#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৩
রাত্রি নয়টা। খাবার ঘরে পরিবেশনের সময় আজ স্ত্রীকে দেখে নি মাহাদ। সারাদিন অফিসে পার করে বাড়ি ফিরবার পর যেটুকু সময় সে পায়, সেটুকুর পুরোটাই প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেবার জন্য মুখিয়ে থাকে সে। অফিস থেকে ফিরে প্রথম শরবতের গ্লাস হাতে একঝলক দেখা দেয়া থেকে শুরু করে রাতে ঘুমোবার পূর্ব পর্যন্ত ওর সঙ্গ পেতে চায় ব্যাকুল মন। রোজকার নিয়মে তাইই হয়। প্রতিটা মুহূর্তে অনু পাশে থাকে বটে, তবে আজ কেন যেন ব্যতিক্রম হয়েছে! আর অনুর দেখা পায় নি সে। এক লহমার জন্যও নয়! তবে মা – ভাবির কাছ থেকে শুনেছে অনেক অনেক কিছু! সকালের ঘটনা থেকে বিগত দিনগুলোর অনেক কিছুই সেসবের মধ্যে ছিল!
অন্ধকার ঘরে জানালার কাছে দাড়িয়ে আছে অনু। জানুয়ারির রাতের শীতালু বাতাস বয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বাইরে কুয়াশা। অনু উদাস চোখে চেয়ে আছে সেদিকে। হঠাৎ অনুভব করলো দু’টি বরফ ঠাণ্ডা হাত পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে নিয়েছে, নির্মেদ কোমড়ে বিচরণ চলছে এলোমেলো। উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে কাঁধে। ক্ষণিকের জন্য শিউরে উঠলেও স্বামীকে চিনতে অসুবিধে হলো না ওর। নিজের দুহাত দিয়ে হাত আটকে দিলো মাহাদের। চট করে মুখ ফিরিয়ে তাকালো। চোখ রাখলো চোখে। মাহাদ কোমল সুরে বললো,
— “কি হয়েছে অনু? এতক্ষণ ছিলে না কেন ঘরে?”
কি ছিল ওর কণ্ঠে? জাদুর ছোঁয়া? অনু আহ্লাদে গলে গেল যেন। অন্যদিকে ফিরে অভিমানী সুর তুললো,
— “আমার খেয়াল এ-বাড়ির কয়জন রাখে? যে যাবো?”
মাহাদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ওকে দু’হাতে আগলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “এভাবে বলছ কেন? কিছু হয়েছে?”
— “ন্যাকামো করো না। এ-বাড়ির লোকজনের যা স্বভাব! ওরা এতক্ষণে তোমায় কিছু না বলে আছে?”
কপট রাগ দেখালো অনু। বাহুডোর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস চালালো। মাহাদ ছাড়লো না। শক্ত-পোক্ত বাঁধনে জড়িয়ে নিলো ওকে। সারাদিন এতো ঝক্কি পোহানোর পর বাড়ি ফিরে এসব ঝামেলা তার ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগে। এখন রেগে কিছু বললে কথা কাটাকাটি হবে। অশান্তি বাড়বে। তাই শান্ত হয়ে বললো,
— “শুনেছি আমি। কিন্তু সেটা এক পাক্ষিক। বিচার তো এভাবে হবে না। তোমার পক্ষের কথাও তো শোনা উচিৎ। ঠাণ্ডা মাথায় বলো?”
অনু সরে যেতে যেতে বললো,
— “থাক। শুনতে হবে না। যা জেনেছ, তাই নিয়েই থাকো। আমি নতুন করে কিছু বলবো না।”
— “কেন?”
বড্ডো করুণ শোনাল। অনুর একরোখা উত্তর,
— “এমনিই। তোমার বিচার করার প্রয়োজন, তুমি একপক্ষ শুনেই করো। আমি কিছু বলতে চাই না।”
মেয়েটা রেগে আছে। বোঝা যাচ্ছে। মাহাদ উদাস হয়ে কি যেন ভাবলো। সংসার মানেই কি এতো ঝুট-ঝামেলা? সে তো ভেবেছিল, সংসার মানে অনেক ভালো কিছু। স্বামী-স্ত্রীতে মিলেমিশে থাকা। যাদের মধ্যে প্রেম থাকে, একে – অপরকে বুঝবার ক্ষমতা থাকে, বিশ্বাস থাকে— সবচেয়ে বড় কথা ভালবাসা থাকে!
কিছু সময় পর মুখ খুললো সে। আশ্চর্য শীতল সুরে বললো,
— “যা যা শুনেছি, তাই যদি আসল ঘটনা হয়; তবে তোমাকে আমি সাপোর্ট করতে পারি না অনু। সংসার কখনো একার চেষ্টায় সুন্দর হয় না। সবাই মিলেমিশে থাকলে, একত্রে চেষ্টা করলে, তবেই একটা সুন্দর জীবন হয়। আনন্দপূর্ণ জীবন হয়। এখানে কেউ তোমার পর নয়। সবাই আপন। তুমি যেমন আমার কাছে প্রিয়, এরাও আমার তেমনই প্রিয়। আর আমাকে বিয়ে করে তুমি এই মানুষগুলোকে নিজের আপন হিসেবে পেয়েছ। তাদের হাসিমুখে গ্রহণ করো। কোনো মানুষ ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নেই। সবাই ছোটখাটো দোষ আছে। সেগুলো নিয়ে দুঃখ পেয় না। একে-অন্যকে খুঁচিও না। আমি জানি তুমি একটু রাগী। কিন্তু সেটাকে সংবরণ করো। অশান্তি বাড়িও না। কাউকে অযথা হিংসে…”
বিদ্যুৎ বেগে ফিরে আসে অনুলেখা। চোখে একপলের জন্য ঝিলিক দিয়ে গেল রাগের ফুল্কি। মাহাদের মুখোমুখি এসে দাড়াল সে। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
— “আমি হিংসা করি? আমি অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করি? এতবড় কথা তুমি বলতে পারলে? পারলে?”
মাহাদ সংগোপনে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বললো,
— “আমি সেভাবে বলি নি, অনু। ভুল বুঝ না। আমি শুধু তোমাকে বুঝাতে চেয়েছি—”
ওকে শেষ করতে দিলো না অনু। চেঁচিয়ে উঠলো তারস্বরে,
— “কি বুঝাতে চেয়েছ তুমি? আমি বুঝি না? তোমরা সবাই একই রকম। নিজেদের ভুল ধরবে না! অন্যেরটা ধরে টানাটানি করবে। তোমাকে বিশ্বাস করে, তোমার উপর ভরসা করে, এই বাড়িতে এসেছি আমি। কোথায় তুমি আমার সাথ দেবে, না— বিয়ের আগে খুব দরদ দেখানো গিয়েছিল। এখন সেসব হাওয়া, না? বুঝি তো— বোকা না আমি। এখন বিয়ে হয়ে গেছে। সস্তা পেয়েছ—”
ইত্যাদি ইত্যাদি নানান কথা বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটা। পেছনে হতবাক হয়ে দাড়িয়ে রইলো মাহাদ। সে কি বলতে চেয়েছিল, আর কি হলো? আশ্চর্য!
____
সবে কেবিন থেকে বেরিয়েছে সৌভিক, পেছন থেকে নিখিলের গলা ভেসে এলো,
— “দোস্ত, দাড়া!”
ওর দাড়াবার ইচ্ছে ছিল না। উপেক্ষা করে চলে যাওয়াতেই মন ছিল।তবুও কি যেন ভেবে দাড়িয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করলো,
— “কি সমস্যা?”
ত্বরিৎ পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসলো নিখিল। চট জলদি বললো,
— “তোর সঙ্গে কথা আছে আমার, চল!”
— “কোথায়? আর কেন?”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ওর কাঁধ চাপড়ে নিখিলের প্রত্যুত্তর,
— “ক্যান্টিনে। বললাম না, কথা আছে? চল!”
নিজের মতো বলেই পা বাড়ালো। সৌভিক ঘাড় কাত করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো ওর দিকে। একটু এগিয়ে নিখিল যখন ফিরে তাকালো, তখন বললো,
— “আমার কাজ আছে। সময় নেই। আমি যাব না।”
কণ্ঠে তিক্ততা মিশে। নিখিল ততোধিক শান্ত সুরে বললো,
— “পাক্কা আধ ঘণ্টার লাঞ্চ ব্রেক, সৌভিক! আই থিঙ্ক ইট’স এনাফ। আর তোর কোনো কাজ নেই। এমনিও আজ হাফ ডে নিয়েছিস। জানি আমি!”
সৌভিক এবার একটু রাগই হলো। ওর সব ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে কেন? কীসের এতো খবরদারি নিখিলের? বাঁকা চোখে তাকালো,
— “নজরদারি করছিস?”
নিখিল হাসলো,
— “সেটা করতে যাবো কেন? কারো উপর নজরদারি করার অভ্যাস আমার নেই। হাফ ডে নেয়ার বদৌলতে তোর বাদবাকি কাজ আমার ঘাড়ে এসে চেপেছে। তাই জানি সব।”
সৌভিক কিছু বললো না আর। চুপ করে রইলো। নিখিল কিছুক্ষণ সময় দিলো ওকে। এগোতে এগোতে বললো,
— “ক্যাফে নির্ঝরে চল্। কফিতে সিপ দিতে দিতে আলাপটা সারছি!”
কফি এসে গেছে। ধোঁয়া ওঠা গনগনে গরম কাপে একের পর এক চুমুক বসিয়ে যাচ্ছে সৌভিক। নিশ্চল-নির্বিকারে। এক ফাঁকে আড়চোখে নিখিলকে দেখে নিলো। সেও নিশ্চুপ। কুচকুচে কালো আলকাতরা রঙের কফির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ। সিপ তুলছে না, কিন্তু চেহারা গম্ভীর। সম্ভবত কথা গুছিয়ে নিচ্ছে। আচ্ছা, নিক। সৌভিক বাঁধা দেবে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নিখিল মুখ না খুললে কিছু বলবে না। একটা বাক্য এমনকি শব্দও নয়!
কিয়ৎক্ষণ পর নিখিল কথা শুরু করলো। ফার্স্ট বলে উইকেট নেয়ার জন্য বলকে ঠিক যেভাবে হিট্ করা উচিৎ, সেভাবেই মোক্ষম কথার বাণ ছুঁড়ে দিলো বন্ধুবরের উদ্দেশ্যে,
— “আই নৌ, চারু ইজ ইয়্যুর লাভ। বাট আনফরচুনেটলি, সে তোর হয় নি। তুই ওকে ভালোবাসিস, ব্যাপারটা সম্ভবত সে জানেও না। তাই না?”
চট করে মুখ তুলে তাকালো সৌভিক। কাপে পরবর্তী চুমুক বসাতে উদ্যত হওয়া ঠোঁট দু’টো ঝুলে গেল তৎক্ষণাৎ। বিস্ময়াহত চাউনিতে অনিমেষ চেয়ে রইলো ইয়ারি দোস্তের পানে।
নিখিল পুনর্বার হাসলো,
— “আমি জানি, তুই অবাক হচ্ছিস। এটা ভেবে যে যেকথা কেউ জানলো না আমি কি করে জানলাম? শোন, তোর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ত্ব। তাই তোর আচরণ কোন ক্ষেত্রে কেমন হতে পারে সেটা আমি জানি। চারুকে ভালোবাসিস বলেই ওকে নিয়ে তুই ওভার পজেসিভ। যেটা তোর অন্য বোনদের ক্ষেত্রে নেই। স্বভাবতই তুই মিশুক ছেলে, কেয়ারিং ম্যান। কিন্তু চারুর প্রতি তোর কেয়ারিং অনেক বেশি। ওর জন্য অনেক বেশি কনসার্ন তোর! সবই খেয়ালই করি—”
— “সবই যদি জেনে থাকিস তবে, ওর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালি কেন? কেন বন্ধুর ভালোবাসাকে নিজের দিকে টানতে গেলি?”
হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো সৌভিক। রাগে ওর শরীর জ্বলছে, দাউ দাউ অনলের ধারালো শিখা মন – মস্তিষ্কের ভেতর!
নিখিল রাগলো না। বরং ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে খুব ঠাণ্ডা গলায় বললো,
— “কারণটা খুব সহজ, সৌভিক। তুই ওকে ভালোবাসিস এ-কথা আমি জানতাম না। সেক্ষেত্রে আমার ফল করা কি দোষের? দেখ, চারু ইজ অ্যা ভেরি প্রীটি গার্ল। অভিয়াসলি অ্যাট্রাক্টিভ অ্যান্ড সুইট। আরেকটা ওয়ার্ড বলতে মন চাইছে, কিন্তু তুই ওর ভাই বলেই বলছি না। কটু শোনাবে। বাট বন্ধু হিসেবে…”
নিখিল দুষ্টু হাসলো। রাগ করলো সৌভিক,
— “আমাকে চেঁতাস না, প্লিজ! আমি জানি না কি করে ফেলবো!”
— “ওকে, ওকে। ক্ষেপে যাস না। দেখ, চারুর এতো এতো গুণ থাকার পর ওকে দেখে প্রেমে পড়ে যাওয়া কি অসম্ভব কিছু! এমনকি ভালোবেসে ফেলা? আমি ঠিক ভালোবেসেই ফেললাম। সঙ্গে বিয়ের পরিকল্পনাও চলে এলো মাথায়। তখন তোর ভাবনা মাথায় এলো। তুই ছেলে ভালো, তোদের ফ্যামিলি ভালো। বন্ধুর ছোট বোনকে প্রেমের প্রস্তাব না দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়াই যুক্তিযুক্ত। ভেবেই তোকে বলতে গেলাম, আর তুই? তখনই আমি বুঝতে পারি, ব্যাপারে ঘাপলা আছে। তোর অনুভূতি আছে ওর প্রতি!”
— “কিন্তু—”
— “আমাকে কথাটা শেষ করতে দে?”
— “কর।”
নিখিল শ্বাস ফেলে পুনরায় শুরু করলো,
— “চারুর অক্ষমতা, বিশ্রী অতীত — এগুলো কোনটা নিয়েই আমার মাথা ব্যথা ছিল না, সৌভিক। আমি সবটা মেনে নিতে পারি, নিয়েছিও। এতে তোর সমস্যা হওয়ার কথা না। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক চলছে। তুই সবই জানিস। কিন্তু সব জেনেও তুই এরকম কেন করছিস? শুধু ওকে ভালোবাসিস বলে? কিন্তু তুই তো এতদিন কিছু বলিস নি? তাহলে? নাকি তুই চাস, চারু সারাজীবন দুঃখী দুঃখী মুখ করে তোদের বাড়ির চার দেয়ালের ভেতর আটকে থাকুক? ভুলে যাক সমস্ত সুখ, স্বপ্ন-আহ্লাদ?”
— “বাজে বকবি না একদম। আমি এমনটা চাই না মোটেও!”
— “তবে তুই কি চাস?”
নিখিলের প্রচন্ড চিৎকারে কেঁপে উঠলো পুরো কফিশপটা। উঁচু গলার স্বর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে বারবার কানে বাজতে লাগলো সৌভিকের। আশেপাশে চেয়ে দেখল, সকলেই হতভম্ব চোখে দেখছে ওদের!
নিখিল নিঃশ্বাস ফেললো। মেজাজটা খিঁচড়ে গেছে হঠাৎ। সত্যিই সে ওকে বুঝতে পারছে না। কি চায়, সৌভিক? কি চায়?
একটুপর সৌভিক বললো,
— “আমি তখন সদ্য ভার্সিটিতে যাই। সারাজীবনের বেড়ে ওঠা প্রিয় বাড়ি, প্রিয় আঙিনা ছেড়ে হলে উঠেছি। অবাধ স্বাধীনতা আমার দুয়ারে এসে হানা দিয়েছে। আশেপাশের রঙিন পৃথিবী দেখছি। মনটা উড়ু উড়ু করছে। নতুন জগৎটাকে আমার ভীষণ ভালো লাগতে শুরু করলো। মনে হলো, ইসস, এত্ত সুন্দর সবকিছু! কিন্তু প্রায় মাসখানেক থাকবার পর এই রঙিন দুনিয়াটা হঠাৎ করেই আমার ভীষণ অসহ্য ঠেকলো। আমি ধীরে ধীরে অনুধাবন করলাম, এখানে আমার মন টিকছে না। যান্ত্রিক শহরের চাকচিক্য, পশ লাইফ স্টাইল — আমায় ক্ষণিকের জন্য আকর্ষণ করেছিল। আমার মন এখানে ভালো নেই। শূণ্য বুক জুড়ে আমার হাহাকার। কেননা এখানে ভালোবাসা নেই!
আমি ফিরতে চাইলাম, কিন্তু ফেরা হলো না! যে পাখি পিঞ্জর ছাড়ে একবার, তার যে আর ফেরা হয় না!
সেবার ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে সেখানককার সবকিছুকেই আমার খুব ভালো লাগলো। মা-বাবা, চাচা-চাচী, ভাইবোন — সবাইকেই। আর বিশেষ করে ভালো লাগলো কাকে, জানিস? চারু! ভার্সিটিতে আমার অনেক অনেক মেয়ে বন্ধু ছিল; তুই জানিস সেটা। কিন্তু তাদের কাউকেই আমার ভালো লাগতো না। কারণ চারু। ওর মতো স্নিগ্ধ, শান্ত, নম্র-ভদ্র মেয়েকে ছেড়ে অন্যদের কেন ভালো লাগবে? ওর প্রতি অনুভুতির শুরু আমার ঠিক কখন থেকে, আমি জানি না। তবে সেবার ঈদের ছুটিতে গিয়েই আমি টের পাই আমার ভালোবাসা চারু।
আমি গোপনে গোপনে ভালোবাসতে থাকি। চারুকে প্রাণভরে দেখি, মনে মনে কতশত কল্পনা করি! এসব কিছুই ওকে বলি নি। পাছে অবজ্ঞা করে দূরে থেকে দেয়? আমি অপেক্ষা করি সময়ের। যেদিন চাকরী পাবো, সেদিন বড় আব্বাকে বলবো। তার মেয়ের হাত চাইবো…”
এ পর্যায়ে নিখিল মৃদু কণ্ঠে শুধালো,
— “তবে করলি না কেন?”
— “সুযোগ হয় নি।
— “মাস্টার্সের ছাত্র আমি তখন। ছুটিতে বাড়ি যাবার কথা। কিন্তু কি যেন এক ঝামেলায় যাওয়া হলো না। কিছুদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম। ফোনটা নষ্ট হয়েছিল। তার মাস খানেক পরেই সম্ভবত পুজোর ছুটি ছিল। সেই ছুটিতে বাড়ি যাবো, মা ফোন করে বললো ওরা আসছে। তখনই জানতে পারি, চারুর বিয়ের কথা। কেনাকাটা করতে ঢাকা আসছে সবাই। ওই মুহূর্তে কি রিয়েকশন দেখানো উচিত ছিল আমি জানি না। বালির বাঁধের মত ঝুরঝুর করে পড়ে গিয়েছিল আমার সমস্ত স্বপ্ন, সাধ-আহ্লাদ!
ওরা সবাই ঢাকায় এলো। হৈচৈ হুল্লোড়! কি আনন্দ সবার চোখেমুখে। চারুকে একবার জিজ্ঞেস করলাম,
‘তুমি খুশি?’
মেয়েটা লজ্জায় মাথা নোয়ালো। কষ্টে বুক ফেটে গেল আমার। আমি দাদুর কাছে ধর্না দিলাম। আকুল হয়ে নিজের মনের কথা বললাম। দাদু গম্ভীর হয়ে জানালো, আমি যা ভাবছি তা সম্ভব নয়। চারুর আংটি বদল হয়েছে আগের মাসে, বিয়ের তারিখ ঠিকঠাক। এতদিন ধরে তারা পাত্র দেখেছে, কথাবার্তা হয়েছে, এখন কি করে—
তাছাড়া আত্মীয়ে-আত্মীয়ে সম্পর্কটা বাড়ির লোকজন ভালো চোখে দেখবে না। এসব কথা উঠলে ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝামেলা হতে পারে। দাদুর এতবছরের আগলে রাখা এই সংসার! ঠুনকো কারণে তিনি ভাঙতে দেবেন না।
চারুর তো মাহতাবকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই। সে নাকি খুশিই ছিল। তাহলে?
দাদুর কাছে ব্যর্থ হয়ে আমি মা’র কাছে ছুটলাম। তার ছোট ছেলে আমি, অতি আদরের। কিন্তু সেই আদরের ছেলের একটিমাত্র আবদার তিনিও রাখলেন না। বড় চাচীর সঙ্গে তাঁর কি রেষারেষি আছে, বড় চাচীর মেয়েকে ছেলের বৌ করতে তিনি নারাজ। ঘরের মেয়ে, মেয়ে হিসেবেই নাকি মানায়। বৌ হিসেবে মানা যায় না!
সবদিক দিয়ে আমায় নিরাশ হতে হলো। সেই ছুটিতেই চারু বিয়ে করে মাহতাবদের সঙ্গে চলে গেল শ্বশুরবাড়িতে!”
— “তারপর? তারপর দু’ বছর পর আবার তোর কাছে সুযোগ আসে। তুই তখনো চারুকে নিজের করে নিতে পারতি!”
সৌভিক একটা ক্লান্ত নিশ্বাস ফেললো। কফির কাপে শেষ চুমুকটা বসিয়ে বললো,
— “চারুর সংসার হলো না। মাহতাব ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিলো। বাড়ি ফিরে চারু খুব ভেঙে পড়েছিল। আমি সময় দিচ্ছিলাম ওকে। নতুন করে সবটা সাজাতে চেয়েছিলাম। আমি জানি এবারও পরিবার আমার বিপক্ষে যাবে। ছ’ মাস আগে মা আমার বিয়ের কথা তুলেছিল। আমি চারুর কথা বলতেই উনি আবারও নারাজ হলেন। রাগারাগি করলেন। নাতি – নাতনির মুখ তিনি দেখতে চান। আগে তাও যেটুকু মেনে নেয়ার সম্ভবনা ছিল, সব কর্পূরের মতো উবে গেল। আমার বিয়ের প্রসঙ্গ ধামাচাপা দিলেন। আমিও রাগ করে ঢাকায় ফিরলাম। তারপর বাড়ি যাওয়া হয় নি।
এবার তোকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম, অনুর বিয়ে খেতে। এরমধ্যে…”
নিখিল কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে আসলেই বুঝতে পারছে না এখানে কার দোষ বেশি! কিংবা কার দোষ কম!
কোনোমতে বললো,
— “আমি সত্যিই জানতাম না, সৌভিক। জানলে নিজের প্রিয় বন্ধুর ভালোবাসাকে আমি কেড়ে নিতাম না। কিন্তু এখন আমি কি করবো, বল তো? আমি চারুকে ভালোবাসি। যতটুকু বুঝি, সেও আমাকে। তুই কেন আগে কিছু বললি না? কেন সময়কে বিশ্বাস করলি? এই সময় যে তোকে আগেও ধোঁকা দিয়েছিল!”
চলবে___
#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৪
দেখতে দেখতে মাস গড়ালো। ফেব্রুয়ারিতে পদার্পণ করলো মাস। শুষ্ক-শীতল আবহাওয়ায় দিনগুলো ভালোই কাটছিল। সৌভিক-নিখিলের মতো কর্মকরা মানুষের কর্মব্যস্ত দিন। চারুর সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্কটা বেশ জমেই গিয়েছে নিখিলের। রোজ রোজ ফোনকলে কথা, সকালে অফিস যেতে-যেতে, দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকের ফাঁকে আর রাতে বাড়ি ফিরে বিছানায় শরীর এলিয়ে টুকটুক করে দু’ প্রান্তের দু’জন মানুষ গল্পে মেতে ওঠে। সারাদিন কি কি করলো তারা, লাইনের ওপাশের অপরপক্ষকে জানায়। মাঝে মাঝে ভিডিও কলেও সাক্ষাৎ হয় ওদের। কিন্তু তা মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়। ভিডিও কলে নিখিলের সামনে বসে কথা বলতে ভীষণ লজ্জা পায় কি-না! নিখিল অবশ্য হাসে খুব। এই নিয়ে ওকে পঁচানি দিতেও ছাড়ে না,
— “এখনই এতো লজ্জা পাচ্ছেন? বিয়ের পর কি করবেন, বলুন তো?”
ওর চোখের দুষ্টু ইশারা বুঝতে অসুবিধে হয় না চারুর। লাজে রাঙা গাল নিয়ে মন্তব্য ছুঁড়ে ওর দিকে,
— “সে তখন দেখা যাবে!”
— “তখন কিন্তু এসব লজ্জা-ফজ্জা চলবে না, ম্যাডাম! শুধুই আদর চলবে!”
চারু লজ্জায় অবনত আরক্তিম মুখখানি লুকোনোর জায়গা খুঁজে পায় না। চট করে কল কেটে অফলাইনে চলে যায়। ওপাশ থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নিখিল!
রিংকু-টিংকুর মতো ভীষণ দুষ্টু ছেলেদের জন্য মহানন্দের সময়। তারা কোনোমতে উতরে গেছে তাদের ক্লাস এইট। বছর শুরুর দিনগুলি। তাই দু’ ভাইয়ের এখন পড়ালেখা নেই। তাদের জোর দাবি তারা বড় হয়ে গেছে। ক্লাস নাইনে উঠেছে কি-না!
অনুলেখার সাংসারিক জীবন চলছে তার মতন। রোজকার একঘেঁয়ে রুটিন। আজকাল বাপের বাড়িকে খুব মনে পড়ে মেয়েটার। মাঝে মাঝে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে এ বাড়িতে, তার আজন্ম বেড়ে ওঠা প্রিয় ‘অরুণা ম্যানশনে’! কিন্তু ফেরা হয় না। যে নারী একবার ‘কবুল’ বলে স্বামী নামক মানুষটির হাত ধরে বাড়ি ছাড়ে, তার যে বাপের বাড়ি বলে আর কিছু থাকে না!
মাঝে মাঝে দু’ একদিনের জন্য আসে বটে কিন্তু আগেকার সেই দখলদারিত্ব, দাপুটে ভাবটা আর নেই। মনে মনে অনুও জানে সেরকম অহং দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। ক্ষণিকের অতিথি হয়ে ফিরে যায় শ্বশুরবাড়িতে; তার বর্তমান এবং ভবিষ্যতের একমাত্র ঠিকানায়।
এরমধ্যে একটা খবর এসে জীবনটাকে সুখের করে তোলে তার। অনু জানতে পারে, সে মা হতে চলেছে। দু’ বাড়িতেই মোটামুটি খুশির জোয়ার বয়ে যায়। সেই প্রথমবার, হ্যাঁ, সেই প্রথমবারের মত বড় বোনকে টেক্কা দিতে পেরে ভীষণ আনন্দিত হয় অনুলেখা। তার সারাজীবনের আফসোস, চারুর চেয়ে এগিয়ে না থাকার, প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ হতে না পারার আক্ষেপ, মুছে যায় নিমিষেই!
মাতৃত্বের আনন্দের চেয়ে এই আনন্দটাই ওর কাছে বেশি হয়ে ওঠে তখন। চারুকে সে হারিয়ে দিয়েছে!
____
ক’দিন ধরে অফিসে আসে না আনিকা। কি যে হয়েছে আল্লাহ্ মালুম। এমডি স্যার সেদিন খোঁজ করলেন। সৌভিকের উপর দায়িত্ব পড়েছে মেয়েটার। খবর রাখা আবশ্যিক। ও কল করলো। একবার না, কয়েকবার। ধরবে তো দূর, কল তো গেলই না! সুইচ অফ্ বলছে। বিরক্ত সৌভিক আর কল করল না। এরকম ইরেস্পন্সিবল এমপ্ল্যোই নিয়ে চলা মুশকিল।
ক’ দিন কাটলো। আনিকা তখনো অনুপস্থিত অফিসে। সৌভিক এরমধ্যে যোগাযোগের চেষ্টা করে নি। লাঞ্চ ব্রেকে ওর এক কলিগ রাসেলের কাছেই শুনলো আধো আধো,
— “বুঝলেন, ভাই। অফিসের যে নতুন এমপ্ল্যোই গুলো এসেছে অধিকাংশই কেমন যেন। সব ইরেগুলার, ইরেস্পন্সিবল। এদের নিয়ে যে কি করবো—”
— “কেন? কে আবার কি করলো?”
খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো সৌভিক। রাসেল শ্রাগ জানালো,
— “আর বলবেন না, ভাই। আমার ঘাড়ে পড়েছে এক উজবুক। এমন বেকুবের বেকুব মাস খানেক ধরে বুঝিয়েও কিছু বুঝাতে পারছি না। ইসস, জীবনডা জ্বালায় ভেজে ভেজে খাচ্ছে—”
রাসেলের আহাজারি শুনে সৌজন্য হাসলো সৌভিক। কিছু বললো না। উনি নিজেই ফের বললেন,
— “আপনার কি অবস্থা? ওই মেয়ে, কি যেন নামটা, আনিতা—আনিশা—”
— “আনিকা।”
সৌভিক শুধরে দিতেই সায় দিলেন,
— “হ্যাঁ, হ্যাঁ। আনিকা। তার কি অবস্থা? দেখতে – শুনতে তো ভালোই মেয়ে। কিন্তু বোধ হয় একটু ঢিলে। খামখেয়ালী টাইপের— না?”
সৌভিক মাথা নাড়ালো,
— “কি জানি, ভাই। অতশত বুঝি না। কিন্তু একটু উইয়ার্ড মেয়ে। কোনো কথা বললে কেমন যেন রিয়েকশন দেয়। চট করে কিছু বোঝে না। কাজে মন নেই। উদাস কিন্তু কাজ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে খুব উৎফুল্ল। অদ্ভুৎ!”
— “অদ্ভুৎ তো বটেই। কিন্তু মেয়েটা কিন্তু খুব ব্রিলিয়ান্ট। এটা খেয়াল করেছেন? সেদিন আমার একটা প্রবলেম ফট করে সলভ করে দিলো! আ’ম ইমপ্রেসড্!”
রাসেল ভাইয়ের চোখে তৃপ্তি। সৌভিক অনিমেষ চেয়ে লক্ষ্য করলো। আনিকার গুণ শুনে একটু অবাকও হলো। সে বরাবরেই এই মেয়েকে বাতিলের খাতায় ফেলেছে। ওর ধারণা আনিকার মতো উদাস, বেখেয়ালি মেয়েকে দিয়ে আর যাই হোক, কর্পোরেট দুনিয়ায় চাকরী হবে না! এখন শখ করে হয় তো এসেছে, টিকতে পারবে না। কিন্তু সহকর্মীর কথায় অবাক হলো,
— “মেয়েটা ক্রিয়েটিভ আছে, বুঝলেন? কিন্তু কেয়ার করে না। আল্লাহ্ সবসময় অপাত্রেই ভালো জিনিস দান করেন কেন কে জানে!”
সৌভিকের বড় ইচ্ছে করলো জিজ্ঞেস করতে ‘কি এমন গুণ দেখলেন ওই উড়নচণ্ডী মেয়ের মধ্যে? এতো মুগ্ধ গিয়ে গেলেন?’ — কিন্তু জিজ্ঞেস করলো না। অজানা সংকোচ ঘিরে ধরলো। কথা পাল্টে বললো,
— “ও কদিন ধরে অফিসে আসে না কেন, জানেন?”
— “জ্বর এসেছে তো। জানেন না? কাল বসের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছে।”
— “ওহ্। জানতাম না।”
ক্লান্ত শ্বাস বিমোচন করলো সৌভিক। সে সত্যিই জানতো না কিছু। মেয়েটা তবে অসুস্থ! সেজন্যই আসে না! সে আরো না জেনে মেয়েটাকে ‘ইরেগুলার, ইরেস্পন্সিবল’ কতকিছু বললো! কাজটা ঠিক হলো না। মেয়েটা অন্যমনস্ক কিন্তু অতটাও খারাপ নয়! ফাঁকিবাজি নেই ওর ভেতর। তারপরেই হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, সবাই যেটা জানে ও সেটা জানলো না কেন? নিতান্ত আনিকা সম্বন্ধে কিছু জানতে চায় নি, আগ্রহ দেখায় নি বলেই?
___
ছেলের ঘরে যাচ্ছেন নিলুফার নাজিয়া। রাতের খাবার খেতে ডাকছেন সেই কখন থেকে। নিখিলের কোনো পাত্তা নেই। রাগ করে এলেন, ওর কান ধরে টেনে নিয়ে যেতে। ‘রাত কত হয়েছে, সে হুশ আছে? সারারাত কি ভাত নিয়ে আমি বসে থাকবো? আমার আর কাজ নেই?’ — রাগে গজগজ করতে করতে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। ঘর ফাঁকা। লাগোয়া বাথরুম থেকে পানির তিরতির শব্দ আসছে। নিখিল ওয়াশরুমে। বিছানায় রাখা ওর ফোন বাজছে। উনি গলা উঁচিয়ে ডাকলেন,
— “এ্যাই ছেলে? বেরোবি না? তাড়াতাড়ি বেরো!”
ভেতর থেকে সাড়া নেই। হয় তো আওয়াজে শুনতে পায় নি। নাজিয়া দু’ সেকেন্ড পর ফের হাঁক দিলেন,
— “এ্যাই নিখিল! শুনছিস?”
ট্যাপ বন্ধ হলো। পানির ঝিরঝিরে শব্দটা কমে এলো। নিখিল জবাব দিলো,
— “হুম। থামো।”
— “থামো মানে? তোর ফোন বাজছে তো। কানে শুনিস না? কল রিসিভ করবে কে?”
একটু বাদেই বিখিলের জবাব,
— “রিসিভ করে দেখো তো কে! আমি গোসল সারছি…”
— “রাত-বিরেতে তোকে গোসল করতে হবে কেন? শুনি! এই শীতে— নিউমোনিয়া হলে দেখিস।”
রাগে গজগজ করতে করতে ফোনের কাছে এগোলেন। অনবরত বেজে চলেছে সেটা। কি এক রিংটোন ব্যবহার করে তার ছেলে। একটানা চ্যানচ্যানে আওয়াজ! উফ্! মাথা ধরে যায়! মুখ কুঁচকে ফোনটা হাতে তুলে নিলেন নাজিয়া। স্ক্রিনে গোল করে ভাসছে একটা মেয়ের ছবি। চমৎকার রূপবতী এক মেয়ে। নিচে ইংরেজিতে লেখা,
“Charulota Jafrin”
কে এই মেয়ে? নিখিলের সঙ্গে চাকরী করে না-কি? কলিগ? ভাবতেই ভেতর থেকে ছেলের গলা শোনা গেলো,
— “আম্মি, রিসিভ করলে? কে এলে?”
— “হুঁ, করছি।”
— “তাড়াতাড়ি করো।”
তাড়া দেয়ায় আর কিছু ভাবলেন না তিনি। স্ক্রিনের জ্বলজ্বলে সবুজ অংশে সোয়াইপ করে সেলফোনটা কানে চাপলেন। ওপাশ থেকে মেয়েলি মিষ্টি স্বর ভেসে এলো,
— “আসসালামু আলাইকুম, নিখিল সাহেব। কেমন আছেন?”
এই কোকিলা কণ্ঠি নারীর পরিচয় কি? জানতে উদগ্রীব হলেন নাজিয়া। সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
— “ওয়ালাইকুম আসসালাম। নিখিল নেই, মামণি। আমি ওর মা বলছি।”
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। চারু থমকালো। নিখিলের মা বলছে? কেন? নিখিল কোথায়?
— “নিখিল নেই?”
— “ও তো শাওয়ার নিতে গেছে। তুমি কে বললে না তো? ওর কলিগ?”
চারু আবারও সময় নিলো। কি পরিচয় দেবে এখন? নিখিলের বন্ধুর ছোটবোন? ধুর, সে পরিচয়ে আবার কিছু হয়। তবে? সে কি করে বলবে ‘আপনার পুত্রের প্রণয়িনী আমি’? এ কি বলা যায়? একে তো লজ্জার কথা, তার উপরে—
একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে স্বপ্রতিভ গলায় বললো,
— “জ্বি না, আন্টি। আমি চারুলতা জাফরিন। আপনার সঙ্গে কখনো কথা হয় নি আমার। আশা করি ভালো আছেন। একটা প্রয়োজনে কল দিয়েছিলাম। ফিরলে তাকে বলবেন। পরিচয়টা নাহয় উনিই দেবেন!”
বাহ্, মেয়েটার বলবার ভঙ্গি তো দারুণ! নাজিয়ার ভীষণ পছন্দ হলো এই অচেনা মেয়েকে। কলিগ নয় তবে এ কে? নিখিল প্রেম করছে? ও-মা! ‘তুমি কি ওর প্রেমিকা?’ — প্রশ্নটা করতে গিয়েও করা হলো না, ওপাশ থেকে মেয়েটার নির্মল ঝরঝরে কণ্ঠ,
— “রাখছি, কেমন? ভালো থাকবেন আন্টি!”
কল কেটে গেল। বিস্ময়াহত নাজিয়া স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো নিখিল। হাতের টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে মার উদ্দেশ্যে বললো,
— “কে কল দিয়েছিল, মা? বললে না?”
সেলফোনটা পূর্বের স্থানে রেখে ছেলের দিকে সরু চোখে তাকালেন,
— “চারুলতা জাফরিন কে রে? কল দিয়েছিল!”
হুট করে মায়ের কথা শুনে চমকে উঠলো নিখিল। ত্বরিত কর্মরত হাত দু’ খানি থেমে গেল। বিমূঢ় বনে নিস্পলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার দিকে। নাজিয়া এগিয়ে এলেন কয়েক পা। কোমড়ে হাত রেখে বললেন,
— “তুই প্রেম করছিস, বলিস নি কেন হুঁ?”
মার বলার ধরণ দেখেই হেসে ফেললো নিখিল। যদিও হাসা উচিৎ না। কঠিন পরিস্থিতি। তবুও হাসি আটকানো গেল না।
নাজিয়া থমথমে মুখে বললেন,
— “হাসছিস কেন, বজ্জাত ছেলে!”
— “তুমি এমন অ্যাটম বোlমের মতো ফুলে আছো কেন মা? কি হাস্যকর দেখাচ্ছে জানো?”
হাসতে হাসতে বললো নিখিল। নাজিয়া রাগে ফেটে চৌচির,
— “বদমাশ! ঢং করবি না কিন্তু। আসল কথা বল আগে! কতোদিন ধরে চলছে এসব? শুধু প্রেম না বিয়েও করে রেখেছিস? হুঁ?”
হুংকার দিয়ে উঠলেন। নিখিল এসে মাকে আগলে নিল। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— “বলছি তো। হাইপার হচ্ছো কেন?”
— “না, আগে বল। বিয়ে করেছিস? না শুধু প্রেম— বল।”
তেঁতে উঠলেন। নিখিল হাসলো,
— “তুমি যে কি-না, আম্মু! বিয়ে করবো কেন? তাও তোমায় না জানিয়ে, একটু আধটু কথা হয়—”
— “কবে থেকে? বলিস নি কেন আমাকে?”
ক্রোধানল কমলো জননীর। বদৌলতে অভিমানি কণ্ঠে অনুযোগ করলেন। নিখিল শান্ত করবার চেষ্টা করলো তাকে,
— “বেশিদিন হয় নি। আমি জানাতাম তোমাকে। কিন্তু—”
— “জানাতি, না? মিথ্যুক!”
— “ওওও মা! শোনো তো—”
মাকে বুঝিয়ে খাবার ঘরের দিকে এগোলো নিখিল। খেতে খেতে ধীরে-সুস্থে বলবে সব।
চলবে___
#মৌরিন_আহমেদ
(পরবর্তী পর্ব পেতে পেইজে লাইক-ফলো দিয়ে সঙ্গে থাকুন। গল্প আপলোড দেয়া মাত্র নিউজফিডে পৌঁছে যাবে ❤️)
[যে মানুষটির সঙ্গে ফোটনের বিয়ে ঠিক হয়েছে তাকে দেখে ওর একটুও পছন্দ হলো না। গোমড়ামুখো বিদ্যেধরী সেই পুরুষটিকে দেখেই ফোটন নাক কুঁচকে মনে মনে ভাবলো,
–এ আমায় বিয়ে করে করবে কি? সোহাগ করবে, না মাস্টারি?
হ্যাঁ, ফোটনের বরটি পেশায় একজন মাস্টার। প্রাইমারি স্কুলের নয়, কলেজের মাস্টার। ভদ্র ভাষায় বললে ‘প্রভাষক’। নাম হলো, খন্দকার জাফর। নামের মধ্যেই কেমন একটা অহংকার মিশে আছে না? অন্তত ফোটনের তাই মনে হচ্ছে। ইসস, খন্দকার! কেমন ঢং ওয়ালা নাম। শুনেই গা জ্বলে ওঠে!
চেহারাটাও তেমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নয়। ফর্সা ছিল বোধ হয় কোনো কালে! এখন তামাটে বর্ণ হয়েছে। আয়ত চোখ, উঁচু নাক আর গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সোফায় বসে থাকায় উচ্চতাটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে আন্দাজ করা যায়, গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে একটুখানি লম্বা। কিন্তু তাতে কি?
নায়কোচিত কোনো হাবভাব তো নেই। রাশভারী গাম্ভীর্য, মার্জিত, মেপে মেপে কথা বলার ভঙ্গি দেখেই নিজের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের মানুষটির প্রতি অদ্ভুত এক বিরক্তিতে মনটা ভরে এলো। বসার ঘরের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পাত্রের মুখখানায় দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হলো না আর। সবেগে পর্দা উড়িয়ে নিজের উপস্থিতির কথা সক্কলকে জানিয়ে, দর্প নিয়ে হেঁটে ফিরে গেল ঘরে!
পাত্র তার পছন্দ হয় নি, একটুও নয়!
ঘরে গিয়ে পৌঁছানো মাত্রই পিছু পিছু চলে এলো মায়মুনা বেগম। একমাত্র কন্যারত্নের এই বেত্ত্মিজ আচরণ দেখে শাসাতে এসেছেন তিনি। কিসব ব্যবহার এগুলো?
রাগ করে বললেন,
–এসব কি ফোটন? তুই ওখানে দাড়িয়ে ছিলি কেন? আর এলি যখন চুপ করে আসতে পারিস নি? হস্তিনীর মতোন আসবার কি দরকার?
মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরলো ফোটন। আদুরে গলায় বললো,
–গোমড়ামুখো প্যাঁচাটাকে আমার পছন্দ হয় নি, আম্মা। আমি বিয়ে করবো না।
–বিয়ে না করলে কি করবি, মা?
মায়মুনা বেগম স্নেহাতুর হয়ে তাকান। ফোটনের বয়স উনিশ চলছে। তাদের মফস্বল শহরে মেয়ে বিয়ে দেয়ার এই তো উপযুক্ত সময়! জেদী বাচ্চার মত মাথা নাড়ে ফোটন,
–জানি না!
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন মায়মুনা। মেয়ের চিবুক ধরে উঁচু করলেন মুখটা। বললেন,
–মেয়েদের বিয়ের বয়স হলে, বিয়ে করে নেয়াই ভালো। তোর আব্বারে তো চিনিস। নিজে যা বুঝে তাই করে। তার উপরে কারো বলার সাধ্য নাই। সে যে পাত্র দেখছে, তার সাথে বিয়ে হলে তুই সুখী হবি রে মা!
নীরবে সম্মতি দিলো ফোটন। ওই গম্ভীর ভালুকটাকে তার পছন্দ না হলেও করবার কিছু নেই; আব্বা বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন!
ফোটনের আব্বা ফারুক আহমেদ। স্থানীয় একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। একুশ বছরের চাকরী জীবনের শুরুতে ছিলেন পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। পদোন্নতি হয়ে অধ্যক্ষ হয়েছেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন বলেই হয় তো, তার চরিত্রে ‘মাস্টার মাস্টার’ ভাবটা স্থায়ী হয়ে গেছে। ঘরে – বাইরে সবজায়গায় তার কর্তৃত্ব। স্বৈরাচারী এই লোকটির ভয়ে তটস্থ ছাত্রসহ বাড়ির মানুষগুলো পর্যন্ত!
তার একমাত্র কন্যার আজ আংটি বদল। পাত্র তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীর সুযোগ্য ছেলে ‘খন্দকার জাফর’। যে নিজেও একজন সরকারি বেতনভুক্ত কর্মী, কলেজের শিক্ষক!
মিনিট ত্রিশেক পরেই নিচ থেকে ডাক পড়লো ফোটনের। ফারুক আহমেদ উঁচু গলায় ডাকলেন মেয়ের মায়ের উদ্দেশ্যে,
–মায়মুনা? মেয়েকে নিয়ে আসো।
লাল টুকটুকে শাড়ি পরা পুতুলের মতো জবুথবু হয়ে মেহমানের সামনে গেল ফোটন। মায়ের শিখিয়ে দেয়া পন্থায় কুশল বিনিময় করলো। তারপর চুপটি করে বসলো পাত্রের ঠিক মুখোমুখি। কথাবার্তা হলো। আংটি পরানোর পর মিষ্টিমুখ করানো হলো। এরপর পাত্রের পিতা খন্দকার জুলফিকার প্রস্তাবখানা পেশ করলেন,
–ফারুক ভাই, ছেলে-মেয়েদের আলাদা করে কথা বলা উচিৎ ছিল না?
এতক্ষণে ফোটনের স্বৈরাচার বাপের মনে হলো, কথাটা আসলেই যুক্তিযুক্ত। ছেলেমেয়েদের একান্তে কথা বলতে দেয়া উচিৎ। উত্থাপিত প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে তিনি মেঘমন্দ্র গলায় বললেন,
–ফোটন? যাও তো আম্মা, জাফররে ছাদটা ঘুরায় আনো। বাগান দেখাও।
বাপের কথায় দিরুক্তি করবার সাহস ফোটনের নেই, কোনোকালেই ছিল না। অতএব, পিতার আদেশ শিরোধার্য মেনে সে খন্দকার জাফরকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ছাদ দেখাতে নিয়ে গেল।
আগে ছেলেটাকে দেখা হয় নি। তাই ফোটন চাইলেই নিরিবিলিতে তাকে ভালোমত দেখে নিতে পারত। পাঁচ মিনিটের ক্ষুদ্র সময়ে ভালোমন্দ বলার সুযোগ না হোক, ভালো করে একটা মানুষকে দেখে তো নেয়া যায়?
কিন্তু অতিরিক্ত লাজুকতায় ফোটন তা পারলো না। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের সামনে পাত্রী হিসেবে দাড়াতে তার লজ্জায় – সংকোচে হাঁটু কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। মুখ তুলে চেয়ে দেখা হলো না মানুষটিকে। নিশ্চল নীরবতায় ছেদ ঘটিয়ে একটি চমৎকার পুরুষালি স্বর বলে উঠলো,
–তোমার নাম ফোটন? অদ্ভুত নাম তো!
কণ্ঠের গভীরতায় ফোটনের বুক কেঁপে উঠলো। আশ্চর্য তো! একটা মানুষ এত সুন্দর করে কীভাবে কথা বলতে পারে? রাশভারী আওয়াজ অথচ কি ঝরঝরে সুন্দর প্রতিটি উচ্চারণ! ফোটন একটু একটু করে গলতে লাগলো।
জাফর আবারও বললো,
–তুমি সাইন্সের ছাত্রী? ফোটন মানে জানো?
লজ্জায় মুখে কিছু বলতে পারলো না মেয়েটা। আরক্তিম চেহারায় কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে জানালো,
–হুঁ।
–বলো তো কি?
–আলোর কণা।
এই প্রথম মুখ খুললো ফোটন। জাফর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে স্বগতোক্তি করলো,
–তোমার কণ্ঠটা তো বেশ সুন্দর! অবশ্য তুমিও খুব সুন্দর…
শরমে মরে গেল ফোটন। ইচ্ছে করলো, একবার লোকটার মুখের দিকে তাকাতে। আড়চোখে একপল চেয়েও দেখলো। বিশেষ কোনো ব্যাপার চোখে পড়লো না বটে; তবে প্রথমবারের মত খারাপও লাগলো না।
ভালো লাগলো লোকটাকে। জাফর ফের প্রশ্ন ছুঁড়লো তার দিকে,
– সবে উচ্চ মাধ্যমিক দিলে, এখনই বিয়ে করতে চাইছ কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাও না?
ব্যস্! ফোটনের মেজাজটা বিগড়ে যাওয়ার জন্য একটা প্রশ্নই যথেষ্ট ছিল। হলো তো? ষোলোকলা পূর্ণ? মাস্টার সাহেব, মাস্টারি শুরু করলেন তো? সারাজীবন এক মাস্টারের খপ্পরে পড়েই কূল পায় নি, সঙ্গে আরও একজন যোগ হলে চলবে কি করে? বেশ তো কথা কইছিলে বাপু, ফের পড়ার প্রসঙ্গ আনা। কেন?
ফোটনকে চুপ করে থাকতে দেখে জাফরের রাশভারী সুর প্রতিধ্বনিত হলো পুনর্বার,
–তুমি বোধ হয় কথা কম বলো, না?
কথাটা একেবারেই মিথ্যে। কারো সঙ্গে একবার মিশে গেলে ফোটন যে কতো কথা বলতে পারে, তা তো ধারণায়ই নেই মাস্টার মশায়ের! তথাপি ফোটন সরলপানা মুখ করে বললো,
–জ্বি।
–তবে তো হলো না, আমিও যে কম কথা বলি? স্বামী – স্ত্রীতে বোবা হয়ে থাকবো নাকি?
বলেই হাসলো জাফর। গম্ভীর ভালুকটাকে হাসতে দেখে অবাক হয়ে তাকালো ফোটন। এই লোক হাসতেও জানে?
মুক্তোর মতো সাদা দাঁতের ঝলক আর বাতাসে ঝংকার তোলা সুন্দর হাসিটা দেখে ওর একমুহূর্তের জন্য মনে হলো, এই লোকটাকে সে পছন্দ করে ফেলেছে।
সম্ভবত একটু না, অনেক বেশিই!
____
চলবে।