উত্তরাধিকার পর্ব-১০

0
1350

#উত্তরাধিকার
#১০ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



হেমা অবশেষে বাধ্যই হলো মেহেরের বাড়ি ছাড়তে।তাও চুরির অপবাদ মাথায় নিয়ে। এক প্রকার ঘাড় ধরেই বের করে দিলো মেহের তাকে।হেমা আর প্রতিবাদ করলো না। কিংবা সহজ করে বললে বলতে হবে প্রতিবাদ করার কোন রকম সুযোগই ছিল না তার। চুপচাপ বেরিয়ে এলো ওর বাড়ি থেকে। কিন্তু বেরিয়েই সে চিন্তায় পড়ে গেল। কোথায় যাবে সে?কে দিবে তাকে একটুকু আশ্রয়?
হেমার কান্না পাচ্ছে। ভীষণ রকম কান্না!সে প্রথমে গিয়ে উঠলো বাবার বাড়িতে।ভাবলো রাতটা বাড়িতে কোন রকম থেকে কাল অন্য চিন্তা করবে। যদিও তার মনে ভয় ছিল। আজমল হোসেনের মাথার ঠিক নেই।যদি রাতটা ওখানে থাকতে না দেয়!
আশ্চর্য জনক বিষয় হলো আজ আজমল হোসেনের মাথা ভালো। তিনি মেয়েকে দেখেই চমকে উঠলেন।মেয়ে যে তার এক কাপড়ে এই আবছা সন্ধ্যায় চোখে জল নিয়ে বাপের বাড়ি চলে এসেছে!
তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে গেলেন। তারপর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন,’কী হয়েছে মা?কী হয়েছে তোমার? হঠাৎ সন্ধ্যা বেলায় যে এসেছো?’
হেমা বাবার বুকের ওমে কপাল ঠুকে বললো,’বাবা, আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে! আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে বাবা!’
আজমল হোসেন মেয়েকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে এলেন। তারপর মেয়ের কাছ থেকে সবকিছু শোনলেন।
আজমল হোসেনের চোখে জল এসে কিলবিল করছে।নাকে সর্দি জমেছে তার। তিনি থরথর করে কাঁপছেন। কাঁপতে কাঁপতে তিনি বললেন,’মা,মাগো, আমার ভাগ্যটা বড় মন্দ মা! ভাগ্য যদি মন্দই না হতো তবে আজ আমার এই অত দুর্দশা কেন? একমাত্র ছেলে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেল বিদেশ বাড়িতে।তার আর কোন খোঁজ খবর নাই। তোমার মা মারা গেল রোগে শোকে জর্জরিত হয়ে।আর ।আর শেষে তোমার শান্তির ঘরটিও ভেঙে গেল মা। আমার যা সহায় সম্পত্তি ছিল তাও অত্যাচারিরা কেড়ে নিলো! তবে মা একদিন সুখ ফিরে আসবে। ওইসব জালেমদের শক্তি তখন থাকবে না। থাকবে না জোর করে কেরে নেয়া হারাম সম্পদ ওদের। হয়তোবা সেদিন আমি আর থাকবো না এই পৃথিবীতে! দেখতে পারবো না এইসব দৃশ্য। তবে আল্লাহ এদের কাউকে ছেড়ে দিবেন না!’
হেমা বাবার কোলে মাথা রেখে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে সে বললো,’বাবা, আমার কী উপায় হবে? কোথায় যাবো আমি?’
আজমল হোসেন অসহায়ের মতো মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর নিজের চোখ মুছলেন।মুছে বললেন,’মাগো,আমি এই জীবনে আল্লাহ ছাড়া কোন মানুষের কাছ থেকে কখনো কোন দয়া নেই নি। কিন্তু এই প্রথমবারের মতো আমার মেয়ের জন্য কারো কাছে সাহায্য চাইবো আমি।’
হেমার চোখে তখনও জলভরা।সে সেই জলভরা চোখে আরো বেশি অসহায়ের মতো করে তাকালো সে।তার খুব কষ্ট হচ্ছে এখন।তার জন্য তার বাবার এই বুড়ো বয়সে মানুষের কাছ থেকে দয়া নিতে হবে!

আজমল হোসেন তার ছাত্র জীবনে যে ঘরে লজিং থাকতেন সেই ঘরের বৃদ্ধ চাচা সেই কবে মারা গেছে। তবে তার একমাত্র ছেলে আছে। সেই ছেলেও এখন বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে। বৃদ্ধের ছেলের নাম বুলবুল চৌধুরী। বুলবুল চৌধুরী ঢাকা শহরের বিখ্যাত শিল্পপতি।বড় বড় কয়েকটি পোশাক কারখানার মালিক তিনি। আজমল হোসেনের সাথে ছাত্র জীবনে বুলবুল চৌধুরীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।একে অপরকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না। কিন্তু এক সময় কী করে যেন যোগাযোগ না হতে হতে সেই সম্পর্ক ভাটা পড়লো। অবশ্য এর জন্য দায়ী আজমল হোসেন নিজেই।কারণ তিনি ভাবছিলেন বুলবুলের সাথে যোগাযোগ রাখলে ও বুঝি তাকে দয়া দেখাবে।বড় চাকরি দিতে চায়বে। কিন্তু তিনি তো এসব পছন্দ করতেন না। দুনিয়ার ধন সম্পদের প্রতি তার তেমন মোহ ছিল না
কিন্তু এখন তো তিনি নিরুপায়। মেয়েটির জন্য কিছু একটা না করলে যে তিনি দায়ী থাকবেন মেয়ের কাছে! তবে তিনি নিশ্চিত, ওখানে গিয়ে হাজির হলে, তার এই দুর্দিনের কথা বললে হেমার জন্য একটা কিছু ব্যবস্থা করে দিবেন বুলবুল চৌধুরী।তার কাছে তো আর চাকরির অভাব নাই!
আজমল হোসেন তাই করলেন।হেমাকে নিয়ে পরদিন ভোর সকালেই ঢাকার পথে যাত্রা করলেন।

দীর্ঘ দীর্ঘ দিন পর প্রিয় বন্ধুকে কাছে পেয়ে বুলবুল চৌধুরী যারপরাণই খুশি! বুলবুল চৌধুরী কফির মগে এক চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’কি রে আজমল, কী খবর সব ভালো তো?’
আজমল হোসেন বড় দুঃখভরা গলায় বললেন,’কিছুই ভালো নেই রে বন্ধু! আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে!’
তারপর আজমল হোসেন এক এক করে সবকিছু খুলে বললেন। হেমার বিষয়েও বললেন। বললেন,’একটা চাকরি বাকরি যদি দিতে পারতি!আমি আর বাঁচবোই বা কদিন! কিন্তু মেয়েটার যদি কোন একটা গতি করে না যাই তবে তো মরেও আমি শান্তি পাবো না!’
আজমল হোসেন কেঁদেই ফেললেন।তার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে গালে।
বুলবুল চৌধুরী ধমকের সুরে বললেন,’চোখ মুছ। এক্ষুনি মুছে ফেল!’
বুলবুলের পুরনো অভ্যেস এটা। বন্ধুদের ধমক দিয়ে কথা বলা।
আজমল হোসেন পাঞ্জাবির কুট দিয়ে চোখ মুছে নিলেন।
এবার বুলবুল চৌধুরী বললেন,’তকদির এমন একটা বিষয় কখন এসে মানুষ কোথায় মিলে যায় তার নাই ঠিক ঠিকানা! আচ্ছা শোন,তোর মেয়েকে আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আমার পছন্দ হলেই তো আর হবে না। আমার ছেলের সাথে আমি আগে কথা বলে দেখি সে কী বলে!’
আজমল হোসেন কিছুই বুঝতে পারলেন না।তাই বোকার মতো জিজ্ঞেস করলেন,’চাকরি কী তোর ছেলে দিবে?তোর হাতে পাওয়ার নেই?’
বুলবুল চৌধুরী এবার বললেন,’সময় হলে আপনি থেকেই সব জানতে পারবি। এবার রেস্ট নে।ঘুমা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুই এখানেই আছিস।তোর মেয়েও এখান থেকে সরছে না!আপাতত শুধু এটুকুই জেনে রাখ।’
আজমল হোসেন কেমন খটকার ভেতর আছেন। বুলবুল চৌধুরীর কথাবার্তা তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না!

পরদিন সকাল বেলা আজমল হোসেনের খটকা মিটে গেল। বুলবুল চৌধুরী তার সাথে বসে নাশতা খেতে খেতে বললেন,’আমার একমাত্র ছেলে সজলের ওয়াইফ গত বছর কোলন ক্যান্সারে মারা গেছে।তার তিন বছর বয়সী এক মেয়ে আর পাঁচ বছর বয়সী এক ছেলে আছে। এই ছেলে মেয়ে দুটির লালন পালন আদর সোহাগের জন্য হলেও সজলের বিয়ে করা প্রয়োজন।যেহেতু হেমাও ওই ছেলের ঘরে আর ফিরবে না তাই ভাবছিলাম সজলের জন্য হেমাকে রেখে দিবো বউ করে। এই জন্য গতরাতে সজলকে জিজ্ঞেস করলাম। হেমার সাথে কথা বলেছে সে।অন্য কিছু নয় জাস্ট পরিচিত হওয়া। সজলকে আমি জিজ্ঞেস করেছি তোর পছন্দ হয়েছে?
সজল বলেছে, আমার পছন্দই তার পছন্দ।
এবার তুই যদি আপত্তি না করিস তবে তোর মেয়েকে জিজ্ঞেস করতে পারিস এই ব্যপারে।হেমা যদি অমত না করে তবে ওই ছেলের কাছ থেকে ডিভোর্স নিয়ে তারপর আমরা বিয়ের আয়োজন করতে পারি!’
আজমল হোসেন যেন তার বন্ধুর কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছেন না কিছুতেই!তিনি বিড়বিড় করে বললেন,’এসব সত্যি বলছিস রে বুলবুল?’
বুলবুল চৌধুরী গাঢ় হাসলেন। তারপর বললেন,’হ্যা সত্যি। এবার তোর মেয়েকে জিজ্ঞেস করে দেখ কী বলে!’
আজমল হোসেন হেমার কাছে জিজ্ঞেস করলেন। বললেন,এ ব্যপারে তার কী মন্তব্য।
হেমা বললো,বাবা আমি অসহায়। আমার আশ্রয় প্রয়োজন। তাছাড়া বড় কথা হলো আমি কোনদিন মা হতে পারবো না।এটা জেনেও তারা বিয়েতে রাজি। এখানে আমার দুটি সন্তানও থাকবে।যারা আমায় মা বলে ডাকবে।এটা ভাগ্যের ব্যাপার।আমি রাজি বাবা!
আজমল হোসেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। মেয়েকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে তিনি কপালে চুমু খেলেন।

মেহেরের সাথে হেমার ছাড়াছাড়ি হতে সময় লাগলো আরো এক মাস। অবশ্য এসব সহজ ভাবে সম্পন্ন হলো হেমার প্রভাবশালী হবু বর সজল চৌধুরীর কল্যাণেই। ডিভোর্সের পর ধর্মানুযামী যতোদিন একা থাকতে হয় ততোদিন হেমা একা রইলো। তারপর সময় মতো সজল চৌধুরীর সাথে বিয়েটা তার হয়ে গেল।

বিয়ের পর হেমার সুন্দর একটি ঘর হলো। আশ্রয়স্থল হলো।দুটি সন্তান হলো। একজন ভালো স্বামী ভাগ্যে জুটলো। পিতার মতো শশুরও পেলো সে। কিন্তু বিয়ের মাত্র তিনদিন পর চিরদিনের জন্য জন্মদাতা পিতাকে হারালো হেমা।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে