#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৭
মে মাস। কাঠফাটা রোদ্দুরে সবকিছু পুড়ে যায়। ফ্যান ছাড়া এক মুহূর্তও টেকা দায়! অথচ বাসায় এখন বিদ্যুৎ নেই। বিনা নোটিশে সে লাপাত্তা। সেই কোন কাক ডাকা ভোরে চারুর ঘুম ভেঙেছিল, চোখ মেলে দেখে সিলিংয়ে চুপটি মেরে আছে ফ্যানটা। সারা শরীর ঘামে ভিজে চিপচিপে! কি অবস্থা!
আজকাল বিদ্যুত না থাকলে কি চলা যায়? একঘণ্টার জন্য হলেও একটা কথা ছিল, কোনোমতে ম্যানেজ করে নেয়া যেত। কিন্তু এ তো সারাদিনের ব্যাপার! বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষেরই মেজাজ এখন চড়া। একেকজন একেকটা কাজ করছেন আর বারেবারে গাল দিচ্ছেন বিদ্যুত অফিসের লোকদের। চারু বিরস মুখে সোফায় বসে। ওড়নার প্রান্ত নাচিয়ে বাতাস করতে ব্যস্ত নিজেকে। এমন সময় দরজায় ‘ঠকঠক’ শব্দ হলো।
একঝলক আশেপাশে চেয়ে নিলো চারু। এই গনগনে গরমওয়ালা ভর দুপুরে বাড়ির সক্কলে এখন ভাতঘুমে মগ্ন। দরজার ঠকঠকানি কি কারো কানে যাবে? ওকেই উঠতে হবে ভেবে এগোলো দরজা খুলতে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার অথচ আগন্তুকের যেন ধৈর্যের বড্ডো অভাব! নয় তো কাজের ভীষণ তাড়া! যেভাবে আওয়াজ করছে!
— “তুই?”
দরজা খুলতেই ছোট বোনের মুখখানি দেখে বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো চারু। অনুর কি হলো কে জানে! কিছু না ভেবেই হঠাৎ জাপটে ধরলো ওকে। বহুদিন পর কোনো প্রিয় মানুষকে দেখে আমরা যেমন আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠি, উচ্ছ্বাসে জড়িয়ে ধরি একে-অপরকে; ঠিক তেমনি করে! চারু খুব অবাক হলো। অনু নিজেও! আচমকা এমনটা করবে সে হয় তো নিজেও ভাবে নি।
সম্বিৎ ফিরতেই ওকে চট করে ছেড়ে দিলো। খানিক তফাতে দাড়িয়ে অপ্রস্তুত কণ্ঠে শুধালো,
— “কেমন আছিস?”
— “আমি ভালো। তুই?”
চারু মিষ্টি হেসে জানতে চাইলো।
— “এইতো—”
লাগেজ নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল অনু। দরজা আটকাতে গিয়ে চারুর প্রশ্ন,
— “একা যে? মাহাদ কই?”
— “আসে নি।”
— “সে-কি! কেন রে?”
বোনের সরল কথায় হুট করেই বিরক্ত লাগতে শুরু করলো অনুর। ত্যক্ত গলায় বললো,
— “কেন? আমি একা আসতে পারি না? তোর কোনো আপত্তি আছে? থাকলে বল?”
আকস্মিক এমন হওয়ায় চারু ভড়কালো। মাত্রই তো ভালো ছিল মেয়েটা, আবার রাগ করছে কেন? আশ্চর্য! ওর কি কোনদিন পরিবর্তন হবে না?
একদম হুট করেই বাপের বাড়িতে আসা হলো অনুর। ও যে আসবে আগে থেকে কেউ জানতো না। একটা কলও করে নি। মন চেয়েছে, চলে এসেছে। বোধ হয় মাহাদকেও জানায় নি। মেয়ের কাণ্ড দেখে বাড়ির সবাই যেমন খুশি তেমন দুশ্চিন্তাতেও পড়লেন। এমন করে কেউ? পথে কিছু একটা হয়ে গেলে?
আজমীর রাজা কড়া সুরেই ধমকালেন ওকে। আহাদ রাজাও নাতনির আচরণেও সন্তুষ্ট নন বোঝা গেল। অনু অবশ্য সেসব রাগের ধারে-কাছেও গেল না। সে তার মতো রইলো। মা-চাচিদের আদর আপ্যায়ন সাদরে গ্রহণ করলো। রিংকু – টিংকুর সঙ্গে ঝগড়া করলো। এবং খুব সুন্দর করে চারুকে এড়িয়ে গেল। সবসময়ই অবশ্য সে চারুকে এড়িয়ে চলে, তবে ক্ষেত্র বিশেষে সামনে পড়ে গেলে খোঁচা মারতে ভোলে না। এবার তা হলো না। বড় বোনের প্রতি মনে তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করলেও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটালো না!
অনুর পাঁচ মাসে পড়েছে। গর্ভধারণের লক্ষণ শরীরে স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। ওর দিকে তাকালে প্রথমেই নজরে আসে স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু উদর। সেই ফোলা পেটটা স্বগর্বে জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্বের কথা। বলছে,
‘দেখো আমার ভেতরে কি আছে! একটি ছোট্ট ভ্রূণ, একটি ছোট্ট প্রাণকে আমি সযত্নে আগলে রাখছি আমার ভেতরে!’
নিজে কখনো মা হতে পারবে না চারু। এই নির্মম সত্যতা মানতে কষ্ট হলেও মেনে নিয়েছে সে। এমতাবস্থায় ছোট বোনের মাতৃত্বের সংবাদ শুনে তার ভেতরে কোনো খারাপ লাগা কাজ করে নি। বরং খুশি হয়েছে। সে নিজে যা পারবে না, অপারগ-অক্ষম, অন্য কেউ সেটা পারলে হিংসে করাটা ওর ধাঁতে নেই। এ যে ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। তবে হ্যাঁ, অনু যখন তার ফোলা পেটটা নিয়ে হেঁটে বেড়ায় সারা বাড়িময়, ঘুরে-ফিরে ওর চোখের সামনে আসে তখন কেমন অদ্ভুৎ বিষাদের অনুভূতি জাগে ওর। কোনো দ্বেষ নেই, কোনো ঈর্ষা নেই। দুঃখী চারুর প্রবল দুঃখে ব্যথিত মনে শুধু একটা অব্যক্ত হাহাকার ভেসে বেড়ায়। না চাইতেও মাঝেমাঝে মনে হয়,
কেন এমন হলো? সৃষ্টিকর্তা কেন তাকে পূর্ণতা দিলেন না?
___
আনিকার জব পার্মানেন্ট হয়ে গেছে। ট্রেনিংয়ের জন্য এতদিন ধরে হেড অফিসেই ছিল তার ডেস্ক। আজ সকালে এমডি স্যার তাকে কেবিনে ডেকে পাঠালেন। ট্রান্সফার নোটিশটা হাতে দিয়ে জানালেন, তার বদলি হয়ে যাচ্ছে। সিলেটের মৌলবীবাজার জেলায়। লেটার হাতে নিয়ে আনিকা হতভম্ব!
অতো দূরে সে যাবে কি করে?
আনিকার বাড়ি ঢাকার কাছেই এক ছোট্ট মফস্বল শহরে। জন্ম-বেড়ে ওঠা — সবই সেখানে। কলেজ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ঢাকায় আসে। তারপর এই চাকরি। যদিও ওর পরিবার সায় দিচ্ছিল না তাতে। মেয়ে মানুষের চাকরী করবার দরকার কি? বিয়ে দিলেই তো সব শেষ। সংসার সামলাতে হবে না?
তবুও একপ্রকার জেদ করেই আনিকা এই চাকরিটা নিয়েছে। এতো কষ্ট করে করা লেখাপড়া, ডিগ্রি অর্জন — তার কি কোনো দাম থাকবে না? তাছাড়া স্বাবলম্বী হওয়া তো খারাপ না। ছেলে হোক বা মেয়ে স্বাবলম্বী সকলেরই হওয়া উচিৎ। ইত্যাদি ইত্যাদি বুঝিয়ে সে পরিবারকে রাজি করিয়েছে। কিন্তু এখন চাকরির জন্য যদি সুদূর পূর্ববঙ্গের মৌলভীবাজারে যেতে হয় তবে কি করে মানাবে তাদের? ওর আব্বা তো সাফ মানা করে দেবেন। বেশি কিছু বললে হয় তো ঘাড় ধরে বিয়ের পিরিতেও বসাতে দেরি করবেন না!
চিন্তিত মুখে ক্যান্টিনে বসে এসবই ভাবছিল মেয়েটা। হাতে ধরা কাপটায় কোন আমলে চা ঠাণ্ডায় পানি হয়ে গেছে ওর হুশ নেই। চটকা ভাঙলো সৌভিকের কথায়,
— “আপনি রোজ এই টেবিলটা দখল করেন কেন? আমার পছন্দের বসবার জায়গা — এটা ছাড়া অন্য কোথাও বসতে কি হয়?”
অভিযোগ নয়, নেহাৎ ঠাট্টা। আনিকা সেসব বুঝলো না। কাপ হাতে তড়িঘড়ি করে উঠতে নিলো,
— “স্যরি, স্যার। আপনি এই জায়গা পছন্দ আমি জানতাম না। আসলে—”
হড়বড় করে আরও কিছু বলবে, ওকে থামিয়ে দিলো সৌভিক। অপর পাশের চেয়ার টেনে বসলো দ্রুত। ওকেও ইশারা করলো বসতে,
— “বসুন। সবসময় এমন অদ্ভুৎ আচরণ করেন কেন আপনি?”
ধপ করে বসে পড়লো আনিকা। সিনিয়রের দিকে চেয়ে মিনমিন করে বললো,
— “কি করেছি আমি, স্যার?”
সেই সুর এতটাই নিম্নগামী যে সৌভিকের কান পর্যন্ত পৌঁছলো না। সে নিজের মতো বললো,
— “আমার দেখা সবচেয়ে অদ্ভুৎ মেয়ে আপনি। প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি খুব খামখেয়ালী, উদাস, উড়নচণ্ডী। ব্যাপারটা একদমই তেমন নয় বটে, কিন্তু খুব ব্যতিক্রমও নেই। আপনার কাণ্ড কীর্তি দেখে আমি অবাক হতে বাধ্য! এমন কেন আপনি?”
আনিকার মন ভার হলো। সে আসলে এমন কেন সে তো নিজেও জানে না। চরিত্রে একটু উদাসীন, খামখেয়ালী বলে কতো মানুষই তাকে রোজ এ প্রশ্ন করে। সে উত্তর দেয় না, কিংবা দিতে পারে না।
আজও মুখ নামিয়ে চুপ করে বসে রইলো সে।
সৌভিক কিন্তু চুপ করলো না। প্রসঙ্গ পাল্টালো। আজ তার মনটা বেশ ফুরফুরে। তাই কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব। বন্ধুবর নিখিল নেই। অফিসিয়াল কাজে বরিশাল গিয়েছে দু’দিন হলো। কথা বলতে তাই আনিকার কাছেই এলো সে!
— “শুনলাম, পার্মানেন্ট হয়েছেন? ট্রিট দেবেন না?”
হাসি মুখে জানতে চাইলো। আনিকার মুখটা মলিন হয়ে গেল আরো,
— “চাকরীটা বোধ হয় ছাড়তেই হবে, স্যার। সেটার ট্রিট নেবেন?”
— “মানে? বুঝলাম না ঠিক—”
— “ট্রান্সফার হয়েছে আমার। সকালে লেটার পেলাম।”
— “ভালো তো। কোথায় সেটা?”
— “মৌলভীবাজার।”
বিরস শোনালো কণ্ঠটা। সৌভিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
— “ট্রান্সফার হওয়া তো ভালো। হেড অফিসে চাপ বেশি। অন্য ব্রাঞ্চে কাজ কম। কিন্তু এর সঙ্গে চাকরি ছাড়বার কথা আসছে কেন?”
— “আপনি বুঝবেন না, স্যার। মেয়ে হয়ে জন্মানোর অনেক জ্বালা। স্বাধীন হয়ে বাঁচতে চাওয়া এখানে অপরাধ। আমাকে তো চাকরিই করতে দিতে চায় নি, ঢাকায় বলে তাও মেনেছিল। মৌলভীবাজার, অতোদূর যেতে দিবে কেন?”
রোদন রুদ্ধ কণ্ঠে কোনোমতে বললো মেয়েটা। সৌভিক অবাক চোখে তাকালো ওর দিকে। নির্নিমেষ চেয়ে রইলো মুহূর্তখানেক। একটু কি মনটা খারাপ হলো? কি জানি!
____
সন্ধ্যার চায়ের আড্ডায় শামিল সবাই। অনেকদিন পর শ্বশুরবাড়ি থেকে এলো অনু, সে খাতিরেই আসর জমজমাট। মুড়ি মাখায় চানাচুর কম পড়েছে চারু ভেতরে চলে গেল তাই আনতে।
সেকেন্ড ত্রিশের মাথায় চারুর ফোনে বিপ্ শব্দে স্ক্রিনের আলো জ্বলে উঠলো। অনু পাশেই বসে ছিল। না চাইতেও আড়চোখে তাকালো সেদিকে। কল আসছে একটা। স্ক্রিনে ভাসা ‘আম্মি’ নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল আপনাআপনিই। আম্মি আবার কে? ভালো করে আশেপাশে চেয়ে দেখল ওর মা আছে কি-না। ওই তো ছোট চাচীর পাশেই ওদের মা বসে। উনি কীভাবে কল করবেন চারুকে? আশ্চর্য!
এরমধ্যেই চারু ফিরে এলো, মুড়ির বাটিটা সবার সম্মুখে রেখে নিজের স্থানে ফিরলো। ফোনের দিকে চোখ পড়তেই খানিক অপ্রস্তুত হলো। নিখিলের মা কল করেছেন। এই অবেলায়! আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। ঋতু কি একটা বিষয়ে আলাপ তুলেছে, তাই নিয়ে তর্কাতর্কি চলছে!
সবার অগোচরে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে, আসর ছেড়ে উঠে গেল চারু। দোতলায় সিঁড়ির কাছে নিরিবিলিতে এসে আলাপে মত্ত হলো। লক্ষ্য করলো না পেছন পেছন এসে কেউ লুকিয়ে কথা শুনছে তার!
চলবে___
#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৮
ব্যালকনিতে একা দাড়িয়ে চারু। মুঠোফোনটা কানে ধরে রাখা। লাইনের ওপাশে কথাপাগল নিখিল একাধারে কথা বলে যাচ্ছে। চারু মাঝে মাঝে ‘হু হা’ করছে শুধু। মনটা বড্ডো উদাস। আনমনা দৃষ্টি গগনপানে ন্যস্ত। সেই গাঢ় নীলরঙা সুন্দর নভোস্থলে সফেত মেঘপুঞ্জের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে নিখিলের বকবক শুনে যাচ্ছে। লোকটা এতো কথা বলতে পারে!
ক্ষণিকক্ষণ পরে নিখিল নরম সুরে বললো,
— “মন খারাপ?”
— “উহু।”
— “তবে? এতো অন্যমনস্ক লাগছে কেন? কিছু হয়েছে?”
আবারো জানতে চাইলো সে। চারু ইতস্তত করলো। তার মন খারাপ নয়, তবে সত্য সত্যই সে বেশ অন্যমনস্ক আজ। সেটা বুঝতে নিখিলের অসুবিধে হয় নি। কিন্তু কারণটা বলতে চায় না চারু।
— “আমি অন্তর্যামী নই, চারুলতা। কিন্তু সমস্যার কথা বললে সমাধান করে দেয়ার চেষ্টা করতে পারি। বলুন না, কি হয়েছে?”
চারু সময় নেয়। কিয়ৎক্ষণ পর মৃদুস্বরে জানায়,
— “আগামীকাল অনুর ‘সাধ’ আয়োজন করেছে। সেই উপলক্ষ্যে বাড়িতে অনেক মেহমান— ওরা— ”
— “ওরা কি, চারু?”
কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছে মেয়েটার। অজান্তেই ফুঁপিয়ে উঠেছে। আকস্মিক এমন কাণ্ডে নিখিল থমকালো, চমকালো। বহুদূর থেকে বেতার মাধ্যমে যোগাযোগ করায় ইচ্ছে থাকলেও প্রেয়সীর ব্যাকুল রোদনে কিছুই করতে অপারগ সে। না জানে সে দুঃখের হেতু; না আছে তা ভোলানোর শক্তি। কি করবে নিখিল? কি দিয়ে সান্ত্বনা দিবে?
— “ওরা কি তোমায় নিয়ে বাজে কথা বলেছে? কোনো কটূক্তি—”
কথা শেষ করবার শক্তি নেই। কান্নার বেগ বাড়লো চারুর। হু হু করে কেঁদে উঠলো। সে আসলেই জানে না তার দোষ কোথায়। কেন মানুষ তাকে নিয়ে বাজে কথা বলে, কেন তাকেই ‘মুখপুড়ি, বাঁজা মেয়ে মানুষ, আটকুঁড়ী, অপয়া, অলক্ষ্মী’ — ইত্যাদি বিশ্রী বিশ্রী উপাধি দেয়া হয়? আচ্ছা, কোনো মানুষ কি নিজেই নিজের অক্ষমতা তৈরি করে?
নিখিল ওকে থামালো না। কাঁদতে দিলো ইচ্ছেমত। একটুপর নিজেকে সামলে নিলো মেয়েটা। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “আচ্ছা, একটা কথা বলবেন? আমি তো ডিভোর্সী, উপরন্তু বাচ্চা জন্ম দেয়ার ক্ষমতাও নেই। আমাকে বিয়ে করলে আপনি কষ্ট ছাড়া কি পাবেন? লোকের কটু কথা, আজেবাজে মন্তব্য — জেনেশুনে কেন আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছেন? কেন পথ তৈরি করে দিচ্ছেন লোকেদের কথা শুনানোর?”
নিখিল হাসে। শান্ত হয়ে বুঝায়,
— “আমি যদি বিয়ে না করে সারাজীবন একা কাটাই, লোকে কি বলবে বলুন তো? আইবুড়ো, চিরকুমার — বলে ক্ষেপাবে না? আবার চাকরী করা মেয়ে বিয়ে করি, বলবে এ আমি কি করলাম? বৌ চাকরী করবে না সংসার? চাকরী ছাড়া সুন্দর রূপবতী নারীকে ঘরে আনি, তখনো তার একটা খুঁত ধরবেই? আপনাকে বিয়ে করলেও ছাড় দেবে না। তাহলে পুরো ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে?
আমি যাই করি না কেন, সমাজ আমাকে কথা শোনাবে!
নিন্দুকের মুখ তুমি কোনোভাবেই বন্ধ করতে পারবে না। তাহলে কি লাভ সে চেষ্টা করে? জীবনটাকে নিজের মতো গুছিয়ে নেয়াটাই কি ভালো না?
তোমাকে ভালোবাসি, তাই বিয়ে করবো। এতে লোকে কি বলবে তাতে আমার কি দরকার?”
অনেকটা সময় দু’ জনে চুপ করে থাকে। আসলে তখনো তাদের কথোপকথন চলতেই থাকে, কিন্তু নীরবে-নিঃশব্দে। একসময়ে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে হঠাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ে নিখিল। খুব আদরে-আহ্লাদে জানতে চায়,
— “আপনি কবে আমাকে ভালোবাসবেন, চারুলতা? কবে স্ত্রী হয়ে আমার ঘরের শোভা হয়ে আসবেন? আমি যে অপেক্ষায় আছি—”
আচানক কথার জন্য প্রস্তুত ছিল না চারু। চট করে মাথা নুইয়ে ফেলে সে। লাজে কাবু হয়ে অসাড় শরীর নিয়ে দাঁড়ায়। কোত্থেকে একদল লজ্জার লাল-নীল প্রজাপতি এসে ছুটতে শুরু করে মন বাগানে। কান দিয়ে ধোঁয়া ছুটছে, গাল দু’টো যেন লাল টুকটুকে আপেল। জবান নেই মুখে!
ওপাশ থেকে অধৈর্য হয় নিখিল। তাড়া দেয়,
— “বলুন না, কবে আসছেন? কবে আমার করে পাচ্ছি, আমার চারুকে!”
— “আপনি যেদিন চান!”
লজ্জার মাথা খেয়ে শেষমেষ বলেই দিলো চারু। সঙ্গে সঙ্গেই কল কেটে ফোন বন্ধ করে ফেললো। কারণ সে জানে, এরপর ওই পাগল লোকটা কি করবে! কতভাবে, কতো পদ্ধতিতে যে ওকে লজ্জায় ফেলবে! ভাবতেই দ্বিগুণ বিব্রত হয়।
________
বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিল। অনুর সাধ।
এ-বাড়ির প্রথম কোনো মেয়ের বাচ্চা হচ্ছে। তার জন্য আয়োজনের ত্রুটি রাখেন নি আহাদ রাজা। ছোট করে প্যান্ডেল-স্টেজ সবই বানানো হয়েছে। আঠারো পদের খাবার, যার সবগুলোই অনুর প্রিয়; প্রস্তুত হয়েছে। নিকটাত্মীয়, বন্ধুবান্ধব সবাই আমন্ত্রিত। সারাদিন চললো বাচ্চাদের হৈ-চৈ, বড়দের সমাগম, আলাপ-আলোচনা। অনাগত সন্তানের জন্য উপহার নিতে নিতে ক্লান্তই হলো অনু।
ব্যস্ততম দিন কাটিয়ে অবশেষে ছাড়া পেল সন্ধ্যায়। এককাপ চা নিয়ে ছাদে বসলো। শান্তি লাগছে খুব। ক’দিন ধরে মনের ভেতর খচখচানি ছিল, আজ তা কেটে গেছে। কয়েক মাস আগেই মাহিয়ার বাচ্চা হওয়া উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান করেছিল ওর বাপের বাড়ির লোকজন। মাহতাব যেহেতু বেশ টাকা পয়সার মালিক, বড়লোক মানুষ — স্ত্রীর জন্য কম খরচা করে নি। সেই নিয়ে মাহিয়ার কি অহং!
দাম্ভিক চিত্তে সে অনুকে দেখিয়েছিল সব। অনুষ্ঠানে কে কি দিয়েছে, কতো কতো উপহার পেয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি গল্পের চোটে ক’দিনের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল ওর। সারাক্ষণ দেখো অহংকারী গল্প, দেমাগী চাল-চলন, কথাবার্তা। সব অসহ্য ঠেকছিল ওর। তাই তো হুট করে বাপের বাড়ি চলে এলো সে। দাদুর কাছে আহ্লাদ করে বলতেই তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। বড়সড় আয়োজন করলেন নাতনির জন্য। আর করবেন নাই বা কেন!
সে কোন অংশে কম ওই মাহিয়ার চেয়ে? রূপে-গুনে-বংশ মর্যাদায় কোন দিক দিয়ে হার মানাতে পারবে সে ওকে?
নিজের মনেই কথাগুলো ভাবছিল অনু। সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুৎ আনন্দে তার মনটা ভরে আসছিল। তৃপ্তির হাসি ঠোঁটের কোণে!
হঠাৎ দু’টো উষ্ণ হাতের স্পর্শ তার উদরে পড়লো, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ওকে মাহাদ। অনু হেসে ঘুরে তাকালো,
— “তুমি? কখন এলে?”
— “এইতো একটু আগে। কেমন গেল তোমার দিন?”
হেসেই প্রত্যুত্তর করলো মাহাদ। তীব্র আনন্দের ঝলকানি দেখা গেল ওর সারা মুখ জুড়ে,
— “দারুণ! জানো, আজ কতো মানুষ এসেছিল? বেবির জন্য কত্তো গিফট্ দিয়েছে? তুমি কেন ছিলে না বলো তো? থাকলে কতো কি হতো —”
— “ছুটি পাই নি যে! মন খারাপ করো না। তুমি বরং আমায় তোমার গল্প শোনাও, কি কি হলো আজ সারাদিন?”
একহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে, এলেমেলো চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো মাহাদ। অনু উচ্ছ্বসিত হলো। তার প্রবল আনন্দের সময়টায় তার প্রিয় মানুষটি ছিল না। এই দুঃখে কিঞ্চিৎ ব্যথিত ছিলো হৃদয়। কিন্তু এখন তাকে পেয়ে এক মুহূর্তেই সব ভুলে গেল যেন! হর্ষে-উল্লাসে ফেটে পড়লো মেয়েটা,
— “আর বলো না! এতো মানুষ, এতকিছু। বাপরে! দাদু যে এতবড় আয়োজন করবেন আমি কল্পনাও করি নি। মাহিয়া ভাবির অনুষ্ঠানে কয়জন এসেছিল, এখানে জানো পুরো তল্লাট চলে এসেছিল…”
একসঙ্গে অনেক কথা বলে যেতে লাগলো। আজ সে খুশিতে আত্মহারা। বাঁধনহারা সুখে একের পর এক গল্প সে বলতে চাইলো মাহাদকে, তার প্রিয় স্বামী, প্রিয় মানুষকে। মাহাদ শুনলো, মন দিয়ে শুনলো। একসময় হঠাৎ তার মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠলো। হাসি-খুশি চেহারাটা ধীরে-ধীরে বিলীন হয়ে যেতে লাগলো। প্রিয়তমার মুখের দিকে একধ্যানে চেয়েও সে ডুবে গেল অন্য ভাবনায়!
পৃথিবীতে অনেক ধরণের মানুষ আছে। এরমধ্যে একধরণের মানুষ আছে যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে। অন্যদের গুরুত্ব দিতে চায় না। সবক্ষেত্রে নিজেকে সবচেয়ে ভালো, নিখুঁত মনে করে। তারচেয়ে কেউ ভালো হলেও তাদের মূল্য দিতে চায় না। অন্যকে তুচ্ছ – তাচ্ছিল্য করে। কিংবা অন্য কারো শ্রেষ্ঠত্ব দেখে নিজের ভেতরে ঈর্ষা অনুভব করে। হিংসায়- ক্রোধে জ্বলে পুড়ে মlরে। মাহাদ খেয়াল করে দেখেছে এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কিছু অনুর মধ্যে বিদ্যমান। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যিই সে শুরুতে ব্যাপারটা খেয়াল করে নি। এমনকি বিয়ের আগে সে এর বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারে নি। অনু আসলে সুপ্রেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগছে!
এ নিয়ে মানসিক চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছে মাহাদ। কিন্তু তা করলেই অনুকে কাউন্সেলিংয়ের জন্য ডাকবে তারা; তখন কীভাবে ওকে নিয়ে যাবে বুঝতে পারে নি। অনু যা বদরাগী! কথা এগোতে পারে নি তাই
তাই নিজে থেকেই ওকে বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে মাহাদ। খেয়াল করে দেখেছে, অনুর এই সমস্যাটা সবক্ষেত্রে নেই। বিশেষ কিছু মানুষের ক্ষেত্রেই শুধু দেখা যায়। যেমন এ-বাড়ির চারুলতা, ও-বাড়ির মাহিয়া। বয়স, অভিজ্ঞতা কিংবা অন্য যেকোনো ক্ষেত্র — অনু এদের চেয়ে বেশ ছোট। সঙ্গত কারণেই বাড়িতে এরা দু’জনেই ভীষণ রকমের প্রাধান্য পায়। চারুর সঙ্গে নিয়মিত উঠাবসা নেই বলেই ওর সঙ্গে রেষারেষির ঠিক কারণটা মাহাদ জানে না। তবে মাহিয়ার সঙ্গে ঝগড়ার ব্যাপারটা সে খুঁজে বের করেছে। ও-বাড়িতে মাহিয়ার প্রভাব বিস্তর! বড় বৌ হওয়ার সুবাদে সকলেই ওকে মান্য করে, ভালোবাসে। অনুকে যে বাসে না, তা নয়। তারপরও অনু কেন যে নিজেকে মাহিয়ার সঙ্গে তুলনা করে কে জানে!
মাহিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়েই আজকাল সবকিছু করে অনু, মাহাদ বুঝতে পারে। এই যে এতোবড় করে একটা অনুষ্ঠান করলো, কারণ কি? মাহিয়ার সঙ্গে মানসিক দ্বন্দ্বে জেতা। শুধুমাত্র নিজের আত্মিক প্রশান্তির জন্যই এসব। এরকম আরো কতো কাণ্ড যে অনু করে!
চটকা ভাঙলো অনুর কথায়,
— “কি হলো? কিছু বলছ না যে?”
বাহু ধরে ঝাঁকালো। ভাবনা ছেড়ে সম্বিৎ ফিরতেই একটু হাসলো মাহাদ। স্ত্রীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সচকিত কণ্ঠে বললো,
— “একটা কথা শুনবে, অনু?”
— “কি?”
আহ্লাদী সুরে বলেই ওর গলায় ঝুলে পড়লো অনু। চোখ পিটপিট করে আবেদনময়ী ভঙ্গিতে তাকালো। মাহাদ উসখুস করলো কিছুক্ষণ।একসময় খুব করুণ চোখে চেয়ে বললো,
— “কারো সঙ্গে দ্বন্দ্বে যেও না কখনো। কাউকে পরাস্ত করতে গিয়ে একটু দেখো, যেন তোমার-আমার মাঝে দেয়াল তুলে দিও না। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, অনু। অনেক সাধনা করে তোমাকে পেয়েছি। কোনো দেয়াল এসে গেলে, তা ভাঙবার শক্তি যে আমার নেই!”
শেষের কথাগুলো একেবারেই অস্পষ্ট শোনালো। অনু সেসবের কিছুই শুনলো না, বুঝলো না। কেবল ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে রইলো ওর পানে!
চলবে___