উত্তরাধিকার পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
2090

#উত্তরাধিকার
#শেষ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



মেহের এক ঘোষণার মাধ্যমে তার সব মিল ফ্যাক্টরি এমনকি বাসার নাম পরিবর্তন করে এগুলোর নতুন করে তার ছেলের নামে নাম করণ করেছে।সাঁজবাতির দায়িত্ব আরো বেড়েছে।মেহেরের অনুপস্থিতিতে সে-ই এসবের হর্তাকর্তা। দুটো ফ্যাক্টরি অলরেডি তার দায়িত্বে চলছে। এবং সে তার যোগ্যতা দিয়ে পরিচালনা করে দেখিয়ে দিয়েছে মেহেরের চেয়ে সে ব্যবসা বাণিজ্য ভালো বোঝে।মেহেরের স্বপ্ন আরো বাড়ছে।দুই স্বামী স্ত্রী মিলে কাজ করে অল্প কদিনের ভেতর দেশের সবচেয়ে বড় বিজনেস ম্যানের তালিকায় নাম উঠাবে তার।মেহেরের যেন আর তর সয় না!
বিপুলও বড় হচ্ছে। এবার সে চার বছরে পড়েছে। এই চার বছর বয়সেই সে অনেক পটু হয়ে উঠেছে।সব তার মায়ের খেল।সাঁজবাতি ছেলেকে গড়ে তুলেছে তার নিজের মতো করে।
ওদিকে এমপি সাহেবের সাথেও তার সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ়োতর হচ্ছে।এমপি সাহেব তার সাথে দেখা করতে চায়। কিন্তু সে এক্ষুনি দেখা করতে প্রস্তুত নয়।তার আরো একটি বছর সময় প্রয়োজন। এই এক বছরে সে আসল কাজটি করে ফেলবে।

বছর খানেক পর ডাক্তার সাবেরের সাথে যোগাযোগ করেছে সাঁজবাতি।সাবের বললো,’শালাকে একেবারে মেরে ফেলো।দেশে তো গুন্ডা পাণ্ডার কোন অভাব নাই।লাখ দুয়েক টাকা দিলে মেরে এমন হাল করবে যে লাশ দেখেও পুলিশ ঠাহর করতে পারবে না এই লাশ মানুষের না কুকুরের!’
সাঁজবাতি বললো,’না না এমন কিছু করা যাবে না।’
‘কেন করা যাবে না? তুমি তো ওকে মেরে ফেলতেই চায়ছো!’
‘ধীরে ধীরে ও মরবে।ধরো এমন কোন অসুখ হলো যাতে সে বিছানায় লেগে যায় একেবারে।হাত পা অচল হয়ে উঠে। এবং মৃত্যু দিনে দিনে ঘনিয়ে আসে।’
ডাক্তার সাবের বড় অবাক হলো।অবাক হয়ে বললো,’তোমায় আমি বুঝতে পারি না সাঁজ! ওটাকে ধীরে ধীরে মারার কী আছে বল তো?এতে কী লাভ তোমার?’
সাঁজবাতি হাসলো। হেসে বললো,’লাভ আছে। ধরো সে খুন হয়ে গেল অথবা হুট করে একদিন মরে গেল।তার মৃত্যুর পর কিন্তু সব জমি জমার মালিক হয়ে যাবে আমার ছেলে। বিপুল। জমি জমা মিল ফ্যাক্টরি ছেলের নামে না।আমি নিজের নামে করাতে চায়।’
সাবের প্যাঁচাতে থাকে। আসলে সে রহস্যটা জানতে চায় ভালো করে।তাই সে জিজ্ঞেস করে,’ছেলে থাকতে তোমার নামে জমি জমা কল কারখানা দলিল করে দিবে কেন তোমার হাসব্যান্ড?’
সাঁজবাতি হাসলো। হেসে বললো,:কারণ মেহের আমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। আমার উপর সে প্রবল ভরসা করে। হয়তোবা তার নিজের উপর নিজেরই অতটা ভরসা নাই যতোটা ভরসা আমার উপর তার আছে!’
ডাক্তার সাবের সবকিছু বুঝতে পেরে বললো,’অও।’
তারপর খানিক সময় চুপ করে থেকে ডাক্তার সাবের আবার বললো,’আমি নেক্সট উইকে ঢাকা আসছি।মেডিসিনটা তুমি নিজের হাতে এসে নিবে আমার কাছ থেকে। তৃতীয় কাউকে দিয়ে এসব করানো যাবে না।এতে ফেঁসে যাওয়ার পসিবিলিটি শত পার্সেন্ট!’
সাঁজবাতি বললো,’ঠিক আছে।হাতে হাতেই নিবো।’

এক সপ্তাহ পর ডাক্তার সাবের একটা ছোট্ট প্যাকেটে অল্প সাদা পাউডার দিয়ে গেল ওর কাছে। দিয়ে বললো, পানিতে মিশিয়ে খাইয়ে দিতে।যখন পানি চায়বে তখন দিলেই বেটার।
সাঁজবাতি ওর কথামতোই প্লান সাজালো।রাত নটায় বাসায় ফিরে মেহের। ওর ইদানিং কী এক অভ্যেস হয়েছে।অফিস থেকে ফিরেই সে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেতে চায়।পানি দিতে দেরি হলে রাগ করে।তাই কদিন ধরে সাঁজবাতি আগে ভাগেই গ্লাস ভর্তি করে টেবিলের উপর পানি রেখে দেয়।আজ আরো সুযোগ হলো।সাঁজবাতি আটটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই এক গ্লাস পানিতে পাউডারটা ভালো করে মিশিয়ে রেখে দিলো। তারপর কিচেনে গেল বাজিটা গরম করতে।
কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস।মেহের বাসায় ফিরে যেইনা গ্লাসটা নিয়ে জল পান করতে যাবে ঠিক তখনই তার ঘুমন্ত ছেলে বিছানায় উঠে বসে হুট করে বললো,’বাবা পানি খাবো।’
ছেলে পানি খাবে বলে কথা!মেহের সঙ্গে সঙ্গে নিজের পানি পান করা রেখে গ্লাসটা এনে ছেলের ঠোঁটের কাছে ধরলো। ছেলের পানি খাওয়ার আবদার কিচেনে থেকেও শুনেছিল সাঁজবাতি। শোনেই তার মন কেমন করে উঠলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে ওখান থেকে দৌড়ে এলো সে । কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারলো না। ততোক্ষণে সাঁজবাতির পাঁচ বছর বয়সী ছোট্ট বিপুল এক গ্লাস পানি পুরোটাই ঢক ঢক করে গিলে ফেলেছে!

পৃথিবীতে কতো শতো রহস্য বিদ্যমান। সেইসব রহস্যের কূল কিনার খুঁজে পাওয়া ভার। এই ঘটনাটিও কী এমন নয়?বাবা আর মায়ের ভয়ংকর পাপ নিষ্পাপ একটি ছেলের জীবন নষ্ট করে দিলো!
এই বিষাক্ত পানিটা খাওয়ার এক সপ্তাহ পরেই বিপুল বিছানায় পড়ে গেল। ছোট্ট একটা ছেলে সারা জীবনের জন্য অচল হয়ে পড়েছে।হাত পা শরীর কোন কিছুই আর সে নড়াতে পারে না।কী ভয়াবহ রোগ।
সাঁজবাতি খারাপ হলেও মা।বিপুলকে জন্ম দিয়েছে সে।তাই নিজেকে সে ক্ষমা করতে পারলো না কিছুতেই। ছেলের এমন দুর্দশা দেখে সে নিজেই মেহেরের কাছে সবকিছু স্বীকার করলো। এবং স্বীকার করার পর মেহের ওকে কিছু করার আগেই নিজে নিজেই পয়জন খেয়ে নিজের জীবন নাশ করেছে!
মেহের এবার পড়েছে ভয়াবহ বিপাকে। অবশ্য এই মুহূর্তে তার সব ভুল ভেঙেছে। কিন্তু লাভ তো নেই। অসময়ে এসব বোঝ এলেও কোন কাজ হয় না!
সে এবার ছেলেকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য এ দেশ ও দেশ বহু দেশ ঘুরেও ছেলের রোগ মুক্তি আর করতে পারলো না। এই যে অহংকার, কোথায় রইলো তা?আর উত্তরাধিকারী জন্ম দেয়া যে সম্পদ আর মিল ফ্যাক্টরির জন্য ওইসব সম্পদ আর মিল ফ্যাক্টরি কোনটিই কী আর তার হাতে রইলো ? ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে সবকিছুই বিক্রি করে দিলো সে। এমনকি থাকার বহুতল মনোরম ভবনটিও। শেষমেষ ছেলেটাও তার আর বাঁচলো না!
মেহেরকে এখন আর এদিকে দেখা যায় না। কোথায় জানি মিলিয়ে গেছে। হয়তো বা মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওর। হয়তো বা গাড়ি চাপায় মরে পড়ে গেছে।অথবা এমনও হতে পারে পাগল হয়ে কোন এক মফস্বলের ছোট্ট স্টেশনের পরিত্যক্ত ট্রেনের বগিতে বসত বাড়ি করেছে!
কেউ আর তার খোঁজ নেবারও নাই এখন।ওই অফিসের অত শতো কর্মচারী, লাইন ম্যান, সেক্রেটারি কেউ আর তার নয় আজ।ওরা এখন অন্য কারোর।

সজল চৌধুরীর একটা অভ্যেস হলো সে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঘুরাফেরা করা তেমন পছন্দ করে না। তবে যে স্ত্রী সন্তানকে ঘুরাফেরা করতে নিষেধ করে বিষয়টি তেমন না।হেমা তার ছেলে মেয়ে নিয়ে শুক্রবারে আশে পাশে ঘুরতে বের হয়। কিন্তু তার মনে একটা দুঃখ থাকে সব সময়। দুঃখটা হলো তার স্বামী তাকে নিয়ে ঘুরতে যায় না।যদি একদিন যেতো তবে অনেক মজা হতো! ভালো লাগতো ওর!
আশ্চর্য জনক বিষয় হলো একদিন বুধবার সকাল বেলা সজল চৌধুরী বললো,’একটু সাজুগুজু করো বউ।দ্রুত!’
হেমা অবাক হয়ে বললো,’ও মা! সকাল বেলা হুট করে এসব কেন?’
সজল চৌধুরী বললো,’ছেলে মেয়েদেরকেও ভালো কাপড় চোপড় পরাও।’
এবার আরো আশ্চর্য হলো হেমা।বললো,’কী হয়েছে বল তো? সকাল সকাল সাজুগুজু করে কী হবে?আর ছেলে মেয়েরাই বা নতুন কাপড় চোপড় পরবে কেন?’
সজল চৌধুরী হেসে বললো,’তোমাদের নিয়ে ঘুরতে বের হবো।’
হেমার যেন বিশ্বাস হতে চায় না কিছুতেই। এই লোক কী সত্যি সত্যি তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুবে!
বিশ্বাস না হলেও সে ঠিকই একটা উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরলো। একটু সাজগোজ করলো।ছেলে মেয়েদেরকেও ভালো কাপড় পরিয়ে নিলো।
তারপর বললো,’আমরা প্রস্তুত।’
শেষমেষ সজল চৌধুরী সত্যি সত্যি হেমা এবং ছেলে মেয়ে নিয়ে ঘুরতে বেরুলো। তবে এটা কোন পার্ক লেক কিংবা পাহাড় সমুদ্রের কাছে নয়।এক এক করে দশটি মিল ফ্যাক্টরিতে নিয়ে গেল হেমাকে সজল। এই মিল ফ্যাক্টরি গুলো খুব ভালো করেই চিনে হেমা। কিন্তু সে কোন প্রশ্ন করলো না সজলকে। এরপর যখন বহুতল মনোরম একটি ভবনে নিয়ে গেল হেমাকে সজল তখন হেমা কথা বললো।সে তখন জিজ্ঞেস করলো,’এই বাসা আর মিল ফ্যাক্টরি গুলো তো মেহেরের। এখানে আমায় নিয়ে এলে কেন?’
সজল তাকে চমকে দিয়ে বললো,’মেহেরের ছিল। কিন্তু এখন এইগুলো তোমার।আমি কিনে নিয়েছি ওর সব মিল ফ্যাক্টরি সহায় সম্পত্তি এমনকি এই থাকার বাসাটিও। তোমার জন্যই এইগুলো কিনেছি। একদিন তোমাকে মেহের তার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল সে অপমান করে।অর্থ বিত্তের অহংকারে। কিন্তু খোদার কী খেলা দেখো।আজ এই ঘর বাড়ির মালিক তুমি। কিন্তু এর পুরনো অহংকারী মালিকের কোনও হদিস পর্যন্ত নেই!’
হেমা কিছু বলতে চায়লেও তাকে কিছু বলতে না দিয়ে সজল আবার বলতে শুরু করলো।সে বললো,’আজ থেকে তুমি তোমার সন্তান সন্ততি নিয়ে এই বাসাতেই থাকবে। আমিও এখানে থাকবো। বাবার সাথে কথা হয়েছে। বাবাও এখানে থাকবেন। এবং তোমার যে কাজের বুয়া ছিল ওর সাথেও আমার আলাপ হয়েছে। সমিরন।সেও আবার তোমার কাছে আসবে। তোমার কাজ করবে!’
হেমার এইসব কিছু বিশ্বাস হতে চায় না।কী করে এমন হতে পারে? বাস্তবে এমন কিছু হওয়া সম্ভব?
সে জিজ্ঞেস করলো সজলকে। বললো,’কীভাবে এমন হলো?’
সজল সবকিছু খুলে বললো হেমাকে।
তারপর আরো একটি তথ্য দিয়ে চমকে দিলো হেমাকে সজল।সে বললো,’তোমাদের বাড়িতে যে সহায় সম্পত্তি ছিল এর সবগুলো আমি তিন গুণ বেশি দাম দিয়ে তোমার চাচাতো ভাইদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছি। এখন ওই জায়গায় কে থাকবে জানো?’
হেমা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,’কে?’
সজল মৃদু হেসে বললো,’তোমার মিসবাহ ভাই।’
হেমার কথা আটকে আসে।সে বড় কষ্টে জিজ্ঞেস করে,’কীভাবে সম্ভব এসব কীভাবে?’
সজল চৌধুরী গাঢ় হেসে এবার বলে,’তোমার ভাই
আসলে কোন বিদেশী ম্যাম টেম বিয়ে করেনি।সে প্রতারকও নয়। ভালো মানুষ। একটা মিথ্যে মামলায় ফেঁসে গিয়েছিল সে। এবং এক যুগ হাজত খেটেছে ওখানে।সে জেল থেকে বেরিয়েই চিঠি দিয়েছে। তোমাদের বাড়িতে গিয়ে যখন তোমার চাচাতো ভাইদের কাছ থেকে জমি কিনেছি তখনই তোমার চাচাতো ভাইয়েরা আমায় চিঠিটা দেখিয়েছে। তোমার ভাই আগামী সপ্তাহে দেশে ফিরবে!’
হেমার যেন এবার সবকিছুকেই স্বপ্ন বলে মনে হয়। কিছুই আর বিশ্বাস হতে চায় না তার।সে কেমন জল ছলছল চোখ নিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে প্রিয়তমো স্বামীর মুখের দিকে।আর সজল ঠোঁটে চোরা হাসি ঝুলিয়ে মনে মনে আনন্দের প্রমোদ গোনে।আহা সুখ!ঘরের স্ত্রীকে খুশি করার মতো আনন্দ এই পৃথিবীতে আর কি বা আছে!
তবে সব পুরুষ এমন হয় না। হয়তোবা পৃথিবীতে হাতে গোনা দু চারটে পুরুষ এমন হয়।যদি পৃথিবীর সকল পুরুষ এমন হতো তবে এই পৃথিবী হতো স্বর্গের মতোই। সুন্দর।মনোরম!
—সমাপ্ত—

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে