উত্তরাধিকার পর্ব-০৪

0
1339

#উত্তরাধিকার
#৪র্থ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



অদ্ভুত বিষয় হলো সাঁজবাতি ইন্টারভ্যূ দিতে ঠিকই এলো। যদিও মেহের আশা ছেড়ে দিয়েছিল এবং মোড অফ করে সিগারেট ধরিয়েছিল। তখনই তার সেক্রেটারি আবুল হিসাম এসে জানালো,’স্যার,সাঁজবাতি এসেছেন।’
শোনে চমকে গিয়েছিলো মেহের। তারপর দ্রুত সিগারেট নিভিয়ে এসট্রের ভেতর রেখে দিয়ে বললো,’তাকে আসতে বলো।’
সাঁজবাতি সালাম দিয়ে রুমে ঢুকলো।
মেহের ওর মুখের দিকে তাকালো।যেন এই বদ্ধ ঘরে আকাশের উথাল পাতাল জোছনা ঢালা ছাদ এসে নেমেছে। এবং মেয়েটি যথেষ্ট পরিমাণ স্মার্ট।
সে বসতে বললো।
সাঁজবাতি বসলো এবং বললো,’স্যার আমি খুব সরি!দেরি করে ফেলেছি।’
মেহের মৃদু হাসলো। হেসে বললো,’ইটস্ ওকে। কেমন আছেন আপনি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ স্যার। আপনি কেমন আছেন স্যার?’
‘ভালো আছি। যদিও অনেক লেইট করে ফেললেন!’
‘স্যার এক্সট্রিমলি সরি!’
‘ইটস্ ওকে। ‘
তারপর সহজ কিছু কোয়েশ্চন করে নিলো মেহের। ইংরেজি উচ্চারণ টা দেখলো।আই এল টি এসে ভালো মার্কস আছে।মেহের বললো,’কংগ্রেচ্যুলেশন। আপনি আগামীকাল থেকেই অফিসে আসুন।জয়েন করুন!’
মেয়েটি চমকে উঠলো।তার চাকরি টা হয়ে গেছে!
সে বললো,’থ্যাংক য়্যু স্যার।থ্যাংক য়্যু!’

সেদিন বড় আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরলো মেহের।তার মন ফুরফুরে।সে হঠাৎ হেমার সাথে ভালো আচরণ করতে শুরু করলো।বললো,’হেমা কী রাঁধলে তুমি আজ?’
হেমা যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো।যেন ওর একটি ডাকের তেষ্টায় মরে যাচ্ছিলো সে।হেমা সঙ্গে সঙ্গে বললো,’তোমার ফেভরিট খাবার। খাঁসির মাথা দিয়ে মুগ ডাল।’
মেহের অবাক হলো।বললো,’খাঁসির মাথা কে এনে দিলো?’
হেমা বললো,’বুয়াকে দিয়ে কিনিয়ে এনেছি বিকেলে।’
মেহের খুশি হলো।সে বললো,’খুব ভালো করেছো।থ্যাংক য়্যু হেমা!’
হেমা কেঁদে ফেললো। তবে এ কান্নার কোন শব্দ নেই।সে নিরবে দু চোখের জল আঁচলে মুছে ভাত বাড়লো মেহেরের জন্য। তারপর বড় বাটিতে করে ডাল আর খাসির মাথা নিয়ে এলো মেহেরের জন্য।
মেহের বললো,’তুমিও বসো। দুজন একসাথে খাবো।’
হেমা বললো,’না।আজ আমি তোমাকে খাইয়ে দিবো।’
মেহের বললো,’দেও তবে দেখি। কতদিন তুমি খাইয়ে দেও না। উপভোগ করবো এটা আমি।’
হেমা সত্যি সত্যি ওর হাতে তুলে মেহেরকে খাইয়ে দিচ্ছে। মেহেরও ছোট বাচ্চাদের মতো করে খাচ্ছে। ওকে খাওয়াতে গিয়ে কতবার যে হেমার চোখ দুটি জলে ভিজলো!

সে রাতে হেমার কাছাকাছি এলো মেহের। অনেক অনেক দিন পর। তারপর মাঝরাত অবধি তারা একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল।মেহের ওকে আদর করলো।গোনলে হাজার ছাড়াবে ঠিক অতগুলোই জাদুমাখা নামে ডাকলো হেমাকে মেহের।হেমা যেন তখন স্বর্গে।আহা সুখ! এমন একটি দিনের জন্য সে কুরবান হতে পারে!
কিন্তু সুখটা এক রাতও স্থায়ী হলো না।ক্লান্ত মেহের তখনও ওর গলা জড়িয়ে ধরে আছে।আর হেমা মেহেরের কালো চুলের জমিনে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।মেহের তখন বললো,’হেমা, তুমি বিশ্বাস করো আমি যে তোমাকে ভালোবাসি?’
হেমা যেন কেঁদে ফেলবে এবার।সে ভেজা ভেজা গলায় বললো,’জানি।আমি জানি মেহের।’
মেহের এবার বললো,’তুমি বাসো আমায় হেমা?’
হেমা বললো,’খুউব বাসি। এই এক পৃথিবীর চেয়েও অনেক বেশি বাসি!’
এবার মেহের অন্য দশটা পুরুষের মতোই চিরাচরিত একটি কথা বললো।সে বললো,’তুমি যদি আমায় সত্যিকার ভালোবাসো তবে আমার দ্বিতীয় বিয়েটা মেনে নাও প্লিজ!কেন অবোঝের মতো আচরণ করো তুমি বলো? আমাদের তো একটা বেবির প্রয়োজন।আমরা তো চাই একটা বেবি আমাদের দুজনকে বাবা মা ডাকুক।কী চাই না হেমা?’
হেমা কথা বলতে পারে না।মুখ বুজে আসে ওর।
মেহের ওকে আরো শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে। তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,’হেমা রাজি হয়ে যাও লক্ষ্মীটি! তোমাকে ছুঁয়ে আমি কথা দিচ্ছি, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা অন্য কেউ নষ্ট করে দিতে পারবে না!কথা দিলাম!ওয়াদা করলাম আমি!’
হেমা জবাব দেয় না।ওর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ও পাশে ফিরে বালিশে মুখ চেপে কাঁদে।
পরদিন সকাল বেলা যথারীতি সে মেহেরকে নাশতা দেয়। এবং ওর পাশে বসে বলে,’মেহের,আমি রাজি। তুমি বিয়ে করো।’
কথাটা বলতে গিয়ে তার বুকটা ছিঁড়ে যায় পৃথক হওয়া নদীর মতো।কী যে কষ্ট লাগে তখন তার! তবুও ঠোঁটে হাসি ধরে রাখে সে। এবং জিজ্ঞেস করে,’মেয়ে দেখেছো নাকি? ‘
মেহের সাঁজবাতির বিষয়টি এড়িয়ে যায়। এবং বলে,’কীভাবে দেখবো! কেবলই তো এগ্রী করলে তুমি।’
হেমা বললো,’আজ থেকেই দেখতে শুরু করো। এবার নিজে দেখে পছন্দ করো।’
মেহের হাসলো। হেসে বললো,’তোমার পছন্দ হলেই বিয়ে হবে। তুমি পছন্দ করেই বউ আনবে ঘরে।’
হেমা বললো,’আমার তো পছন্দ ভালো না।নিজেই আমি কুৎসিত একটা মেয়ে। এবং দূর্ভাগা! আমার পছন্দের মেয়ে আনলে অমঙ্গল হবে খুব!’
কথাটা বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেলেছিল হেমা।কী কষ্ট করে যে নিজেকে সংবরণ করলো সে!
সংবরণ করে গলা খাঁকারি দিয়ে স্বাভাবিক হলো।
মেহের বললো,’নিজেকে ছোট ভাবো কেন তুমি? তুমি নিজেও জানো না তুমি কতোটা সুন্দর!’
হেমা ঠোঁটে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করে। যদিও মনে মনে সে বড় দুঃখ করে বলে,আমি যদি সত্যিই সুন্দরী হতাম তবে কী আর তুমি বাসর রাতে আমায় ফ্লোরে শুতে দিয়েছিলে!তাও কনকনে শীতের রাতে!
তারপর মেহের অফিসে চলে গেল।হেমা টিফিন ক্যারিয়ার তুলে দিলো ওর হাতে।

সাঁজবাতি অফিসে এসেছে।তার সাজ পোশাক ইংরেজ ম্যামদের মতো। গলায় টাই পর্যন্ত বেঁধে এসেছে।এটা তাকে বেশ মানিয়েছে।মনে হচ্ছে এই অফিসটা তার।সে এখানকার সম্রাজ্ঞী!
উফ্! অফিসের প্রতিটা পুরুষ চোখ দিয়ে যেন ওকে চেটে খাচ্ছে! কিন্তু কেউ সাহস করে হাই হ্যালোটাও বলতে পারছে না পর্যন্ত।
সেদিনই মেহেরের সেক্রেটারি আবুল হিসামের ডিমোশন হয়ে গেল একধাপ নিচে।সে হয়ে গেল এসিস্ট্যান্ট থেকে এডিশনাল এসিস্ট্যান্ট। আর সাঁজবাতি হয়ে গেল রিপ্রেজেন্টেটিভ থেকে এসিস্ট্যান্ট। এবং চাকরির প্রথম দিনই এমন প্রমোশনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো মেয়েটি। এবং তার এই আনন্দ আরো একধাপ বাড়িয়ে দিতে মেহের তাকে জানালো তার সাথে সে আজ বাইরে কোন রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করবে।
এই অফার পাওয়ার পর নিজেকে নিয়ে গর্ব হতে লাগলো সাঁজবাতির।

আবুল হিসামের খুব মন খারাপ ছিল। কিন্তু মেহের তাকে ডেকে নিয়ে বললো,’আরে মন খারাপ করছো কেন? তুমি ফূর্তি করো। এটাকে ডিমোশন ভেবো না।ভাবো ছুটি। তোমার এখন কাজ টাজ কমে যাবে। তোমার এখন অফিসে এসে শুধু বসে থাকা। এবং আনন্দের বিষয় হলো তোমার ভাবীর হাতের রান্না দিয়ে রোজ লাঞ্চ করবে। এমন সৌভাগ্য বলো কজনের আছে? আমার স্ত্রীর হাতের রান্না খাবে এটা ছিল তোমার কাছে স্বপ্নের মতো তাই না? কিন্তু এখন রোজ খাবে। এখন বসে বসে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো। এবং এই যে টিফিন ক্যারিয়ার নেও। খেয়ে দেয়ে আবার আমার এখানে রেখে যাবে।’
আবুল হিসাম সত্যি আনন্দিত হলো। তবে তার মনে কৌতুহল জন্মালো। এবং সে ভাবলো তার স্যারের চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। সুন্দরী মেয়েটাকে হাতের নাগালে পেয়ে যা তা করবে।তা করুক গিয়ে।সেও যদি সুযোগ পেতো কম করতো না। কিন্তু দূর্ভাগ্য এমন যে সে কর্মচারী হবার যোগ্যতা নিয়েই জন্ম নিয়েছে এবং বড় হয়েছে। সুতরাং মালিকের শিকারের প্রতি তাকিয়ে জিভ চেটে লাভ নেই।এরচে বরং মালিকের স্ত্রীর হাতের স্বাদের রান্না খাওয়া ভালো।এতে তার লাঞ্চ খরচটা তো বেঁচে যাবে!’

ওরা গেছে শহরের পাঁচতারা একটি হোটেলে। অবশ্য এর আগে বহুবার এইসব হোটেলে যাওয়া আসা আছে সাঁজবাতির। তবুও সে এমন ভাব করলো যেন এমন হোটেল কখনো চোখেও দেখেনি!
সে অবাক হওয়া গলায় বললো,’ওহ মাই গড্!জীবনেও ভাবিনি আমি এমন কোথাও এসে কোনদিন লাঞ্চ করবো!তাও আপনার মতো স্বনামধন্য একজনের সাথে!সার আপনি আমার সারপ্রাইজ দিলেন! এবং তা এতো বড় যে আমার এখনও মনে হচ্ছে আমি মিড নাইট ড্রিমে আছি। এবং এটা সুখকর!’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে