#ইমপারফেক্ট_কাপল
#পর্ব_০১
#লেখা_রিমি_ইসলাম
গানের তালে তালে উড়াধূড়া নাচতেছি। এদিকে আমার নাচের ঠেলায় পরনের শাড়ি বইন কখন যে খুলে ছিটে পড়েছে খেয়াল হয়নি। বান্ধবী তিথি ইঙিত করতেই চোখ দিয়ে দেখেই দিলাম ভৌ দৌড়। কিন্তু এখানেও পাকে প্যাঁচ। দৌড় দিতে হুশ হলো ওয়াশরুম কোনদিকে আমার জানা নেই।
একে ওকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে লেডিস ওয়াশরুম খুঁজে ঢুকে দরজা না লাগিয়েই আমার কাজে লেগে পড়ি। শাড়ির নাস্তানাবুদ হাল।
সব কুচি খুলে একজোট পাকিয়ে আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে। মাগো মা, জম্মে পরি নাই শাড়ি। তারপর এই অবস্থা দেখে আমি শেষ। কোনোরকম যেনো তেনো ইউটিউব ঘেঁটে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পড়ছি।
ঠিক এ সময় হুড়হুড় করে কেউ একজন ঢুকে দরজা লাগালো। প্রথমে তোহাক্কা করিনি। কারণ
মহিলা টয়লেটে মহিলা ছাড়া আর কেউ ঢুকবে না সেটা নিশ্চিত। তবে বাইরে প্রচুর আওয়াজ হচ্ছে। অস্পষ্ট কানে আসছে যার অর্থ বুঝতে পারছি না।
— ওহ গড্, আরিয়ান জাহিদ। প্লিজ ওপেন দ্যা ডোর।
দরজা ভেঙে ফেলার মতো বাইরে থেকে চিৎকার আর সাথে ফ্রিতে লাথি তো আছেই।
আমি কুচিতে ভাঁজ ফেলতে ফেলতেই বললাম,
— আপু প্লিজ দরজা খুলে দেন। কারো ইমার্জেন্সি হতে পারে।
— নো ওয়ে। ওরা নির্ঘাত খেয়েই ফেলবে আমাকে।
কথাটা ভরাট পুরুষালি গলার যা আমার হৃদয়ে গভীর কাঁপন ধরালো তৎক্ষনাৎ। আল্লাহ, লেডিস টয়লেটে ছেলে কি করে? খারাপ কোনো উদ্দেশ্যে আমাকে ফলো করে চলে এলো না তো? এবার চোখ পাকিয়ে
তাকাতেই সাথে সাথে চোখ জোড়া আমার
কোমল হয়ে উঠলো। আতঙ্ক আর ভয়ের জায়গায় ঠোঁটে ফিনিক হাসি এসে ভরে গেল।
বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার সামনে আরিয়ান জাহিদ অর্ক। বর্তমানের জনপ্রিয় ইউটিউব সিংগার আমার সামনে দাঁড়িয়ে। তার কনসার্ট
এ্যটেন্ড করতেই তো ফ্রেন্ডদের সাথে এখানে
আসা৷ আর এসেই মাঝপথে শাড়ি আমার সাথ ছেড়ে দিলো। ছেলেটা দেখতে মহামারী ভাইরাসের মতো। আর বাস্তবে তাকে দেখে আমি আক্রান্ত হয়ে গেছি। একবার দেখলে দেখতেই ইচ্ছে হবে। পরনে ঢোলা জিন্স, সাদা শার্টের উপর ভারী জ্যাকেট। মাথায় উইন্টার হ্যাট। ফর্সা স্কিনে চাপ দাড়ির পরল। কি দারুণ দেখাচ্ছে তাকে!!
যাই হোক, আমি খুশিতে বাক-বাকুম হয়েই বললাম,
— ভাইয়া আপনি? সত্যি-ই এটা আপনি? একটু ছুঁয়ে দেখবো? প্লিজ??
আরিয়ান অর্ক কেমন নাক ছিটকে নিলো। বুঝলাম আমাকেও তার পাগল, নাছোড় ফ্যানদের তালিকায় ছাড়া অন্য কিছুতে ফেলেনি।
— নিতান্তই বিপদে পড়ে লেডিস টয়লেটে ঢুকেছি। জেন্টস টা খোলা পাইনি। অ্যাম সরি।
ইতস্তত করতে করতে অর্ক বললো।
অর্ককে দেখে আমি যে কাজে এসেছি সে কাজ ভুলে গেলাম। কোথায় শাড়ি কোথায় আমি।
কুচি খুলে গড়াগড়ি দিচ্ছে মেঝেতে। আমি হা করে এখনো বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছি না।
ভাবুন আপনার প্রিয় সিঙ্গার আপনার সামনে
দাঁড়িয়ে, তাহলে আপনি কি করতেন?
আমারো ঠিক সেরকম অবস্থা। বাইরে অগণিত
মেয়ে অর্ককে সামনা সামনি একবার দেখতে, একবার কথা বলতে হা হুতাশ করে মরছে।
এদিকে সে নিজে আমাকে দর্শন দিতে এসেছে।
আবার কথাও বলছে।
সোনায় সোহাগা কপাল আমার।
অর্ক এতক্ষণে আমাকে ড্যাবড্যাব করে দেখে নিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে অপর পাশে ফিরে বললো,
— আরে প্লিজ আপনার শাড়ি ঠিক করেন। মাই গড্, অসংখ্য চিড়িয়া প্রাণীর হাত ছেড়ে
শেষে এসে পড়লাম মহা অদ্ভুত চিড়িয়ার পাল্লায়। আজব!!
আমারো এতক্ষণে হুঁশ ফিরলো কি হালে আমি
তার সামনে রয়েছি। ঝটপট শাড়ির কুচি মুঠো ধরে কুড়িয়ে যাতা করে গুঁজে আঁচল ঠিক করে
তাকে ডাকলাম।
— এবার তাকাতে পারবেন।
অর্ক সেদিকে কর্ণপাত করলো না। বাইরের
শোরগোল আর শোনা যাচ্ছে না দেখে বললো,
— শুনুন তো, বাইরে ঝামেলা হচ্ছে কি-না?”
— না না, খামোখা বাইরে ঝামেলা কেন হতে যাবে?
অর্ক চোখ রাঙাতেই খেয়াল হলো তার ফ্যানরা এতক্ষণ পাগলের মতো ওয়াশরুমের বাইরে চিৎকার, লাথি মারছিলো।
ভ্যাবলাকান্ত হেসে বললাম,
— ওহ স্যরি। মনে হচ্ছে ওরা চলে গেছে।
অর্ক এবার হাফ ছেড়ে বেঁচে তড়িৎ দরজা খুলে হুটহাট যেমন এসেছিলো তেমনই বেরিয়ে গেল। এদিকে আমার ঘোর পুরো কাটেনি তখনও।
পুনরায় কনসার্টে এ্যটেন্ড করলাম। আরিয়ান জাহিদ অর্কের ব্রেক টাইম শেষ। আর মাত্র একটা গান গেয়েই কনসার্ট শেষ করবে বললো। তিথি জিজ্ঞেস করলো,
— এত দেরি হলো যে?
আমি তাকে সব ব্যাপার খুলে বলতে যেয়েও
থেমে গেলাম। পরবর্তীতে বলে ওকে একেবারে চমকে দেবো।
কনসার্ট শেষ করতে রাত দশটা বেজে গেল। মজার ব্যাপার হলো যাবার আগে অর্ক আমাকে ভিড়ের মাঝে একবার দেখে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। তিথি হিংসুটে গলায় বললো,
— বাব্বাহ আরিয়ান জাহিদ অর্ক তোর দিকে তাকালো! ব্যাপার কি রে?
আমি ব্যাপারটা জেনেও কেবল মুচকি হেসে নিরবতা পালন করলাম। তিথি বিরক্ত হলো। তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না।
বাসায় এসে লম্বা হয়ে শুয়ে এক ঘুমে রাত পার। সকালে উঠে নীলক্ষেত গেলাম কিছু বই কিনতে। আমার আবার বই দেখলে সবই নিয়ে নিতে ইচ্ছে হয়। একটার পর একটা হাতে নিয়ে পছন্দসইগুলা কিনে ফেলি। এভাবে চারটা বই সিলেক্ট করে পাঁচ নম্বরটা হাতে নিয়ে গভীরভাবে
যাচাই বাছাই করছি ঠিক তখন দোকানের সহকারী ছেলেটা এসে বললো,
— স্যরি আপু, এই বইটা দিতে পারবো না। আপনি অন্যটা সিলেক্ট করেন। ইট’স আ রিকুয়েষ্ট।
আমি অবাক হলাম। বললাম,
— বাট ভাইয়া বইটা ভীষণ পছন্দ। ইন্টারেস্টিং মনে হলো।
— স্যরি আপু, ওইযে ওই ভাইয়াটা এই বইটা কিনে ফেলেছে।
আমি সহকারী ছেলেটার ইশারা বরাবর চেয়ে বুক সেল্ফের ফাঁক দিয়ে কেবল একটা লোককে দেখলাম। তাও আবার পেছন সাইড থেকে। বুঝলাম না দোকানে এই একটা বই নিয়ে কেনো এত টানাটানি?
আবারো ছেলেটাকে বললাম,
— আরেক কপি দিয়ে দেন।
— সম্ভব না আপু। এই রাইটারের সব কপি শেষে আমাদের হাতে মাত্র এই এক কপি অবশিষ্ট আছে। ওই ভাইয়া আমাদের পুরনো কাস্টমার। কাল ফোন করে আগেই এই বইটার খোঁজ করে পরে বলে দিয়েছিলো বইটা যেনো কেবল তার জন্যই রেখে দেই। সো স্যরি আপু। এক্সকিউজমি!!
আমার কোনো কিছু একবার পছন্দ হয়ে গেলে
পরে জগতের শ্রেষ্ঠ জিনিস সামনে আনলেও আর পছন্দ হয় না। কি করি, কি করি ভেবে একটা আইডিয়া মাথায় এলো।
যদি ওই লোকটাকে রিকুয়েষ্ট করি তবে নিশ্চয়ই না করবে না।
— এক্সকিউজমি!! মে আই হ্যাভ ইওর এ্যটেনশন প্লিজ?
আমার বিনয়ী কণ্ঠের প্রভাবে লোকটা তার হাতে ধরা বই সেল্ফে রেখে আমার দিকে ঘুরলো। কিন্তু একি! আবারো আরিয়ান জাহিদ অর্ক যে। এখানেও? ওই যে বলে, আল্লাহ যখন দেন তখন সব উজাড় করে দেন। আজও তার পরনে ঢোলা জিন্স। তবে মাথায় উইন্টার হ্যাটের বদলে নরমাল টুপি। চোখে বসানো সানগ্লাসটা খুলে বুকের টিশার্টে গুঁজে বললো,
— ইয়েস!
এমনভাবে বললো যেনো আমাকে চিনতেই পারেনি। এতে অবশ্য আমি রাগ করতে পারছি না। সেলিব্রিটি মানুষ হাজারো লোকের সাথে প্রতিনিয়ত দেখা সাক্ষাৎ হয়। কতজনকেই বা মনে রাখবে?
আমি বিনয়ী হেসে বললাম,
— আপনি যে বইটা কিনেছেন ওটা আমার সাথে এক্সচেঞ্জ করলে হয় না? ওইটা আমাকে দিলে উপকৃত হতাম।
— স্যরি।
বলেই আবার সে বই দেখতে মন দিল।
আমার মাথা ঘুরে গেল। ছেলেটার বিহেভ এত খারাপ কেন? গতরাতেও কেমন বাজে ব্যবহার দিয়েছে আবার আজও এমন করছে যেন আমাকে তুচ্ছ ছাড়া অন্য কিছু ভাবছেই না।
তবুও হাল ছাড়লাম না। আবারো হাসি বজায় রেখেই বললাম,
— একটু সেক্রিফাইস করেন ভাইয়া। বইটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।
— সেটা আমি তো আপনাকেও বলতে পারি যে, একটু সেক্রিফাইস করেন। বইটা কারোর জন্য গিফট্ হিসেবে সিলেক্টেড। আপনার জন্য কিছু করার নেই। এক্সকিউজমি!!
বলেই সে গটগট করে হেঁটে চলে গেল। ওর গা থেকে তীব্র দেমাকের গন্ধ পেলাম। দেমাক দেখালো আমাকে? এ্যাহ! ব্যাটা নিজেরে কি মনে করে? আমি প্রচন্ড রেগে পণ করি, বই আমি ওইটাই নিয়ে ছাড়বো।
পেছন পেছন ঘুরতে লাগলাম। দ্য সিংগার আমাকে আড়চোখে দেখেই মুখ দিয়ে একটা বিরক্তি সূচক শব্দ করলো। বুঝলাম আমার উপস্থিতি তার জন্য পীড়াদায়ক।
সেল্ফ থেকে বইটা নিয়ে কাউন্টারে দিলো। কাউন্টার ম্যান বইটা আবার র্যাপ করতে শুরু করেছে। এই-ই লাস্ট চান্স। মাথায় কিছু আসছে না কি করবো।
হঠাৎ অর্ক বললো,
— আপনার প্রবলেম টা কি হ্যাঁ? ছেলে দেখলেই আপনাদের রোগ শুরু হয়? তার উপর আমাকে দেখেই সব রোগ চাড়া দিয়ে উঠলো। আজব!! কখন থেকে পোষা কুকুরের মতো পেছন পেছন ঘুরছেন। হোয়াট’স দ্য প্রবলেম?
এত র্যুড বিহেভে আমার প্রচন্ড কান্না পেলো। এই আচরণটা কি আমার প্রাপ্য ছিলো? ছিলো না তো। তবে? কোনো মানুষের কথায় এতটা কষ্ট পাইনি যতটা তার কথায় পেলাম। বললাম,
— আপনি একটা জঘন্য মানুষ। বইটা ভালোই ভালো বলছি দিয়ে দিন।
অর্ক ভ্রুতে ভাঁজ ফেলে বললো,
— নো, নেভার। ইউ ফুল।
চলবে………