উজান ঘাটের মাঝি পর্ব-০৯

0
455

#উজান_ঘাটের_মাঝি
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
#পর্ব_০৯

খুব ধুমধামে আনন্দের সাথে বাড়ির প্রথম বিয়ে অনুষ্ঠিত হলো।প্রথমে সবার মনে একটু নাখোশ থাকলেও পরবর্তীতে মাহামুদের মনের কথা সবাই জানলে সবাই বেশ খুশীই হয়,সানন্দে শাহাবুদ্দিন খানের কথা মেনে নেয়।বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই থাকলো,ছেলের বউ হিসাবে বাড়ির শান্ত মেয়েটাকেই আনলো এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে?
আপন বোন, আর চাচাতো ভাই দুজনের বিয়েতে কোনোকিছুর কমতি রাখতে রাজি না আরফান।মারিয়াকে পরীর মতো করে সাজানো হয়েছে।মারিয়াকে গম্ভীরমুখো মাহামুদের সাথে বসিয়ে ছবি তুলা হয়।মারিয়া কাঁচুমাচু করে মাহামুদের দিকে তাকায়,বরবেশে মাহামুদকে দেখার তীব্র ইচ্ছা দমিয়ে রাখতে পারেনি।সে তাকানোতে মাহামুদ তার দিকে রাগী চোখে গম্ভীর দৃষ্টি নিয়ে দেখে,মাহামুদের এমন দৃষ্টি দেখে মারিয়া ভড়কে যায়,সোজা তাকিয়ে ভাবে মাহামুদ এভাবে তাকাচ্ছে কেনো?সে তো এখন তার স্ত্রী! তাহলে এভাবে তাকাবে কেনো?একটু নরম করে,আদরমাখা চোখে তো তাকাতেই পারতো তাই না!নাকি মাহামুদ তাকে বিয়ে করে সুখী না!হাজারো চিন্তায় জর্জরিত হয়ে মারিয়ার মন খারাপ হয়ে যায়,মূহুর্তে মুখের রঙ বদলে যায়। আরফান ছবি তুলছিলো,সদ্য বিবাহিত স্বামী স্ত্রীর এমন গম্ভীর রূপ দেখে বললো,
“দুজন একটু হাস।মুখটা এমন করে রেখেছিস কেনো?”

আরফানের কথায় দুজনেই হাসার চেষ্টা করে।তিতির পাশ থেকে বললো,
“ভাইয়া একটু কাছে যাও,এতো দূরে বসেছো কেনো?”

তিতিরের কথায় মাহামুদের খুব রাগ হয়,চোখ পাকিয়ে বোনের দিকে তাকায় ঠিক আছে কিন্তু এতো মানুষের মাঝে কিছু না বলে বাধ্য ছেলের মতো কাছে যায়।রোমান্টিক ভঙ্গিমায় কয়েকটা ছবি তুলে আবার আগের অবস্থানে বসে পরে।একটু সময়ের জন্য মাহামুদ যখন কাছে এসেছিলো তখন মারিয়ার বুকটা ধুকপুক করে জানান দিচ্ছিলো মাহামুদ তার স্বামী,তার একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষ।এই পুরুষটা কাগজে,কলমে তার নামে লিখা হয়ে গেছে।এখন অন্তরে লিখা বাকি,মাহামুদের অন্তরে মারিয়া আছে কি নেই তা সে জানে না,অবশ্য আস্তে আস্তে জেনে নেবে।তার দৃঢ় বিশ্বাস সে মাহামুদের ভালোবাসা জয় করে নেবেই।মারিয়া আবার এটাও ভাবে যে মাহামুদ রাজী না হলে কি আর বিয়ে হতো!সব প্রশ্নের উত্তর রাতেই মিলবে।

তিতির আজকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।এতোদিনের চেনা,চাচাতো ভাইকে নিজের সঙ্গী হিসেবে ভাবতেই লজ্জায় গাল ভারী হচ্ছে,না চাইতেই মুখে লাজুক হাসি চলে আসছে।আরফানের মুখোমুখি হলেই রাতের টুকরো ভালোবাসার মূহুর্ত সিনেমার পর্দার মতো চোখের সামনে ভেসে উঠছে,এতো করে লজ্জারাঙ্গা মুখের লাল আভার পরিমান যেনো তরতর করে বাড়ছে।আরফানও কম দুষ্টু না,সে তিতিরকে দেখলেই চোখ মা,রছে,দুষ্টুমি মাখা চোখে বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে।তিতির নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রাখছে,তার কেনো জানি মনে হচ্ছে তার মনের কথা বাড়ির সবাই জেনে যাবে।

রাত এগারোটা।বাসর ঘর সাজানো হয়েছে।সাদা ফুলের মাঝে লাল বেনারসি পরে মারিয়া জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।মাহামুদকে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছা ছিলো আর সেটা যে এতো সহযে পেয়ে যাবে তা সে কখনো ভাবেনি।ভালোয় ভালোয় বিয়েটা তো হলো কিন্তু এখন তার নার্ভাস লাগছে,ভ,য়ে গলা শুকিয়ে আসছে।মারিয়া চুপচাপ বসে আছে,মাহামুদের জন্য অধীর অপেক্ষায় বসে আছে। তার অপেক্ষার প্রহর যেনো শেষ হচ্ছেনা।এভাবে বসে থাকতে থাকতে ছোট মনে উঁকি দেয় হাজারো স্বপ্ন, লাজে লাল হয়ে সে হাসে কিন্তু মাহামুদ আসে না। মাহামুদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তার মন খারাপ হয়,নতুন বউকে এতোক্ষণ বসিয়ে রাখার কোনো মানে আছে?
রাত একটা বাজে মাহামুদ ঘরে আসে।কাঠের ভারী পাল্লা লাগানোর শব্দে মারিয়া দরজার দিকে তাকায়।মাহামুদ চকিত নয়নে একবার মারিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে হ্যাঙ্গার থেকে কাপড় নিয়ে বাথরুমে কাপড় পাল্টাতে চলে যায়। মারিয়া আশায় ছিলো মাহামুদ আসলে সে লাজুক হয়ে তাকে সালাম দেবে,মাহামুদ কথা বলবে আরো কতো কি ;কিন্তু এই পুরুষ যে পরীতুল্য এমন বউকে অবহেলা করে বাথরুমে চলে গেলো।কিছুক্ষণ পরে মাহামুদ বেরিয়ে আসে।মারিয়াকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
“কাপড়চোপড় পালটে,শুয়ে পড়।অনেক রাত হয়েছে। ”

এই কথাটা বলতে বলতে মাহামুদ বিছানার ফুল সরিয়ে আস্তে করে পাশ ফিরে শুয়ে পরে।মাহামুদের কাজে মারিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়,ঠোঁট কেঁপে উঠে,চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে পানির ধারা।মাহামুদের এই অবহেলা সে সহ্য করতে পারে না,বুকে অসামান্য ব্যথা অনুভূত হয়,নিশ্চুপ কান্নায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।বাসর রাত নিয়ে সবারই কতো স্বপ্ন থাকে,মারিয়ারও ছিলো, মাহামুদকে নিয়ে নতুন জীবনে পা দেয়ার ইচ্ছেটা কতো রঙ্গিন ছিলো কিন্তু মাহামুদ এমন করছে কেনো? মারিয়া
কান্নাভেজা চোখে মাহামুদের দিকে তাকিয়ে আছে,তার এখনো মনে হচ্ছে মাহামুদ উঠে বসে হেসে ফেলবে, আর তাকে জড়িয়ে ধরে বলবে,’মজা করেছি।’
কিন্তু না ঘড়ির কাটা টিক টিক করে বয়ে যাচ্ছে মাহামুদ আর উঠে না।মারিয়া ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে,নিজের অপরাধ কোথায় তা বুঝতে পারে না।ছোট মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিয়ের ভারী কাপড় পাল্টানোর কথা ভুলে খাটের এক পাশে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়ে পরে।
কান্নার ফোফানোর শব্দ বন্ধ হওয়ার
পরে মাহামুদ উঠে বসে।গভীর চোখে অপলক তাকিয়ে থাকে লাল টুকটুকে বউটার দিকে।এতোক্ষণ সে সজাগ ছিলো, মারিয়ার প্রতিটা কান্নার শব্দ তার কর্ণগোচর হয়েছে।ঘুমন্ত বউটার দিকে তাকিয়ে সস্থির নিঃশ্বাস ফেললো নিজের একটু কষ্ট হলেও মারিয়ার এই শাস্তিটা পাওয়া প্রাপ্য। হাত বাড়িয়ে মারিয়ার কান্নাভেজা ফ্যাকাসে গাল ছুঁয়ে দেয়।

খুব ভোরে মারিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়।পাশে ঘুমন্ত মাহামুদকে দেখে নতুন জীবনে পদার্পণের কথা মনে পরে।মাহামুদকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পেয়েছে বলে খুশী লাগছে আবার তাকে এমন প্রত্যাখ্যান করেছে বলে কষ্টও লাগছে।মারিয়া ঘুম ভাঙ্গার কারণ হিসাবে আবিষ্কার করলো গায়ের ভারী কাপড় আর গহনাগুলোকে,এগুলোর কারনেই গরমে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে ।নতুন বউ হিসাবে আজকে তার নতুন শাড়ি পরার কথা সে অনুযায়ী মারিয়া নতুন কাপড় হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়।হালকা গোলাপি শাড়ি পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে মারিয়া হতভম্ব হয়ে যায় কারণ ততক্ষণে মাহামুদ কাপড় পরে রেডী।মাহামুদের প্রস্তুতির যোগার দেখে বুঝতে পারে মাহামুদ ঢাকা চলে যাচ্ছে।মাহামুদ মারিয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে বেরিয়ে যায়।মাহামুদের এমন কাজে মারিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলে,মাহামুদ তো এতো নি,ষ্ঠুর ছিলো না তাহলে হঠাৎ এমন নি,ষ্ঠুর আচরণ করছে কেনো?

