আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস পর্ব-১৭+১৮

0
1140

#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ ১৭

রমজান খান বারান্দায় পায়চারি করছেন। টানা যে পায়চারি করছেন ঠিক তা নয়। থেকে থেকে থামছেন আবার নতুন উদ্দ্যমে হাঁটা শুরু করছেন। থামছেন তিনি তার সাধের ফুলগাছগুলোর কাছে। বারান্দায় তার নতুন অতিথি এসেছে। তাদের নিয়েই অন্যরকম উষ্মা ছেয়ে আছে রমজানের চোখে মুখে। ফুলগুলো তিনি আনিয়েছেন বিসিকে যাওয়ার পথে মেইন রোডে যে সরকারি নার্সারিটা পরে সেখান থেকে। গোলাপ ফুল, নয়নতারা, দুই রঙের বাগান বিলাস আরো বেশ কয়েকটি ফুলগাছ তিনি কিনেছেন। হাটার মাঝপথে তিনি মনের আনন্দে ফুলগুলো স্পর্শ করে যাচ্ছেন। সেই হাত আবার নাকে নিয়ে শুকছেন। কি মিষ্টি গন্ধ! আচ্ছা সবগুলো ফুলের গন্ধ মিশিয়ে কি পারফিউম তৈরি করা যায় না? রমজান খানের যদি পারফিউমের ফ্যাক্টরি থাকতো তাহলে তিনি অবশ্যই চেষ্টা করে দেখতেন। আরো বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি চললো। ক্লান্তিরা অবশ্য বেশিক্ষণ রমজান খানকে ছুটি উপভোগ করতে দিলো না। হাপাতে হাঁপাতে তিনি চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দিলেন। এমন সময় সাহেলা হাতে চা নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করলো। একটু শব্দ করেই চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর রাখলো। রমজান খান ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
‘কি ব্যাপার? মুখ এরকম কয়লার মতো কালো বানিয়ে রেখেছো কেনো?’
সাহেলা কোনো উত্তর দিলো না।
‘কি আজব ব্যাপার! কথা বলো না কেনো? হয়েছে কি?’
সাহেলা খেঁকিয়ে উঠলো,
‘কি হয়েছে সেটা বলেই বা কি হবে? বাড়ির কেউ কি আর আমার কথা শুনে? আমার কথা ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়? যার যা খুশি তাই করছে। তা করুক গে! আমি এ বাড়িতে এসেছিলাম বান্দী হয়ে, মরবোও বান্দী হয়ে। আমার আবার কিসের এতো আপত্তি?’
রমজান খান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
‘আহা! কি হয়েছে সোজা সাপ্টা বলো না। এত পেচিয়ে বলার কি প্রয়োজন ?’
সাহেলা এবার কঠিন গলায় বললো,
‘বাড়ির বউ ব্যাগ কাধে এখন ঢ্যাং ঢ্যাং করে ভার্সিটি পড়তে যাবে। এসবও আমার দেখা লাগবে!’
রমজান খান খুব সাবধানে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তারপর গলা কেশে পরিষ্কার করে বললেন,
‘রুদালির কথা বলছো? ও কি ভার্সিটি গিয়েছে নাকি আজকে?’
‘হু’।
‘তা বেশ তো! এতে ক্ষতি কি! মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো। তাছাড়া বিয়ের সময় ওর বাবাকে আমি কথা দিয়েছি। মেয়েকে পড়ালেখা করাবো’।
‘এরকম একটু আধটু কথা নেওয়া দেওয়া হরহামেশাই হয়। তার মানে এই না যে সেসব ধরে বসে থাকতে হবে’।
কথোপকথনের এই পর্যায়ে রমজান খানের কপালে ভাঁজ পরিলক্ষিত হলো। তিনি গুরুগম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘কি চাইছো তুমি? খুলে বলো তো’।
‘বাড়ির বৌ এরকম রঙ ঢং করে বাইরে পড়তে যেতে পারবে না’।
‘কেনো? কি সমস্যা? অর্নব সারাদিন বাড়িতে থাকে না। তুমি রান্নাঘরে অন্য কারো উপস্থিতি সহ্য করতে পারো না। মেয়েটা সারাদিন বাড়ি বসে করবে কি?’
‘এত কিছু জানি না। আমার মন চান দিচ্ছে। খানিকটা সন্দেহও হচ্ছে!’
‘সন্দেহ? কি নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে তোমার?’
‘যেভাবে মেয়েটাকে হুট করে আমাদের ছেলের ঘাড়ে তুলে দিলো, আমার তো মনে হয় মেয়ের সমস্যা আছে। তুমিও যাচাই বাছাই না করে মত দিয়ে দিলে’।
‘তুমি খামোখা এত ভাবছো’।
‘যাই বলো, আমি মেয়ের পড়াশোনার পক্ষে না’।
রমজান খান চুপ হয়ে গেলেন। মনস্থির করলেন আর কথা বাড়াবেন না। অবশ্য কথা বাড়িয়েও লাভ নেই। সাহেলা কথার পিঠে কথা বলতেই থাকবে। যুক্তি তর্কও চলতে থাকবে। চলতেই থাকবে। অনন্তকাল। আনস্টপেবল আর্গুমেন্ট। সাহেলা সহজ গলায় বললো,
‘একটু পরে কমলাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। কাপ নিয়ে যাবে’।
সাহেলা বের হয়ে গেলো। রমজান খান কানের পাশে চশমা গুঁজে নিলেন। আজকের পত্রিকা এখনো পড়া হয় নি।

রুদালি মাওলানা ভাসানি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রবেশাদ্বার দিয়ে ঢুকলো। অভ্রর সাথে দেখা হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সম্ভাবনা বাদ দিয়ে আশঙ্কা বলা হচ্ছে কারণ রুদালি চায় না অভ্রর সাথে সাথে তার দেখা হোক। কিন্তু প্রকৃতি বড় অদ্ভূত। মানুষের ইচ্ছের বিপরীতে চলতে তার সীমাহীন আনন্দ! ভার্সিটির পুকুর পার হওয়ার সাথে সাথে অভ্রর দেখা পাওয়া গেলো। গাছের গোঁড়ায় বসে আছে। একা। হাতে বই। অভ্রর গল্পের বই পড়ার অভ্যাস নেই। তাই একাডেমিক বই হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। একবার রুদালি অভ্রকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই পড়তে দিয়েছিলো। চোখের বালি। লেগে থেকে প্রথম কয়েক পাতা পড়ানো গেলো। বাকি পাতাগুলো সে ছুঁয়েও দেখলো না। আবার কে জানে! হয়তো নতুন করে গল্পের বই পড়া শিখেছে। বা কেউ শিখিয়ে নিয়েছে। রুদালির মানসিকতা বদলাতে শুরু করলো। তার অভ্রর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। ছেলেটা কেমন আছে জানতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা প্রাক্তন হয়ে যাওয়ার পর তার খবরাখবর নেওয়াটা কি অন্যায়ের মাঝে পরে?

‘কেমন আছো?’
অভ্র চমকে উঠলো। মুখ তুলে চাইলো। বুকটা ধক করে উঠলো। মরীয়া বাতাসে যেনো অভ্যন্তরীন হাহাকার গুলো জেগে উঠেছে। সে নিজেকে সামলে নিলো। হাসিমুখে উত্তর দিলো,
‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
‘ভালো আছি’।
প্রত্যুত্তরে অভ্র শুধু হাসলো মাত্র। আরো কিছু জিজ্ঞেস করবে নাকি তার বোধগম্য হচ্ছে না। রুদালি আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো অপেক্ষা করছে। অভ্র কিছু জিজ্ঞেস করবে কিনা! অভ্র জিজ্ঞেস করলো,
‘তোমার পরিবারের সবাই কেমন আছে?’
‘আমার এখন দুটো পরিবার। কোন পরিবারের কথা জানতে চাইছো?’
‘নতুন পরিবার’।
রুদালি হাসলো। হেসে উত্তর দিলো,
‘ভালো আছে। সবাই অনেক ভালো আছে’।
অভ্রও হাসলো। আবার কিছুসময়ের জন্য পরিবেশ থমকে গেলো। এ যেনো ক্ষণিকে ক্ষণিকে মন খারাপের বার্তা। পুরোনো দিনের একসাথে কাটানো মুহূর্তের ঐকতান। এ যেনো কোনো উপন্যাসের কলমের ছোঁয়ানো ইতিকাল। পুরোটো উপন্যাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় যেনো তারাই ছিলো। তাদের ভালোবাসার চিত্রকলা ফুটে উঠছিলো। শুধু শেষটা হলো তাদের অনিচ্ছায়। বাস্তবতার মোহে হলো উপন্যাসের বিচ্ছিন্ন এক শেষ।
রুদালি বললো,
‘আমি তাহলে ক্লাসে যাই।’
‘যাও।’
‘ভালো থেকো’।
‘তুমিও’।
রুদালি সামনে পা ফেলত শুরু করলো। আজ থেকে অভ্রর সাথে তার মাঝে মাঝে দেখা হবে। তাদের আকাশে মেঘগুলো জমাট বেধেছে। এ মেঘগুলো স্থির। এ যেনো চোখের পলক না ফেলতেই হারিয়ে ফেলা সময়। মনের ক্ষুধা না মিটতেই বিযুক্তির খবর। চাইলেও এখন আর জেলা রোডের ফুচকা আর চটপটির প্লেটে কেউ ভাগ বসাতে আসবে না। আজ অভ্রর কাছে যেতেই সেই সস্তা পারফিউমের গন্ধ রুদালির নাকে লেগেছে। আজ সেই গন্ধটা তার কাছে অচেনা বলে মনে হয়েছে। চিরচেনা লাগে নি! রুদালি সবে বুঝতে পেরেছে গন্ধটা ভীষণ ঝাঁঝালো। আগে তো কখনো মনে হয় নি! রুদালির বিছানার পাশে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটা মিষ্টি গন্ধযুক্ত পারফিউম গায়ে মাখে। সেই গন্ধে এখন রুদালি বিমোহিত। সময় বদলে যাচ্ছে। নিয়ে যাচ্ছে পুরোনো অনুভূতি। দিয়ে যাচ্ছে নতুন আবেগ। এইতো জীবনের সংজ্ঞা।

রাতে অর্ণব অফিস থেকে ফিরলো। ঘরে ঢুকে দেখলো রুদালি জানালার কাছে বসে আছে। উদাস দৃষ্টি মেলে দিয়েছে আকাশে।
‘সারাদিন কেমন গেলো আজ? ভার্সিটি কেমন ছিলো?’
রুদালি আগের অবস্থায় থেকেই জবাব দিলো,
‘ভালো।’
‘পুরোনো বন্ধুদের সাথে মন খুলে কথা বলেছো?’
রুদালি হেসে বললো,
‘আমার তেমন কোনো বন্ধু নেই যার সাথে মন খুলে কথা যায়।’
‘ও।’
এমন সময় শব্দ করে কোথাও বাজ পড়লো। রুদালি ছিটকে উঠলো কিন্তু জানালার কাছ থেকে সরলো না। অর্ণব অবাক হয়ে বললো,
‘বাজ পড়লে তুমি ভয় পাও না?’
‘না। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ আছে কি?’
‘কি আজব মেয়েরে বাবা! বাংলা সিনেমাতে দেখো না বাজ পড়লে নায়িকারা ভয় পায়। নায়ককে জড়িয়ে ধরে। তোমার আমার মাঝে এ জাতীয় ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই দেখা যায়।’
রুদালি প্রত্যুত্তরে হাসলো।
‘ রুদালি বাইরে যাবে?’
‘এখন!’
‘হ্যাঁ। চুপ করে বেরিয়ে যাবো।’
‘কোথায় যাবো?’
‘ক্যাপসুলের সামনে। আইসক্রিম খেতে।’
‘আকাশের যে অবস্থা! যখন তখন বৃষ্টি শুরু হবে।’
‘শুরু হলে হবে। ভিজতে ভিজতে আইস্ক্রিম খাবো।’
রুদালি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজে আইস্ক্রিম খাওয়ার পরিকল্পনা রুদালির কাছে নতুন নয়। বহু আগে তার ডায়রির পাতায় এই ইচ্ছের কথা লিখা হয়ে গেছে। অর্ণবের প্রতিটি পদক্ষেপ সেই ডায়রির লিখাগুলোর সাথে মিলে যায়। কেনো যায় এও এক রহস্য!

(চলবে…)

#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ ১৮
মাস কয়েক পর।
অভ্র এখন দুজনকে পড়ায়। বাম্পু আর ট্যাম্পুকে। বাম্পু ক্লাস এইট এ পড়ে। ট্যাম্পু পড়ে ক্লাস নাইনে। ট্যাম্পু বাম্পুর চাচাতো ভাই। তাদের নাম মিলিয়ে রাখা হয়েছে। এ বংশের সব ভাই বোনদের নাম কি মিলিয়ে রাখা হবে? মকবুল ভাই বাম্পুর বড় বোনকে পড়াতেন। সেই মেয়ের নাম হলো শ্যাম্পু। অর্থাৎ বাম্পুর বড় বোনের নাম শ্যাম্পু। ট্যাম্পুর কোনো বোন আছে কিনা অভ্র এখনো জানে না। কিন্তু সে ধারণা করতে পারছে। ট্যাম্পুর কোনো বোন থাকলে তার নাম হবে ল্যাম্পু। এই বংশের নাম একসময় ‘এম্পু’ হয়ে যাবে। বাচ্চাগুলো বড় হয়ে পরিচয় দিবে আমরা ‘এম্পু’ বংশের সন্তান। ব্যাপারটা বেশ মজাদার!

দুজনকে পড়ানোর ফলে হাতে আরো কিছু টাকা আসছে অভ্রর। হেসে খেলে না হলেও মাস কেটে যাচ্ছে তার।
আজ বাম্পু আর ট্যাম্পু দুজনই ভিন্ন মানসিকতা নিয়ে পড়তে এসেছে। ট্যাম্পুর চোখ চিকচিক করছে। যেনো দুচোখে জ্বলজ্বল করে তারা জ্বলছে। আর বাম্পুর চোখে ভয়। তারও কারণ রয়েছে। বোর্ড পরীক্ষাকে সকলেই ভয় পায়। বাম্পুর জে এস সি পরীক্ষার তারিখ ঠিক করে ফেলা হয়েছে। এদিকে এস এস সি ক্যান্ডিডেট দের টেস্ট পরীক্ষা শুরু হলো বলে! ট্যাম্পুদের স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে। অবশ্য টেস্ট পরীক্ষার ঝামেলা মিটলে তাদের বার্ষিক পরীক্ষার ঝামেলা শুরু হবে। কিন্তু এ নিয়ে ট্যাম্পুকে খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না। বাম্পুর মাথায় অভ্র হাত বুলিয়ে দিলো। নরম কন্ঠে বললো,
‘মন খারাপ কেনো?’
‘ভয় লাগছে, স্যার’।
‘ভয় লাগছে! কেনো?’
বাম্পু চুপ করে রইলো। পাশ থেকে ট্যাম্পু বলে উঠলো,
‘স্যার, বাম্পু পরীক্ষা নিয়ে টেনশন করছে’।
অভ্র বাম্পুকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
‘ভয় কিসের? তুমি অনেক ভালো রেজাল্ট করবে’।
বাম্পু কিছুক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে বসে থেকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ট্যাম্পু ভাইয়ার থেকেও ভালো করবো?’
ছেলেটার প্রশ্ন শুনে অভ্র কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। সে চোখে এক ঝাঁক বিস্ময় নিয়ে দেখলো বাম্পুর চোখের কোণায় পানি।
‘একি বাম্পু! কান্না করছো কেনো?’
‘আমি যদি ট্যাম্পু ভাইয়ার চেয়ে বেশি না পাই মা আমাকে খুব মারবে। বলেন না স্যার, আমি কি ট্যাম্পু ভাইয়ার চেয়ে বেশি পাবো?’
অভ্র বুঝতে পারলো তার ধারনা ভুল ছিলো না। প্রথম যেদিন সে বাম্পুকে পড়াতে আসে ছেলের হাতে লম্বা লম্বা কালো দাগ আবিষ্কার করেছিলো। কিন্তু তাকে এবিষয়ে কিছু শুধায় নি। অবশ্য, শুধানোর প্রয়োজন মনে হয় নি। পারিবারিক ব্যাপারে নাক ঘষা উচিত নয়। সে বাইরের লোক। তবে বাম্পুর মা ছেলের পড়াশোনার বিষয়ে যে কতটা সিরিয়াস সেটা তার কথা বার্তা আর অভিযোগের ফুলঝুরি ছড়ানো দেখেই অভ্র আঁচ করতে পেরেছিলো। এই বয়সের ছেলেরা অনেক চঞ্চল প্রকৃতির হয়। কিন্তু বাম্পু একদম আলাদা। খুব চুপচাপ। অভ্র পুনরায় বাম্পুর মনে শক্তি জোগালো।
‘নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই তুমি ভালো করবে’।
এ পর্যায়ে ট্যাম্পুও বলে উঠলো,
‘হ্যাঁ, ভাই। তুই আমার থেকেও ভালো করবি। মিলিয়ে নিস’।
অভ্র আর ট্যাম্পুর কথায় বাম্পু ভরসা করতে চাইলো। কিন্তু ঠিক কতখানি ভরসা করতে পেরেছে তা বোঝা যাচ্ছে না। অভ্র তাদের বই খাতা খুলতে বললো।
পড়ানোর এক ফাঁকে, অভ্রর মনের মখমলের পর্দার আড়াল হতে রায়া বেশ কয়েকবার উঁকি দিলো। বড় জানতে ইচ্ছা করছে তার, মেয়েটার প্রস্তুতি কেমন? টেস্ট পরীক্ষায় এবার উত্তীর্ণ হবে তো?

বিশাল বড় একটি গ্লাস রায়ার পড়ার টেবিলের ওপর রাখা হলো। কাচের গ্লাসে ধবধবে সাদা দুধ। দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে। কিন্তু খেতে ঠিক ততটাই বিশ্রি লাগবে। তবুও রায়ার খেতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত দুধের গ্লাস খালি হবে না নুরুল আলম এক ইঞ্চিও এদিক সেদিক নড়বেন না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবেন। দুধ খাওয়া নিয়ে রায়ার ওপর এই অত্যাচার শুরু হয়েছে বিমল স্যারের নির্দেশে। তিনি নুরুল আলমকে বলেছেন,
‘আপনার মেয়ে এবারো ফেল করবো। তার মাথায় তো দুধের অভাব’।
‘মাথায় দুধের অভাব?’
তিনি পান চিবোতে চিবোতে উত্তর দিয়েছেন,
‘জ্বে। তাকে বেশি কইরা দুধ খাওয়ান। মাথায় দুধ গেলে, ব্রেন পুষ্টি পাবো। মেয়ের বুদ্ধি বাড়বো’।
‘নিয়মিত দুধ খেতে না দিলে মেয়ে পাশ করবে না।?’
‘জ্বে না। পাশ করাতে চাইলে তারে দুধ খাওয়ান। পাশের সাথে বুদ্ধি ফ্রি। মাইয়া মানুষের মাথায় বুদ্ধির অভাব’।

বিমল বাবুর কথা নুরুল আলমের মনে ধরেছে। তিনি নিষ্ঠার সাথে স্যারের নির্দেশ পালন করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন রায়াকে জোর করে এক গ্লাস দুধ খেতে হচ্ছে। বুদ্ধি বাড়লো কিনা তা নিয়ে নুরুল আলমের মাথা ব্যাথা নেই কিন্তু মেয়ের এবার পাশ করতে হবে। রায়া শান্ত গলায় বললো,
‘বাবা, আমি দুধ খাবো না’।
‘খাওয়া লাগবে। মাথায় দুধ নাই তোর’।
রায়া বিরক্তি ভরা কন্ঠে বললো,
‘বাবা মূর্খদের মতো কথা বলবে না। দুধের জন্য কি মস্তিষ্কে আলাদা পাকস্থলি রাখা আছে যে দুধ মাথায় যাবে?’
‘না’।
‘তাহলে এজাতীয় কথা বলবে না’।
‘আচ্ছা বলবো না। কিন্তু তুই দুধটুকু খেয়ে নে’।
‘যেহেতু মাথায় আলাদা পাকস্থলি নেই সেহেতু আমার মাথায় দুধ যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। কাজেই, আমি দুধ খাবো না’।
‘পরীক্ষায় ফেল করবি এবারো’।
‘দুধ খাওয়ার সাথে পাশ ফেলের সম্পর্ক কি? দুধে কি অংকের সূত্র মেশানো?’
‘জানি না। বিমল বাবু বলে গেছেন’।
‘উনি সবসময়ই ভিত্তিহীন কথা বলেন। উনার কথা ধরে বসে আছো তুমি!’
নুরুল আলম হতাশ কন্ঠে বললেন,
‘দুধ খেলে কি তোর কোনো ক্ষতি হবে?’
‘না। কিন্তু আমার খেতে ইচ্ছে করছে না’।
নুরুল আলম এক চুলও নড়লেন না। রায়ার পাশে দাঁড়িয় রইলেন। যত যাই হোক, বাবাকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা যায় না। রায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুধটুকু খেয়ে নিলো।

অভ্র হলের বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে বসে আছে। পাশে মুড়ির টিন রাখা। খরচ বাঁচাতে আজকাল রাতে সে একমুঠ মুড়ি খায়। প্রথম দিকে সমস্যা হলেও এখন আর সমস্যা হয় না। সয়ে গেছে। কথায় আছে_ শরীরের নাম মহাশয়, যা সহাবেন তাই সয়। সবই অভ্যাসের বিষয়। আচমকা তার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রীনে নাম দেখে অভ্র ফোন রিসিভ করলো। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মেয়েটা বলে উঠলো,
‘আপনার মাথায় দুধ আছে?’
এমন প্রশ্ন শুনে অভ্র হেসে ফেললো।
‘আপনি এমন উদ্ভট উদ্ভট প্রশ্ন কই খুঁজে পান?’
‘কেউ একজন আমার বাবাকে বলেছে আমার মাথায় দুধের অভাব। তাই তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে এক গ্লাস দুধ আমাকে খাওয়াচ্ছেন!’
‘বেশ তো। ক্ষতি কি?’
‘ক্ষতি নেই। কিন্তু আপনি আমাকে এটা বলেন, যে মানুষ এ কথাটা বলেছে তিনি মূর্খ না?’
‘না। মূর্খ কেনো হবে?’
‘মূর্খ হবে না কেনো? মানুষের মাথায় দুধের প্রয়োজন এটা কেমন তর কথা?’
‘হয়তো উনার কথার অভিগমন ভিন্ন। উনি বোঝাতে চেয়েছেন আপনার বুদ্ধি কম, তাই দুধ খাওয়া প্রয়োজন’।
‘আপনারো কি আমাকে নিয়ে একই মতামত?’
‘কোন বিষয়ে?’
‘বুদ্ধির বিষয়ে?’
‘না। আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী’।
মেয়েটা হাসলো। তার হাসি আচমকা অভ্রর কাছে বেশ পরিচিত বলে মনে হলো। কোথায় যেনো শুনেছে! কিন্তু মনে করতে পারলো না।
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
অভ্র বললো,
‘করুন’।
‘আপনি যখন কোনো কিছু নিয়ে অনেক চিন্তায় থাকেন তখন কি করেন?’
‘চিন্তাদের ছুটি দিয়ে দেই’।
‘সেটা কিভাবে?’
‘অনেক অনুশীলনের বিষয়। এর জন্য আপনাকে সবসময় চিন্তার মধ্যেই থাকতে হবে। চিন্তা দিয়ে বাড়িঘর বানাতে হবে। চিন্তার বিছানায় কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে হবে। চিন্তার গ্লাসে প্লেটে খেতে হবে। নিজের পৃথিবী টা হয়ে যাবে চিন্তাময়। একসময় আপনি চিন্তাদের সাথে সমঝোতায় আসতে পারবেন। বলবেন, চিন্তা ভাই, অনেক খাটুনি তো হলো। আপনি আপনার পরিবার এবং আত্মীয় সজনদের নিয়ে দূরে কোথাও ছুটি কাটাতে যান’।
‘তখন চিন্তা ভাই কি করবে?’
‘চিন্তা ভাই প্রস্তুতি নিবে। ব্যাগ পত্র গোছাবে। আপনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হবে। গাড়ি ছাড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সবাইকে নিয়ে ফিরে আসবে’।
‘বাহ!’
‘হঠাৎ এমন প্রশ্ন করার কারণ?’
‘এমনি। জানতে ইচ্ছে করলো। আচ্ছা আমি রাখছি’।
‘ঠিকাছে’।

রায়া কান থেকে ফোন নামিয়ে পাশে রেখে দিলো। ‘তনিমা’ চরিত্রটি থেকে বের হয়ে আসলো। পরীক্ষা নিয়ে সে বেশ চিন্তায় আছে। তাদের ক্ষণিককালের জন্য ছুটি দেয়া প্রয়োজন।

আতিয়া আদিবা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে