উত্তরাধিকার (১ম পর্ব)
লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি
*************************
গতরাতেও ঠিকমতো ঘুম হয়নি বেলা চৌধূরীর।গাইনী ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার পর থেকে মনটা ভার হয়ে আছে তার!
ডাক্তার কোনো আশ্বাসই এবার দিতে পারেন নি।
এর আগে ছেলেকে দিয়ে বৌকে চেন্নাই ও পাঠিয়েছিলেন দু’বার।
সেখান থেকে তারাও এসিওর করেছে যে তার একমাত্র ছেলে রাফিজ আর বৌমা প্রিয়ন্তী দুজনই ফিজিক্যালি ফিট।
তাদের কোন সমস্যা নেই!
আল্লাহ চাহেতো যে কোনো দিন সুসংবাদ শোনাবে তার বড় বৌমা প্রিয়ন্তী!
কিন্তু বেলা চৌধুরীর মন তাতে ভেজেনি কারন এই স্তোকবাক্য তিনি গত পাঁচবছর ধরে শুনে আসছেন যে প্রিয়ন্তীর মা হতে কোনো বাধা নেই!
গাইনোকলজিষ্ট রেহানা শিকদার তার একজীবনের ক্লাসমেট ছিলো!সে প্রতিনিয়তই সান্তনা দিয়ে আসছে তাঁর ছেলে রাফিজ যে কোনো দিনই বাবা হবার সৌভাগ্য অর্জন করবে!
কিন্তু সেই সৌভাগ্য আজো ধরা দেয়নি বেলা চৌধুরীর কাছে!
স্বামী মারা যাবার পর থেকে বিগত পঁচিশ বছর ধরে স্বামীর রেখে যাওয়া বিশাল সম্পত্তি পাহাড়া দিয়ে আসছেন বেলা চৌধুরী একা।
এক হাতে সামলেছেন ব্যবসা আর একমাত্র ছেলে রাফিজকে !তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, মানুষ করেছেন।ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছেন এক শিল্পপতির সুন্দরী মেয়ের সাথে।বাবার ব্যবসা সে’ই এখন দেখাশোনা করছে।সপ্তাহে দুদিন দেশে থাকলে বাকী পাঁচদিন দেশের বাইরে দৌড়ায় সে!
কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললেও আসল জায়গাতে এসেই আটকে গেছেন তিনি।
তার বংশের একটি প্রদীপ নেই যে তার ভবিষ্যত জীবনকে আলোকিত করবে!তাঁর একটি ওয়ারিশ দরকার যা প্রিয়ন্তী তাকে দিতে পারছেনা।কাউকে দত্তক নেয়াও চলবেনা কারন সেটি তো আর তার বংশের কেউ হবেনা! আবার তিনি যে,প্রিয়ন্তীকে রেখে কিংবা বাদ দিয়ে ছেলেকে আরেকটি বিয়ে করাবেন! সেটিও সম্ভব নয়।
কারন প্রিয়ন্তী ধনী বাবার আদরের মেয়ে। প্রিয়ন্তীর বাবা পান থেকে চুন খসলে বেলা চৌধুরীকে ছেড়ে কথা কইবেন না এটা বেলা চৌধুরী ভালোই বোঝেন !
এদিকে তার এতবড় সম্পত্তির উত্তরাধিকারীর অভাবে নষ্ট হয়ে যাবে, বারো ভুতে এটাকে লুটে পুটে খাবে এটাও তিনি মেনে নেবেন না!তিনি কোনোভাবেই এটা হতে দিতে পারেন না!
*
তাঁকে কিছু একটা করতেই হবে।যে করেই হোক তাঁর একজন উত্তরাধিকারী লাগবেই। তাঁর জীবদ্দশায় যদি তিনি এ সমস্যার সমাধান না করে যান তবে এটি সমস্যাই থেকে যাবে,সমাধানের মুখ আর দেখবেনা!
নানান চিন্তায় রাতে পাগলের মতো লেগেছিলো বেলার।
সকালের দিকে চোখটা লেগে এসেছিলো !
কিন্তু হতচ্ছাড়া বেলের শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো তাঁর !
কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ঘুম না আসায় উঠে পড়লেন তিনি!
বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ছিটা দিলেন !তারপর বাইরে এসে ড্রইংরুমের দিকে যেতেই সুললিত কন্ঠের ক্বুরআনের তেলাওয়াৎ শুনে থমকে গেলেন।
★
মনে পড়লো,প্রিয়ন্তী এসময় কুরআন পড়তে বসে এক মহিলার কাছে!মাসখানেক ধরেই শিখছে সে।
ও নাকি একদমই ক্বুরআন পড়তে জানেনা তাই নিজেই কোন এক বান্ধবীর মাধ্যমে এক মাদ্রাসা শিক্ষিকাকে খুঁজে বের করেছে যে তাকে প্রতিদিন বাড়ী এসে ক্বুরআন পড়তে শিখিয়ে দিয়ে যাবে!নিঃসন্দেহে খুবই ভালো উদ্যোগ।বেলাও সায় দিয়েছেন এতে!
★
বেলা চৌধুরী ঘরে চলে আসতে গিয়েও কি ভেবে ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়ালেন।ভাবছেন,যে মেয়েটা পড়াতে আসে ওকে একবার বলে দেখবে নাকি যে,সন্তান ধারনের কোনো আমল বা তাবিজ কবজের কথা ওর জানা আছে কিনা!
মাদ্রাসায় যখন পড়ায় এ ব্যপারে কিছু জানলেও জানতে পারে!
এসব ভেবে মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি!
বেলা চৌধুরীকে প্রবেশ করতে দেখে মেয়েটি তার পড়া থামালো!
সালাম দিলো বেলা চৌধুরীকে!
বেলা চৌধুরী মাথা নাড়লেন।
মেয়েটি সামান্য হেসে বললো-“আন্টি সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব।ওভাবে মাথা নাড়াটা কিন্তু সুন্নত সম্মত নয়!”
বেলা চৌধুরী মেয়েটার দিকে কৌতুহলী চোখে তাকালেন!বাহ্,বেশ স্মার্ট মেয়ে তো! ওর দিক থেকে চোখ না সরিয়ে সালামের জবাব দিলেন তিনি!
তারপর প্রশ্ন করলেন-“বাড়ীতে কে কে আছেন তোমার?”
মেয়েটি স্মিতহাস্যে জানালো ওরা পাঁচবোন।মেয়েটি সবার বড়ো!বাবা নেই!মা আর চার বোনকে নিয়েই তাদের সংসার।বোনেরা সবাই লেখাপড়া করে! দুজন মাদ্রাসায় আর ছোটো দুজন স্কুলে!
বেলা চৌধুরী সরাসরিই প্রশ্ন করলেন-‘তোমাদের সংসার চলে কি করে?”
মেয়েটি মৃদু হেসে বললো-“আল্লাহতা’লাই চালান!”
-“তা তো বুঝলাম।কিন্তু আল্লাহ তো আর আসমান থেকে টাকাপয়সা ফেলেননা। মানুষকে তো কিছু না কিছু করে খেতে হয়।না করলে সে খাবে কি?তুমি মাদ্রাসায় আর ক’টাকাই বা বেতন পাও?এতগুলো বোন আর মা’কে নিয়ে সংসার চলে?”
মেয়েটার হাসি কিছুটা মলিন হলো!সে নম্র অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললো-“আল্লাহপাক সাত আসমানের উপর আরশে আছেন।তিনি সেখান থেকেই তাঁর রহমতের বৃষ্টি জমিনে বর্ষণ করেন।আল্লাহ আসমান থেকে না ফেললে জমিনে কেবল হাত পা নেড়েই অনেকে অনেক কিছু করে ফেলতে পারতো!শুধু হাত পা নাড়লে আর চেষ্টা তদবীর করলেই যদি চলতো তাহলে মানুষ আল্লাহর কাছে সাহায্য ভিক্ষা চাইতো না!আমি হাত পা নেড়ে যে টাকা আয় করি তা দিয়ে আমাদের সংসার চলা মুশকিল হতো যদিনা আল্লাহ আসমান থেকে তাঁর রহমতের বারিধারা বর্ষণ না করতেন।আল্লাহর ঐ অশেষ রহমতের কারনেই আমরা অন্য অনেকের চেয়ে ভালো আছি !”
-“হমম….!”
বলে বেলা মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকালেন।মেয়েটির বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর শুনে তিনি মনে মনে কিছুটা চমকে গেলেন।
তবে মেয়েটির মনের উষ্মা কিছুটা টের পাওয়া গেলো!মেয়েটি তার কথা শুনে হয়তো কিছুটা রেগে গিয়ে থাকতে পারে।ওকে আরেকটু বাজিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো বেলার।
প্রিয়ন্তী ওদের কথা বলতে দেখে উঠে ঘরে গেলো!বেলা অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়েটার দিকে।কমদামী একটা কালো বোরকা পড়ে আছে মেয়েটা।চেহারাটা সাদামাটা তবে মায়াকাড়া।
কথাবার্তায় যথেষ্ট ;বুদ্ধিমত্তার ছাপ রয়েছে!বেলা বললেন-
-“তাহলে তুমি বলতে চাও,আল্লাহ আসমান থেকে রহমত ফেলেন বলেই তোমরা কম উপার্জনেও ভালো আছো?”
মেয়েটা মৃদু হেসে বললো-
-“জ্বী,আলহামদুলিল্লাহ!”
-“তা,আল্লাহর রহমত না থাকলে হাত পা নেড়েও কেউ ভালো থাকবেনা বলতে চাচ্ছো?”
-“জ্বী,অবশ্যই!কিছু যদি মনে না করেন আর অভয় দেন তো একটা কথা বলি?”
বেলা মাথা নাড়লেন-“বলো!”
-“উদাহরন হিসেবে আমি আপনার পরিবারকেই দেখাতে পারি!কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালছেন,ডাক্তার কবিরাজ এক করে ফেলছেন,বাংলাদেশ ইন্ডিয়া চষে ফেলেছেন একটি শিশুর মুখে দাদু ডাক শোনার জন্য!অথচ আপনার তো মাশাআল্লাহ টাকার অভাব নেই!আপনি কি ভালো আছেন,আন্টি?”
বেলা পুরো ফ্লপ মেরে গেলেন।মুখের হাসি মুছে গেলো!সত্যিইতো,মেয়েটিতো মিথ্যে বলেনি!সব কিছু থাকার পরেও তিনি আজ কাঙালীনি।তার বংশ নিবু নিবু প্রায় একটা প্রদীপের অভাবে।রাফিজের পরে তার বংশ আর কোনো উত্তরাধিকার পাবেনা।
মাথাটা আবার ধরে এলো!সেই পুরোনো চিন্তা আবার জেঁকে ধরলো তাকে।তিনি মেয়েটিকে বাচ্চা হবার তদবীর সম্পর্কেই জিজ্ঞেস করতে এসে অন্য কথায় পড়ে গেছেন।মেয়েটাকে সেই কথাটাই জিজ্ঞেস করতে হবে।মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতী চৌকস মনে হচ্ছে!
বেলা ওকে বললেন-“আচ্ছা,আমার বৌমার সন্তান হবার ব্যপারে কোনো ভালো তদবীর তুমি বলতে পারবে বা কোনো তাবিজ কবজ?যদিও আমি এসব মানিনা!”
মেয়েটা সহজ কন্ঠে বললো-
-“আলহামদুলিল্লাহ, যে আপনি তাবীজ মানেন না!তাবীজ ষ্পষ্ট শির্ক।আমাদের রাসুল সাঃ বলেছেন-“যে তাবীজ পড়লো সে শির্ক করলো!”তাই তাবীজ থেকে বেঁচে থাকা জরুরী।আর তদবীর বলতে সবচে বড় কথা হলো,প্রচুর ইস্তেগফার করুন আর রাতের নামাজ অর্থাৎ তাহাজ্জুদে কাঁদুন।তাহাজ্জু
দ হচ্ছে বান্দার সাথে আল্লাহর মোলাকাতের সবচে উত্তম সময়।আল্লাহ চাহে তো আপনার ঘর আলোকিত হবে ইনশাআল্লাহ। ঐ যে বললেন না,আল্লাহ আসমান থেকে ফেলে কিনা।জ্বী,আল্লাহর রহমত আসমান থেকে জমিনে বর্ষিত হয় ঠিকই কিন্তু দুহাত না পাতার কারনে সেই রহমত অনেক সময় আমাদের হস্তগত হয়না!আমরা নিজ গাফিলতিতে রবের রহমত বঞ্চিত হই।যে চায় সে পায়।
কেউ না পেলেও হতাশ হওয়া চলবেনা।সবর করতে হবে।এটাই একজন ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য।পেলে শোকর না পেলে সবর!”
,-“হমম….বুঝলাম।তা তোমার নাম কি?”
-“জ্বী,আমার নাম “নাজিয়াত!”
বেলা তীক্ষ চোখে তাকিয়ে বললো-“নাজিয়াত,তুমি খুব ভালো কথা বলতে পারো!হয়তো শিক্ষকতা করো বলে! ”
-“জ্বীনা,আন্টি!আসলে আমি শিক্ষকতার পাশাপাশি একজন দাঈ।অর্থাৎ মাদ্রাসার শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন ঘরোয়া মজলিশে আমি দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে থাকি।আর একজন দাঈ কে অকপট এবং প্রাঞ্জল কথা বলায় পারদর্শী হতে হয়।হয়ত সে কারনেই আপনার কাছে আমার কথাগুলো অন্যরকম মনে হচ্ছে!”
-“হমমম…তোমার কথাগুলো আমার ভালো লেগেছে।তা আমাদের বৌমা কেমন পড়ছে?”
-“জ্বী,ওনাকে আমি একেবারে গোড়া থেকে শুরু করেছি।যেন মাখরাজটা ঠিক করে নেয়া যায়!কারন উনি আগে যে মাখরাজে পড়া শিখেছেন সেটা ভুল।তাই নতুন করে ধরতে হচ্ছে!”
কথাবার্তার এ পর্যায়ে প্রিয়ন্তী এসে পড়ায় বেলা আর কথা বাড়ালেন না! উঠে পড়তে গিয়ে হঠাৎ ওনার মনে একটা চিন্তা বিদ্যুৎ গতিতে খেলে গেলো! বারান্দা পেরিয়ে ঘর পর্যন্ত আসতে গিয়ে চিন্তাটা উনাকে একেবারে আচ্ছন্ন
করে ফেললো!
অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি,প্রথমে প্রিয়ন্তীর সাথে তাকে কথা বলতে হবে তারপর রাফিজের সাথে।রাফিজ অবশ্য কোনো ফ্যাক্ট না!তিনি যা বলবেন রাফিজ সেটাই মানতে বাধ্য।তবে মেয়েটির সাথে খুব কৌশলে কথা বলতে হবে!মেয়েটা এমনিতেও খুব বুদ্ধিমতী।তার মনের খবর টের পেয়ে গেলে রাজী নাও হতে পারে।এজন্য আগে ওর সব খবর জানতে হবে,তারপর ওকে লোভ দেখাতে হবে।তারপর কার্যসিদ্ধি করতে হবে!
সব যদি ঠিক মতো চলে তাহলে তিনি হয়তো পেতে পারেন একজন উত্তরাধিকার!
যে তার বংশে প্রদীপ জ্বালাবে!
আর তার সেই অন্ধের ষষ্ঠীর বুদ্ধিটাও মনে হয় ভালোই হবে,প্রিয়ন্তীর মতো গবেট যে সে হবেনা তা ভালোই বোঝা যায় কারন যেমন মা তেমন ছা।
কারন নাজিয়াত আসলেই বড় বুদ্ধিমতী মেয়ে।
…..
চলবে…..