পনেরো দিন পরে সুফিয়া খানম সবার সাথে আলোচনায় বসে।
“আম্মা,আরশের তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার।”

জয়তুন বেগম বললো,
“হ্যাঁ তা তো করা লাগবেই।”

শাহাবুদ্দিন খান বললো,
“এক কাজ করি মাহামুদের জন্য যে আকবর আলীর নাতনীর কথা বলেছিলাম তা তো আর দেখা হলোনা কিন্তু আরশের জন্য দেখতে তো ক্ষতি নেই।”

জয়তুন বেগম হাত নাড়িয়ে ছেলেকে থামিয়ে দেয়।মুখের পান আয়েশ করে চিবিয়ে বললো,
“এতো মেয়ে দেখা দেখির কি আছে?আমাদের ঘরেই যখন এতো সুন্দর পরী আছে তখন আর বাহিরে যাবো কি দরকারে?”

জয়তুন বেগমের কথায় সবাই চমকে যায়।উনি যে তিতিরের কথা বলেছে এটা কারো বোঝার বাকি নেই।তিতিরের মা প্রতিবাদ করে বললো,
“আম্মা,তিতির তো অনেক ছোট।এসব বলবেন না।”

বউয়ের কথায় জয়তুন বেগম বললো,
“তুমি চুপ থাকো।মহিলাদের এতো কথা ভালো না।”

শাহাবুদ্দিন খান বললো,
“আম্মা!তিতিরকে কিভাবে বিয়ে দেবো?ও ছোট। ”

সুফিয়া খানম বললো,
“মারিয়াও তো তিতিরের বয়সি।মাশাল্লাহ কি সুন্দর বিবাহিত জীবন।”

মহিবুল্লাহ খান বললো,
“না। বুবু তা হয়না।আমার একটা মেয়ে আমার অনেক স্বপ্ন।”

সুফিয়া খানম রেগে বললো,
“আমার ছেলে কি ফালানো?বেয়াদবের মতো তর্ক করবিনা। আমার ছেলের কাছে তোর মেয়ে যতো সুখে থাকবে অন্য কোথাও এমন সুখ পাবে?আমার ছেলের মতো এমন ছেলে পাবি?”

তানিয়া এবার কেঁদে দেয়।স্বামী আর ভাসুরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার মেয়ে আমি বিয়ে দেবোনা।”

জয়তুন বেগম বললো,
“এতো কথার দরকার কি?আরশের সাথেই তিতিরের বিয়ে হবে।আর এটাই আমার সিদ্ধান্ত।আমার সিদ্ধান্তই এই বাড়ির চূড়ান্ত কথা।”

এই বিয়ে নিয়ে হাজারো কথা কাটাকাটি হয় কিন্তু কেউ জয়তুন বেগমকে উনার সিদ্ধান্ত থেকে নাড়াতে পারে না।শেষে জয়তুন বেগম বললো,
“আমার ছেলে হিসেবে যদি আমার কথা না রাখিস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি।বুড়া বয়সে আমি ক,লঙ্ক করে ম,রবো।”

মায়ের এমন কথার পরে আর কোনো কথা হয়না,ছেলেরা আর কিছু বলার সাহস পায় না।আরশের সাথে তিতিরের বিয়ে ঠিক হয়।কলেজ থেকে বাড়ি এসে এসব শুনে তিতির গলা ছেলে কাঁদে।দেয়ালের সাথে কপাল আ,ঘাত করে কপাল ফুলিয়ে র,ক্তাক্ত করে ফেলে।চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলে,
“আম্মা,আমি কিন্তু বিয়ে করবো না।এই বুড়িকে বিয়ে দাও।আমাকে কেউ বিয়ের কথা বললে আমি বি ষ খেয়ে নেবো।”

মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে মহিবুল্লাহ খান এগিয়ে আসে।উনার আম্মাকে উনি অনেক মান্যগণ্য করেন।মেয়ের গালে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
“এতো কথা বলছিস কেনো?বিয়ে ঠিক হয়েছে বিয়ে হবে।এতো কথা বলবি না।”

তিতির রুমে গিয়ে আরফানকে ফোন দেয় কিন্তু ফোন বন্ধ।বন্ধ ফোনের দিকে তাকিয়ে তিতির কেঁদে দেয়।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে