উত্তরাধিকার পর্ব-০২

0
1650


#উত্তরাধিকার
#২য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



মেহের সেই সকাল নটায় অফিসে চলে গেছে।অন্যদিন ঘরে নাশতা করে মেহের।এক গ্লাস দুধ, একটা কলা,ডিম আর নুডুলস খায়। কখনো পরোটা আর ডিম ভাজা খায়। সকালে তার খাবার সব সময় হালকা।হাতে সময় থাকলে এক কাপ কফিও খায়।আর যাওয়ার সময় সাথে করে টিফিন ক্যারিয়ারে করে দুপুরের খাবার নিয়ে যায়।হেমা ওকে একদম বাইরের খাবার খেতে দেয় না।বলে বাইরের খাবারে ভেজাল।অসুখ করবে!
মেহেরও এর ব্যতিক্রম করে না। বাইরের খাবার সে খায় না।আর হেমার হাতের খাবার খেয়ে খেয়ে এমন অভ্যেস হয়েছে যে অন্য কারোর রান্না তার মুখে আর রুচেয় না।
কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো আজ সকালে মেহের নাশতা করেনি।হেমা নাশতা করার জন্য ডাকলে বলে দিলো, ‘ভালো লাগছে না।খিদে নেই আমার।খবো না।’
হেমা তবুও ওর কাছে এক গ্লাস দুধ আর একটা কলা নিয়ে এলো। মেহের তখন খাটের উপর বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে ফেসবুকে স্ক্রুলিং করছিলো। তখন হেমা
এসে বললো,’অন্তত দুধ কলাটা তো খেয়ে যাও।’
মেহের বললো,’এক কথা কতোবার বলবো?রাগ পাচ্ছে কিন্তু আমার। আমাকে ডিস্টার্ব করো না তো!’
যাওয়ার সময় হেমা টিফিন ক্যারিয়ারটা এনে ওর হাতে দিতে চাইলে মেহের বললো,’আজ বাইরে খাবো বন্ধুদের সাথে। রাতেও আমার জন্য ওয়েট করবে না। সম্ভবত আমার ফিরতে দেরি হবে!
আর তুমি মানসিক ভাবে প্রিপিয়ার থাকো।ডিভোর্সের দিন কিন্তু ঘনিয়ে আসছে!’
কথাগুলো বলে টাইয়ের নবটা ঘুরিয়ে ঠিক করে চলে গেল মেহের।
হেমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর চলে যাওয়া পথের দিকে। ততক্ষণে মেহের গাড়িতে চড়ে বসে গেইট পেরিয়ে বাইরে চলে গেছে। তবুও সে তাকিয়ে আছে।তার দু গাল ভেসে যাচ্ছে গরম জলে।আর বুকের ভেতরটা চিনচিনে একটা ব্যথায় কাবু করে নিচ্ছে!

হেমা আয়নার সামনে গিয়ে তাকালো। এবং নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো।সে কী দেখতে আসলেই কুৎসিত?
মোটেও না।হেমা খুব ভালো করে নিজেকে দেখলো।তার নিজেকেই নিজের মনে হচ্ছে সে দেখতে যথেষ্ট সুন্দর। মানুষ তার চাপা গায়ের রংটা নিয়ে কথা বলে।অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে এই চাপা রং ছাড়া তাকে মোটেও মানাতো না।
কিন্তু মানুষ চামড়ার সাদা রংটাকেই পছন্দ করে। এই সাদা রং নিয়ে মানুষের কতো গর্ব কতো বড়াই!কতো যে শ্যাম বর্ণের মেয়ে আছে যারা সেই জন্মের পর থেকেই মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে আসছে। বিয়ে হচ্ছে না।বয়স বাড়ছে। পাড়ার লোকেরা মন্দ কথা রটে দিচ্ছে। এসব নিয়ে মেয়েদের বাবার,মার কতো যে কষ্ট দুঃখ যন্ত্রণা!
হেমা কেঁদে ফেলে আবার।আর মনে মনে বলে,আহ্ দুনিয়া।রঙের দুনিয়া!
তারপর শাড়িটা সামান্য সরিয়ে নিজের উন্মুক্ত মসৃণ তুলতুলে পেটের দিকে তাকায় হেমা। এবং দু হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে সে তার পেট। তারপর বসে পড়ে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে। এই যে পেট তার আছে। এই পেটে একটি সন্তান এলে এমন দোষ কী হয়ে যায়!কী পাপ করেছিলো সে? বিয়ের পর প্রতিটি মেয়েই তো মা হতে চায়।মেয়েরা তো মা হবে বলেই ছোট বেলা থেকে মমতাময়ী হয়ে বেড়ে উঠে। কিন্তু সবাই হতে পারে না কেন?এ কেমন বিচার!
হেমার কান্না বাড়ে।বাসার কাজের বুয়া সমিরন দৌড়ে আসে তার কাছে। এসে বলে,’কী হয়ছে গো আম্মা আফনের কী হয়ছে?কান্দেন ক্যানে?’
হেমা কান্না থামিয়ে আঁচলে চোখ মুছে নিয়ে ভার গলায় বলে,’এমনি। আমার কাঁদতে ভালো লাগছে। এখন তুমি এখান থেকে যাও।বাড়ি চলে যাও।আজ তোমার ছুটি।’
সমিরন যেতে চায় না। দাঁড়িয়ে থাকে কাঠ হয়ে।
হু হু করে সেও কেমন কেঁদে উঠে। আঁচলে চোখ মুছে বলে,’আম্মা,আফনেরে কানতে দেখলে আমার কান্দন পাই।আল্লা মাবুদ জানে,আফনেরে আমি নিজের মেয়ে জ্ঞান করি!’
হেমা কথা বলে না।চুপ হয়ে থাকে।
সমিরন নিজেই এবার বলে,’আম্মা তাইলে আমি যাই।আমি থাকলে আফনের কষ্ট আরো বাড়বো।আমি যাই!’
বলে চোখ মুখ মুছে চলে গেল সমিরন। সমিরন চলে গেলে আবার কাঁদতে শুরু করে হেমা।সে তো সমিরনকে কষ্ট দিতে চায়নি। এভাবে কথা বলতে চায়নি। তবুও কেন জানি এমন আচরণ করলো। হয়তোবা মেহেরের উপর প্রকাশ করতে না পারা রাগটা সমিরনের উপর প্রকাশ করলো। মানুষ স্বভাবগতভাবেই এমন।দূর্বলের উপর কর্তৃত্ব করা তাদের স্বভাব।
হেমা খুব কষ্টে কান্না থামালো। তারপর বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে মোবাইল হাতে নিলো। বাবাকে ফোন করলো সে।
তার বাবার নাম আজমল হোসেন। আজমল হোসেন ফোন রিসিভ করতেই হেমা কান্নায় ভেঙে পড়লো।
আজমল হোসেনের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। তিনি ভয় পাওয়া গলায় বললেন,’কী হয়ছে মা?কী হয়ছে তোমার? কাঁদো কেন গো তুমি মা?’
হেমা বলে,’বাবা, তুমি তো জানো আমি কোনদিন মা হতে পারবো না। কিন্তু মেহেরের সন্তান চায়।সে আরেকটা বিয়ে করতে চায় এই জন্য। আমাকে সম্মতি দিতে হবে।আমি সম্মতি দেইনি বলে সে আমার হাতে ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিয়ে বলেছে,সে আমায় ডিভোর্স দিতে চায়।যেহেতু আমি ওর দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি না তাই সে আমায় ডিভোর্স দিবে!’
কাঁদতে কাঁদতে বললো কথাগুলো হেমা।
আজমল হোসেন মেয়ের কথাগুলো শোনে ভীষণ কষ্ট পেলেন।তার এই একটি মাত্রই মেয়ে। আরেকটি ছেলে ছিল। মিসবাহ তার নাম।বড় ভালো ছেলে ছিল। বাবাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না একদম।মা মুখে ভাত তুলে না দিলে খেতোই না কখনো।বড় হয়েও এই অভ্যেসটা ছিল তার।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়েছে সে। তারপর স্কলারশিপ নিয়ে ওই যে অস্ট্রেলিয়া গেল। ওখানে গিয়ে নাকি এক ফরেন খৃষ্টান মেয়ের সাথে রিলেশনে জড়িয়েছিল। তারপর বিয়ে। বিয়ের সময় নাকি মিসবাহ খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। ভালোবাসাকে পেতে নিজের ধর্ম জলাঞ্জলি দিয়েছে। দুজনই এখন ওখানে স্যাটেল। ভালো চাকরি হয়েছে। ওদের নাকি একটা ছেলেও আছে। কিন্তু আজমল হোসেনের সাথে ছেলের কোন ধরনের যোগাযোগ নাই। মানুষের মুখে মুখে শুনেছেন তিনি এসব। কীভাবে যেন ছেলেটা বদলে গেলো।বাবা মা এবং দেশ মাতৃকাকে এভাবে ভুলে গেলো!
আজমল হোসেনের এখন এই একটি মাত্র মেয়েকে নিয়েই সব স্বপ্ন। এই মেয়েটি ভালো থাকলেই তার ভালো থাকা।তিনি ধনবান মানুষ নন।বয়স থাকতে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। এখন অবসরে আছেন।শরীরও দূর্বল হয়েছে। পেনশনের টাকায় বাড়িতে একটা ঘর করেছেন।একটা লাইব্রেরী দিয়েছেন ঘরের বারান্দায়।এর বেশি কিছু করতে পারেননি। এখন নিজের চলতেই কষ্ট হয়।তিনি যে ইচ্ছে করলেই হেমাকে সাহস করে তার বাড়িতে নিয়ে আসবেন তা তিনি পারবেন না।তিনি এখন দূর্বল।বয়সের ভারে নূহ্য। কখন মারা যাবেন তা নিজেও জানেন না। তবে এটা জানেন যে মৃত্যু তার খুব কাছাকাছি আছে। হঠাৎ তিনি এই ধরাধাম ত্যাগ করবেন। তাছাড়া তার স্ত্রীও অসুস্থ। সারা বছর এটা ওটা লেগেই থাকে।
আজমল হোসেন মেয়েকে কী বলবেন বুঝতে পারছেন না কিছুই।তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। তবুও তিনি কান্না থামিয়ে বললেন,’মা,আমি মেহের বাবার সাথে দেখা করবো। একদিন তোমাদের বাসায় আসবো আমি।’
হেমা তার চোখ মুছে নাকের স্বর্দিটা পরিষ্কার করে নিয়ে বললো,’বাবা একদিন না তুমি কালই আসো। আমার মনে হয় মেহের তোমার অনুরোধটা শুনবে!’
আজমল হোসেন নিজের চোখ মুছলেন।কথা বলতে বলতে কখন যে তার চোখ ভিজে উঠেছে তিনি টেরও পাননি। কিন্তু এই মুহূর্তে গাল বেয়ে টপ করে একফোঁটা জল কাঁধের উপর গড়িয়ে পড়ায় তিনি বুঝতে পারলেন তার চোখে জল এসেছে। তিনি মনের অজান্তেই কাঁদছেন।
চোখ মুছে নিয়ে এবার তিনি বললেন,’মা আমি কালই আসবো ইনশাল্লাহ! তুমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো কেমন? টেনশন করো না। কপালে যা আছে তা হবেই।ভাগ্যের লিখুনি ইচ্ছে করলেও কেউ ফেরাতে পারবে না। তোমার কপালে যদি সুখ থাকে তবে তা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।আর তোমার কপালে দুঃখ লেখা থাকলেও কেউ তা দূর করতে পারবে না!’
———– ———– ———-
অফিসে বসে একটা লিস্ট দেখছে মেহের। সেই লিস্টের নাম দেখে ফাইল বের করে সার্টিফিকেট, এবং বিভিন্ন দরকারি পেপারস দেখছে।তার নতুন গড়ে তোলা মেহের গ্রুপের আরেকটি শাখার জন্য দুইজন রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়োগ দেয়া হবে। একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে।যারা ফরেন বাইয়ারদের কাছে তাদের পণ্য রিপ্রেজেন্ট করবে। এই পদে স্যালারি অনেক। তবে সিলেক্ট হতে হলে তাকে অবশ্যই ভালো ইংরেজি জানতে হবে।স্মার্ট এবং সুন্দর হতে হবে।যেন এক পলক দেখলেই মোহগ্রস্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে বাইয়ারেরা। এবং তাদের গলার কন্ঠ হবে মিষ্টি ,মিহি।যেন বাইয়ারেরা তাদের সাথে কথা বললেই একেবারে গলে যায়। অবশ্য এতে অনেক ফাইল জমা হয়েছে।যারা রিটেনে এলাও হয়েছে তাদের সংখ্যা পনেরো।পনেরো জন থেকে বাছাই করে নেয়া হবে মাত্র দুজন।বিষয়টা খুবই কঠিন।মেহের ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ একটা ফাইলের উপর পাসপোর্ট সাইজের দেয়া ছবিটা দেখে চমকে উঠলো সে।কী সুন্দর চেহারা! কী মিষ্টি হাসি।এই মেয়েটির নাম কী?
মেহের ফাইল খুলে নাম দেখলো।
– ‘সাঁজবাতি’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে