#উজানের_ঢেউ ( ৭)
কলমে✍️ #রেহানা_পুতুল
“ভাবি যত দ্রুত সম্ভব বাবাকে শেষ দেখার জন্য আমি আসছি রাজনকে নিয়ে।”
ভাবি ফোন রেখে দিলো। আমি আহত কন্ঠে মাকে বিষয়টা বললাম। মা বাবাকে মোবাইলে জানালো। বাবা যেতে বলল। তবে একা যেতে বারণ করলো। এবং এটাও বলে দিলো মাকে, সাবধানতা অবলম্বন করেই যেনো তাদের বাড়িতে থাকি। যেহেতু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন ও নাজুক।
মা বলল,
” রাবুকে নিয়ে যা। রাজনকে রাখতে পারবে সে। তুই যেভাবে বললি, তাতে বেশি সুবিধা ঠেকল না আমার কাছে। ”
রাবুকে ডাক দিয়ে যেতে বললাম আমার সঙ্গে। রাবু চনচনিয়ে উঠল।
বলল,
” আমি যাবনা ভাই। মাফ চাই। আমার আজ জরুরী ক্লাস আছে কলেজে। ওই কুত্তাদের বাড়িতে কে যায়। আমার মাথা বিগড়ে গেলে বাজে আচরণ করে ফেলব ওদের সাথে। সো তার চেয়ে বেটার,তুই নয়নকে নিয়ে যা। মাত্র সেভেনে পড়ে ও। ভোলাভালা নাদান শিশু। চুপচাপ থাকবে রাজনকে নিয়ে।”
আমি গোমড়া মুখে মার দিকে চাইলাম। মা আমাকে ইশারা দিলো চুপ থাকতে।
রাবুকে বলল,
” নয়নকে আমার কাছে পাঠা। তুই যা তোর ব্যারিস্টারি পড়তে।”
রাবু বিরক্তিকর কন্ঠে মাকে বলল,
” তুমি পারনা যেতে? তোমার তো বেয়াই লাগে।”
” আগের মতো হলে আমি কেন, আমরা সবাই যেতাম। কিন্তু যেখানে আমার মেয়ের ভাত উঠে গেলো সেই সংসার থেকে। ওসব আজরাইলের দুয়ারে কে যায়। ”
প্লিজ #রেহানা_পুতুল পেজে like ও Follow দিয়ে আমাকে বাঁচার আনন্দটুকু দিবেন। 🙏🥲
নয়ন মায়ের তাড়া পেয়ে পুকুর থেকে গোসল করে এলো। অল্পক্ষণেই শার্ট প্যান্ট পরে নিলো। আমিও গোসল করে তড়িঘড়ি করে রেডি হলাম। মা রাজনকে রেডি করে দিলো। বাবা বাজার থেকে এলাকার পরিচিত সিএনজি পাঠিয়ে দিলো বাড়িতে। গ্রামের পথেঘাটে শহরের মতো জ্যাম নেই। ভিড় নেই। জটলা নেই। তাই হোসেনপুর গ্রামে পৌঁছাতে আমাদের সময় লাগলো না।
তাদের উঠানের একপাশে কয়েকটি কুকুর অনবরত ঘেউ ঘেউ করে ডেকে যাচ্ছে। একটি কাক গলা ফাটিয়ে ককর্শ স্বরে ডেকে যাচ্ছে। ছোট ছোট কিছু বাচ্চা ঢিল ছুঁড়ে মারছে তাকে তাড়াবার জন্য। আমি গলা উঁচিয়ে দেখলাম, কাকটি স্থান পরিবর্তন করলো নিজেকে আত্মরক্ষার চেষ্টায়। তবে চলে গেলনা। হয়তো অভুক্ত কুকুরটি বুঝতে পেরেছে আজ এ বাড়িতে মাংস রান্না হবে।
ঘরের ভিতর থেকে গুমরে গুমরে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রাজনের দাদাকে ঘরের সামনের রুমে মাটিতে বড় একটা বেতের পাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বন্ধ চোখে উনার জীর্ণশীর্ণ দেহখানি নির্জীবের মতো পড়ে আছে। আমি বাবা বলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। পাশে একটি বাটিতে পানি ও চা চামচ রাখা ছিলো।
