#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ ১৯
ইদানিং পল্টনদার সাথে রমজান খানের বেশ ভাব জমেছে। পল্টনদার বাড়ি এইতো বেশি দূরে নয়, দশতলা বিল্ডিংটার ওপারে। সে মাঝে মাঝেই বাসায় আসেন। রমজানের সাথে বসে গম্ভীর মুখে নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। দুঃখ করেন। তার পচ্ছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে এলাকার মেয়র নির্বাচন করলেন অথচ এলাকার কোনো উন্নতি নাই। আজও বিষাদগ্রস্ত স্বরে বললেন,
‘বুঝলেন রমজান সাহেব? সবই মিথ্যা। সবই ছল ছাতুরি। ইলেকশন স্পিচ দিয়ে তারা সাধারণ জনগনের মন গলাবে। ইলেকশন শেষে পাছায় লাত্থি মারবে। উন্নতির নাম গন্ধ নাই!’
‘ঠিকই বলেছেন দাদা। এরা কি আসলেই মুখ দিয়ে কথা বলে কিনা কে জানে?’
‘ভাবলাম আজিজ সাব রে উঠাইলে এবার শহরের উন্নতি হবে নি। কিসের কি? ঘুরে ফিরে তালগাছ আমার। রাত নামতে না নামতেই সামনের টং এ গাঁজার আসর বসাচ্ছে। এইতো সেদিন একখানা খুনও হয়ে গেলো। আর রাস্তাঘাটের তো যাচ্ছেতাই অবস্থা!’
‘হক কথা, দাদা। হক কথা’।
‘বউ বাচ্চা যে বাসা থেকে বের হবে তা নিয়েও হয়রানি হতে হয়।’
‘এই ভয় তো আমিও পাই। বৌমা ভার্সিটি যায়। এতদিন না হয় অর্ণব ছিলো। কোনো ঝঁঝাট হলে সমস্যা ছিলো না। আজ ছেলেটা ঢাকা যাচ্ছে। এখন বেশ চিন্তা হচ্ছে’।
‘ও’ পল্টনদা নাক কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘তা বাড়ির বৌ এর আবার এত পড়াশোনা কিসের?’
এমন সময় সাহেলা চা আর বেলা বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। রমজানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি বলে উঠলেন,
‘এ কথা উনাকে বলে লাভ নাই দাদা। আমি কম বলেছি? বাপ বেটা কেউই দু পয়সা পাত্তা দিলো না। বলি যে, এখন মেয়ে পড়াশোনা করেই বা করবে টা কি? জজ ব্যারিস্টার হবে?’
পল্টন অভিযোগের সুরে বললেন,
‘এটা ঠিক না ভাই। আপা কিন্তু ঠিকই বলেছে। তাছাড়া মেয়ের বয়স কম। দেখতেও সুন্দর’।
রমজান খান বুঝলেন পল্টন তাকে কি বুঝাতে চাইছে। এই কথাগুলো সাহেলার ওপর বাজে প্রভাব ফেলবে। ইতোমধ্যে তার চেহারার রঙ পাল্টাতে শুরু করেছে! তিনি দ্রুত অন্য প্রসংঙ্গে কথা তুললেন,
‘দাদা, আপনার মেয়ে ইন্ডিয়া থেকে ফিরবে কবে?’
‘এ বছরের শেষে আসার কথা। গত বছরই আসতো কিন্তু তখনই আমার নাতনিটা হলো। তাই আর আসে নি’।
‘ও আচ্ছা!’ রমজান খান কথার ফাঁকে একবার আড়চোখে সাহেলার দিকে তাঁকালেন। সাহেলার মুখ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। রমজান খান খুব সাবধানে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। সাহেলা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলো না। কমলা এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেছে।
পল্টন তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন,
‘নাতনি আমার বড় ভক্ত। ভিডিও কলে কথা বলে। ট্যান ট্যানা কন্ঠ। হা হা হা। অর্ণবের বিয়ে হলো ক মাস যেনো হলো ভাই?’
‘এইতো আট মাস’।
‘ও’ পল্টন পিরিচ থেকে বানানো পান নিয়ে মুখে পুরলো। রমজান খানও পান মুখে দিলেন। এমনিতে তার অথবা সাহেলার কারোরই পান খাওয়ার অভ্যেস নেই। কিন্তু সামনে কেউ পান খেলে সঙ্গী হওয়াটা তার স্বভাব। এছাড়া পান না খেলেও সাহেলা নিয়মিত পান, সুপাড়ি কিনে রাখে। সুন্দর একখানা পানদানী ও আছে তার। চমৎকার কারুকাজ করা। এক প্রকার খানদানী ভাব আছে। রমজান খান একদিন স্ত্রীকে আদুরে গলায় বলেছিলেন,
‘ওগো, আমার সহধর্মিনী। খাও বা না খাও। এক দুখানা পান বানিয়ে আঁচলে বেঁধে রাখলেই পারো’।
সাহেলা খেঁকিয়ে উঠে বলেছে,
‘হ্যাঁ, চাবির গোছা ফেলে এখন পান বেঁধে রাখি। বাপ বেটা মিলে যা মন চায় করছো তাতেও শখ মিটছে না। এখন আমার সংসার হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা’।
রমজান প্রত্যুত্তরে আর কিছু বলেন নি। শাশুড়ি আর বৌ এর সম্পর্ক নিয়ে তিনি প্রায়ই ভাবেন। সাহেলা যে রুদালিকে পচ্ছন্দ করে না ব্যাপারটা এমনও নয়। এইতো সেদিন, গা পুড়িয়ে জ্বর এলো রুদালির। সাহেলা গম্ভীর মুখে ঘরে প্রবেশ করলেন। বললেন,
‘তুমি আজ তোমার বেটার সাথে গিয়ে শোবে’।
রমজান চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করেন,
‘সেকি বৌ ফেলে বেটার ঘরে গিয়ে ঘুমাবো কেনো?’
‘রুদালির জ্বর। ওকে আমার কাছে শোয়াবো’।
নাহ। রুদালির প্রতি সাহেলার ভালোবাসা মিথ্যে নয়। আবার জেনারেশন গ্যাপের বিষয়টাকেও উড়িয়ে দিলে চলবে না। চিন্তা ভাবনা প্রজন্মের সাথে বদলায়। তবে জগতে মনুষ্যত্বের বিবর্তন বলে কিছু নেই। বৌ টা তার শাশুড়ি হিসেবে মন্দ, একথা বলা চলবে না।
রুদালি টাওয়েল হাতে বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণব আজকেও টাওয়েল নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে ভুলে গেছে। এ যেনো তার রোজকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কাজটা অর্ণব অনিচ্ছাকৃত ভাবে করে রুদালির তা মনে হয় না। আবার টাওয়েল হাতে নিয়ে দরজার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকতে তার খারাপও লাগে না। তাই কোনো অভিযোগ করে নি। তবে আজ তার মন খারাপ। অর্ণব ঢাকা যাচ্ছে। বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য। এখনি বুকের ভেতোরটা শূন্যতায় ছেয়ে যাচ্ছে তার। এই সম্পর্কটার প্রতি রুদালির মায়া জন্মে গেছে যে! এই আট মাসে তারা একসাথে কম স্মৃতি কুড়িয়েছে?
মধুচন্দ্রিমার নামে শীতাকুন্ডে এডভেঞ্চার। রাতে ট্রেন জার্নি। বৃষ্টির রাতে ভিজে ভিজে আইসক্রীম খাওয়া আরো কত কি! অনুভূতি জন্মেছে। এতো অস্বীকার করার মতন নয়। অর্ণব গোসল করতে করতেই জিজ্ঞেস করলো,
‘রুদালি?’
রুদালি উত্তর দিলো, ‘হু’
‘বাবা কি করছেন?’
‘পল্টন কাকা এসেছেন। উনার সাথে গল্প করছে’।
‘আচ্ছা’।
আবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে অর্ণব ডাক দিলো,
‘রুদালি?’
‘হু’
‘আচ্ছা। তুমি হালি হালি ডিম খাও না কেনো? তোমার নাম রুদালি। হালি হালি ডিম খাওয়ার কথা না?’
অর্ণবের প্রশ্নে রুদালির বিয়ের পরের দিনের কথা মনে পড়ে গেলো। মনের অজান্তেই সে অল্প পরিসরে হেসে নিলো। কিন্তু অর্ণবকে গম্ভীর কন্ঠেই উত্তর দিলো,
‘আমার পা ব্যাথা করছে। আপনার আর কতক্ষণ লাগবে?’
‘হয়ে গেছে। জাস্ট গিভ মি টু মিনিটস’।
অর্ণব রুদালির হাত থেকে টাওয়েল নিয়ে গা মুছতে মুছতে বের হয়ে এলো। আলনা থেকে নতুন হালকা সবুজ রঙের শার্ট পড়তে পড়তে বললো,
‘ব্যাগ গরম কাপড় ভরেছো?’
‘হু’
‘তোমার কি মন খারাপ?’
‘হু’
‘কেনো কি হয়েছে?’
‘রুদালি কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনি ফিরবেন কবে?’
‘কাজ শেষ হলেই ফিরে আসবো’।
রুদালি আর কিছু বললো না। বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে রইলো। জানালার বাইরে হালকা কুয়াশার চাদর। ফেব্রুয়ারি মাস চলছে। সে নিজেও গায়ে শাল জড়িয়ে আছে। অর্ণব ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চুল ঠিক করছিলো। রুদালির মনমরা চেহারা আয়নায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রুদালি এক দৃষ্টিতে জানালার বাইরে দেখছে। তার ধ্যান ভাংগলো অর্ণবের কন্ঠে। অর্ণব জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে?’
রুদালি কিছুক্ষণ বোকার মতো অর্ণবের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরলো। বিবাহিত জীবনের এই প্রথম আবেগঘন মুহূর্ত। অর্ণবও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সে আশা করে নি। অর্ণব আরো অবাক হলো যখন লক্ষ্য করলো তার বুকের কাপড় ভিজতে শুরু করেছে। হায়! রুদালি কাঁদছে!
‘বোকা মেয়ে। কাদছো কেনো?’
‘আমি জানি না কেনো কাঁদছি’।
‘কি হয়েছে তোমার আমাকে বলো তো?কেউ কিছু বলেছে? মার সাথে কিছু হয়েছে?’
‘না’।
‘তাহলে?’
‘আপনি এত বলদ কেনো?’
অর্ণব অবাক হয়ে বললো,
‘আমি বলদ সেজন্য তুমি কাঁদছো কেনো। কাঁদার কথা আমার!’
‘ধুর’। রুদালি অর্ণবের দুই হাতের বাঁধন খুলে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। অর্ণব তাকে আটকালো। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘আমি খুব দ্রুত চলে আসবো।’
রুদালি নাক টানলো। মুখে কিছু বললো না। অর্ণব রুদালির কপালে ছোট্ট একটি ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দিতে ঠোঁট জোড়া এগিয়ে দিলো। কিন্তু সংকোচ পিছু ছাড়লো না। অর্ণব নিজেকে সামলে নিতেই রুদালি ভ্রুঁ কুঁচকালো। কপাল এগিয়ে দিলো অর্ণবের ঠোঁটের দিকে। অর্ণব মুচকি হেসে উষ্ণ ঠোঁট জোড়া রুদালির কপালে ছোঁয়াল। মেয়েরা বরাবরই ভালোবাসার কাঙ্গাল। ভালোবেসে এদের মনে জায়গা করে নেওয়াটা খুব সহজ।
(চলবে…)
#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্ব – ২০
রায়া ঘড়ির দিকে তাঁকালো। অংক পরীক্ষা শুরু হতে আর মাত্র এক ঘন্টা বাকি। স্কুল বেশি দূরে নয়। রায়াদের বাড়ি থেকে পায়ে হাঁটা পথ মিনিট পাঁচেক হবে। রায়া ডায়রি হাতে নিয়ে বসলো। মায়ের দোয়া নিতে হবে না? এই ডায়রিটাই তো তার মায়ের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের একমাত্র মাধ্যম! সে ডায়রির বাদামী পাতায় খসখস করে লিখতে শুরু করলো।
বান্ধুবীদের মুখে শুনেছিলাম। পরীক্ষার আগে তারা মা বাবাকে কদমবুসি করে দোয়া নেয়। মায়েরা তার সন্তানের কপালে চুমু এঁকে দেন। বাবারা মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। বাবা আমার মাথায় হাত তো রাখবেন কিন্তু আমার কপালে চুমু এঁকে দেওয়ার জন্য তুমি নেই কেনো মা? আজ আমার অংক পরীক্ষা। আমি গত দুবছর ধরে এই পরীক্ষায় ফেল করে আসছি। এর জন্য শুধুমাত্র তুমি দায়ী। এপর্যন্ত অংকে টেনেটুনে পাশ করা এই মেয়েটার জন্য আজকের অংক পরীক্ষাটা পাহাড় সমান। কারণ তার জীবনের সবচে প্রিয় অংকের শিক্ষক আজ ওই দূর আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র।
ছোটবেলায় তোমার কোলে বসেই প্রথম গুণতে শিখেছিলাম। বিকাল বেলা সুনীল আকাশে শঙ্খচিল গুলো যখন উড়ে বেড়াতো, তুমি তোমার আঙুল দিয়ে সেদিকে ইঙ্গিত করতে। কিন্নর কন্ঠে বলতে,
‘বল তো মা? কয়টা চিল উড়ে বেড়াচ্ছে?’
আমি তোমার গাল ধরে বলতাম,
‘ঠিক ঠিক উত্তর দিলে আমায় কি দিবে মা?’
তুমি বলতে,
‘অনেক অনেক আদর দিবো তোকে’।
আমি গুণতাম। আনন্দ নিয়ে গুণতাম। একটা, দুইটা, তিনটা। তুমি খুশি হয়ে যেতে। চুমোয় ভরিয়ে দিতে আমার মুখমন্ডল। আজ আমার অংকের উত্তর মিলে গেলেও চুমোয় ভরিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই। যে উত্তর মিলে গেলেও প্রতিদানে কিছু পাবো না সেই উত্তর না মিললেও ক্ষতি তো নেই!
প্রতিটি সন্তানের জীবনে মায়ের উপস্থিতি কতটা প্রয়োজন আমি বেশ বুঝতে পারি। আমিও তো একদিন মা হবো। সেদিন তুমি দেখবে। আমি আমার সন্তানকে ছেঁড়ে কখনো চলে যাবো না। সবসময় বুকে আগলে রাখবো। প্রতিদিন কপালে চুমু খাবো। শ্রেষ্ঠ মা হয়ে দেখাবো। তুমি মিলিয়ে নিও!
রায়া ডায়রি রেখে দিলো। তার দুচোখ বেয়ে লোনা বৃষ্টি ঝরঝর করে ঝরছে। বালিশে মুখ লুকিয়ে রায়া কাঁদছে। হঠাৎ তার মনে হলো কেউ তার মাথায় আলগোছে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। স্পর্শটা রায়ার খুব পরিচিত। যেনো এই স্পর্শের সাথে তার আত্মিক কোনো সম্পর্ক রয়েছে। বছরের পর বছর কেটে গেছে। এই স্পর্শ সে হন্যে হয়ে খুঁজে বেরিয়েছে। রায়া কপাল কুঁচকে মাথা তুললো। ফোলা ফোলা চোখে দেখলো চিত্রা তার সামনে বসে আছে। পড়নে ধবধবে সাদা শাড়ি। কি পবিত্র দেখাচ্ছে তাকে! অস্ফূট স্বরে রায়া বলে উঠলো,
‘মা!’
চিত্রা মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেমন আছিস?’
মায়ের কথা গুলো কেমন গমগমে শোনাচ্ছে রায়ার কাছে। সে কোনো উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে রইলো।
‘হ্যাঁ রে! আমার ওপর তোর ভীষণ রাগ। তাই না?’
‘মানুষ তাদের সবচে কাছের মানুষগুলোর সাথে রাগ করে। তুমি কি আমার কাছের মানুষ? তোমার ওপর রাগ কেনো থাকবে?’
‘আমি তোর কাছের মানুষ নই?’
‘মোটেও না। কাছের মানুষ কখনো তার আপনজনদের ছেড়ে হারিয়ে যায়?’
চিত্রার মুখে বিষাদের ছায়া নেমে এলো। সে পুনরায় হেসে বললো,
‘সবাইকেই একসময় না একসময় এই দুনিয়া ছেড়ে, প্রিয়জনদের বাঁধন ছিন্ন করে চলে যেতে হয়। সৃষ্টির শুরুতে ফিরে যেতে হয়। এই তো জীবন, মা! এইতো জীবন!’
‘সবাই তো এত দ্রুত চলে যায় না, মা। কই দাদী তো বাবাকে ছেড়ে এখনো দূরে চলে যায় নি! তুমি কেনো চলে গেলে? আমি কি খুব বেশি দুষ্টুমি করতাম? তোমায় খুব বেশি কষ্ট দিতাম?’
চিত্রার চোখ ভিজে উঠলো। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে মেয়েকে দু বাহু প্রসার করে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু মৃত মানুষকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয় নি। তারা চাইলেই জড়িয়ে ধরে শূণ্য বুকের হাহাকার দমিয়ে নিতে পারে না। ভালোবাসায় ভরিয়ে নিতে পারে না।
‘চুপ করে আছো কেনো, মা? বলো? আমি কি অনেক দুষ্টুমি করতাম?’
চিত্রা ভেজা চোখে হেসে বললেন,
‘স্কুলে একবার ছুটির ঘন্টা বেজে গেলে তোদের স্কুলে থাকতে দেয়?’
‘না। দেয় না। দারোয়ান মামা বের করে দেয়’।
‘তাহলে আমি কিভাবে থাকতাম রে? আমারো যে মৃত্যু ঘন্টা বেজে গিয়েছিলো! তাই এই দুনিয়াতে থাকার অনুমতি ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। কে চায় সম্পর্কের বাঁধন ছিন্ন করে হারিয়ে যেতে? কেউ চায় না। তবুও এটাই বাস্তবতা। এটাই সবচে বড় সত্যি! এই মৃত্যুঘন্টা উপেক্ষা করার সাধ্য কারো নেই।’
রায়া মাথা নিচু করে কেঁদে ফেললো। চিত্রা ভেজা চোখে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। নরম কন্ঠে বললেন,
‘একটু বাদেই তোর অংক পরীক্ষা। এখন কাঁদলে চলবে?’
‘আমার অংক করতে ভালো লাগে না মা। তোমার কথা ভীষণ মনে পরে!’
‘রায়া, মানুষের জীবন সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটি উপহার। কারো কারো ক্ষেত্রে এই উপহার উপভোগের সময়কাল দীর্ঘ। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত। আমরা কেউই জানি না এক মুহূর্ত পর কি হতে চলেছে। জীবন থেকে যেটুকু হারিয়ে গিয়েছে সেটুকু হারিয়ে যেতে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আর যেটুকু আদায় করে নেওয়া সম্ভব সেটুকুর পেছোনে শ্রম দিয়ে যেতে হবে। হার মানলে চলবে না’।
একটু থেমে চিত্রা আবার শুরু করলো,
‘আমি খুব স্বল্প সময় হাতে নিয়ে তোর কাছে এসেছি, মা। আমার ফিরে যেতে হবে। আর কখনো তোর সামনে আসতে পারবো না। তবে একটা কথা মনে রাখিস, যতদিন বেঁচে আছিস তোর অভিমানের পাল্লা কখনো ভারী হতে দিবি না। মুক্ত করে দিবি। মুক্ত পাখির মতন ছেড়ে দিবি খোলা আকাশে। দেখবি তাদের ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ তোকে কতটা স্বস্তি এনে দেয়। উঁচু নিচু চলার পথ কেমন সমতল ভূমি বলে মনে হয়’।
এমন সময় নিচ থেকে নুরুল আলমের গলার স্বর পাওয়া গেলো।
‘রায়া মা? তৈরি হয়েছিস?’
চিত্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘তৈরি হয়ে নে। আমিও চলি। ঘন্টা বেজে গেলো যে!’
‘মা। তুমি সত্যি আর কখনো আসবে না? এভাবে আমার সাথে এসে গল্প করে যাবে না? আমার ভীষণ একা লাগে, মা।’
চিত্রা ছলছলে চোখে বললো,
‘আমাকে যে আর আসতে দিবে না রে, মা! তুই ভালো থাকিস’।
চিত্রা উঠে দাঁড়ালো । রায়া এগিয়ে গিয়ে মায়ের পা দুটো ছুঁয়ে দোয়া নিলো। চিত্রা আলগোছে মেয়ের কপালে একটা চুমু এঁকে দিলেন। রায়া চোখের পাতা জোড়া এক করে ফেললো। টপ করে একফোটা পানি গাল গড়িয়ে মেঝেতে পরলো। ঘটঘট শব্দে ফ্যান ঘুরছে। নুরুল আলমের কন্ঠস্বর আরো একবার শোনা গেলো। রায়া চোখ মেললো। পুরো ঘরে সে একা। এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো।
‘মা তুই তৈরি হয়েছিস?’
‘এখন হবো। আমি রেডি হয়ে নিচে নেমে আসছি। তুমি একটু অপেক্ষা করো বাবা’।
‘ঠিকাছে, মা। তুই নিচে নেমে আয়’।
রায়া বড় করে শ্বাস নিলো। নিজেকে তার ভীষণ হালকা মনে হচ্ছে। এতক্ষণ তার সাথে যা ঘটেছে তা সত্যি ছিলো নাকি নিছক কল্পনা তা নিয়ে রায়া ভাবতে চায় না। তবে মায়ের প্রতি জমিয়ে রাখা অভিমান গুলোকে সে আজ মুক্ত করে দিতে চায়। তারাই না হয় শঙ্খচিল হয়ে উড়ে বেড়াক ওই খোলা আকাশে! রায়া জানালার পাশে বসে আবারো গুণবে। একটা, দুইটা, তিনটা।
দোতলা অফিসটার সোফায় অভ্র বসে আছে। সে এসেছে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। মকবুল ভাই সেদিন পত্রিকা পড়তে পড়তে উল্লাসিত কন্ঠে বলে ওঠেন,
‘অভ্র রে! একটা চাকরির বিজ্ঞপ্তি ছাপাইছে। চেষ্টা করে দেখবি নাকি? সদরের মধ্যেই।’
অভ্র হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।
‘এই পোড়া কপালে সামান্য টিউশনিই জোটে না। চাকরি – সে তো সোনার হরিণ! বামুন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন’।
‘নারে! কম্পানিটা নতুন। ইন্টার মিডিয়েট পাশ করেই এপ্লাই করা যাবে। তবে অনার্স পড়ুয়াদের দাম একটুখানি বেশি। বেতনও ত অনেক’।
‘কত?’
‘পনেরো হাজার টাকা’।
পনেরো হাজার টাকা!- অভ্রর চোখ চিকচিক করে ওঠে। চাকরিটা পেলে মাকে একটা ভালো সেলাই মেশিন তো কিনে দেওয়া যাবে তাই না? অসুস্থ্য বাবার ওষুধ কেনার জন্য অন্যের দুয়ারে হাত পাততে হবে না। বহুদিন পর অভ্র যখন গ্রামে ফিরবে, সোনার আংটি বন্ধক রেখে তার মায়ের ভালো মন্দ বাজার করতে হবে না। অভ্র নিজেই মাছ, মাংস, শাক সবজি ভর্তি চটের ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে গ্রামে ফিরবে। এসব ভাবতে ভাবতে অভ্রর চোখের কোণায় জল জমে যায়। সে হাতের উলটো পিঠ চোখে চেপে ধরে মকবুলকে বলে,
‘ভাই চেষ্টা তাহলে করে দেখি। মেঘ না চাইতে বৃষ্টি যদি ভুল করেও পেয়ে যাই?’
মকবুল অভ্রর পিঠ চাপড়ে বলে,
‘পারবি। তুই ঠিক পারবি’।
অভ্র ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে ডাক পেয়েছে। শ’ খানিক সিভি জমা পড়েছিলো বোধ হয়। তার বয়সী অনেক ছেলে আছে। তার চেয়ে বয়সে ছোট এমন ছেলেও আছে। পুরো অফিসে সেন্ট্রাল এসি । এই শীতের মাঝেও এসি চালিয়ে রাখার হেতু অভ্র বুঝতে পারছে না। যেখানে রাস্তায় ক্ষণিক দূরের ব্যবধানে কাঠ খড় পুড়িয়ে সবাই আগুন পোহাচ্ছে! সেখানে এই কনকনে ঠান্ডায় বিজবিজ শব্দে এসি চলছে।
আতিয়া আদিবা