আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস পর্ব-২৬+২৭(শেষ পর্ব)

0
1755

#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ ২৬

নুরুল আলমের বাড়ি গতরাত থেকেই মেতে আছে সানাইয়ের সুরে। সানাই বাজাচ্ছেন হাড় জিরজিরে একজন বয়স্ক লোক। তার শরীর কাঠের মতো চিকন এবং পাতলা। নুরুল ভাবছিলেন, এই লোকটিকে ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে। আসলেই উড়ে যায় কিনা তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য তাকে বেশ কয়েকবার লোকটির আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু ফুঁ দেওয়া সম্ভব হয় নি। যখনি ঠোঁট দুটো সূঁচালো করেছেন ঠিক তখনি কেউ না কেউ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অবশেষে, এই ফুঁ দেওয়ার চিন্তা তার মাথা থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বের করতে হয়েছে।
আজ বাড়িতে মেহমানের সমাগম হবে । তবে দ্বিপ্রহরের পরে। তিনি রাতের খাবার আয়োজন করেছেন। সবকিছু তার পরিকল্পনা মতই এগুচ্ছে। রায়াও মতবিরোধ করে নি। নুরুল আলমের ধারনা পাত্রকে তার মেয়েরও পচ্ছন্দ হয়েছে। যখন বিয়ের কথা বার্তা চলে মেয়েরা দ্বিমত পোষণ করবে। পাত্র যোগ্যতা সম্পন্ন হলেও করবে। বিয়েতে আগ্রহ নেই বোঝাবে। এটাই নিয়ম এবং মেয়ে জাতির স্বভাব। এত কিছুর পরেও নুরুল আলমকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। অহেতুক চিন্তা করছেন ব্যাপারটা তাও নয়। চিন্তা করার মতো বিষয় নিয়েই চিন্তা করছেন। সকাল থেকে তার বাম চোখের পাতা লাফাচ্ছে। তার চিন্তা মগ্নতার এটি একটা কারণ। অপর কারণটি হলো তিনি ভয়ংকর একটি দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। তিনি দেখেছেন, রায়া বিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এমন স্বপ্ন দেখলে যে কোনো বাবার কপালেই তিন চারটি ছোট বড় ভাঁজ একসাথে ফুটে উঠবে। আবার চোখের পাতা লাফানোর বিষয়টি কুসংস্কার হিসেবে ধরা হলেও নুরুল আলম হালকা ভাবে নেন না। তিনি যখন টগবগে যুবক তার বাবা মারা গেলেন। তিনি মারা গেলেন অত্যন্ত ভালো সময়। আসরের ওয়াক্তে।মাগরিবের আগে জানাজার কাজ সম্পন্ন করা হলো। সেদিন সকাল থেকেই নুরুল আলমের বাম চোখের পাতা বিরামহীন লাফিয়ে গেছে। আরেকবার, গ্রামে নদী ভাঙ্গন শুরু হলো। তাদের গ্রামের ভিটা জমি নদীর স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। সেবারও, তার চোখের পাতা লাফিয়েছে। অর্থাৎ, এই বাম চোখের পাতা লাফালাফি অবশ্যই কোনো দুঃসংবাদ বয়ে আনবে। মেয়ের ওপর আলাদাভাবে নজরদারি রাখা প্রয়োজন। হঠাৎ করে শান্ত হয়ে যাওয়াটা শুভ লক্ষণ নয়।

রায়া আয়নার সামনে বসে আছে। পরনে লাল কাতান শাড়ি। সাজুগুজুর পর্ব এখন শুরু হবে। আরও আগে শুরু হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু যে মেয়ে তাকে সাজিয়ে দিবে তার পোঁছতে দেরী হয়ে গেছে। রায়া ভেবেছিলো মধ্যবয়স্ক কেউ আসবে হয়তো। কিন্তু এই মেয়ে বয়সে তার চেয়েও ছোট। সে এটাও ভেবেছিলো মেয়েটি হয়তো উপজাতি গোত্রের কেউ হবে। কিন্তু একে নিতান্তই গ্রামের সাধারণ মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। তাকে তুমি করে বলবে নাকি আপনি করে বলবে এই নিয়ে রায়ার মস্তিষ্কে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে অনেক আগে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রায়া খানিকটা ইতস্তত করে বললো,
‘আপনার আরো এক ঘন্টা আগে আসার কথা ছিলো’।
মেয়েটা সহজ গলায় বললো,
‘পার্লারে এত ভীড় ছিলো! কি আর কমু আফা। কাস্টুমার রাইখা কি আসা সম্ভব বলেন?’
‘আচ্ছা বুঝেছি। এখন চট জলদি শুরু করে দেন। টেবিলের ওপর সব রাখা আছে’।
‘আমি আপনার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হবো। আপনি আমাকে তুমি করে বলেন’।
‘নাম কি তোমার?’
‘বেলী’।
‘সুন্দর নাম। আচ্ছা বেলী শোনো। আমাকে একদম হালকা করে সাজিয়ে দিবে। যতটুকু না দিলেই নয়।’
‘কোনো সমস্যা নাই, আফা। আপনি যেমন সাজতে চান তেমনই সাজায় দিবো। কেউ বলতে পারবে না এই বেলীর সাজ অসুন্দর হয়। পার্লারে বৌ সাজতে গেলে কাস্টুমার আমারেই খোঁজে। সেই ডিমান্ড আমার’।
এতটুকু বলে বেলী হাসলো। অহংকারী হাসি।
রায়া কোনো উত্তর দিলো না।
‘আফা আপনার কি প্রেমের বিয়া?’
‘হু’।
‘ও। ভাই কই থাকে?’
‘আমেরিকা’।
‘বিদেশী জামাই? আমারও ইচ্ছা ছিলো বিয়া করুম প্রবাসী। দেশের বাইরে ঘুরবার যামু। কিন্তু বাসা থিকা বিয়া দিলো এক বুইড়া বেটার সাথে। সেই বেটাও বিয়ার এক বছর পর গেলো মইরা। রাইখা গেলো এক বস্তা ঋণ। হের, ঋণ শোধ দিতে দিতেই জীবন যৌবন সব মাটিতে মিশা গেলো’।
রায়া এবারো কোনো উত্তর দিলো না। বেলী আবার বললো,
‘মাশা আল্লাহ। আপনার চেহারা দেইখাই বোঝা যায়। এই বিয়াতে আপনার মত আছে। চেহারা কেমনে গেলেস দিতাছে! কিছু কিছু কাস্টুমার তো সাজানোর সময়ও কান্দে! চেহারা দেইখাই বোঝা যায় জোর কইরা বিয়া বসতাছে।’
রায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘বেলী আমার মাথা ব্যাথা করছে। আমি চোখ বন্ধ করে থাকলে কি তোমার অসুবিধা হবে?’
‘না আফা। বরং আমার সুবিধা হইবো। আরামে চোখের মেকাপ করবার পারুম’।
‘ঠিকাছে করো’।
রায়া চোখ বন্ধ করে ফেললো। তার বিয়েটা প্রেমের বিয়ে না। তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেদিন টিয়া রঙের শাড়ি পরে পাত্র পক্ষের সামনে গিয়েও কোনো লাভ হয় নি। কিভাবে লাভ হবে? শাড়িটি পরে রায়া যখন আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নিজেই নিজেকে দেখে চমকে উঠে। তাকে সুন্দর লাগছে! অথচ এই রঙটা তাকে একদমই মানায় না। পাত্রের নাম শিহাব। তাকে দেখে মোটেও আমেরিকা পজিটিভ বলে মনে হয় না। চেহারায় খাঁটি দেশী ভাব। ছেলে শ্যামলা। উঁচা লম্বা। চেহারা কাটিং ভালো। সামনা সামনি পাত্রকে দেখার পর নুরুল আলম একই বুলি আওড়াচ্ছিলেন,
‘ছেলে তো দেখতে রায়া মা ছবির চেয়েও সুন্দর। ফার্স্ট ক্লাস ছেলে! কি ঠিক বলছি না?’
‘জানি না বাবা। আমি ছেলের ছবি দেখিনি’।
‘হায় হায়! বলিস কি? এখুনি গিয়ে দেখ। ছবি আর সামনা সামনি আকাশ পাতাল তফাত!’
‘তুমি দেখেছো তাতেই চলবে। আমার আর দেখতে হবে না। তোমার শখ না মিটলে আবার ছবি বের করে দেখো’।
নুরুল আলম সত্যি সত্যি ছেলের ছবি আনতে নিজের ঘরে ঢোকেন।
বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়। আষাঢ় মাসের তিন তারিখ। দেখতে দেখতে মাঝের একমাস কেটে যায়। আজ সেই বিশেষ দিন। রায়ার বিবাহ একই সাথে আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস।

অভ্র পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সে সারাদিন পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে বলে পণ করেছে। আচমকা এরকম অদ্ভুত ইচ্ছে তার কেনো হয়েছে তা সে জানে না। গত বছর এখানটায় দাঁড়িয়েই সে রুদালির হাত ছেঁড়ে দিয়েছিলো। এ জায়গাটা তার প্রথম প্রেমের বিচ্ছেদের সাক্ষী। তবে সেদিন আকাশে অজস্র মেঘ ছিলো। পেজো তুলোর মত মেঘ নয়! আষাঢ় মাসের মেঘ। ময়লা মেঘ। বৃষ্টিও হয়েছে। আজকে আকাশ একদম ফকফকা। সাদা মেঘও নেই। অবশ্য প্রকৃতির ওপর ভরসা করতে নেই। এখন রোদ্দুরে খাঁ খাঁ করছে সব, কিছুক্ষণ পরেই দেখা যাবে রোদের ছিটে ফোটাও নেই। আকাশ অন্ধকার হয়ে বৃষ্টি নেমেছে। সেদিন সে কারো আগমনের প্রহর গুণছিলো। আজ সে গুণছে না। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য টানে সে আজ এখানে এসেছে। চাপা অনুভূতি কাজ করছে তার। এই অনুভূতি কিসের অনুভূতি? কেনো তার মাঝে আজ এত উত্তেজনা? অভ্র বুঝতে পারছে না। তবে তার মন বলছে, ক্ষণিক বাদেই বৃষ্টি নামবে। তার নোকিয়া বারশ ফোনে রিং বেজে উঠলো।
অভ্র হ্যালো বলতেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনি কোথায়?’
‘আমি পোস্ট অফিসের সামনে। কেমন আছেন আপনি?’
মেয়েটি অভ্রর প্রশ্নের উত্তর দিলো না। ফোন কেটে দিলো। অভ্র ভ্রূঁ কুঁচকালো। তনিমা ফোন করেছিলো। কিন্তু মেয়েটা তো কখনো এভাবে ফোন কেটে দেয় না! আজ আবার কি হলো? এই তনিমা মেয়েটাকে তার ভীষণ রহস্যময়ী বলে মনে হয়। মেয়েটা কে? কোথায় থাকে? কি তার পরিচয় এসব কিছুই অভ্র জানে না। কখনো জানার চেষ্টাও করে নি। আগ্রহ খুঁজে পায় নি। অথচ মেয়েটা তার সম্পর্কে প্রায় সবই জানে। এ বিষয়টাও অভ্রকে আজকাল বেশ ভাবায়। এরপর ফোন দিলে মেয়েটার কাছ থেকে সব জেনে নিতে হবে। তার পরিচয়, কোথায় থাকে, কি সমাচার? ইত্যাদি।

অভ্রর ধারনা ঠিক ছিলো। প্রকৃতি তার রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। রোদ মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে। ঝলকে ঝলকে হিমেল হাওয়া তাদের উপস্থিতি জানান দিয়ে যাচ্ছে। অভ্রর শরীর অল্প অল্প কাঁপছে। ঠোঁট দুটিও কাঁপছে। তার উচিত এখান থেকে চলে যাওয়া। শীঘ্রই, বাতাসের ঝলকে বৃষ্টিফোটাও তেড়ে এলো। টিপ টিপ বৃষ্টির বেগ দ্রুত গতিতে বাড়তে লাগলো। কিছুদূরেই একটি অল্পবয়স্ক ছেলে কদম ফুল বিক্রি করছিলো। ছেলেটি প্রবল বর্ষণের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে ছুটতে লাগলো। অভ্রর সামনে দিয়েই সে গেলো। অসাবধানতা বসত কয়েকটি কদম ফুল রাস্তায় পরে গেলো। অভ্র ছেলেটিকে ডাক দিলো। কিন্তু ছেলেটি পেছোন ফিরলো না। ফুলগুলো খুব সুন্দর। তাজা এবং টসটসে। এভাবে অযত্নে রাস্তায় পরে থাকবে অভ্রর তা পচ্ছন্দ হলো না। সে এগিয়ে গিয়ে ফুলগুলো তুলতে লাগলো। গুণে গুণে পাঁচটা কদম ফুল সে কুঁড়িয়ে নিলো। ছয় নম্বর ফুলটি ছোঁয়া মাত্রই কেউ তাকে কাঁপা কন্ঠে পেছোন থেকে ডাক দিলো,
‘অভ্র স্যার’
অভ্র ফুলগুলো হাতে নিয়ে পেছোন ফিরে তাঁকাতেই হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। রায়া! তার সামনে রায়া দাঁড়িয়ে আছে। পরনে লাল কাতানের শাড়ি। গলায় হালকা গয়না। মেয়েটা কাঁদছে। বৃষ্টি তার চোখের পানি ধুয়ে নিচ্ছে। কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার যে হেঁচকি উঠে গেছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অভ্র রায়াকে এভাবে আগেও একবার দেখেছে। ঠিক এভাবেই! লাল কাতান শাড়ি পরনে, শরীরে হালকা গয়না। সেদিনও মেয়েটা এভাবেই পাগলের মতো কাঁদছিলো। কবে দেখেছে? স্বপ্নে! হ্যাঁ স্বপ্নে তাকে ঠিক এভাবেই দেখেছিলো অভ্র। শুধু বৃষ্টি তখনো নামে নি। তবে আকাশে মেঘ ঠিক জমেছিলো!

#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ ২৭ (শেষ পর্ব)

‘তুমি এখানে কি করছো রায়া?’
জিজ্ঞাসু চোখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় অভ্র।
‘স্যার, আজ আমার বিয়ে’।
অভ্রর বিস্ময় ইতোমধ্যে সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে।
‘আজ তোমার বিয়ে?’
‘জ্বি স্যার’।
‘তো তুমি এই বৃষ্টির মাঝে রাস্তায় কি করছো?’
রায়া হেঁচকি তুলতে তুলতে বললো,
‘আমি বিয়েটা করবো না, স্যার’।
‘বিয়ে করবে না! কিন্তু কেনো?’
রায়া এবার রেগে গেলো। উচ্চস্বরে বললো,
‘আপনি কি বোকা? আপনি জানেন না আমি কেনো বিয়ে করতে চাইছি না?’
‘না’।
‘আমি আপনাকে ভালোবাসি, স্যার। আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?’
‘কি সব উলটো পালটা কথা বলছো রায়া? বাড়ি ফিরে যাও। চলো তোমাকে বাড়ি এগিয়ে দিয়ে আসি’।
‘আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?’
‘আমি তোমার সাথে মজা কেনো করবো? এখন কি মজা করার মতো পরিস্থিতি? তুমি পাগলামি করছো রায়া। চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি’।
রায়া হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। অভ্র স্যার সত্যি তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন! তার অনুভূতির কানা কড়ি দামও তাঁর কাছে নেই। অভ্র এগিয়ে আসলো। রায়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘চলো। বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।’
‘প্রয়োজন নেই। আমি নিজের পায়ে ভর দিয়েই চলে যেতে পারবো। কিন্তু আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন এভাবে?’
অভ্র মাথা নিচু করে বললো,
‘বাস্তবতা অনেক কঠিন রায়া। আমি দিবা স্বপ্ন দেখতে জানি না’।
কঠিন স্বরে রায়া বললো,
‘আপনি স্বপ্ন দেখতে জানেন স্যার। কিন্তু ভালোবাসতে জানেন না। কতই না ভালো হতো যদি শিক্ষার পাশাপাশি ভালোবাসার মূল্যটুকু দেওয়াও শিখে নিতেন!’
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে রায়া উলটো ঘুরে হাঁটা শুরু করলো।

(একই সময় অর্ণালি-দম্পতীর সাথে যা ঘটছিলো)
রুদালি বাড়ির ছাদে এসেছে। এই ভর দুপুরে কেউ ছাদে আসে না। সে এসেছে। ছাদে রোদ নেই। আকাশ মেঘলা। জর্জেটের শাড়ির আঁচল এই এলো বাতাসে ছন্ন ছাড়া হয়ে উড়ছে।
‘এই সময় কেউ ছাদে আসে নাকি?’
পুরুষ কন্ঠে রুদালি চমকে উঠলো। বাসায় তার বাবা ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ মানুষ নেই। এই কন্ঠ তার বাবার নয়। এরকম ভরাট কন্ঠ শুধুমাত্র একজনেরই আছে। রুদালি পেছোন ফিরে তাকালো। অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। মুচকি মুচকি হাসছে। তার চোখে চশমা। এই ছেলেটা আবার চশমা পরা শুরু করলো কবে থেকে? আগে তো পরতো না। শীঘ্রই নিয়েছে বোধ হয়। রুদালি অর্ণবকে আপাদমস্তক একবার দেখে পুনরায় উলটো ঘুরলো। ভাবখানি এমন, অর্ণবকে দেখে তার মাঝে কোনো উত্তেজনা কাজ করছে না। ডোন্ট কেয়ার ভাব মুখে ফুটিয়ে তোলার ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাতে লাগলো সে। কিন্তু উত্তেজনা চাপিয়ে রাখার ক্ষমতা মেয়ে মানুষকে দেওয়া হয়েছে ক্ষণিককালের জন্য। অনুভূতি খাচাবন্দি পাখির মতো ছটফট করে সর্বক্ষণ। ফাঁক পেলেই ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। আর অনুভূতির জন্য সেই ফাঁক-টা হলো চোখ। ফুড়ুৎ করে চোখ দিয়ে বের হয়ে আসে। সাধে কি আর মানুষ বলে? চোখ যে মনের কথা বলে!
‘কথা বলবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছো নাকি?’
রুদালি শান্তভাবে উত্তর দিলো,
‘না। এমন কনো প্রতিজ্ঞা করি নি’।
‘তবে প্রশ্নের উত্তর দিলে না যে?’
‘যে প্রশ্নের উত্তর নিজের কাছে নেই, সেই প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দেই কিকরে?’
‘আমার ওপর রাগ করে আছ রুদালি? মাথাটা একটু ঘুরে গেছিলো। বৌ টাকে অনেক ভালোবাসি তো। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো’।
রুদালি এবার অভিমানী স্বরে বললো,
‘আমি কি একবারো সুযোগ পেয়েছি সেদিন কি হয়েছিলো তা বলার? মেয়রের ছেলে পেলে আমায় রাস্তায় কিভাবে হেনস্তা করছিলো আপনি জানেন? জানেন না। জানার চেষ্টাও করেন নি। আমাকে বের করে দিলেন বাড়ি থেকে!’
অর্ণব দ্রুত পায়ে রুদালির দিকে এগিয়ে এলো।
‘এসব কি বলছো তুমি রুদালি! বের করে দিবো কেনো? তোমার পরীক্ষা ছিলো। আমার মনে হয়েছে পল্টন কাকার ওই কথাগুলোর পর তুমি ও বাড়ি থেকে স্বাচ্ছ্যন্দে ভার্সিটি যেতে পারবে না। তাই ভাবলাম_’
‘থাক! আমি এতটাও বোকা না। আমি একটু হলেও বুঝি’।
অর্ণব রুদালির চোখের দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখ ভর্তি পানি। অর্ণব রুদালির চোখের পানি মুছে দিলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে রুদালিকে জড়িয়ে ধরলো। রুদালিও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অর্নবকে।
‘মাফ করে দাও আমায় রুদালি। আমার ভুল হয়ে গেছে। অনেক বড় ভল হয়ে গেছে’।
রুদালি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদছে।
‘ভুল ছাড়া কি মানুষ হয় বলো? তাছাড়া এটুকু ভুল না করলে আমি তো ফেরেশতা হয়ে যেতাম!’
‘মরন’ নাক সিঁটকালো রুদালি।
‘হা হা হা। আচ্ছা শুনো, আর কান্নাকাটি নয়। এবার নিচে চলো। তৈরি হতে হবে’।
‘এখনি কেনো? খেয়ে যাবেন না?’
‘বিয়ের দাওয়াত আছে। আমি তোমাকে নিতে এসেছি’।
‘কার বিয়ে?’
‘নুরুল আংকেলের মেয়ের বিয়ে।’
রুদালি একটু চিন্তিত মুখে অর্ণবের দিকে তাকালো।
‘রায়ার বিয়ে আজ? ছেলে কি করে?’
‘ছেলে আমেরিকায় থাকে। বিয়ে করে ভেটকিকে নিয়ে আমেরিকা চলে যাবে’।
রুদালি হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু মেয়েটা নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এমন সময় অর্ণবের ফোনে ফোন এলো।
‘হ্যা বাবা বলো’।
ফোনের ওপাশ থেকে রমজান খান কি বলছিলেন রুদালি শুনতে পেলো না। তবে কথা বলতে বলতে অর্ণবের কপালে ভাঁজ পরলো। ফোন রাখার পর রুদালি জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে?’
অর্ণব হতাশ গলায় বললো,
‘রায়া পালিয়ে গেছে’।
‘পালিয়ে গেছে?’
‘হুম’।
‘তার মানে বিয়ে ক্যান্সেল?’
‘হু। কনে ছাড়া বিয়ে কিভাবে হবে?’
‘তাহলে আর তৈরি হয়েও বা কি হবে?’
‘তাই তো ভাবছি’।
রুদালি মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারছে। রায়া পালিয়ে কার কাছে গিয়েছে তাও সে জানে। তবে যার কাছে গিয়েছে তার সিদ্ধান্ত কি হবে তা নিয়ে রুদালিরও বেশ চিন্তা হচ্ছে। রায়া মেয়েটার জন্য তার মায়া হয়। তার এক পক্ষীয় ভালোবাসার একটি সুন্দর উপসংহার রুদালি মনে প্রাণে চাইছে। এমন সময় আকাশ গর্জে উঠলো। রুদালি বললো,
‘বৃষ্টি নামবে মনে হয়’।
‘হুম’।
‘আপনার হাত ধরে এখনো বৃষ্টিতে ভেজা বাকি’।
‘আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিতে?’
‘হুম’।
অর্ণব হাসলো। চারিদিকে ঝমঝম বৃষ্টি। রুদালি আর অর্ণব হাত ধরাধরি করে হাঁটছে ।
‘মেয়েটা কই গেলো বলো দেখি, রুদালি?’
‘আমি মনে হয় জানি ও কই গিয়েছে।’
অর্ণব আগ্রহ ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘কই গিয়েছে?’
‘এখন বলতে ইচ্ছা করছে না। পরে বলবো’।
‘ঠিকাছে পরে বলবে। কিন্তু তুমি আমায় আপনি করে বলা ছাড়ো নইলে রাগ করবো’।
‘আচ্ছা। তুমি করেই বলবো’।
‘এখনি বলো’।
‘কি বলবো? যে কোনো কিছু। তোমার ইচ্ছা। শুধু তুমি করে বলবে’।
রুদালি লজ্জামিশ্রিত হাসি হেসে বললো,
‘তোমার হাত ধরে হাঁটতে ভালো লাগছে’।
অর্ণব হেসে ফেললো।
দুজনেই ভাবছে, এমন আষাঢ় যেনো তাদের জীবনে বার বার ফিরে আসে।

ঝুম বৃষ্টি রায়া এবং অভ্রর মাঝে যেনো হালকা সিল্কের পর্দা তৈরি করে ফেলেছে। এই বৃষ্টির পর্দা ভেদ করে রায়ার চলে যাওয়া দেখে হঠাৎ অভ্রর বুকে হু হু করে উঠলো। জেলা সদর রোডে চটপটি আর ফুচকার প্লেটে গড়ে ওঠা ভালবাসা সে হারিয়ে ফেলেছে। বাস্তবতা সে ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে। তবে টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি ভালোবাসা আরো একবার তার জীবনে এসেছিলো। এ ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে তার কি খুব বেশি অসুবিধা হবে? রায়ার প্রতি তারও জমানো আবেগ ছিলো। শুধু আবেগের বশে সে আসতে চায় নি। কারণ মধ্যবিত্তদের জন্য প্রেম নয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই? অভ্র ভাবলো। গভীরভাবে ভাবলো। এদিকে রায়ার সাথে তার শারীরিক দূরত্ব বেড়েই চলছে! যদি এখন না হয়, তবে কখনোই হবে না। অভ্র সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
‘রায়া?’
এই ডাকটাই যেনো মন প্রাণ দিয়ে প্রার্থনায় চাইছিলো রায়া। সে ভেজা চোখে পেছোন ফিরে তাঁকালো। দেখলো তার অভ্র স্যার ক্রমশ এগিয়ে আসছে। তার হাতে অংক বইয়ের পরিবর্তে একগুচ্ছ কদম। তাকে মোটেও অংক স্যার বলে মনে হচ্ছে না। তাকে দেখাচ্ছে প্রেমিক পুরুষের মতো। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সে এগিয়ে আসছে। ক্লান্ত দুপুরে কল্পনার আসরে রায়া তার অভ্র স্যারকে যেভাবে পেতে চাইতো ঠিক সেভাবে। রায়ার একদম সামনে এসে অভ্র থামলো।
‘অংকে পাশ করেছো?’
রায়া কোনো কথা না বলে অভ্রর দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।
অভ্র নিচু স্বরে বললো,
‘সর্বনাশ করেছো। বৌ এস এস সি পাশ না করলে চলবে নাকি? মুখ দেখাবো কিভাবে?’
অভ্রর কথার মানে বুঝতে রায়ার বেশ সময় লেগে গেলো। কিন্তু যখন বুঝতে পারলো তখন আর অপেক্ষা কিসের? অভ্রর বুকে ঝাঁপিয়ে পরলো।
‘পাশ করেছি। আমি এবার অংকে পাশ করেছি’।
অভ্র পরম ভালোবাসায় রায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। যেনো ওর জন্যই অবচেতন মনে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলো আজ।
‘আমি এখানে আছি তা তুমি কিভাবে জানলে?’
রায়া মুখ টিপে হেসে বললো,
‘তনিমা বলেছে’।
অভ্র চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে রায়ার দিকে তাঁকিয়ে রইলো। পুরো কাহিনী মাথায় ধরা দেবার পর সে চোখ পাঁকিয়ে বললো,
‘কি দুষ্ট তুমি!’
রায়া খিলখিল করে হাসছে। আর অভ্র সেই হাসিতে আজীবন মুগ্ধ হয়ে থাকার পরিকল্পনা পাকা পোক্ত করছে।

কি ভেবে অভ্র রায়ার হাত ধরলো? কেনো শামসুর সাহেবের এগ্রো ফার্ম! যখন জীবন তাকে ভালোবাসা আর সুযোগ দুটোই একসাথে দিতে চাইছে, তবে তা গ্রহণে সমস্যা কোথায়? অহং ভুলে জয় হোক না প্রতিটি মধ্যবিত্ত ভালোবাসার। আষাঢ়ের তৃতীয় দিবসে।

সমাপ্ত।
——————————————————————-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে