#উজানের_ঢেউ ( ৯)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
তাহলে রাবুর কথা সত্যি হলে, আমার বিয়ে কার সাথে ঠিক করলো বাবা, মা? কার সাথে?
এলোমেলো ভাবনায় জড়ানো পায়ে সামনের উঠানে গেলাম মাকে না দেখতে পেয়ে। মা উঠানে বসে বটি দিয়ে নারকেল শলা নিচ্ছে পাতা ছাড়িয়ে। আমি শলাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছি হাতে তুলে। মা বিছানা ঝাড়ু তৈরি করবে এই নারকেল শলাগুলো দিয়ে। রাজন অন্যদিকের এক চাচীর কাছে রয়েছে। নয়ন সেই উঠানে ফুটবল খেলছে অন্যদের সাথে। রাজন মুগ্ধ দর্শক হয়ে একমাত্র মামার খেলা উপভোগ করছে উৎসুক দৃষ্টিতে।
খুউব মন চাচ্ছে মাকে জিজ্ঞেস করি রাবুর বলা কথাটা। এমন কল্পনার সূতো ছিঁড়ে যায় উঠানে রাবুর পদধ্বনি দেখতে পেয়েই।
আমি পাশে থাকায় রাবু মার সাথেও কথা বলেনি। সোজা ঘরে ঢুকে গেলো। রাবুর চেহারার বেশ দেখে দমে গেলাম। তাকে জিজ্ঞেস করতে গেলেই এখন তেড়ে আসবে। মা কাজ করতে করতে বলল,
” তোর বোনের কি হয়েছে? সকাল থেকেই দেখি গাল ফুলিয়ে রাখছে বেলুনের আকারে?”
আমি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলাম। সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত হলাম।
বললাম,
” আমি জানি কারণ টা।”
” কি হইছে আবার ঢংগীর? উনার আহ্লাদীপানার শেষ নাই। জ্বালাইয়া মারলো আমারে। ”
মায়ের কন্ঠে রাবুকে নিয়ে বিরক্তির রেশ।
বললাম,
“আমি রাতে ওর গালে থাপ্পড় মারছি। জোরেই দিলাম। তবে থাপ্পড় ছিলো একটাই।”
মায়ের হাত থেমে গেলো। নেমে গেলো বটি থেকে। সন্ধিৎসু চোখে চাইলেন আমার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন,
” করছেটা কি হারামজাদি? বোনের হাতেও চড় খাইতে হলো?”
” রাবু গত সন্ধ্যায় আমার সাথে ফাজলামি করছে। ”
” কি করছে কবি তো? ”
” আমি আসছি শোকের বাড়ি থেকে। মন মেজাজ খারাপ। নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে বসে দুরুদ পড়ছি তসবিহ হাতে। ও পট করেই বলে উঠলো,
আপা তোর বিয়ে। আব্বা ঠিক করছে। আমরা সবাই রাজী। ”
আড়চোখে লক্ষ্য করলাম,
আমার কথা শুনেই মায়ের চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। রাবুর উপর ক্ষেপে গেলো। মা বলল,
” তাহলে ঠিক করেছিস। কিসে খোঁটায় মনে হয় তারে। বদের হাড্ডি একটা। মন চায় আমিও গিয়ে চেঁচা দিই। ”
” আমি তো ভাবছি রাবু আমার নামে বিচার দিবে তোমার কাছে। কিন্তু দেখলাম চুপ। বিষয়টা ব্রেনে ধরলনা মা।”
মা চুপ রইলো। রাবু শুনতে পেলো আমার কথা। উঠানে এসে ঠোঁট উল্টিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,
” আম্মার কাছে বলিনাই, তারমানে এই না আমি মিথ্যা কইছি।”
আমি তব্দা খেলাম রাবুর কথা শুনে। নিমিষেই মায়ের ফর্সা নাক মুখ লাল হয়ে গেলো। মা বটি ফেলে উঠে গিয়ে রাবুর দুই গালে দুই থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। গজগজ করে রাবুকে বললেন,
” এই বান্দরনী। ফিডার খাস?কিসের পড়াশুনা করিস? সামান্য আক্কেলজ্ঞান নাই। কি বলছে তোর বাপে তোরে? পঁচা পুঁটি কোথাকার। পেটে কথা হজম হয়না। ঘর থেকে বাইর হইয়া যা বলছি।”
মায়ের কথা শুনে বুঝলাম রাবুর বলা সত্যি না হলেও মিথ্যে নয়। সত্য মিথ্যার মাঝামাঝি কিছু একটা হবে। রাবু দুই পা দিয়ে আছাড়ি পিছাড়ি করে মারতে লাগল ঘরের টিনের বেড়ার মাঝে। আমি বিশেষ ঘাটালাম না রাবুকে। ক্ষেপানো ব্যক্তিকে দরদ দেখাতে গেলে প্রশ্রয় পেয়ে সে আরো বেশি ক্ষেপে যায়।
#রেহানা_পুতুল পেইজে 👉Like ও Follow দিয়ে আমাকে বাঁচার পূর্ণ আনন্দটুকু দিবেন। প্লিইজ।🙏🥲💚
উঠানের কাজ সব গুছিয়ে নিলাম। মা খোয়াড়ে হাঁসমুরগি ঢোকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পুকুরঘাটে গেলাম হাতমুখ ধোয়ার জন্য। পারুল ভাবির সাথে দেখা হলো। ভাবির চোখের চাহনিতে কৌতুক খেলা করছে।
নিচু গলায় জানতে চাইলাম,
” এই ভাবি কাল যে বললে আমার বিয়ে। আব্বা ঠিক করছে। এটা তুমি কিভাবে জানো?”
ভাবি চারদিকে নজর বুলিয়ে নিলো। নেত্রপল্লব না ফেলেই বলল,
” আমার দেবর মাহমুদ আমার কাছে চুপিচুপি বলছে তোকে বিয়ে করবে। প্রস্তাব পাঠাবে কাকার কাছে।সেতো তোরে আগে থেকেই লাভ করে।”
” তাহলে বললে যে বাবা ঠিক করছে?”
” ওটা বাড়ায়া বলছি। কাকা জানেই না। মাইন্ড করিস না তুই।”
পারুল ভাবি চলে গেলো। আমি ঘাটের উপরের সিঁড়িতে উঠে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়ালাম। মুখ তুলে গগনপানে চাইলাম। মাথার উপরে বিস্তৃত রক্তিম আকাশ। শারদীয় সাঁঝলগ্ন। অপূর্ব, অকল্পনীর মন ভালো করা দৃশ্য। তবুও মন ভার হয়েই রইলো। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ম্রিয়ম্রাণ লাগছে আমার কাছে। চারপাশের প্রকৃতিতে ভর করছে ক্রমশ গা ছমছমে নির্জনতা। হাঁটা ধরলাম পা বাড়িয়ে ঘরের দিকে।
সন্ধ্যার পরে ইউটিউব ও গুগল দেখে নোটপ্যাডে পার্লারের জিনিসপত্রের লিস্ট লিখে নিলাম সিরিয়াল করে। যদিও বেশ সময় লাগলো বুঝেসুঝে লিখতে। লিখা শেষে আঞ্জুমানকে ফোন দিলাম। জানালাম। সে বলল,
” রত্না, শুন দোস্ত, হুট করে কিছু কিনে ফেলিস না। আগে পার্লারের জন্য রুম ঠিক হোক। আর তুই পারলে কাল মার্কেটে আয় একবার। এখানে আমার পরিচিত পার্লার রয়েছে। সরাসরি কথা বলব তুই আমি। কি কি শুরুতেই লাগবে। এবং কি কি পরে হলেও চলবে। এসব জেনে নিলে তোর জন্য সহায়ক হবে। ”
” ভালো বলছিস আঞ্জুমান। প্রাণঢালা ভালোবাসা নিসরে। কিনবনা তো। জাস্ট লিখে রাখছি। কিনব তো পরেই। কাজ এগিয়ে রাখা বলে যাকে। ”
কিছুক্ষণ কথা বলে আঞ্জুমান থেকে বিদায় নিলাম। মনের ভিতর উসখুস করছে বিয়ের বিষয়টা নিয়ে। মা বাবা যেহেতু নিজ থেকে কিছু বলেনি। বরং মনে হলো লুকিয়ে রাখছে কিছু। তাই তাদের জিজ্ঞেস করার বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলি। রাবু থেকেই বিষয়টা ক্লিয়ার হতে হবে। কিন্তু রাবুকে এখন কিভাবে কোনমুখে জিজ্ঞেস করবো। সেটা বড় প্রশ্ন। সবমিলিয়ে একটা বাজে কাণ্ড ঘটে গেলো। বিচ্ছিরি অবস্থা। রাবুর জন্য মন পুড়ছে অতিরিক্তভাবে। বেচারি আমার জন্য দুজনের হাতে মার খেলো। ভারি অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেলাম। ভেবে রাখলাম, দু তিনদিন যাক। রাবুও একটু নরমাল হউক। তখন জেনে নেওয়া যাবে। এত অস্থির হয়ে এখন কোন লাভ নেই।
আমি ও রাবুর মাঝখানে রাজন ঘুমিয়ে আছে। রাবু কোন কথাই বলছেনা আমার সঙ্গে। বিছানার একপাশ হয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছে। আমার ঘুম আসছে না। সত্যি বলতে সেই নিশি রাতের নিস্তব্ধতায় মাহমুদ ভাইয়ের কথাগুলো বারবার উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো মনের আরশিতে। চাইলেও সরাতে পারছিনা তাকে। ভোলার জন্য ঘুমের ট্যাবলেট ইপনিল খাই। তন্দ্রাঘোরে হেলে পড়ি অল্পসময়ের ব্যাবধানেই।
পরেরদিন রাজনকে মায়ের কাছে রেখে বেরিয়ে পড়ি। আঞ্জুমানের ফাস্টফুড দোকানে যাই। ও জোর করে অনেক কিছু খাওয়ালো। পরে ওকে নিয়ে সেই পার্লারে যাই। অনেক না জানা কিছু জানলাম। সঞ্চিত হলো নতুন অভিজ্ঞতা।
দুইদিন পর রাতে মাহমুদ ভাই ফেসবুকে মেসেজ দিলো।
” কেমন আছিস পানকৌড়ি? কবে দিবি ডুব সাঁতার। আসবি কবে আমার কাছে?”
আমাকে ছোটবেলা থেকে প্রকাশ্যেই পানকৌড়ি বলে ডাকে মাহমুদ ভাই। আমি পুকুরে গোসল করতে নামলে একঘাটে ডুব দিয়ে আরেকঘাটে গিয়ে ভেসে উঠতাম মরা মাছের মতো। এদিকে অন্যরা আমাকে পানিতে এদিক সেদিক চেয়ে খুঁজতো। মাহমুদ ভাই দু চারদিন দেখে গিয়েছে। এমন এক দুপুরে মাকে বলে উঠে, চাচী,
” ওর স্বভার দেখি পানকৌড়ি’র মতন। ডুব দিয়ে অন্যদিকে গিয়ে ভেসে উঠে। ওর নাম দিলাম আমি পানকৌড়ি। নামটা সুন্দর না চাচী? ”
মা হেসে সায় দিতো মাহমুদ ভাইয়ের কথায়। মায়ের বড় ছেলে নেই বলে মাহমুদ ভাইকে মা বেশী ভালোবাসে। মা তখন বলছে,
“তুই নাম দিছিস। তাই তুই ডাকিস বাপ ওই নামে। আর কারো ডাকার দরকার নেই।”
তখন মাহমুদ ভাই আমার চুলের ঝুঁটি ধরে টান মেরে,
” কিরে পানকৌড়ি, তোর নামের নিবন্ধন তো করে ফেললাম। তোর আপত্তি আছে?”
আমি বত্রিশ দাঁতের পাটি মেলে ধরে খিলখিলিয়ে হেসে উঠতাম। কিছুই বলতাম না। একদৌড়ে অন্যদিকে ছুট দিতাম চঞ্চল চড়ুই পাখির মতো। এই গল্প আমার আজকালকার নয়। কিশোরীবেলার।
আমি মেসেজ সিন করে চুপ করে আছি। খানিক পরেই মনে যা আসলো লিখলাম। কিছু একটা ভেবে কেটে দিলাম। মাহমুদ ভাইয়ের আইডি থেকে পূনরায় মেসেজ এলো,
” এতসময় যা টাইপিং করেছিলি। লিখে এগেইন সেন্ড কর। কুইক।
“আপনি কি বেকার মাহমুদ ভাই? আর কোন কাজ নেই? আমি টাইপিং করেছি। তাও ফলো করেছেন?”
” আমি তোর চিরদিনের ফলোয়ার।জীবনের ফলোয়ার। ফলো যে করতেই হয় পানকৌড়ি। ”
” কে পানকৌড়ি? কিসের পানকৌড়ি? আমার সুন্দর একটি নাম রয়েছে। রত্না।”
**” তুই আমার যৌবন কালের উড়ন্ত পানকৌড়ি, তোতে মন ডুবছে সারাক্ষণ।
তুই সকাল সন্ধ্যাকালে, চুপটি করে বসে থাকিস, আমার হৃদয় বৃক্ষ শাখে।
তুই দুষ্টমিতে মেতে, বরষার একলা দুপুরে,
শিস দিয়ে যাস আমার,সরস প্রেমের ক্ষেতে।” **
মাহমুদ ভাইয়ের এই কাব্যিক নিবেদনে কি রিপ্লায় দিব বুঝে উঠতে পারলাম না।
“শুভরাত্রি ” বলে অফলাইনে চলে এলাম। কিন্তু নিজের অজান্তে,অনাগ্রহে সুপ্ত চিত্তখানি তাকে নিয়ে কল্পনায় ফানুস উড়াতে লাগলো। একদিকে মাহমুদ ভাইয়ের আকুল করা হাতছানি। আরেকদিকে বাবা নাকি বিয়ে ঠিক করলো। মানসিক টানাপোড়েন ও দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলাম। আহ! বেঁচে উঠাই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে আমার জন্য
দুদিন কেটে গেলে একটু আধটু করে রাবু আমার সাথে কথা বলা শুরু করলো। তবে সেই পরিবেশটা আমিই ক্রিয়েট করেছি। রাবুকে বুকে টেনে নিয়ে স্যরি বলেছি। এটা ওটা বানিয়ে সামনে নিয়ে গিয়েছি। রাবুও বুঝতে পারলো আমারো ভুল ছিল না ওকে চড় মারাতে।
একসপ্তাহ হলো ডিভোর্সের তিনমাস পূর্ণ হয়েছে। রাজনের বাবা আমাকে ফোনদিয়ে কখন কবে কোর্টে থাকতে হবে জানিয়ে দিলো। এবং এও বলল সেই সব কাগজপত্র গুছিয়ে রেড়ি করে রাখবে। আমি আচ্ছা বলে রাখলাম। গুরুত্বপূর্ণ কথার বাইরে একটি শব্দও সে উচ্চারণ করেনি। নিশ্চিত হলাম শিরিন তাড়া দিয়ে এটা করাচ্ছে। নয়তো কখন আবার সে আমাকে নিয়ে যায়। রিস্ক থেকে যায়।
আজ একটি চিরবন্ধন আনুষ্ঠানিকভাবে ছিন্ন হবার দিন। ভিতর টা কেনো জানি পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে। আমার জন্য নয়। আমার রাজনের জন্য। ব্রোকেন পরিবারের সন্তান হয়ে সে বেড়ে উঠবে। বেঁচে থাকবে পিতৃ পরিচয়হীন হয়ে। ভাবতেই কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো।
আমরা সবাই গেলাম কোর্টে। সে এবং তার রিলেটিভ দুজন পুরুষ ছিলো। আমি এদের তেমন চিনিনা। আমি মুখ না ঢেকেই মাথায় হিজাব বেঁধে ছিলাম। রাবু চোখের ইশারায় আমাকে বলছে, আশরাফুল নাকি বারবার আমার মুখের দিকে দেখছে। সে লেনদেন নিয়ে ঝামেলা করলো না। প্রাপ্য টাকা পুরোটাই দিলো। রাজনের জন্য মাসান্তে খরচ কত দিবে। তাও চুড়ান্ত হলো। আমি তার দিকে একপলকও চাইনি। বরং সজাগ ছিলাম দৃষ্টি যেনো না পড়ে। সেটাও নাকি সে পরখ করে দেখছে। এমন হীন আর কুৎসিত মানসিকতার মানুষের দিকে ভুল করে তাকাবার রুচিবোধ নষ্ট হয়ে গিয়েছে সেই কবেই।
সে হঠাৎ করে আমাকে অনুরোধের ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
” রত্না আমি একটু কথা বলতে চাই তোমার সাথে একাকী।”
” আমি প্রয়োজন মনে করিনা একদম।”
বিরস কন্ঠে অন্যদিকে চেয়ে বললাম গলায় তেজের ঝাঁপি ঢেলে। সে মা,বাবার কাছে মাফ চেয়ে আরজি করলো আমাকে যেনো বলে, তার সাথে কথা বলতে।
আমার পক্ষের কেউই তার ভুলানো কথায় গলে গেলো না।
আমি কোর্টে উকিলকে বললাম,
” আমি সাইন কোথায় করবো? পেপারস দেন।”
সে অসহায়ের মতো মুখ করে মায়া মায়া কন্ঠে আমাকে বলল,
” নাহ! রত্না প্লিজ! আমার কিছু কথা শোনো সাইন করার আগে।”
চলবে..