উনার মুখে দুই চামচ পানি দিলাম।
ধরা গলায় মিনতি করে বললাম,
” বাবা আমি রত্না। কখনো যদি কোন ভুল করে থাকি আমাকে মাফ করে দিবেন আল্লারওয়াস্তে।”
তারপরেই উনার হৃৎকম্পন থেমে গেলো চিরতরে। সাঙ্গ হলো এক মানব সন্তানের ইহলীলা। বাড়ির অন্য মুরুব্বিরা উনার মাথার নিচ থেকে বালিশ সরিয়ে নিলো। আগেই প্রস্তুত রাখা একরঙা বিছানার চাদর দিয়ে উনাকে আপাদমস্তক ঢেকে দিলো। আমি ঢুকরে কেঁদে উঠলাম। তবে জানিনা আমার কন্ঠ ও কথা শোনার মতো শ্রবণশক্তি উনার ছিলো কিনা।
তার আগেই কিন্তু রাজনের দাদী নয়নের কোল থেকে রাজনকে টেনে নিলো। তার গালে কপালে অজস্র চুমু খেয়ে বলল,
দাদুভাই দাদাকে দোয়া করে দাও। মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। বলে রাজনের কচি হাতখানিকে তার দাদার মাথায়,মুখে বুলিয়ে নিলো বার কয়েক।
মৃত বাড়ি। শোকের কলরবে চারপাশ মুখরিত। থেকে থেকে অশ্রু বির্সজন দিচ্ছে রাজনের দাদী ও ফুফুরা। রাজনের চার ফুফু। রাজনের বাবা সবার ছোট ও আদরের। অধিক স্নেহ মমতা পেয়েই নাকি সে উচ্ছনে গিয়েছে তাদের ভাষ্যমতে। বাড়িতে সবাই উপস্থিত রয়েছে একজন ছাড়া। রাহিমা আপা ঢাকা থেকে আসলেই লাশ দাফন সম্পন্ন হবে। আমার ভাসুর শহীদ ও অন্যান্য বাকি আয়োজনে ব্যস্ত।
শিরিনের পরিবারের সবাই আছে। তার মা, বোনের জামাইয়ের জন্য আকূল হয়ে বিলাপ করছে। আমার বিশ্বাস ছিলো শিরিন ও তার নব্য স্বামী রাহিমা আপাসহ একসাথেই আসবে। যেহেতু তারা তার বাসায় ছিলো আমার জানামতে। আমার বিশ্বাস উবে গেলো। রাহিমা আপা,তার স্বামী ও তার ছেলেমেয়েরা এলো ঢাকা থেকে। বাকি দুজন নেই। আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। হতবিহ্বল হয়ে গেলাম আমি।
পারিবারিক বেদনার চেয়ে ব্যক্তিগত বেদনা,ক্রোধ আমাকে ঘিরে আছে।
লাশ দাফন হয়ে গেলো। বাড়ির অন্যদিকে রান্না হলো মৃতের পরিবারের জন্য। নয়নের ক্ষুধা লেগে গেলো। গাইঁগুই করছে আমার কাছে এসে। পরে তাকে রাজনের চাচাতো বোন ভাত, মাংস, মাষকলাইয়ের ডাল এনে দিলো টেবিলে।
আমাকে রাজনের দাদী ও ফুফুরা জোর করলো খেতে। আমি বিপুল অনাগ্রহ প্রকাশ করলাম খেতে। এবং খেলামও না।
শেষ বিকেল হয়ে গিয়েছে। ঝিমানো প্রকৃতিতে রোদের তেজ মৃদু হয়ে এলো। চলে যেতে হবে। সত্যিটা জানা জরুরী। আমি লায়লা ভাবিকে নিরালায় ডেকে জিজ্ঞেস করলাম ভাবি,
“বাবার লাশ দেখতে তার ছোট ছেলে এলনা কেন? কেমন সন্তান সে?”
লায়লা ভাবি আমার হাত ধরে বাঁশঝাড়ের পিছনে নিয়ে গেলেন। দুঃখ ও ক্ষোভ মিশ্রিত চাপানো স্বরে বললেন,
” বাড়ি ভর্তি লোকজন। ক্যামনে বলিই সব। সন্তান না শয়তান বল ওই লুইচ্চারে। সংক্ষেপ কইরা বলি। বাড়িতে আসেনাই, কারণ বাবা তাকে সব সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে দিছে রেজিষ্ট্রি অফিসে গিয়াই। ত্যাজ্যপুত্রও করে দিছে কাগজে কলমে। সবাইকে বলছে তার মরামুখ ও যেনো সে না দেখতে আসে। এইই।
কারণ তোমারে ছাইড়া দিলো সে
।আর রাজনরেও চায়না তার জীবনে।
আর বাকিটা হলো আজাদ ভাই নাকি বিদেশ থাকতেই শিরিনের বিয়া ঠিক করছে ঢাকার কোন বাড়িওয়ালার ছেলের লগে। তো এখন তো পুরাই বেইজ্জতি হইলো সে। উনি ঢাকায় গিয়া কৌশলে শিরিন ও তারে খুঁইজা বাইর করছে। তারপরে লোকজন নিয়া ইচ্ছামতো নাকি মারলো। শিরিনরেও নাকি মারছে। দুজনেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলো কতদিন। এখন নাকি নরসিংদী তার কোন বন্ধুর বাসায়। আমার কাছেতো তোর নাম্বার আছে। কখন কি হয় তোরে জানামু। আবার এরা দুই বোনের পরিবার ফোনে ফোনে দুই গ্রামে থেকে কি যে তুমুল ঝগড়া হইতো। কি বাজে কথা বলতো একজন আরেকজনকে। বলার মতো নয়। ”
ভাবির কথা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। বিস্মিত কন্ঠে বললাম,
” কি বলছেন ভাবি! সব সম্পত্তির থেকে বঞ্চিত? ত্যাজ্যপুত্র? বেধড়ক মার? কি ভয়ংকর অবস্থা! অবশ্য এসব তার পাওনা তাই পেয়েছে। যেমন কর্ম তেমন ফল। ঠিকই করেছে বাবা। জন্মদাতা পিতাকে না দেখতে পারার মতো দূর্ভাগ্য আছে আর পৃথিবীতে?”
ভাবি পরিতাপের সাথে দম ফেললেন। বললেন,
” সেটাই। তুইতো এখন চলে যাইবি। ভালো থাকিস। আমারে ভুল বুঝিস না। তোকে আমি বোনের মতই জানিরে।”
” ভাবি আপনার সাথে আমার কোনকালেরই দ্বন্ধ নেই। আর সেই পথও রইলো না আর। আচ্ছা, ভাবি লুইচ্চা কেনো বললেন তারে?”
লায়লা ভাবি চোরের মতো লুকানো চোখে এদিক সেদিক চাইলেন। ফিসফিস করে বললেন,
” তোর মায়ের কসম দিয়ে বলছি, আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করিস না ভুলেও। তার চরিত্রেও সমস্যা। সে তোকে বিয়ে করার আগে আমার শরিরের স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে বাজেভাবে হাত দিতো সুযোগ পেলেই। সত্যি বলতে একদিন জোর করে ধর্ষণ ও করছে আমারে। তোর ভাইও এটা জানেনা। আমাকে সে হুমকি দিয়ে দিছে। তাই ডরে বলিনাই। চুপ মাইরা ছিলাম। আজ সে তোর জীবনে নাই।তাই বলতে বাধ্য হইছি। তুই আরেকজন কে বিয়ে নিস বইন। ”
ভাবির কাছে ওকথা শুনেই আমার বমি আসার অবস্থা হলো ঘৃণায়। ধিক্কার! এমন জঘন্য ও হীন চরিত্রের মানুষের জন্য। ভাবি তার ও শিরিনের প্রেম নিয়ে কিছু বলতে গেলেই থামিয়ে দিলাম।
” ভাবি সে আমার জীবনে অভিশাপ। তার নোংরা নিষিদ্ধ সুখের গল্প শুনে আমার বিশুদ্ধ সময়টাকেও কলংকিত করার কোন রুচিবোধ নেই আমার। মাঝে মাঝে আপনাদের খবর নিবো।”
ওদের সবার কাছে বলে বিদায় নিয়ে চলে এলাম আমাদের বাড়ি।
বাড়ির কাচারি ঘরের সামনেই নেমে পড়লাম। নয়ন রাজনকে নিয়ে ঘরের দিকে চলে গেলো। আমি বোরকা খুলে নিলাম। পুকুর ঘাটে গিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য অজু করে নিলাম। উঠে আসার সময় ঘাটে সেই পারুল ভাবির সাথে দেখা। উনি আমাকে দেখেই কেমন রহস্যভরা চোখে হাসলেন।
বলে উঠলাম,
” আমি মরা বাড়ি থেকে আসলাম। মন বেজায় খারাপ। আর তুমি হাসছো ভাবি? ভূতে ধরছে নাকি তোমাকে?”
” সেটা তোর বিষয়। আমি হাসছি একটা কঠিন সুখবরর আছে। তাই। ”
আমি কন্ঠে দারুণ অনীহা প্রকাশ করে বললাম,
” চাইলে বলতে পারো। শোনার তেমন ইচ্ছে নেই। গেলাম”
” কাকা তোর বিয়ে ঠিক করেছে। মশকরা নয় রত্নু।”
আমি একমুহূর্ত আর সেখানে দাঁড়ালাম না। ধুপধাপ পায়ে ঘরের ভিতরে ঢুকলাম। নামাজ পড়ে নিলাম। তসবিহ গুনছি মৃত শ্বশুরের জন্য। মনটা হাহাকার করছে উনার সান্নিধ্যে কাটানো মুহূর্তগুলোকে স্মরণ করে। আহা মানব জনম। ইহজগতে আমরা ক্ষণিকের অতিথি। তবুও আমাদের দম্ভ,অহমিকা ও স্বার্থপরতার অন্ত নেই।পারুল ভাবির কথা গায়ে মাখলাম না। এর মনে যখন যা আসে তাই বলে ফেলে। তামাসার বিষয়কেও পারুল ভাবি সিরিয়াস মুডে বলতে পারে।
রাবু আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কিছু বলবে বলবে ভাব তার মুখমন্ডলে। বললাম,
” কিরে কিছু বলবি? কোন আকাম করছিস নাকি?”
রাবু ঈষৎ হেসে বলল,
” আপা তোর বিয়ে। আব্বা ঠিক করেছে। আম্মাও রাজী। আমিও রাজী।নয়ন কে আমরা হিসেবে ধরিনা। রাজন তো ল্যাদা। তুই কি আব্বা আম্মার পছন্দকে ইগনোর করতে পারবি?সো বিয়ের সানাই বাজবেই। রাবু এবার নাচবেই। আগেতো পিচ্চি ছিলাম।কুদাকুদি করতে পারিনাই। এবার খেলা হবে।”
আমি বোকা বোকা স্তব্ধ চাহনিতে কেবল ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে রইলাম রাবুর দিকে।
চলবে.. ৬