#এই মন তোমাকে দিলাম (পঞ্চম পর্ব)
#ঈপ্সিতা মিত্র
কিন্তু এরপর সাত দিন বাদে ছেলেটা হিয়ার দেখা পেয়েছিল হঠাৎ, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। শেষ বিকেলের গোধূলি আলো ছড়িয়ে ছিল সেই সময় চারিদিকে। স্পন্দন ল্যাব থেকে বেরিয়ে কিছু ডকুমেন্টস জেরক্স করাতে যাচ্ছিল বাইরে। তখনই করিডোর থেকে দেখেছিল হিয়াকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে। হিয়া সেই সময় ওর ক্লাসেরই দুজনের সাথে কথা বলছিল। কিন্তু ও নিজেও সেই মুহূর্তে হঠাৎ খেয়াল করেছিল স্পন্দনকে। ওকে দেখে যেন ওরই দিকে এগিয়ে আসছিল ছেলেটা জোর পায়ে! ব্যাপারটা দেখেই হিয়া আর দাঁড়ায়নি। তাড়াতাড়ি নিজের কথা শেষ করে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল। তারপর বেশ তাড়াহুড়ো করেই বেরিয়ে গেছিল ক্যাম্পাস থেকে। কিন্তু স্পন্দন সবটাই লক্ষ্য করেছিল সেদিন। হিয়া যে ওকে দেখেও অদেখা করে চলে গেল; এটা বুঝেছিল স্পন্দন। তার মানে কি হিয়া ওর সাথে কথা বলতে চায় না! এটা ভেবেই কেমন খারাপ লাগা তৈরি হয়েছিল মনে।
কিন্তু এরপরের দিনও একই ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন লাইব্রেরীতে স্পন্দনের মুখোমুখি হয়েছিল হিয়া। তবে স্পন্দন আজ ওকে যেতে না দিয়ে নিজেই ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল দেয়ালের মতন। তারপর খুব স্থির গলায় বলেছিল,
——-” তুই কেন করছিস এরকম! আমার ফোন ধরছিস না! আমার সাথে দেখা হলে কথা বলছিস না? কেন করছিস এইভাবে বিহেভ?”
এই কথায় হিয়া আজ খুব কম কথায় বলেছিল নিজের চোখটা নামিয়ে,
——” আমাদের আর কথা না বলাই উচিত। যাইহোক, ক্লাস আছে আমার। যেতে হবে।”
কথাটা কোন রকমে শেষ করে হিয়া নিজেই স্পন্দনের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছিল লাইব্রেরী থেকে।
তবে এবার যেন স্পন্দনের ধৈর্য্য শেষ হয়ে যাচ্ছিল কেমন। হিয়ার কাছ থেকে এই দূরত্বটা একসেপ্ট করতে পারছিল না ও কোনভাবেই। তাই পরেরদিন ও নিজে এসে হাজির হয়েছিল হিয়ার মাসির ফ্ল্যাটে। এখানে যদিও স্পন্দন আগে এক দুবার এসেছে; তাই সুকন্যার সাথে আলাপ আছে ওর। যাইহোক, সেদিন তবে সুকন্যা বেশ অবাক হয়ে গেছিল শান্ত স্বভাবের স্পন্দনকে এরকম অস্থির, এলোমেলো দেখে! তাই কথা না বাড়িয়ে হিয়াকে ডেকেছিল ড্রইং রুমে স্পন্দনের সাথে কথা বলার জন্য।
সেদিন হিয়া ড্রইং রুমে এসেই তবে কেমন থমকে গেছিল। স্পন্দন এখানে কি করছে! কথাটা ভাবতেই স্পন্দন বলেছিল বেশ কঠিন স্বরে,
——” কথা আছে তোর সাথে আমার। ছাদে যাবি?”
না, হিয়া এটা শুনে আর না করেনি ওকে, কারণ স্পন্দনকে আজ সত্যিই ভীষণ অস্থির লাগছিল যেন।
তবে সেদিন ছাদে আসতেই স্পন্দন বেশ চেঁচিয়ে বলেছিল হিয়াকে,
——” তোর কি হয়েছে একটু বলবি আমাকে? প্লিজ! একদিন, শুধু একদিন আমি রাগ করেছি তোর ওপর। তার জন্য তুই এইভাবে কথা বন্ধ করে দিবি! আমাকে দেখলে এইভাবে এভয়েড করবি! এমনকি তুই আমার কল অব্দি রিসিভ করছিস না এতদিন ধরে! মানছি, সেদিন ভুল ছিল আমার। আমি জন্মদিনের দিন তোকে টাইম দিতে পারিনি! এন্ড এম সরি ফর দ্যাট.. আর সুচেতার ব্যাপারে তোর ওপর রাগ দেখানোর জন্যও সরি.. কিন্তু তার জন্য তুই এইভাবে শাস্তি দিবি আমাকে? একদম বন্ধুত্বটাই শেষ করে দিবি!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল স্পন্দন। কিন্তু হিয়া এই মুহূর্তে খুব কষ্ট থেকেই বলেছিল ওকে,
——” সরি বোলো না প্লিজ! তুমি কোন ভুল করোনি। আর আমি কোন শাস্তিও দিচ্ছি না কাউকে। আসলে প্রবলেমটা আমার! আমি ফিল করি তোমার জন্য, মোর দ্যান আ ফ্রেন্ড.. আজ থেকে না, অনেক বছর ধরে। সেই জন্য নিজের লিমিটটা ক্রস করে গেছিলাম সেইদিন। সেই জন্য সুচেতাদি কে নিয়ে এত ইন্সিকিউরিটি ছিল আমার! তবে তোমার জন্মদিনে আমি একটা কথা বুঝেছি, যে এই ফিলিংসগুলো এক তরফা। আর এতে কোন দোষ নেই তোমার! কেউ কারোর জন্য ফিল না ই করতে পারে। তবে, আমি আর পারবো না। তোমার সাথে কথা বললে, টাইম স্পেন্ড করলে আরো বেশি করে জড়িয়ে যাবো এই ফিলিংস গুলোর সাথে! আর একতরফা কষ্ট পাবো শুধু। কেউ সঙ্গে থেকেও দূরে থাকার কষ্ট। তাই আমাদের কথাবার্তা এখানেই শেষ করতে হবে। এন্ড এম রিয়ালি সরি ফর অল অফ দিজ.. ভালো থেকো খুব।”
কথাগুলো কিরকম নিজের মনে বলে গেছিল হিয়া। তবে এই মুহূর্তে স্পন্দনও যেন কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছিল হঠাৎ! হিয়াকে দেওয়ার মতন কোন উত্তর নেই আসলে ওর কাছে। হিয়া যে ওর জন্য ফিল করে, এটাই জানা ছিল না এতদিন! আর নিজেও তো কখনো ভেবে দেখেনি এইভাবে। হিয়া ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু আলাদা করে তো ওকে নিয়ে ভাবেনি কখনো স্পন্দন! কথাগুলো ভাবতেই খেয়াল করলো হিয়া ছাদটা খালি করে দিয়ে চলে গেছে এই মুহূর্তে। তবে স্পন্দনও যেন কেমন কথাহীন হয়ে গেছে হঠাৎ! মনে হচ্ছে হিয়াকে না বুঝে ভীষণ হার্ট করে ফেলেছে ও। আর সত্যিই সব কিছু আর আগের মতন হবে না কখনো। দুজনের মধ্যে একটা নিঃস্তব্ধতার দেয়াল থাকবে হয়তো সারা জীবন!
<৯>
এই মন খারাপের বিকেল পেরিয়ে আরো কটা মাস কেটে গেছে শহর থেকে। তবে স্পন্দন আর হিয়ার মাঝে আজও সেই নিঃস্তব্ধতার পাহাড়। আসলে স্পন্দন বুঝতে পারে না সেদিন বিকেলের পর কিভাবে আবার কথা শুরু করবে হিয়ার সাথে! আর সত্যিই তো এতদিন মিশেও ও বোঝেনি হিয়ার মন। বোঝেনি হিয়া ফিল করে ওর জন্য! আসলে স্পন্দন তো নিজের কেরিয়ার আর পড়াশুনা ছাড়া কখনো অন্য কিছু ভাবেনি জীবনে। আর হিয়া ওর খুব ভালো বন্ধু। নিজের ভীষণ সিরিয়াস একটা জীবনে কিছু হাসি মজার মুহূর্ত নিয়ে আসে যে; এমন একজন মানুষ। যার সাথে স্পন্দন একদম বেহিসেবী ভাবে কথা বলতো, সহজ ভাবে মিশতে পারতো।
কথাগুলো আজ ভীষণ ভাবে মনে হয় ওর। যখন একই ক্যাম্পাসে দেখা হলেও হিয়া নিঃশব্দে চলে যায় চোখ নামিয়ে, যখন আর হঠাৎ করে ওর ঘরে এসে বকবক শুরু করে দেয় না অকারণে, যখন নিজের বই খাতা নিয়ে পড়তে আসে না স্পন্দনের কাছে, এলোমেলো কথা বলে হেসে ওঠে না জোরে! এই সমস্ত কিছুই যেন ভীষণভাবে মিস করে স্পন্দন। আসলে এই বন্ধুত্বটার, হিয়ার বকবক শোনার, অভ্যেস হয়ে গেছে ওর; এতগুলো বছর ধরে। তাই হিয়ার না থাকাটা যেন মানতে পারে না ও! একটা ব্যাস্ত দিনের মাঝে সারাক্ষণই কিরকম খালি খালি লাগে রোজ। মনে হয় সমস্ত কিছুর মাঝেও কিছু একটা নেই! সবাই থেকেও খুব একলা স্পন্দন।
তবে এই ব্যাস্ত শহরে শুধু একলা স্পন্দনই না, হিয়াও একা ভীষণ। আসলে যখন নিজেকে জোর করে কারোর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়, যখন এতদিনের ফিলিংসগুলোকে বাক্স বন্দি করে বন্ধ করে রাখতে হয় সবার আড়ালে, তখন কষ্ট হয় ভীষণ! বার বার সেই চেনা নাম্বারে চোখ চলে যায়। বার বার ইচ্ছে হয়, একবার অন্তত গলার আওয়াজটা শোনার! কিছু কথা বলার! কিন্তু তারপর নিজেকেই বোঝাতে হয়, যে সম্ভব না। আর কথা বলা সম্ভব না। আর সেই মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো সম্ভব না। আসলে কেউ কাউকে ভালোবাসলে তো শুধু ভালোবাসাই ফেরৎ চায় সে! তাকে শুধু বন্ধু ভাবা, সম্ভব না।
যাইহোক, এই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার মাঝে হিয়া বদলে গেছে অনেক। আগের মতন হাসি, কথা আর আসে না কারোর সাথেই বিশেষ। তবে এই মন খারাপের ভিড়ে একজন নতুন বন্ধু হয়েছে ওর। উজান। ছেলেটা সুকন্যার কাছে ভ্যাওলিন শিখতে আসে। আসলে ছোট থেকেই ভ্যাওলিন বাজানোটা সুকন্যার হবি। কিন্তু চাকরি জীবনে সেই হবি নিয়ে চর্চা করার বেশি সময় পায়নি! তাই রিটায়ারমেন্ট এর পর হঠাৎই চর্চা শুরু করেছে। আর দু দিন ধরে মিষ্টি ভ্যাওলিন এর সুর শুনে পাশের ফ্ল্যাট থেকে উজান এসে হাজির। ভ্যাওলীন বাজানো শিখবে বলে! যাইহোক, ও আসাতে হিয়া আর সারাক্ষণ চুপ থাকতে পারে না। উজান এসে এলোমেলো বকবক করেই যায়। আসলে ছেলেটা কথা বলতে খুব ভালোবাসে। তাই নতুন কাউকে দেখলেই আলাপ জমিয়ে ফেলে! তারপর এই এক মাস আগে তো হঠাৎ এসে হিয়াকে বললো,
——-” ফেসবুকে দেখলাম সুকন্যা মাসির জন্মদিন আজ। চলো, একটা সারপ্রাইজ দিই। সব এরেঞ্জমেন্টস এ তোমার হেল্প কিন্তু দরকার আমার!”
কথাগুলো শুনে হিয়ার ভালো লাগলো বেশ। আসলে এই হিসেবী পৃথিবীতে কজন পারে কাউকে এইভাবে আনন্দ দেয়ার কথা ভাবতে! তাই উজানের সাথে মিলেই হিয়া কেক কিনে আনা, রুম ডেকরেশন, সব করেছিল। ততক্ষণ সুকন্যা বাজারে ছিল। তবে বাড়ি ফিরেই কেমন থমকে গেছিল যেন! নিজের জন্মদিনে এরকম স্পেশ্যাল কিছু হবে ভাবেনি! যাইহোক, সেদিন মাসির হাসি মুখটা দেখে হিয়ার এত ভালো লেগেছিল যে উজানকে নিজের বন্ধুর জায়গাটা দিতে আর একবারও ভাবেনি ও। আসলে আজ এই আনন্দের মুহূর্ত গুলো তো উজানের জন্যই তৈরি হলো জীবনে!
যাইহোক, এইদিনের পর ও বাড়ি ফিরে এসেছিল নিজের। তবে উজানের সাথে বন্ধুত্বটা রয়েই গেছে। এর মধ্যে আবার ছেলেটা একদিন ওর কাছে এসে অদ্ভুত একটা হেল্প চেয়েছে। উজানের তৈরি শর্ট ফিল্মে অভিনয় করার জন্য খুব করে রিকুয়েস্ট করেছে হিয়াকে দুদিন ধরে। আসলে উজান গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে মাস কম নিয়ে পড়ছে। আর ওদের নতুন একটা প্রজেক্ট দিয়েছে পনেরো মিনিটের একটা শর্ট ফিল্ম বানানোর জন্য। তাই ও হিরোইনের খোঁজে হিয়ার স্মরণাপন্ন হয়েছে অবশেষে। আসলে সুকন্যার কাছে উজান গল্প শুনেছিল, যে হিয়া স্কুল কলেজের এনোয়াল প্রোগ্রামে নাটক করতো নিয়মিত। তাই হিয়াকে ছাড়া ওর গতি নেই! আর ছেলেটা এত বেশি সাধ্য সাধনা করেছে হিয়ার সামনে, যে ওকে শেষ অব্দি রাজি হতেই হয়েছে একটিং করার জন্য।
সেই শর্ট ফিল্মেরই শুটিং করতে এসেছিল আজ উজান। হিয়াদের বাড়ির ছাদেই হিয়ার সিঙ্গেল শট গুলো নেবে ও। সেই মতন ক্যামেরা হাতে বিকেলবেলা ছাদে গেছিল ছেলেটা হিয়ার সাথে! তারপর সিন বুঝিয়ে দেওয়া, বার বার টেক নেয়া, শটের মাঝে হিয়ার চুল ঠিক করে দেয়া, আর কাজের বাইরে অনেক সময়েই অকাজের কথা বলে ওঠা, এইসবই করছিল সারা বিকেল ধরে।
তবে আজ হঠাৎ পড়ার ঘর থেকে এই দৃশ্যটা দেখে কেমন থমকে গেছিল যেন স্পন্দন! বই নামিয়ে ও স্থির হয়ে গেছিল হিয়ার সাথে ওই ছেলেটাকে দেখে। ছেলেটা এত কি বকবক করছে হিয়ার সঙ্গে! তারপর ওর চুল ঠিক করে দিচ্ছে! ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছে! এসব হচ্ছে টা কি! কিছুই যেন বুঝতে পারছিল না ঠিক। তবে এই মুহূর্তে কেমন ভিতরটা জ্বলতে শুরু করেছিল ওর। একটা অদ্ভুত রাগ এসে জমা হয়েছিল মনে। হিয়াকে এই ছেলেটার সাথে দেখে অসহ্য লাগছিল যেন সব কিছু।
চলবে,,