আলো-আঁধার পর্ব-১৬+১৭

0
1060

#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা: সালসাবিল সারা

১৬.
ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমের ঠিক মধ্যখানে বিছানার উপর তূর্যয় বসে আছে।তূর্যয়ের পাশে হালকা একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে।অবশ্য এই টেবিল ল্যাম্পের আলোতে শুধু তূর্যয়ের হাতে থাকা মদের গ্লাস আর তূর্যয়ের বিশাল দেহের অবয়ব দেখা যাচ্ছে।একটু আগেই সে শান্তি মহলে ফিরলো।মনির এতো বলার পরেও রাতের খাবার খায়নি সে।রুমে ঢুকে গোসল সেরে উদোম গায়ে কোমরে তাওয়াল পেঁচিয়ে সে মদের গ্লাস নিয়ে বসে আছে।তূর্যয়ের দৃষ্টি বর্তমানে তার হাতে থাকা মদের গ্লাসে।তূর্যয়ের জীবনে তার অতীতের সুন্দর একটা অংশ আজ সে ফিরে পেলো।যদিও তার সেই সুখের অতীতে তূর্যয় আর রাণীর দুইজনের নাম থাকলেও,রাণী এইসব ব্যাপারে সম্পূর্ণ জ্ঞানহীন। কারণ,তূর্যয় যখন অত্র স্কুলে ক্লাস টেনে ভর্তি হয়েছিল তখন রাণী ক্লাস থ্রিতে পড়তো।তূর্যয় রাণীকে মায়ার নজরে দেখতো তখন,এই ব্যাপারে রাণী একেবারেই অজ্ঞ।ক্লাস টেনে তূর্যয়ের বয়স ছিল তখন বিশ।এর পেছনেও একটা বিশাল কারণ আছে।তূর্যয়ের মা মারা যাওয়ার পর জীবনের সবচেয়ে কালো অধ্যায় দেখেছিল সে।অতীতের নানান কালো অভিজ্ঞতা তূর্যয়ের অতীতকে বিষিয়ে দিয়েছে।তার মা মারা যাওয়ার পর পরই তূর্যয়কে স্কুল থেকে নামিয়ে ফেলে হাসান।এরপর তাকে এক মাদ্রাসায় ঠেলে দেয় হাসান। যেখানে তূর্যয় তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন কাটিয়েছিল।সেখানে তার পড়ালেখা ছুটে গেলো অনেক বছর।এরপর মোল্লা সাহেবের অনুপ্রেরণায় তূর্যয় তার গায়ের আঘাতের যন্ত্রণার সাহায্যে শক্তিশালী হতে শুরু করে।মাদ্রাসার আঘাত তূর্যয়কে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনতে অনেকটা বছর সময় নিয়ে নেয়।এরপর মোল্লা সাহেব,তূর্যয়ের বিশ বছর বয়সে দশম শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেয় বোর্ড পরীক্ষার জন্যে।তূর্যয়ের জীবনে ততদিনে ছেয়ে গিয়েছিল আঁধার।স্কুলের কারো সাথেই তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। উচ্চতায় লম্বা হওয়ার কারণে তূর্যয়কে স্কুলের এসেম্বলি করার সময় সবসময় পেছনে দাঁড়াতে হতো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অধিকারী তূর্যয় সেই পেছন থেকেই সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পেতো। এমনই একদিন এসেম্বলি করার আগে,যাদের জামা অপরিষ্কার তাদের সামনে এনে শাস্তি দেওয়ার জন্যে কিছু স্টুডেন্টকে দাঁড় করিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। সামনে দাঁড়ানো সেই স্টুডেন্টদের মধ্যে ঠিক তখনই তূর্যয়ের নজরে এসেছিল রাণী।রোদের কারণে ঠিক এখনের মতো চোখ মুখ কুঁচকে রাখতো রাণী।যেই মুখের মায়া তূর্যয় আজও ভুলেনি।রাণী প্রায় সবসময় এসেম্বলিতে এমন শাস্তি পেতো।আর তূর্যয় তার মন জুড়িয়ে সেই ছোট্ট মেয়েটির মায়ামাখা মুখ দেখতো।সারাদিনের নানান অবহেলায় বড় হওয়া তূর্যয়ের রাতের বেলা সুখের আবেশ ছিল তার মা আর রাণীর সেই মায়া মাখা চোখের চাহনি।রাণীকে এতো বছর পর ফিরে পেয়ে তূর্যয়ের মনে হচ্ছে তার জীবনটা সত্যি এইবার আলোকিত হবে।এইসব ভাবতেই মুহূর্তেই তূর্যয়ের কপালের রগ ফুলে উঠলো।হাতে থাকা মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে সবটাই খেয়ে নিলো সে।এরপর খুব জোরে গ্লাসটি টেবিলের উপর রেখে তূর্যয় দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,
–“কখনোই না তূর্যয়।তোর জীবনটা এখন একেবারে আঁধারে ঘেরা।এই জীবনে আর আলো জ্বালানোর মতো কিছু নেই,কেউ নেই।তোর এই অন্ধকার জীবনের ভবিষ্যৎ শুধু অন্ধকারই হবে।এইখানে রাণীর আগমন আমাদের দুইজনের জন্যেই ক্ষতি হবে।জেনে শুনে আমি সেই ছোট মেয়েটাকে কষ্ট দিতে পারবো না।কখনোই না।উফফ,তূর্যয়!কেনো খুঁজে পেয়েছিস তুই তাকে?কেনো?খুঁজে পাওয়ার হলে আগে পাসনি কেনো?এখন তোর জীবনে কারো অস্তিত্ব নেই।তোর এই জীবনে শুধু অন্ধকারই আছে।”
তূর্যয় নিজের বুকে হাত চেপে বসে পড়লো বিছানায়।আজ তার কথাগুলো ভাবতে এক প্রকার কষ্ট অনুভব হচ্ছে।এমন চাপা কষ্ট তূর্যয় আগে কখনোই অনুভব করেনি।
“আমার জীবনে,আমি রাণীর অস্তিত্ব কখনোই আসতে দিবো না।আমি জেনে শুনে এক অসহায় মেয়েকে বিপদে ঠেলে দিতে কখনোই রাজি না।”
তূর্যয় মনে মনে বললো কথাগুলো।কিন্তু নাহ,তূর্যয় তার মনের কথার সাথে আজ তাল মেলাতে পারছে না।সবকিছু একপাশে রেখে তূর্যয় শুয়ে পড়লো বিছানায়।মাথা থেকে সবকিছু ঝেড়ে ফেলতে চাইছে সে।কিন্তু,
তূর্যয় কিছুতেই ভুলতে পারছে না।না চাওয়া সত্বেও তূর্যয়ের চোখে ভাসছে রাণীর সেই রোদ মাখা চেহারা।এমনটা তূর্যয়ের নজরে আসতেই তূর্যয় নিজের মুখে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
–“ইসস, রোদ্র কন্যা!”

রাণীকে দেওয়া রাহেলার এক সপ্তাহ শেষ হলো তিনদিন আগে।এই নিয়ে রাণীর চিন্তার কমতি ছিল না।কারণ রাণী তূর্যয়কে এখনো তাকে সাহায্য করার কথা কিছু বলেনি।তবে, এখন রাহেলা শহরে না থাকায় রাণী আরো কিছুদিন সময় পেলো হাতে।এই বিষয়ে রাণী আল্লাহ্ এর কাছে শোকরিয়া করেছে।সেদিন রাণী তূর্যয়ের বাসা থেকে এসে সিমিকে হ্যারির কথা বলেছিল।সিমি বিনা সংকোচে হ্যারির সাথে কথা বলতে রাজি হয়ে গেলো।তবে রাণী জানেনা এখন হ্যারি আর সিমির মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা! হ্যারি রাণীকে তাদের ব্যাপারে কিছুই বলেনি।হ্যারি আর সিমির ব্যাপারটা খেয়াল না করলেও রাণী ঠিক খেয়াল করে,হ্যারি সারাদিন এমন এমন কাজ এর ব্যাবস্থা করে যাতে রাণী আর তূর্যয় একসাথে থাকতে পারে।হ্যারির এইসব কাজকর্ম রাণীর মাথায় একদম ঢুকে না।রাণী সমুদ্রের পাশে অবস্থিত তূর্যয়ের সেই বাড়িতে যাওয়ার জন্যে টেম্পুতে উঠে পড়লো।রাণীর মাথায় প্রত্যেকদিন মতো আজও নানান কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।অবশ্য এইসব কথা তূর্যয়কে ঘিরেই।প্রত্যেকদিন রাণী অফিসে যাওয়ার আগে তূর্যয়ের সমুদ্রের পাড়ের বাড়িতে যেতে হয়।সেখানে রাণী, হ্যারি আর তূর্যয়ের জন্যে সকালের নাস্তা বানায়।এই কাজের জন্য অবশ্য হ্যারি রাণীকে জোর করেছে।রাণীর স্পষ্ট মনে আছে কিছুদিন আগে হ্যারি রাণীর হাত ধরে অনুনয়ের সুরে তাকে বলেছিল,
–“আমি জানি বাঙালি গার্ল তুমি,কুকিং ভালো পারবে।একটা রিকোয়েস্ট করছি,তুমি এভ্রিডে প্রথমে অফিসে না গিয়ে ব্রো এর নিউ বাসায় আসবে।ব্রো প্রত্যেকদিন প্রোটিন শেইক আর অ্যালকোহল খায় বেশি,খাবার খায় কম।তাই আমি চাচ্ছি,ব্রো এর মর্নিং শুরু হোক;টেস্টি অ্যান্ড গুড ব্রেকফাস্ট দিয়ে।আমি একা বললে ব্রো আমার কথা কখনোই শুনবে না।কিন্তু তুমি যদি জোর খাটিয়ে এইখানে এসে নাস্তা বানিয়ে দাও, সাথে আমিও যদি ব্রো এর সাথে নাস্তা করি;তাহলে ব্রো কখনো মানা করবে না।প্লিজ,হেল্প মাই ব্রো।”
রাণী হ্যারির কথায় কিছু বলেনি।শুধু মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বলেছিল রাণী হ্যারিকে।এমনিও রাণীর কিছু বলার ছিল না।সে চাকরি করে ।তাই দ্বিতীয় বস যা বলবে তা তো তাকে মানতেই হবে।আর তূর্যয়ের খাবার খাওয়ার নিয়ম শুনে, রাণী নিজেও হ্যারির চিন্তাকে খারাপ মনে হলো না বরং বেশ ভালই লাগলো তার কাছে।সেই থেকে প্রত্যেকদিন রাণী তূর্যয়ের সমুদ্রের পাড়ের বাসায় যায় নাস্তা বানাতে।এরপর তিনজনই একসাথে অফিস চলে যায়।তূর্যয় ভোরে ঘুম থেকে উঠে জগিং সেরে এরপর এই বাড়ি চলে আসে।অফিসের জন্যে রেডি হয় সে এই বাড়ি থেকে। মোট কথা,তার মায়ের ওয়াদা রক্ষার্থে তূর্যয় রাতে শান্তি মহলে ফিরে।আর বাকিটা সময় তূর্যয় তার নতুন বাড়িতে কাটানোর চেষ্টা করে।

টেম্পু থেকে নেমে রাণী তূর্যয়ের বাড়ির সামনে এসে থেমে গেলো।বাড়ির সামনে লেগে থাকা নেইম প্লেট দেখে সে মনোযোগ দিয়ে সেই নেইম প্লেট দেখছে।নেইম প্লেটে হাত রেখে রাণী চোখ ছোট করে ইতালিয়ান স্টাইলে লেখা ইংরেজি লেখাটা পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো,
–“কি যে লিখেছে এটা! ঐ দানবের ঘরের দেখি নাম দিলো এতদিনে।যাক আক্কেল এসেছে উনার।কিন্তু কিসব লিখেছে ইংরেজিতে পেঁচানো পেঁচানো।উফফ এটা কি ‘ ডি’ লিখেছে নাকি?ধুর বাবা,কিসব লিখা বুঝায় যায় না।কি আর হবে, ‘হিংস্র রাজার ঘর’ নাহলে ‘তূর্যয়ের ঘর:দা কাটাকুটি হাউজ’ এইসব কিছু এটা হ…”
রাণী কিছু একটা বলতে নিয়েও থেমে গেলো।কারণ রাণী বুঝতে পারছে তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।রাণী কিছু বলার আগেই তার পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
–“ডার্ক হাউজ।আমার বাড়ির নাম ডার্ক হাউজ। যার অর্থ অন্ধকার ঘর।”
এমন কথা শুনে রাণী পেছনে ফিরতেই, তার মুখ হাঁ হয়ে গেলো।কারণ,রাণীর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তূর্যয়।তূর্যয়ের গায়ে জগিং এর কাপড় দেখে রাণী বুঝতে পারলো তূর্যয় এখনো বাড়িতেই ঢুকেনি।রাণী তার মুখ থেকে বিস্ময় ছেড়ে দিয়ে মুখে হাসি টেনে বলতে লাগলো,
–“আম..আমি জানি।আপনি কি ভেবেছেন আমি পড়তে জানি না?আমি ইন্টার পাশ। বুঝেছেন আপনি?”
–“হুম,অনেক কিছু। ডি ডি করতেই পুরো সময় পার করেছিস।আবার নাকি ইন্টার পড়ুয়া!সর সামনে থেকে।”
কথাগুলো বলে তূর্যয় রাণীকে হাত দিয়ে তার সামনে থেকে সরিয়ে দিলো।তূর্যয় ধপ ধপ পা ফেলে ভেতরের দিকে যাচ্ছে। আর রাণী চোখ ছোট করে হাত মুঠ করে রাগী গলায় মিনমিন করে বলতে লাগলো,
–“এসেছেন আমাদের মাস্টার মশায়।শয়তান, গুন্ডা,দানব!মারামারি ছাড়া আপনি নিজে কি পারেন?হ্যাঁ?আমি ইন্টার পড়ুয়া।আর আপনি আমাকে নিয়ে হাসছেন?আপনি…আপনি একটা সন্ত্রাসী!”

–“হাহাহা,এতো রাগ কেনো আজ?”
হ্যারির কথায় রাণী তাকিয়ে দেখলো। হ্যারি একটা মোটর সাইকেল থেকে নামছে।রাণী হ্যারির সামনে গিয়ে বললো,
–“আপনি মাত্রই এসেছেন।তাহলে কেমনে বুঝলেন আমি রেগে আছি?”
–“গাড়ি থামানোর আগে দেখলো হাত মুঠ করে তুমি নিজে নিজে কিছু বলছিলে,সিস।এতেই আমি বুঝে গেলাম তুমি রেগে আছো।আফটার অল,আম ইউর ব্রাদার!”
হ্যারি রাণীর কাঁধে হাত রেখে বললো।

রাণী এবং হ্যারি দুইজনই হাঁটতে লাগলো বাড়ির ভেতরে যাওয়ার জন্যে।এরমধ্যেই রাণী মুখ ফুলিয়ে হ্যারিকে বলতে লাগলো,
–“আপনার ব্রো কতটুক পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে, হ্যাঁ?আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে উনি।পড়ালেখার প্রতিযোগিতায় লাগিয়ে দিলে না এই রাণীকে কেউ হারাতে পারবে না। ঐ দানবটাও না।”
হ্যারি হাসলো রাণীর কথায়। রাণীর কাঁধে হাত রাখা অবস্থায় হ্যারি রাণীকে বললো,
–“ভাই গ্রেজুয়েশন শেষ করেছে দেশেই।তবে,নরমাল পিউপল যে টাইমে গ্রেজুয়েশন শেষ করে সে টাইম থেকে অনেক বেশি টাইম লেগেছিল ব্রোয়ের।কারণ, ব্রোয়ের পাস্ট লাইফ একদম হেলের মতো ছিল। যার কারণে, তার স্টাডিতে একটা বিরাট খারাপ প্রভাব পড়ে।ব্রো তো গাংস্টার হয়েছিল তার কলেজ লাইফ থেকে।উফ, ব্রোয়ের নাকি সেই দাপট ছিল। সাম টাইম, কোম্পানির মিটিং এ ব্রো এর আগের কিছু মানুষের সাথে মিট হয়।এদের থেকেই জানতে পারি,আমার ব্রো সুপারহিট ছিল মারপিটে সেই কলেজ থেকেই।ভাই যখন কলেজে এন্ট্রি নিতো,সবাই নাকি ভয়ে শিভার করতো।হা হা হা। স্টিল,
আমার ব্রো এর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার মানুষ আমি একটাও খুঁজে পায় না,শুধু তুমি ছাড়া।হাহাহা।”
হ্যারি হাসতে লাগলো কথাগুলো বলে।কিন্তু,রাণীর মাথায় ঘুরছে হ্যারির মধ্যখানের কথাগুলো যেখানে হ্যারি বলেছে,তূর্যয়ের অতীতের জন্যে তার পড়ালেখার অনেক ক্ষতি হয়েছে।রাণী হ্যারিকে কিছু বলতে যাবে,
এর আগেই দেখলো তারা ঘরের লিভিংরুমে চলে এসেছে।যেখানে তূর্যয় হাতপা ছড়িয়ে সোফায় বসে প্রোটিন শেইক খাচ্ছে।তূর্যয়ের নজর আপাতত টিভির দিকে।যেখানে সংবাদ চলছে।রাণী নিজের মনের কথা ভাবতে ভাবতে নাস্তা বানাতে চলে গেলো।রুটি,
ডিমভাজি,কফি,আর পাউরুটির টোস্ট সাজিয়ে নিলো রাণী টেবিলে।যদিও সে একেবারে রান্নায় সেরা না,তবে এইসব নাস্তা বানাতে সে ভালই পারে।রাণী মাথায় হাত দিয়ে বলতে লাগলো,
–“ভাগ্যিস, আমাকে ভাতের আইটেম কিছু বানাতে হয় না।নাহলে তো ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যেতো।কিন্তু, ব্যাপার না।আজকাল সব কিছু ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।এই বাড়িতে প্রথম রান্না করার আগেই আমার ভিনদেশী ভাই আমাকে একটা ল্যাপটপে ইন্টারনেট দেখে কিভাবে রান্না করতে হয় সব শিখিয়ে দিয়েছিল।ভাত আর এর সব আইটেমও আমি সহজে রান্না করে নিবো ইন্টারনেট দেখে।কারণ,আমি রাণী আমি সেরা।কোনো কাজই আমার জন্যে কঠিন না।”
কথাগুলো বলে রাণী নিজের চুল দুলিয়ে নিলো।

রাণীর এইসব কান্ড তূর্যয় দ্বিতীয় তলা থেকে লক্ষ করছিল।রাণীর এমন কান্ড দেখে তূর্যয় মনে মনে ভাবছে,
–“এই মেয়ে এমন কেনো?কোনো কিছু নিয়েই এই মেয়ের চিন্তা নেই।তাকে দেখলে মনে হয়,এই পৃথিবীতে শুধু সুখ আর সুখ, বেঁচে থাকার জন্যে এই পৃথিবীতে কোনো কষ্ট করতেই হয় না।আশ্চর্য এক মেয়ে!”
এইসব ভাবতে ভাবতে তূর্যয় খাবারের টেবিলে চলে এলো।তূর্যয়কে দেখে রাণী নিজের হাসি বন্ধ করে ফেললো।আর মুখ গম্ভীর করে তূর্যয়ের প্লেটে নাস্তা দেওয়া শুরু করলো।হ্যারি আসলে রাণীও তাদের সাথে নাস্তা করতে বসলো। নাস্তার মাঝে রাণীর মোবাইলে ফোন আসলে রাণী মোবাইল বের করতে গিয়ে নিজের ব্যাগের সব কিছু বের করে ফেললো।রাণী এতো দ্রুত ব্যাগ থেকে জিনিস বের করছিল,তার অফিসের আইডি কার্ড কাঁচের টেবিলে স্লিপ করে তূর্যয়ের কাছে এগিয়ে গেলো।রাণী,হ্যারি,তূর্যয় তিনজনের দুরত্ব একদম কাছাকাছি।টেবিল অনেক বড় হলেও তিনজন বেশ কাছাকাছি দূরত্বে বসেছে।ফলে খুব সহজেই রাণীর আইডি কার্ড তূর্যয়ের কাছে পৌঁছে গেলো।তূর্যয় রাণীর দিকে দৃষ্টি দিতেই তার চোখে পড়লো রাণীর আইডি কার্ড।সেখানে রাণীর নাম শুধু “রাণী” লেখা থাকায় বেশ অবাক হলো তূর্যয়।রাণীর দিকে আবারও তাকালে সে দেখলো রাণী মুখে পাউরুটির টোস্ট ঢুকানো অবস্থায় ফোনে বলে যাচ্ছে,
–“ঠিক আছে,ওয়াচম্যান আঙ্কেল।নিয়ে নিবো।”
ফোন রেখে রাণী মুখে টোস্ট নিয়েই হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
–“আপনাদের অফিসে কি বেতন ভাগ ভাগ করে দেওয়া হয়?আমি নতুন বিধায় ওয়াচম্যান আঙ্কেল আমাকে ফোন দিয়ে অর্ধেক বেতন নিয়ে নিতে বললো।”
–“ইয়াহ।আসলে,মাসের শেষে টাকা দিলে অনেকেই মাসের মাঝখানে মানির প্রবলেমে থাকে।তাই ব্রো এর নির্দেশ,সবার টোটাল স্যালারির এমাউন্ট মাসের মাঝখানে একবার আর মাসের শেষে বাকি হাফ দেওয়া হয়।বাট তোমার বেতন আমি দিবো।আমি ওয়াচম্যানকে তোমার ব্যাপারে বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম।”
হ্যারি কথাগুলো বলে কফির কাপে চুমুক দিলো।এর মাঝে হঠাৎ করে তূর্যয় রাণীকে বলে উঠলো,
–“তোর নামের আগে পরে কিছু নেই কেনো?”
–“কারণ আমার নাম শুধু রাণী।”
রাণীর হাসিমুখের জবাব।
–“এমন কারো নাম হয়?এমন ভাবে বলছিস,তুই যেনো কোনো রাজ্যর রাণী?”
তূর্যয় ভ্রু কুঁচকে রাণীকে বললো।
–“ব্রো,আমার কল এসেছে আমার।আমি আসছি কথা বলে।”
হ্যারি কথাটা বললো,তার মোবাইলে ফোন এসেছে সেই নাম্বারের দিকে তাকিয়ে।

তূর্যয় কিছু বললো না হারিকে। সে এখনো রাণীর জবাবের অপেক্ষা করছে।

আর অন্যদিকে তূর্যয়ের কথার জবাব দেওয়ার জন্যে রাণীর মন আনচান করছে।কমবেশি সবাই রাণীকে এই প্রশ্ন করে। রাণীর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশ খুশি লাগে।এখনো রাণী অতি খুশি হয়ে চেয়ার ঠেলে নিলো।রাণীর হাত ছিল তার কামিজের নিচে। যেটা রাণী একেবারে খেয়াল করেনি।চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে রাণী তার দুই হাত উঠিয়ে বলতে লাগলো,
–“আমি আমার রাজ্যের রাণী!”
কিন্তু, ঘটনা হলো উল্টো। রাণীর হাত কামিজের নিচে থাকায়,হাত উঠিয়ে কথাটা বলার সময় রাণীর কামিজটা উল্টে গেলো আর রাণীর পেটের কিছু অংশ ভেসে উঠলো।

রাণীর এমন উন্মুক্ত পেটের অংশ দেখে তূর্যয় “পুত” করে তার মুখে থাকা কফি বের করে দিলো।আর রাণী! সে তো জলদি নিজের হাত জামা সব ঠিক করে নিতে ব্যস্ত।রাণী নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে বললো,
–“প্লিজ বলুন,আপনি কিছুই দেখেননি!”
তূর্যয়ের মুখ যেনো বন্ধ হয়ে গেলো।সে রাণীর চিকচিক চোখ দেখে কোনো মতে মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলো,
–“উঁহু।”
–“আল্লাহ্ গো, শোকর।আমি দারোয়ানকে বলছি কাজের লোকদের ডেকে সব পরিষ্কার করিয়ে দিতে।আমি এই মুহূর্তে আপনার সামনে থাকতে পারছি না, সরি।”
কথাগুলো বলে রাণী ভোঁ দৌড় দিলো।

তূর্যয় নিজের মাথা চেপে ধরলো।রাণীর পেটের কথা মনে আসতেই তূর্যয় নিজের মাথা চেপে ধরলো। তার ধুকধুক করা বুকে এক হাত দিয়ে অন্য হাতে মাথা চেপে তূর্যয় বলে উঠলো,
–“সরি রোদ্র কন্যা, যা দেখার সবটাই দেখেছি আমি। মিথ্যা বলার জন্যে সরি! হায়, আমার হৃদস্পন্দন!তুই কি এইবার সেই মেয়ের কথা ভেবে জোরে বিট করা বন্ধ করবি?”

হ্যারি এসে রাণীকে না দেখে তূর্যয়কে অনেক কিছু বলতে লাগলো।কিন্তু,তূর্যয়ের মন এইখানে নেই।রাণীর পেটের দৃশ্য যেনো তূর্যয়ের মনে নকশা এঁকেছে।চোখ বন্ধ করে তূর্যয় রাণীর সেই অদ্ভুত মুখ বানানো আর রাণীর লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটাকে স্মরণ করছে বারবার।সাথে রাণীর উন্মুক্ত পেটের কথাটা তূর্যয়ের মাথায় আসতেই তূর্যয়ের গালগুলোও যেনো জ্বলছে।তূর্যয় আপাতত মুখে হাত দিয়ে একটু আগের ঘটনা ভেবে চলছে।

