#উত্তরাধিকার
#৬ষ্ঠ_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
হেমা বুঝতে পারে না যে মেহের তার কাছে রোজ রোজ মিথ্যে বলছে। অনেক কিছুই তার চোখ থেকে আঁড়াল করছে।সে কিন্তু মেহেরকে প্রচন্ড রকম বিশ্বাস করে।সরল মনে ভাবে,তার মেহের তাকে না বলে বাইরে এক কাপ চা অবধি খায় না!
কিন্তু মেহের তার সাথে ঠিকই প্রতারণা করে চলে।সাঁজবাতির সাথে তার বন্ধুত্ব আরো গাঢ়ো হয়।ওরা এবার হাত ধরাধরি করে হাঁটে।সুখ দুঃখে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে কথা বলে। কখনো বা খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে যায়। তাছাড়া সাঁজবাতির বাসায় তো মেহেরের নিয়মিত আনাগোনা আছেই!
ওখানে গিয়ে খায় দায়। কখনো বা দাবা খেলে। খাটের একপাশে হেলান দিয়ে বসে গল্প করতে করতে একে অপরের উপর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।
এভাবেই ছ’ মাস কেটে যায় ওদের বন্ধুত্বের।ছ’মাস পর এক রাতে সাঁজবাতির বাসায় এসে মেহের তাকে চমকে দেয়।ওর হাতে নতুন চকচকে চাবি উঠিয়ে দিয়ে বলে,’তোমার জন্য শুধু!’
সাঁজবাতি অবাক হয়।সে না বোঝার ভান করে বলে,’কিসের চাবি এটা?’
মেহের ওর হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যায়। তারপর আঙুল দিয়ে উঠোনে পার্কিং করে রাখা গোলাপী রঙের নতুন গাড়িটা দেখিয়ে বলে,’এটা তোমার জন্য। মাত্র কিনে আনলাম।’
সাঁজবাতির ভেতরটা যেন কেঁপে উঠে।সে সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরে মেহেরকে।মেহের ওর কপালে চুমু খায়।
সাঁজবাতি থম মেরে যায়। লজ্জায়।অথবা সে লজ্জা না পেয়েও লজ্জার ভান করে।
তাকে এভাবে আবিষ্কার করে মেহের বলে,’সরি!আমি বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি!’
সাঁজবাতি হাসে। হেসে বলে,’আমরা তো বন্ধু।এতে দোষের কী হলো!’
মেহের যেন এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
‘
তারপর আরো কিছু দিন কেটে যায়। ওদের বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে আরো গাঢ়ো হয়!
মেহের একদিন সন্ধ্যা বেলায় বলে,’সাঁজ,আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই।যদি তোমার অনুমতি থাকে!’
সাঁজবাতি যেন হোঁচট খায়।সে অতটাও আশা করেনি।তার মতো করে ওইসব এলিট ফেলিটদের অত বোঝে কে!ওরা তো সুন্দরী নারীদের গাড়ি দেয়,ফ্ল্যাট দেয় দু’ চার ছ’ মাস বেড শেয়ার করার জন্য।কেউ কেউ আছে কয়েক বছরের জন্য রক্ষীতা করে রাখে। তবে বিয়েটা কখনোই করে না! কিন্তু মেহের এমন ব্যতিক্রম কেন?সাঁজবাতি মনে মনে হাসে। এবার বুঝি তার ভাগ্যটা বদলে গেল!আর দু’ চার ছ’ মাস কারোর জন্য নয়।এক জীবনের জন্য। কিন্তু সে ভাবে, একজনের সাথে এক জীবন থাকাতে একগুঁয়েমি লাগবে না? লাগুক।অঢেল সম্পদের মালিক হতে গেলে একটু তো ধৈর্য্য ধরতেই হবে। সম্পদের মালিক হতে পারলে পরে একগুঁয়েমি ভাব কাটাবার জন্য বন্ধুর অভাব হবে না!
মেহের কিন্তু অত কিছু বুঝতে পারে না।সে ভাবে সে সাঁজবাতিকে পয়সা দিয়ে পুতুলের মতো নাচাচ্ছে। কিন্তু সাঁজবাতিই কেবল জানে,সে মেহেরের পয়সাও হাতিয়ে নিচ্ছে সাথে ওকেও বানর নাচ নাচাচ্ছে!
উপর ওয়ালার হিসেবটাও হয়তোবা এরকমই। তুমি যদি একজনকে ঠকাও তবে তুমিও ঠকে যাবে।টেরও পাবে না কখন ঠকছো!কে বা তোমায় ঠকাচ্ছে!
সাঁজবাতি উত্তর দিতে পারে না।চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
মেহের বলে,’তোমার কী কোন বয়ফ্রেন্ড আছে?থাকলে তো জানার কথা ছিল আমার?’
সাঁজবাতি এবার ঝটপট করে উত্তর দেয়।বলে,’আরে না না।এসব নাই।’
‘তবে কিছু বলছো না যে!আমায় বিয়ে করবে না তুমি?’
সাঁজবাতি বলে,’তোমার সাথে আমার কীভাবে যায় বলো? তোমার অফিসের সামান্য কর্মচারী আমি!’
মেহের এসে ওর কোমল হাত ধরে ফেলে। তারপর বলে,’তুমি শুধু আমার বন্ধু।’
‘তুমি যে মেরিড?’
এবার মেহের একটু চুপ থাকে। তারপর বুদ্ধি খেলে বলে,’আমার প্রথম স্ত্রীর কোন বেবি হবে না। এই জন্যই বিয়ে করবো আমি। তুমি আমায় উত্তরাধিকারী দিবে!’
এবার যেন সাঁজবাতির ভেতরটা লাফিয়ে উঠে।
তার পরিচয় এবার বদলে যাবে। শুধুমাত্র সাঁজবাতি থেকে সে এবার হয়ে উঠবে মিসেস মেহের । অফিসে পা রাখলে মানুষ তার পায়ের কাছে ভক্তির চাদর বিছিয়ে দিবে। একটি বাড়ি, কয়েকটি মিল কারখানা এবং গোটা কতক বড় বড় দোকানের সে হয়ে উঠবে সম্রাঙ্গী।
‘
এই বিয়েটা ধুম ধামের সহিত হয় না।মেহেরের মা দু’ বছর আগেই গত হয়েছেন।এক বোন ছিল। সুইজারল্যান্ড থাকে স্বামী ছেলে নিয়ে।দেশে ফিরে না। সুতরাং বিয়েতে বাইরের কারোর উপস্থিতি হয় না। অবশ্য মেহেরের বন্ধু বান্ধব আছে। তবে দু একজন ছাড়া বাকীদের দাওয়াত করেনি সে।যে দুয়েকজনকে দাওয়াত করেছিলো তারাও বিজি থাকায় আসতে পারেনি। এবার বলা যায় বিয়েটা ঘরোয়া ভাবেই হলো।কেউ নেই বাইরের।যারা আছে তারা ঘরের লোক।কাজের লোক।
এই বিয়েতে সবচেয়ে আশ্চর্য জনক বিষয় হলো হেমা আনন্দ চিত্তে সব কিছু করছে।এর আগে কোন বাঙালি নারী বোধহয় এভাবে নিজের স্বামীর অন্য একটি বিয়েতে আনন্দ চিত্তে বিয়ের কাজ কর্ম করেনি। কিন্তু সে করছে। এমনকি নানান জাতের ফুল দিয়ে সে তাদের বাসর সাজিয়ে দিয়েছে।শেষে , খাটের একপাশে বসে সাঁজবাতির জোড়া হাত ধরে সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,’শুনো বোন,আমরা দুজন প্রতিপক্ষ না।আমরা একয় পক্ষের। আমাদের দুজনের স্বামী এক। আমাদের দুজনের ভালোবাসার মানুষ এক। আমাদের উদ্দেশ্য এই সংসারের উন্নয়ন। আমাদের কামনা এই সংসারের সুখ। আমার বিয়ের পাঁচ বছর সাত মাস হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ চাননি এবং আমার কপালে আছে,আমি কোন সন্তান দিতে পারিনি স্বামীকে। সন্তানের শূন্যতা মেহেরকে ব্যথা দেয়। আল্লাহ চাইলে তুমি এই শূন্যতা পূরণ করবা। তার মনের ব্যথা দূর করে দিবে ইনশাআল্লাহ!’
এই কথাগুলো বলে সে মেহেরের পছন্দ অপছন্দের কথা বললো।কী খেতে সে ভালোবাসে।কী করলে রাগ উঠে।রাগ উঠে গেলে কীভাবে তা ভাঙাতে হয়।সেসব কিছুই বললো। তারপর মেহের বাসর ঘরে এলে ওদের দুজনকে একসাথে বসিয়ে দিয়ে সে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
ঘর থেকে বেরিয়ে সে অন্য একটি ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। তারপর সুইচ টিপে বাতি টা অফ করে দিলো। এবার সারাদিন বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা কান্নাগুলোকে একেবারে উন্মুক্ত করে দিলো। হাউমাউ করে হাঁটুতে মুখ গুঁজে দিয়ে কাঁদতে শুরু করলো হেমা। কিন্তু এই ঘরের কান্নাগুলো দেয়াল ভেদ করে ও ঘরে কিছুতেই পৌঁছাতে পারছে না।এ ঘরে যখন হেমা হাঁটুর ভেতর মুখ গুঁজে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে ও ঘরে তখন মেহের তার নতুন সঙ্গীনির বুকে সুখ নিঃশ্বাস ছাড়ছে।এটাই হয়তোবা বিধাতার ইশারা।এটাই হয়তোবা দৈব নিয়ম।
এক ছাদের নিচেই কজন মানুষ।অথচ এদের কারোর আজ সুখের দিন।আর কারোর ভীষণ দুঃখের!
‘
বিয়ের পরদিন সকালে হেমাকে কিচেনেই যেতে দিলো না সাঁজবাতি।হেমা এগিয়ে এসেছিল।সাঁজবাতি তার হাত ধরে নিয়ে গেল মেহেরের কাছে। ওখানে নিয়ে গিয়ে বললো,’একসাথে শুয়ে থাকো।গল্প করো তোমরা।আমি বুয়াকে নিয়ে নাশতা তৈরি করে নিয়ে আসছি। একসাথে খাবো।’
হেমা কিছু বলতে পারে না। জোর করেই ওকে মেহেরের পাশে শুইয়ে রেখে যায় সাঁজবাতি। অবশ্য ওর পাশে শুয়ে থেকেও তার মন শান্ত হয় না।মেহের তখনও মৃদু নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। ঘুমন্ত মানুষের সাথে সে আর কী বা গল্প করতে পারে!
হেমা ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে।
নাশতা তৈরি করে টেবিলে সাজিয়ে রাখে সাঁজবাতি। তারপর ওদের ডাকতে আসে।হেমা ওকে আসতে দেখেই দ্রুত চোখ মুছে। তারপর খাট থেকে নামে।সাঁজবাতি মেহেরকে ডাকলে মেহের বলে তার ঘুম পাচ্ছে।মাথা ব্যথা আছে।আরো পরে উঠবে। ওদের নাশতা করে নিতে বললো।সে পরে নাশতা করবে।
সাঁজবাতি হেমার সাথে গলাগলি করে ডায়েনিংয়ে গেল। তারপর দুজন দু পাশে বসলো। খেতে খেতে এক পর্যায়ে সাঁজবাতি হেমাকে বললো,’আপু,আমি কিন্তু তোমার বাবার বাড়িতেই ফেরত নাইওর করবো। আমার তো বাবা মা নেই। তোমার বাবা মাই হবেন আমার বাবা মা!’
সাঁজবাতির কথাটা শোনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে হেমা।
‘
#চলবে