায় ওরা। রাজিয়া জল’কে কঠোর স্বরে বলে,
–“তোমাকে না বলেছি একদম কাঁদবে না? তুমি কাঁদলে জোনাকি’কে কে সামলাবে?”
শ্বাশুড়ির মৃদু ধমকে জল কান্না থামায়। রাজিয়া জোনাকির পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
–“কেঁদো না, আল্লাহ’র কাছে দোয়া করো যাতে উনারা জান্নাতবাসী হয়। আর তুমি একা কে বলেছে? জল, তোমার বড় বোন আছে না? আমরা সবাই আছি না? আমরা সবাই তো তোমার কাছেরই। নিজেকে একদম একা ভাববে না।”
জোনাকি তখনো ফুঁপাচ্ছে। নিশি জোনাকির মাথায় হাত রেখে বললো,
–“এখন রেডি হও তো, আজ থেকে তুমি আমাদের সাথে স্বপ্ন-নীড়েই থাকবে৷”
–“আমি এ বাসাতেই থাকবো। এখানে আমার বাবা মায়ের অজস্র স্মৃতি আছে। সেগুলো ছেড়ে যেতে পারবো না আমি।”
–“তুই একা থাকতে পারবি না জোনাকি। তুই আমার সাথেই থাকবি। তোকে একা রাখবো না আমি।”
–“প্লিজ আপুই, আমি যাবো না। বাবা মায়ের এই শেষ স্মৃতি চিহ্নটুকু আগলেই বাঁচতে চাই আমি। এইটুকু থেকে দূরে সরাস না আমাকে।”
–“বাসা’টা তোমাদেরই থাকবে। যখন ইচ্ছে হবে এসে দুই বোন ঘুরে যাবে সমস্যা নেই তো।”
রাজিয়ার কথায় নিশি আর জল সম্মতি জানায়। স্বচ্ছ ঘরে প্রবেশ করে তখন। জোনাকি’কে এখনো ওভাবে বসে থাকতে দেখে বললো,
–“কি ব্যাপার এখনো রেডি হওনি?”
জোনাকি স্বচ্ছকে বললো,
–“ভাইয়া সবাইকে বোঝান না, আমি যাবো না। আমি আমাদের বাড়িতেই থাকবো, আমার কোনো সমস্যা হবে না।”
–“সে কি কথা জোনাকি? তুমি ভাবলে কি করে তোমাকে একা ফেলে আমরা চলে যাবো? জলদি রেড হও, কয়েকদিন পর আবার আমরা সবাই মিলে এসে এই বাড়ি থেকে ঘুরে যাবো।”
সবার এত এত অনুরোধ আর ফেলতে পারে না জোনাকি। জল জোনাকি দুইজনে মিলে জোনাকির সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করে নেয়। তারপর সবাই একসাথে বেরিয়ে পড়ে স্বপ্ননীড়ের উদ্দেশ্যে।
চলবে~