চলবে…

#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা: সালসাবিল সারা

১৭.
রাণী নিজের মাথায় ওড়নার সাহায্যে ঘোমটা দিয়ে রেখেছে।লজ্জায় তার নাক কাটা যাচ্ছে।রাণী তার মাথায় দেওয়া ঘোমটার ভেতর নিজের ডান হাতের নখ কাটছে।কিভাবে কি হয়ে গেলো সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।জোরে দৌড়ে আসার কারণে রাণীর বুকটা এখনো ধুকধুক করছে।বাম হাত দিয়ে সে তার বুকের উপর হাত রেখে হালকা মালিশ করছে। লজ্জায় তার মুখের জ্বালা ভাব যেনো ক্রমশই বাড়ছে।রাণী দাঁড়িয়ে আছে তূর্যয়ের গাড়ির পাশে।রাণী এইখানে আসার সাথে সাথেই বাড়ির ওয়াচম্যানকে, কাজের লোকদের পুনরায় আসতে বলে দিয়েছিল।ওয়াচম্যান সাথে সাথেই ফোন দিলো তাদের আর কাজের লোকেরাও চলে এসেছে খুব কম সময়ে। তা দেখে রাণী স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো।রাণী তার ঠোঁট প্রশস্থ করে বললো,
–“যাক,এখন সেই নোংরা টেবিল উনারা পরিষ্কার করবেন।কি এক লজ্জাজনক কান্ড ঘটে গেলো!শেষে কিনা সেই দানব লোকটাকে আমি নিজের পেট…?নাহ নাহ,উনি তো বলেছিলেন আমার কিছুই উনি দেখেননি।যতটুক উনাকে চিনি, উনি মিথ্যা বলেন না।তাহলে ঠিকই দেখেননি।কিন্তু,তখনকার উনার নজরে আমি এক অজানা বিস্ময় দেখেছিলাম।তার মানে!”
রাণী আর কিছুই ভাবতে পারলো না। এর আগেই তূর্যয় আর হ্যারির কথার শব্দ শুনে রাণী একটু চোখ বাঁকা করে তাকালো সেইদিকে।তূর্যয়কে দেখে রাণীর গাল আবারও জ্বলতে শুরু করলো।লজ্জায় আজ রাণীর অস্থির লাগছে।তূর্যয়ের নজর রাণী দেখতে পাচ্ছে না,তূর্যয়ের চোখের কালো রঙের চশমা থাকার কারণে।তূর্যয়কে দেখে রাণীর মুখটা জ্বলার পাশাপাশি রাণীর মুখ অনায়াসে হাঁ হয়ে গেলো।তূর্যয়ের চুল,কাপড়,স্টাইল সবকিছুতে যেনো গুলিয়ে যাচ্ছে রাণী।তূর্যয় তার হাতের গুলি ঠিক করে নিতে নিতে রাণীর সামনের এসে দাঁড়ালো।

তূর্যয় অনেক আগে থেকেই রাণীকে খেয়াল করেছে।তবে রাণী যেনো কোনো অস্বস্তিতে না পড়ে তাই অযথায় নিজের পিস্তল নিয়ে সেটা ঠিক করার ভং করেছে সে।রাণীর এইভাবে ঘোমটা দেওয়ার কারণটা তূর্যয় বেশ ভালো বুঝতে পারছে।

রাণীকে এইভাবে ঘোমটা দিয়ে থাকতে দেখে হ্যারি রাণীকে বলে উঠলো,
–“সিস!তোমার মাথায় এমন ভেইল দিয়ে রেখেছো কেনো? হুয়াট হ্যাপেন্ড?”
তূর্যয় গাড়িতে উঠে গেলো হ্যারির কথা শুনে।জেনে শুনে তূর্যয় রাণীকে আর লজ্জায় ফেলতে চাইছে না।তূর্যয়কে গাড়িতে উঠতে দেখে রাণী নিজের মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে হ্যারিকে বললো,
–“ভিনদেশী ভাই!শুধু হুয়াট হ্যাপেন্ড না।অনেক কিছুই হয়ে গিয়েছে।নাউজুবিল্লাহ!”
হ্যারি কিছু বলার আগেই তূর্যয় রাগী গলায় বলে উঠলো,
–“দেরী হচ্ছে আমার কাজের।এইখানে কি আড্ডার আসরে বসার ইচ্ছা আছে এখন?”
তূর্যয়ের রাগী কণ্ঠ শুনে রাণী একটু চমকে গেলো।আর হ্যারি ফিসফিস করে রাণীকে বললো,
–“লেটস গো, সিস। নাহলে আজ আমাদের আর রক্ষে হবে না।এই অ্যাংরি ম্যান আমাদের পটেটো ভর্তা বানাবে।”
রাণীর মুখে হাসি না আসলেও হ্যারির কথায় সে অল্প হাসলো।রাণী এবং হ্যারি গাড়িতে উঠে পড়লো।রাণী ভুলেও তূর্যয়ের দিকে তাকাচ্ছে না।রাণীর মাথা থেকে সকালের কথাটা যেনো একেবারেই জেঁকে বসেছে।একটু পরপর রাণীর চোখে সকালের দৃশ্য ভেসে আসছে।রাণী নিজের মন অন্য দিকে ফেরানোর জন্যে হ্যারিকে বলে উঠলো
–“ভিনদেশী ভাই?আপনি কি সিমির সাথে কোনো সম্পর্কে গিয়েছেন?”
হ্যারির মুখটা লাল হয়ে গেলো রাণীর কথা শুনে।হ্যারি হাসিমুখ করে রাণীকে উত্তর দিলো,
–“নো।এখনো প্রপোজ করিনি।সামনে সুযোগ পেলে দেন করবো।সিমি ইজ রিয়েলি এ সুইটহার্ট।”
রাণী খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো হ্যারির কথায়।নিজের বান্ধবী হ্যারির মতো এমন একটা ছেলের সাথে সারাজীবন থাকবে,এটা ভাবতেই রাণীর বুকে শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।রাণী তার চিকচিক চোখজোড়া দিয়ে হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললো,
–“বাহ্!আমার ভিনদেশী ভাই তো বেশ রোমান্টিক দেখছি। ইস,সিমি কতো ভাগ্যবতী।”
হ্যারি রাণীর কথার প্রতুত্ত্যরে আবারও জবাব দিলো।

তূর্যয় চুপচাপ রাণী আর হ্যারির কথা শুনছে।হ্যারি শেষ পর্যন্ত প্রেমে জড়িয়ে যাবে এটা ভাবতেই তূর্যয়ের খুশি লাগছে।নিজের জীবনে এমন একটা সুখময় দিন কখনো আসবে কিনা তূর্যয়ের জানা নেই।অচিরেই তূর্যয়ের মন থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।

রাণী,তূর্যয়,হ্যারি তিনজন প্রথমে অফিসে গেলো।সেইখানে একটা মিটিং শেষ করে সেই তিনজন বেরিয়ে গেলো মিশনে।আজ অনেক গার্ড নিয়েছে তূর্যয় তাদের সাথে।রাণী চুপ করে গাড়িতে বসে আছে।সে বুঝছে না আজ তাকে মিশনে যাওয়ার অনুমতি দিবে কিনা তূর্যয়! তূর্যয়ের হাবভাব আজ পর্যন্ত রাণী বুঝে উঠতে পারেনি।মাঝে মাঝে মনে হয় তূর্যয় অনেক ভালো মনের মানুষ।কিন্তু,তার হিংস্রতা দেখে রাণীর এই ভাবনা নিমিষেই গায়েব হয়ে যায়।

অন্যদিকে হ্যারি আছে অন্য চিন্তায়।রাণী আর তূর্যয়ের মধ্যকার কোনো উন্নতি হ্যারি দেখতে পাচ্ছে না।তবে তূর্যয়ের রাণীর দিকে নেশাযুক্ত তাকানোর দৃষ্টি চোখ এড়ায়নি হ্যারির।কিন্তু,তূর্যয় নিজের ভালো লাগার কথা কখনোই রাণীকে বলবে না,এটা হ্যারি বেশ জানে। যার কারণে হ্যারি মনে মনে একটা পরিকল্পনা এঁটেছে।হ্যারি নিজের মুখে সিরিয়াস ভঙ্গি এনে রাণীকে বললো,
–“সিস,তুমি রেডি থাকো আজ।তুমি ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আজ আমাদের সাথে মিশনে যাবে।”

রাণী মাথা নেড়ে “ঠিক আছে” বললো।

কিন্তু হ্যারির কথায় অমত জানিয়ে তূর্যয় হ্যারির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–“আজকের ক্রিমিনাল দল কি পরিমান ভয়ঙ্কর এই ব্যাপারে কি তুমি অজানা,হ্যারি?সেখানে এই মেয়েকে কেনো নিবে?একে সামলাবে কে?ওর কিছু হলে আমি কিন্তু…”
তূর্যয় তার কথা শেষ করলো না।চুপ হয়ে গেলো সে।

তূর্যয়ের চুপ করে যাওয়া দেখে রাণী তূর্যয়কে বললো,
–“আপনি কিন্তু কি?আপনি আমাকে ঐ লোকগুলোর মতো হিংস্রভাবে মেরে ফেলবেন?”
রাণীর কথায় হ্যারি চুপ করতে বললো রাণীকে ইশারায়।

অন্যদিকে তূর্যয়ের বুকটা কেঁপে উঠলো রাণীর মুখে মৃত্যুর কথা শুনে।মুহূর্তেই তার চোখে ভেসে এলো তার মায়ের মৃত চেহারা।রাণীর কথার সাথে তার মায়ের মৃত চেহারা ভেসে উঠতেই তূর্যয় বুঝতে পারলো,রাণীর অস্তিত্ব তূর্যয়ের জীবনে এখন পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছে অনেক ‌বেশী।নাহয়,রাণীর মৃত্যুর কথা শুনে কখনোই তার মায়ের মৃত্যুর কথা মনে আসতো না তার।তূর্যয় নিজের হাত মুঠো করে নিলো। রাণীর মুখে বলা “আমাকে মেরে ফেলবেন” কথাটি তাকে যেনো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খাচ্ছে।ছোট্ট রাণীর প্রতি সেই অনেক বছর আগে থেকেই তার মনে মায়া কাজ করে।আর এই বড় রাণীর জন্যে তূর্যয়ের মনে এক অন্য অনুভূতি কাজ করে ইদানিং।সেই অনুভূতির সাথে রাণীর প্রতি তূর্যয়ের মায়াটা যে যেনো বেড়েছে হাজার গুণ।সেই মেয়েকে তূর্যয় খুন করবে?মাথা ফাঁকা লাগছে আজ তূর্যয়ের।তূর্যয় রাণীর কথার উত্তরে কিছু না বলে চুপ করে রইলো।মিশনের গন্তব্যে পৌঁছালে তূর্যয় হ্যারিকে বললো,
–“এই মেয়েটা যাবে না আমাদের সাথে।”

হ্যারি নিজের মনে তূর্যয় আর রাণীর জন্যে একটা জবরদস্ত পরিকল্পনা করে নিয়েছে।তাই হ্যারি তূর্যয়ের কথা অমান্য করে তাকে বলে উঠলো,
–“কুইনকে আমি রেখেছি জবে।তাই আমি যা বলবো সে তাই করবে।অ্যান্ড ডোন্ট বি এফরেইড ব্রো।আমি আমার সিসের বেশ ভালো টেক কেয়ার করব।”
তূর্যয়ের কপালের রগ ফুলে উঠলো হ্যারির কথায়।আজ পর্যন্ত হ্যারি কখনোই তূর্যয়ের কথা অমান্য করেনি।কিন্তু,
আজ হ্যারির কি হলো কিছুই বুঝতে পারছে না সে।তূর্যয় রাগী মাখা কন্ঠে হ্যারিকে বললো,
–“লাস্ট কবে কার জন্যে মায়া অনুভব করেছি আমি জানিনা। তবে এই মেয়ের কিছু হলে আমি কিন্তু কাউকে ছাড়বো না হ্যারি।”
কথাগুলো বলে রাণীর দিকে তাকালো তূর্যয়।রাণীর চোখ জোড়া যেনো এখনি চোখের কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে।তূর্যয়ের কথা রাণীর মাথায় যেনো গোলক ধাঁধার মতো ঘুরছে।রাণীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তূর্যয় ঝাঁঝালো গলায় রাণীকে বলে উঠলো,
–“আমার মাথা যেভাবে খাস, ঐ জায়গায় এমন কোনো কাজ করবি না।গার্ডদের আড়ালে থাকবি।তুই আর তোর ভাই তোদের নিজেদের সুরক্ষায় থাকবি।আমি এইসব ব্যাপারে কিছু জানিনা। ভাই বোনের অতিরিক্ত প্রেমের টানে উল্টো পাল্টা কিছু হলে বা কেউ ব্যাথা পেলে,
দুইজনকে সেখানেই আমি লটকিয়ে রাখবো গাছের সাথে।”
তূর্যয় ধুম ধুম পা ফেলে হাঁটতে লাগলো।
আজ রাণীর মুখ বন্ধ।তূর্যয় কথাগুলো বলার সময় তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল রাণী। আজ তূর্যয়ের চোখে নিজের জন্যে মায়া দেখতে পেলো সে।রাণীর চোখে খুশির পানি চলে এলো।এই প্রথম কোনো বাহিরের একজন রাণীর জন্যে চিন্তা করছে,এটা ভাবতেই রাণীর চোখ ছলছল করছে।রাণী নিজের চোখের পানি দুই তিন পলক ফেলে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো।হ্যারি তূর্যয়ের কথায় মন খারাপ না করে,উল্টো হাসছে মনে মনে।সে মনে মনে বলতে লাগলো,
–“আই নো ব্রো, ইউ হ্যাভ ফিলিংস ফর কুইন।জাস্ট,
তোমার চোখে আঙুল দিয়ে এটা তোমাকে দেখিয়ে দিতে হবে।নাহলে তোমার এই হিংস্রতার আড়ালে তোমার লাভ লাইফ ভ্যানিশ হয়ে যাবে।বাট,আম হ্যারি। আই উইল মেক শিউর, ইউ হ্যাভ এ ভেরি বিউটিফুল লাভ লাইফ উইথ মাই কুইন সিস।”
হ্যারিকে অন্যমনস্ক হতে দেখে রাণী হ্যারির হাতে হালকা চড় দিয়ে হ্যারিকে বলল,
–“ভিনদেশী ভাই!আপনার ব্রো কি আজ আমাদের জন্যে বেশি চিন্তা করছে?দেখুন না,যেখানে আমাকে উনি ঘৃণা করে সেখানে আজ উনি আমার জন্যে কতো চিন্তা করছে।কিন্তু শেষে উনি কি বললো?আমাদের নাকি গেছে ঝুলিয়ে রাখবে।আসলেই উনি একটা হিংস্র মানুষ।দানব সন্ত্রাসী একটা!ভালো করে অন্যর কেয়ারও করতে পারেন না উনি।”
হ্যারি রাণীর হাত ধরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো।আর রাণীকে হ্যারি বললো,
–“কেয়ার তো করেই। তোমার জন্যে আরো স্পেশাল কেয়ার করে আমার ব্রো।নাহলে ব্রো তার ত্রি সীমানায় কোনো মেয়েকেই ঘেঁষতে দেয়না।সেখানে তুমি ব্রোয়ের সাথে মিশনে যাচ্ছো,ব্রো এর বাসায় যাও।তুমি কি বুঝতে পারো না কিছু,সিস?আর হ্যাঁ,ব্রো এর কেয়ার একদম আলাদা।অ্যান্ড,তুমি আমার ব্রোকে এইসব সন্ত্রাসী ডাকবে না।আমার ব্রো একটা বড় মাপের মাফিয়া অ্যান্ড ব্ল্যাক বিজনেসম্যান।আমার ব্রো এর অনেক রেপুটেশন,
বুঝেছো?”

–“আহারে,কি সুন্দর করে ব্রো এর গুণগান গাচ্ছেন আপনি, ভিনদেশী ভাই।বাট উনি যেভাবে জীবনটা কাটাচ্ছেন, এতে উনারই ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা বেশি।উনার তো শত্রুর অভাব নেই।উনার যা টাকা আছে সেগুলো দিয়ে ভালো একটা কোম্পানি তো খুলতেই পারে উনি।এইসব গুন্ডাগীরি কি বাদ দেওয়া যায় না?”
রাণী বললো হ্যারিকে।

–“উমমম,ব্রোকে এইসব থেকে ছুটানোর ক্ষমতা আমার নেই।আমিও থিঙ্ক করি এইসব সাবজেক্টে।এইভাবে কিল করে,মারপিট করে,ব্ল্যাক কোম্পানি চালিয়ে লাইফটা একেবারে শেষ হয়ে যাবে।এইগুলোর চক্করে রিয়েল লাইফকে এনজয় করতেই পারি না।বাট,ব্রো যতদিন এইসবে থাকবে আমি ততদিন আমার ব্রো এর সাথে থাকবো। পাস্টে এইসব আমি না ভাবলেও,ইদানিং আমার মনে ভয়ংকর সব থটস আসে।তূর্যয় ব্রো এর জন্যে আমার অনেক চিন্তা হয়।ভয়ংকর চিন্তা। অনলি তুমি পারবে এইসব থেকে ব্রোকে বাঁচাতে।বাট,আমার মনে হয়,ব্রো কখনো এইসব ছাড়বে না।কারণ, ব্রো এর ব্লাডে এইসব মাফিয়াগীরি ফ্লো করে।এইসব না ছাড়ুক ব্রো। তারপরও আমার ব্রোকে কেউ খুব করে লাভ করুক তার জীবনে, আমি এটাই চাই।অ্যান্ড তুমি পারফেক্ট আমার ব্রো এর জন্যে।”
রাণীর মনে নানান প্রশ্ন ছেয়ে গেলো হ্যারির কথায়।তূর্যয়ের ভয়ংকর বিপদের কথা ভাবতে রাণীর কপালে হালকা ঘাম বেয়ে পড়লো অজানা কারণে। তূর্যয়ের বিপদটা মেনে নিতে পারছে না সে।তবে রাণী অবাক হলো হ্যারির কথায়। সে নিজের দিকে আঙুল দিয়ে বললো,
–“আমি?”
–“ইয়াহ,তুমি।সময় হলে দেখতে পাবে,সিস।”
রাণীর মাথায় কিছু ঢুকলো না।তবে সে আপাতত তূর্যয়কে নিয়ে চিন্তিত।একটা জায়গায় যেতেই রাণীকে দুইজন গার্ড তাদের আড়ালে নিয়ে নিলো।রাণী তাদের মাঝে একহাতে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে দেখতে লাগলো যুদ্ধ।যে যুদ্ধের ভয়ংকর এক অংশ হিসেবে দেখা যাচ্ছে তূর্যয়কে।দুইহাতে পিস্তল নিয়ে সে এলোপাথাড়ি সবাইকে শুট করছে।একটু পরেই তূর্যয় ঘাড় বাঁকিয়ে রাণীর দিকে ফিরলো।রাণী যেহুতু তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল তাই রাণীর সাথে তূর্যয়ের চোখাচোখি হয়ে গেলো।হঠাৎই তূর্যয়ের উপর আক্রমনের হার বাড়তে লাগলো। ভয়ে রাণীর জান বেরিয়ে যাচ্ছে।এতো লোককে কিভাবে তূর্যয় শায়েস্তা করছে এটাই তার মাথায় আসছে না।তূর্যয় নিজের কোট খুলে ফেলে দিয়েছে।শার্টের হাতা ফোল্ড করে নিজের পায়ের বুটে থাকা ছুরি বের করলো সে।পিস্তল দুইটি নিজের কোমরের গুঁজে নিয়ে এলোপাথাড়ি একে একে সবাইকে ছুরি দিয়ে গলা কাটছে তূর্যয়। একটু পর পর রাণীর দিকেও তাকাতে ভুল করছে না তূর্যয়।আর এই ব্যাপারটা রাণীকে মরিয়া করে তুলেছে।হ্যারি আর বাকিসব গার্ড দৌড় দিয়ে কই যেনো গেলো।রাণী,দুইজন গার্ড আর তূর্যয় আছে এইখানে।হঠাৎ করেই রাণী খেয়াল করলো তার দুই পাশের গার্ড তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সাথেই তারা আর্তনাদ দিলো তূর্যয়ের উদ্দেশ্যে “বস” বলে।

রাণী ভয় পেয়ে পেছনে ফিরলো।গার্ড দুইজন মাটিতে শুয়ে আছে নিথর হয়ে।একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে হাতে বড় একটা ছুরি নিয়ে।তূর্যয়ের দিকে আপাতত কোনো শত্রু পক্ষ নেই।কারণ সব কটার লাশ তূর্যয় মাটিতে শুয়ে রেখেছে।আর বাকি শত্রুদের পেছনে হ্যারি আর বাকি টিম রয়েছে।রাণী ভয়ে কাঁপছে।লোকটা এসে খপ করে রাণীর হাত ধরে তার গলায় ছুরি ধরলো।এই দৃশ্য দেখে তূর্যয়ের দুনিয়া থমকে গেল।তূর্যয়ের মনে হলো,রাণীর কিছু হলে সে কিছুতেই নিজেকে সামলে নিতে পারবে না।রাণী কবে তার জীবনে এতো কাছের হয়ে গেলো,এটাই তূর্যয় বুঝতে পারছে না।রাণীকে হারানোর ভয়ে তূর্যয়ের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।রাণীর প্রতি নিজের মনের অজানা অনুভূতির কোনো একটা নাম দিতে চলেছে আজ তূর্যয়।

অন্যদিকে রাণী এক পর্যায়ে ভয়ে কান্না করতে শুরু করলো। ঐ লোকটা রাণীর গলায় ছুরি ধরে বলতে লাগলো,
–“তূর্যয়ের সাথে কাজ করিস বুঝি?কতো দেয় একরাতে তোকে?এরচেয়ে বেশি টাকা দিবো আমি তোকে।ভেবেছিলাম তোকে মেরে দিবো।কিন্তু তোর গায়ের ঘ্রাণ আর রূপ আমাকে তো মরিয়া করে দিয়ে…”
লোকটা কথা শেষ করতে পারলো না।এর আগেই তূর্যয় কৌশলে লোকটার কপালে শুট করে দিলো।রাণীর কান যেনো ভন ভন করে উঠলো।এক মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না সে।কিন্তু, চোখ তুলে তূর্যয়ের দিকে তাকালেই সে দেখলো তূর্যয় এক দৌড়ে তার কাছে এসে তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে।রাণী যেনো মিশে যাচ্ছে তূর্যয়ের শক্ত হাতের ছোঁয়ার সাথে।তূর্যয় লোকটার দিকে গুলি তাক করে আরো কয়েকটা বুলেট লোকটার বুকে চালিয়ে দিলো সে।রাণীর কোমর আরো জোরে শক্ত করে চেপে ধরে তূর্যয় মাটিতে পড়ে থাকা লোককে বিশ্রী গালি দিয়ে বলতে লাগলো,
–“এই মেয়েটা শুধু আমার জিনিস।এই মেয়ের দিকে তাকানোর সাহস আমি কাউকে দিলাম না এই মুহূর্ত থেকে।এতদিন এর গুরুত্ব বুঝতে না পারলেও, আজ যখন তুই মেয়েটার গলায় ছুরি ধরেছিস আমি বুঝেছি মেয়েটা আমার কাছে অতি আপন।তোকে ধন্যবাদ দিচ্ছি তূর্যয়ের মনের কথা আর এই মেয়েটা তার জন্যে কতো জরুরী এই কথাটা আমাকে বুঝানোর জন্যে।এতো বছর পর আমার মনে হলো,আমার মনে এই মেয়েটার জন্যে মায়ার সীমানা নেই।অতীতের মায়াময়ী সে আমার।এতো বছর পর তাকে আমি পেয়েছি।তাকে আমি আর আমার থেকে দূরে যেতে দিবো না।সবার থেকে আগলে রাখবো আমি তাকে।তার দানব সন্ত্রাসীর রোদ্র কন্যা সে।আমার রোদ্র কন্যা।”
তূর্যয় স্বস্থীর নিঃশ্বাস ফেললো কথাগুলো বলে।নিজের মনে এতো কথা জমে ছিল এইসব ভেবে তূর্যয় নিজেই অবাক হচ্ছে বারবার।কিন্তু,সে আজ এটাই বুঝেছে রাণীর প্রতি তার ভালোলাগার অনুভূতিটা আজ ভালোবাসতে পরিণত হয়েছে।রাণীর দিকে তাকাতেই সে দেখলো রাণী চোখ বুজে আছে।রাণী যে নিজের হুঁশ হারিয়েছে এটা বুঝতে দেরি হলো না তূর্যয়ের।রাণী তূর্যয়ের কথাগুলো শুনেনি,এটা ভেবে তূর্যয় একটু নিশ্চিন্ত হলো।কারণ,এইসব তূর্যয় এখনই রাণীকে বলতে চায় না।আজ রাগের মাথায় তার মুখ দিয়ে সব বেরিয়ে গিয়েছিল।রাণীকে কোলে নিয়ে নিল তূর্যয় সাবধানে।এরপর সে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে রাণীর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
–“পিচ্চি মেয়েটা বড্ড বড় হয়েছে।এই যে মেয়ে,তূর্যয় নামক আঁধারকে শেষ পর্যন্ত নিজের জীবনের আলো দিয়েছিস তুই?ভাগ্যিস,আজকে হ্যারি তোকে এইখানে এনেছে।নাহলে, তোর এই দানব সন্ত্রাসী কখনোই তার মনের কথা বুঝতেই পারতো না।তোর গলায় ছুরি দেখে আমার মনে হলো,আমি আবারও তোকে হারিয়ে ফেলেছি।বিশ্বাস কর,তখন আমার নিজেকে একেবারে নিঃস্ব মনে হচ্ছিলো।কাউকে হারানোর ভয়ে নিজেকে নিঃস্ব মনে হওয়াটাই তো ভালোবাসা। তাই না?কিভাবে তুই এতো দ্রুত আমার জীবনে জায়গা করে নিয়েছিস? হু?উফ,চঞ্চল মেয়েটার মুখ আজ একেবারে বন্ধ।নাহলে আমার কান তো আস্ত থাকতো না।চঞ্চল মেয়ে একটা!উহু,তুই তোর দানব সন্ত্রাসীর একমাত্র রৌদ্র কন্যা।”
রাণীকে হালকা উচুঁ করে তার কপালে শব্দ করে চুমু খেলো তূর্যয়।সাথে সাথে তূর্যয়ের ঠোঁট জোড়া খুশিতে চওড়া হলো।আজ যেনো তূর্যয় তার অতীতে হারানো সব সুখ, পুনরায় খুঁজে পাচ্ছে রাণীর মধ্যেই।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে