একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-০১

0
237

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|সূচনা পর্ব|

–“জোনাকি, এই জোনাকি উঠ না বোন, অনেক বেলা হয়ে যাচ্ছে তো।”

–“উঁহু, আর একটু ঘুমাতে দে আপুই।”

কথাটা বলেই পাশ ফিরে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো জোনাকি। জল, জোনাকির গায়ে থেকে কাঁথা টেনে সরিয়ে দিয়ে বললো,
–“এই আজ না তোর চাকরির ইন্টারভিউ আছে? কখন যাবি তুই? ইন্টারভিউ শেষ হলে?”

ইন্টারভিউ’র কথা শুনে জোনাকি লাফিয়ে উঠলো শোয়া থেকে। পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো ফ্রেশ হতে। জল সেদিকে ক্ষানিক সময় তাকিয়ে থেকে বিছানা গোছাতে শুরু করলো। মিনিট দশেক বাদেই জোনাকি দরজা হালকা খুলে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
–“আপুই আমার চুড়িদারটা দে না, আনতে ভুলে গেছি।”

জল তপ্ত শ্বাস ফেলে ওয়ারড্রব থেকে একটা হালকা গোলাপি রঙের চুড়িদার এগিয়ে দিলো জোনাকির দিকে। জোনাকি জামা নিয়ে আবারো শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলো। জল রুম থেকে বেড়িয়ে দেখলো ওর মা টেবিলে খাবার দিয়ে দিয়েছেন। জোনাকি ছুঁটে এলো বাইরে, দ্রুত কন্ঠে বললো,
–“মা, আপুই আসছি দোয়া করো এবার যাতে চাকরিটা পেয়ে যাই।”

–“আরে কিছু তো খেয়ে যা।”

–“এখন খাওয়ার সময় নেই মা, আমি সময় করে খেয়ে নিবো চিন্তা করো না তোমরা।”

কথাটা বলেই একপ্রকার দৌড়ে বেরিয়ে গেলো জোনাকি। রাস্তায় এসে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। একটা খালি রিকশাও পাচ্ছে না৷ মেজাজ খারাপ হচ্ছে জোনাকির। আজকে একে তো লেট হয়ে গেছে তার উপর রিকশা পাচ্ছে না। আর একটু লেট হলে এবারের চাকরিটাও হাত ফসকে বেরিয়ে যাবে। হঠাৎ করেই এত জোরে একটা গাড়ি গেলো সামনে দিয়ে একটুর জন্য রাস্তার ধারে জমে থাকা বৃষ্টির কাদা পানিগুলো ছিঁটে এসে জোনাকির জামা পুরোপুরি নষ্ট হলো না। ঠিক সময়ে সরে দাঁড়িয়েছিলো, তবে শেষ রক্ষা হয়নি। কিছুটা পানি এসে জোনাকির জামার নিচের অংশে লাগে। জোনাকি মেজাজ হারিয়ে গাড়ির ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“এই যে মিস্টার কানা নাকি আপনি? দেখেশুনে গাড়ি চালাতে পারেন না?”

জোনাকির কথা শুনে গাড়ি ব্রেক কষলো আঁধার। গাড়িটা পিছিয়ে এনে জোনাকির সামনে থামালো। তারপর গাড়ি থেকে নেমে জোনাকির সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
–“হোয়াট ননসেন্স? কি বললেন একটু আগে? কানা? আর আমি?”

–“তো নয়তো কি? কানা বলবো না তো কি বলবো আপনাকে? এভাবে অন্ধের মতো গাড়ি চালালে রাস্তাঘাটে কানা উপাধি তো নিশ্চয়ই পাবেন।”

আঁধার রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“হোয়াট রাবিশ? আপনার কি আমাকে দেখে অন্ধ মনে হচ্ছে?”

জোনাকি এক নজর চোখ বুলালো আঁধারের দিকে। তারপর বললো,
–“এরকম কালো সানগ্লাস চোখে পড়ে গাড়ি চালালে আর চোখে দেখবেন কি করে যে রাস্তার ধারে কাদা পানি ছিলো।”

–“ইউ___”

জোনাকি একটা খালি রিকশা পেয়ে দ্রুত সেটাতে উঠে পড়লো৷ এদিকে আঁধারকে এভাবে ইগনোর করে চলে যাওয়াতে শক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো জোনাকির যাওয়ার দিকে। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। এই অব্দি কেউ আঁধারের সাথে এভাবে কথা বলার সাহস করেনি। আর এই অচেনা মেয়েটা আঁধারকে এতগুলো কথা শুনিয়ে গেলো?

রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিলো জোনাকি। ও এখন পাঁচ তালা বিশিষ্ট একটা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এটাই হচ্ছে এ. আর. গ্রুপের বিল্ডিং। নিচের তিনটে তালা এ. আর. গ্রুপের হোটেল, চার তালায় অফিস এবং পাঁচ তালা এবং ছাদে বিশাল বড় রেস্তোরাঁ। দুদিন আগে এ. আর. এর পিএর পোস্টের জন্যই এপ্লাই করেছিলো জোনাকি। আর আজই ইন্টারভিউ’র জন্য ডেকে পাঠিয়েছে। এই চাকরিটা জোনাকির ভীষণ দরকার। ওর বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। বর্তমানে তিনি অসুস্থ হয়ে কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন। যদিওবা পেনশনের টাকা পাচ্ছেন, কিন্তু সেগুলো দিয়ে আর কতদিন? তাই জোনাকির ইচ্ছে ও নিজে কিছু করবে পরিবারের জন্য। এসব ভাবতে ভাবতেই ভিতরে ঢুকছিলো জোনাকি। এমন সময় কারো শক্তপোক্ত বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে ক্ষানিকটা পিছিয়ে যায় জোনাকি। যেহেতু জোনাকি অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছিলো তাই ও দ্রুত কন্ঠ বললো,
–“স্যরি স্যরি, আমি আসলে__”

কথাগুলো বলে সামনে তাকিয়ে আঁধারকে দেখতে পেয়ে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো জোনাকি। জোনাকি’কে আবারো দেখেই আঁধারের রাগ তড়তড় করে বেড়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“ব্লাইন্ড পিপলস।”

জোনাকি ভ্রু কুঁচকে ফেললো৷ ওর কথাটাই লোকটা ওকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। ও তো তাও নিজের ভুল বুঝতে পেরে স্যরি বলেছে কিন্তু লোকটা কি করলো? এই ভেবে জোনাকি তেড়ে যেতেই আঁধার হনহনিয়ে চলে গেলো ওখান থেকে। জোনাকি রিসিপশনের মেয়েটির থেকে জেনে নিলো অফিস ফোর্থ ফ্লোরে। তাই ও লিফটের দিকে এগিয়ে গেলো। আঁধারও সেসময়ে লিফটেই ছিলো। জোনাকি সেদিকে যেতে দেখে লিফটের বাটন চেপে দিলো। জোনাকি দৌড়ে গিয়েও লিফটে উঠতে পারলো না। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। ইন্টারভিউ টাইম শুরু হতে আর পাঁচ মিনিট বাকী। জোনাকি এখন লিফটের জন্য অপেক্ষা করলে আর ইন্টারভিউ দিতে হবে না। তাই সিড়ি বেয়েই দৌড়ে দৌড়ে চার তালায় উঠতে লাগলো।

–“মে আই কাম ইন স্যার।”

–“কাম ইন।”

জোনাকি নিজের সার্টিফিকেট দেখতে দেখতে কেবিনে প্রবেশ করলো৷ এমডির চেয়ারে আঁধারকে দেখতে পেয়ে বেশ অবাক হলো জোনাকি। ক্ষানিকটা চেঁচিয়ে বললো,
–“আপনি?”

আঁধার একটা ফাইল চেইক করছিলো। চোখ তুলে তাকিয়ে জোনাকি’কে দেখে রাগ হলো। আজকের দিনটাই খারাপ। ঘুরেফিরে এই মেয়েটার সাথে ওর দেখা হচ্ছে আর ঝগড়া হচ্ছে। আঁধার দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“ইয়েস আই এম আঁধার রেজওয়ান। ওনার অফ এ. আর. গ্রুপ।”

জোনাকি আর কিছু বললো না। আঁধার আবারো ফাইল দেখায় মনোযোগ দিলো। নিচ দিকে তাকিয়েই জোনাকির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। জোনাকি কাঁপা কাঁপা হাতে ওর সার্টিফিকেটগুলো দিয়ে দিলো আঁধারের কাছে। আঁধার বেশ ভালো করেই দেখলো সার্টিফিকেট গুলো। তারপর বললো,
–“তো মিস জোনাকি, এই চাকরিটা কেন চাই আপনার?”

আঁধারের এমন প্রশ্নে মেজাজ খারাপ হলো জোনাকির। তেজী স্বরে বললো,
–“চাকরি দিয়ে মানুষ কি করে?”

এরকম বাঁকা উত্তর শুনে সার্টিফিকেট থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো আঁধার। দাঁড়িয়ে টেবিলে একটা থাবা মেরে বললো,
–“কুয়েশ্চন করেছি আন্সার দিবেন, পালটা কুয়েশ্চন করতে বলিনি।”

আঁধার এমন রিয়্যাক্ট করায় জোনাকি ভয় পেয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায়। আঁধার সার্টিফিকেট জোনাকির দিয়ে এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“এই পোস্ট আপনার জন্য না, আপনি আসতে পারেন।”

মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো জোনাকির। একে তো ইন্টারভিউ’র জন্য ডেকে ইন্টারভিউ নিচ্ছে না, উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করছে, রাগ দেখাচ্ছে তার উপর আবার বলছে এই পোস্ট আপনার জন্য না। আজকের দিনটাই খারাপ জোনাকির। কোন অলক্ষুণে যে এই আঁধার রেজওয়ান এর সাথে সকাল সকাল দেখা হলো ভেবে পায় না ও। বদ, রাগী রাক্ষস একটা লোক। মনে মনে আরো অনেক কিছু বলেই বকাঝকা করলো আঁধারকে। তারপর আঁধারের হাত থেকে নিজের সার্টিফিকেটগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে বললো,
–“আপনার মতো বদ লোকের অফিসে আমিও চাকরি করবো না, হুহ।”

কথাটা বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো জোনাকি। আঁধার জোনাকির যাওয়ার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“এই মেয়ের সাহস হলো কি করে আমাকে বদ লোক বলার? একে তো সায়েস্তা করতেই হবে।”

কথাগুলো বিড়বিড় করে বলে কাউকে ফোন লাগালো। ফোন রিসিভ হতেই আঁধার বললো,
–“হ্যাঁ সোহেল? একটু আগে আমার কেবিন থেকে যে মেয়েটা বেরিয়ে গেলো ওকে এক্ষুনি আমার কেবিনে পাঠাও।”

–“স্যার মিস জোনাকি তো লিফটে উঠে গেছেন।”

–“নিচে রিসিপশনে ফোন করে জানিয়ে দাও।”

–“ওকে স্যার।”

খট করে লাইন কেটে দিলো আঁধার। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ভাবতে লাগলো জোনাকির সাহসের কথা।

লিফট থেকে বেরিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছে জোনাকি। এই চাকরিটাও হলো না। খুব শীঘ্রই একটা চাকরি জোগার করতে হবে। পরিবারের হাল ধরতে হবে তো। বাবার পেনশনের টাকায় তো আর বেশিদিন যাবেও না। অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রিসিপশন থেকে একটা মেয়ে এসে বললো,
–“আপনি জোনাকি?”

–“হ্যাঁ, কেন?”

–“স্যার আপনাকে ইমিডিয়েটলি উনার কেবিনে ডেকেছেন।”

জোনাকি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। অস্ফুটস্বরে বললো,
–“স্যার আমায় ডেকেছেন___”

–“হ্যাঁ, আঁধার স্যার এক্ষুনি ডেকেছেন আপনাকে। উনি কিন্তু আবার লেট করা একদমই পছন্দ করেন না।”

কথাটা বলেই মেয়েটা চলে গেলো৷ জোনাকি ভাবলো যাবে না আর। পরমূহুর্তেই আবার ভাবলো যদি চাকরিটা দেওয়ার জন্য ডাকে? ওর তো চাকরিটা দরকার। এই ভেবে জোনাকি আবারো আঁধারের কেবিনের যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

–“তো মিস জোনাকি চাকরিটা চাই আপনার?”

আঁধারের কথায় জোনাকি বিরক্তি চোখে তাকালো আঁধারের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“এটা জিজ্ঞেস করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন? চাকরিটা চাই বলেই ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। সামান্য এইটুকু কমনসেন্স নেই আপনার? আর এত বড় অফিস সামলাচ্ছেন, ভাবার বিষয়।”

–“হোয়াট ননসেন্স।”

–“কেন ডেকেছেন সরাসরি বলেন, নয়তো আমি চললাম, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার কাছে নেই।”

–“চাকরিটা হবে, তবে কিছু কান্ডিশন আছে আমার।”

জোনাকি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কি?”

–“লেইটে অফিসে ঢোকা যাবে না, ঠিক সাড়ে নয়টা’র মধ্যে অফিস থাকা লাগবে, কাজে হেরফের চলবে না____”

এরকম আরো শর্ত জুড়ে দিলো আঁধার৷ জোনাকি বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
–“আমি রাজি।”

আঁধার একটা পেপার এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“সাইন করুন এখানে।”

জোনাকি কিছু না ভেবেই সাইন করে দিলো। আঁধার পেপারটা নিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
–“সো মিস জোনাকি, ইউ উইল জয়েন দ্যা অফিস ফ্রম টুমরো। ইউ ক্যান গো নাউ।”

জোনাকি সম্মতি জানিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। আজ ও ভীষণ খুশি, ফাইনালি একটা চাকরি যোগার করতে পেরেছে৷ এবার সব ভালো হবে। মনে মনে এসব ভেবে প্রশান্তির হাসি হাসলো জোনাকি।

অন্যদিকে আঁধার জোনাকির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
–“আঁধার রেজওয়ান এর মুখে মুখে কথা বলা? আঁধার রেজওয়ান’কে অন্ধ বলা, আঁধার রেজওয়ান এর সাথে উঁচু গলায় কথা বলার ফল আপনি কাল থেকে হারে হারে টের পাবেন মিস জোনাকি। বি রেডি।”

চলবে~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে