#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা: সালসাবিল সারা
১২.
রাণী দৌড় দিয়ে তূর্যয়ের কেবিন থেকে বের হলো ঠিকই।কিন্তু সে অফিস থেকে বের হয়নি।তূর্যয়ের কেবিন থেকে কিছুটা দূরে এসে রাণী একটা সোফা দেখতে পেলো।রাণী তার ব্যাগ কোলে নিয়ে সেই সোফায় বসে পড়লো।রাণীর চোখে পানি টলমল করছে।তবে রাণী তার চোখ থেকে পানি বেরুতে দিচ্ছে না।মাথা উঁচু করে চার পাঁচ বার চোখের পলক ফেলে রাণী নিজের চোখের পানি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।হুটহাট কাজ করা রাণী মোটেও পছন্দ করে না।এইযে এখনো,রাণীর ইচ্ছা করছে তূর্যয়ের এই অফিস থেকে এক দৌড়ে বেরিয়ে যেতে।কিন্তু, এইভাবে হুটহাট কাজ করলে পরে রাণীর ক্ষতিই হবে বেশি।এইভাবে হুট করে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলে একে তো সে তূর্যয়ের কোনো সাহায্য পাবে না।তার উপর এইভাবে ধুম করে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলে রাণী তূর্যয়ের জীবনের রহস্য সম্পর্কেও জানতে পারবে না।অগত্য রাণী সোফায় বসে নিজের মাথা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করছে।রাণী তার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এক চুমুক পানি খেয়ে নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে নিচ্ছে। আশে পাশের কালো রঙের পোশাকের লোকগুলো হাঁটাচলা করছে সাথে রাণীর দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। তাদের এমন কাজে রাণী বেশ বিরক্ত হচ্ছে।রাণীর তার নিজের বিরক্ত ভাব কমিয়ে নিজের মাথায় অন্য একটা প্ল্যান করছে।রাণীর চোখ এখন হ্যারিকে খুঁজছে।রাণীর মতে, হ্যারিই একমাত্র মানুষ যে রাণীকে সাহায্য করতে পারবে।রাণী তার বয়সের একটা ছেলেকে দেখতে পেলো কালো রঙের কাপড় পড়ে বেশ ভাব নিয়ে হাঁটছে।রাণী ছেলেটিকে দেখে মনে মনে বলে উঠলো,”এই ছেলেকে একটু কম ভয়ংকর লাগছে।এর থেকে হেল্প নেওয়া যায়।” রাণী কথাটা ভাবতেই দাঁড়িয়ে পড়লো।ছেলেটা রাণীর সামনে আসতেই রাণী তাকে বলে উঠলো,”এই যে শুনুন?” ছেলেটা থেমে গেলো রাণীর ডাকে।ছেলেটা রাণীকে উত্তর দিলো,”হ্যাঁ,বলুন।” রাণী অসহায়ের সুর করে ছেলেটিকে বললো,”আপনি কি আমার সাথে হ্যারি স্যারের কথা বলিয়ে দিতে পারবেন?” ছেলেটি মাথা নাড়িয়ে তার মোবাইল বের করলো।মোবাইলে হ্যারির নাম্বারে কল দিয়ে ছেলেটি তার মোবাইল দিলো রাণীকে। অপর পাশ থেকে হ্যারি “হ্যালো” বললে রাণী তাকে বলে উঠলো,”ভিনদেশী ভাই!আমি রাণী।আপনি তূর্যয়ের কেবিন থেকে একটু দূরে যেখানে ওয়েটিং জোন আছে সেখানে আসুন,প্লিজ।” হ্যারি অবাক হলো রাণীর কথায়। সে রাণীকে অবাকের সুরে বললো,”হুয়াই?তুমি ঐখানে কেনো?তোমাকে তো ব্রোয়ের অফিসে ওয়েট করতে বলেছিলাম আমি! হুয়াট হ্যাপেন্ড, সিস?” রাণী হ্যারির চিন্তিত কণ্ঠ শুনে বলে উঠলো,”আপনি আসুন।এরপরই আমি বলবো।” হ্যারি “কামিং” বলেই মোবাইল রেখে দিল।হ্যারি কল কেটে দিলে রাণী সেই ছেলেটাকে মোবাইল দিয়ে দিলো। ছোট্ট করে একটা “ধন্যবাদ” দিলো রাণী ছেলেটাকে।ছেলেটা তার মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো অন্যদিকে।রাণী আবারও সোফায় বসলো।মনে তার নানা কথা ঘুরছে।সাথে সে তূর্যয়কে সমানতালে গালি দিয়ে যাচ্ছে,”শয়তান, সন্ত্রাসী।কিভাবে আমাকে অপমান করে বের করে দিয়েছে লোকটা।এতো খারাপ মানুষ আমার জীবনে আমি একটাও দেখিনি।উনার অন্তরে কি একটুও দয়া মায়া নেই?তার উপর সুন্দর এক মেয়ের ছবিও রেখেছেন তার টেবিলের উপর।নিশ্চয় উনার কাছের কেউ হবে ছবিতে থাকা মেয়েটি।সেই মেয়েটি কি পারে না তূর্যয়কে এই হিংস্রতা থেকে দূরে যেতে বলতে?” রাণীর মনের কথনের ধ্যান ভাঙলো হ্যারির কথায়।রাণী মাথা উচুঁ করে দেখলো হ্যারিকে।হ্যারির কথা বুঝতে না পেরে রাণী হ্যারিকে বলে উঠলো,”বুঝিনি।” হ্যারি রাণীর পাশে বসে পড়লো সোফায়।এরপর সে ধীরে ধীরে রাণীকে বলতে লাগলো,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড?এইখানে কেনো তুমি?ব্রো কিছু বলেছে তোমাকে?” রাণীর চোখ লাল হয়ে এলো।সে রেগে হ্যারিকে বলতে লাগলো,”আপনার ব্রো একটা শয়তান,
একটা পাথর।উনি আমাকে কেবিন থেকে বের করে দিয়েছেন। অথচ, এতে আমার কোনো দোষ ছিলো না।আপনার ভাই একটা শয়তান,সন্ত্রাসী।একটা ভিলেন আপনার ভাই।আমার যদি ক্ষমতা থাকতো আপনার ভাইকে আমি এক থাপ্পর দিয়ে ভালো মানুষে পরিণত করতাম।আর এইখানে চাকরি তো কখনোই করতাম না।কিন্তু, চাকরি না করলে আপনার ব্রো আমাকে সাহায্য করবে না। এতে আমার বদনাম বাড়বে আরো।তাই না পারতে সেই জলহস্তীর উপস, মানে আপনার ব্রো এর চাকরি করতে হবে আমার।” রাণী কথাগুলো বলে দম ফেললো। পরক্ষণে সে হ্যারির দিকে তাকালে,সে দেখলো হ্যারি তার দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে।রাণী নিজের মুখে হাত রাখলো।রাণী মনে মনে ভাবছে,”এক ভাইয়ের সামনে অন্য ভাইয়ের এতো ভালো দুর্নাম করেছিস তুই। যা এইবার তোর মরণ কাছে এসেছে, রাণী।”
রাণী হ্যারির দিকে তাকিয়ে বিভ্রান্তিমূলক হাসি দিয়ে বললো,”ইয়ে মানে,সরি।একটু বেশি বলে ফেলেছি কী?” হ্যারি নিশ্চুপ।রাণীর মনের ভয় বাড়তে লাগলো।রাণী ভয়ে নিজের কোলে থাকা ব্যাগকে চেপে ধরলো।রাণী মাথা নিচু করতেই হারির অট্টহাসি শুনতে পেলো রাণী। মাথা উঠাতেই রাণী দেখলো হ্যারি পেট চেপে হাসছে।রাণী অবাক হলো হ্যারির এমন কাহিনী দেখে।রাণী হাসার চেষ্টা করছে হ্যারির হাসি দেখে।হ্যারি নিজের পেট চেপে বললো,”ইউ নো?ব্রো এইসব শুনলে আমাদের দুইজনকে আস্তো রাখবে না।হাহাহা।ইউ আর সো ফানি অ্যান্ড ব্রেভ।ব্রো নিজেও তোমাকে কেনো জানি সহ্য করে নিচ্ছে।আদারওয়াইজ,ব্রো অন্যসব মেয়েদের যা কঠিন শাস্তি দেয়।হাহা।নাও, লেটস গো।ব্রো এর কাছে চলো।আমি সব ওকে করে দিচ্ছি।” রাণী নিজের মাথা নাড়লো হ্যারির কথায়। সে হ্যারিকে বললো,”নাহ,আর দরকার নেই সেখানে যাওয়ার।আমি আপনার সাথেই থাকবো,
ভিনদেশী ভাই।” হ্যারি রাণীর হাত ধরে তাকে আশ্বাস দিয়ে বললো,”আমি তোমার ভাই। সো,আমি থাকতে নো টেনশন। ওকে?” রাণী কিছু বললো না হ্যারির কথায়।সে হ্যারির হাত ধরেই হ্যারি যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই যাচ্ছে।কেনো যেনো রাণীর হ্যারিকে বড্ড বিশ্বস্ত মনে হয়।যদিও হ্যারির গতকালের চালাকির ব্যাপারটায়, রাণী তূর্যয়কেই দোষী হিসেবে জানে।কিন্তু রাণী এটা জানে না, হ্যারি নিজেই তূর্যয়ের অগোচরে অন্য প্ল্যান করেছে রাণী আর তূর্যয়ের ভালোর জন্যে।রাণী হ্যারির হাত শক্ত করে ধরে রইলো।
হ্যারি তূর্যয়ের কেবিনে এসে নক করলেই, তূর্যয় তাকে ভেতরে আসার অনুমতি দিলো।তূর্যয় ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে কিছু করছে।এর মধ্যেই হ্যারি তূর্যয়কে বললো, “তুমি আমাকে সিসকে কেবিন থেকে কেনো বাহির করে দিয়েছো?” তূর্যয় মাথা উঠালো হ্যারির কথায়।তূর্যয় ভ্রু কুঁচকে হ্যারিকে বললো,”এই মেয়ে এখনো যায়নি?কাজ না পারলে তাকে কাজে রেখে কি হবে?আমার সব ফাইলের অবস্থা বারোটা বাজিয়ে এখন তোমার পেছনে লুকিয়ে আছে মেয়েটি!” হ্যারি রাণীকে তার পাশে দাঁড় করালো।সে তূর্যয়কে বললো,”শুনো ব্রো,তুমি যেমন আমার ব্রাদার।তেমনি এই মেয়েটা আমার সিস। সো, আমাকে যেমন লাভ করো; তুমি তাকেও সেভাবে লাভ করবে।” হ্যারির কথায় কেশে উঠলো তূর্যয়।রাণী প্রথমে হ্যারির এমন বাংলা ইংরেজি কথা বুঝতে না পারলেও, একটু পরে হ্যারির কথার অর্থ তার মাথায় আসতেই রাণী চিল্লিয়ে উঠলো,”মরে যাবো আমি।তাও এই স্বার্থপর লোকের ভালোবাসা আমার লাগবে না।আরে এই লোকের কি হৃদয় আছে নাকি,যে উনি অন্যকে ভালোবাসবে?রাগ,হিংস্রতা আর খুন ছাড়া উনি জানে আর কিছু?” রাণী গড়গড় করে কথাগুলো বলে তাকালো তূর্যয়ের দিকে।তূর্যয়ের রাগী লাল চোখ দেখে রাণী নিজের মুখ চেপে ধরে আবারও হ্যারির পিছে গিয়ে দাঁড়ালো।রাণী জোরে চিল্লিয়ে তূর্যয়কে বললো,”সরি।” হ্যারি নিজেই তূর্যয়কে বলতে শুরু করলো,”আমার সিস এখনো বেবি।তাই একটু মুখটা বেশি স্লিপ করে।আমিও তার সাইড থেকে সরি বলছি।” তূর্যয় চেয়ারে হেলান দিলো।সে রাণী আর হ্যারির সব কান্ড ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে।তূর্যয় ভেবে পায় না,রাণীর সাথে হ্যারি এতো দ্রুত কিভাবে একটা সুন্দর বন্ডিং তৈরি করেছে!
তূর্যয় সেইসব মাথা থেকে ছেড়ে দিয়ে হ্যারিকে বললো,
“চুপ।দুইজনই একদম চুপ।মেয়েটাকে ঠিক কোন কাজের জন্যে রেখেছো, হ্যারি?চা, কফি বানানোর জন্যে?এই কাজের মানুষ তো আমাদের আছে।তাহলে?”
হ্যারি মিনমিন করে বলে উঠলো,”তোমার জীবনকে আলোকিত করানোর জন্যে।” হ্যারির মিনমিন কথায় রাণী আর তূর্যয় দুইজনই বলে উঠলো,”হ্যাঁ?” হ্যারি চুপ করে গেলো।পরক্ষণে হ্যারি বলে উঠলো,”আমাদের সাথে মিশনে যাবে রাণী।আগেও তো বলেছি তোমায়,ব্রো।আমাদের সাথে থাকবে সে।” তূর্যয় হ্যারির কথায় তাকে বললো,” এই মেয়ে যাবে মিশনে?এই মেয়েকে মিশনে নিয়ে গেলে তাকে সামলাবে কে?তুমি সামলাবে,হ্যারি?সেদিন তো দেখলে গুলির এক শব্দ শুনেই মেয়েটির অবস্থা কি হয়েছিল।” হ্যারি মাথা চুলকালো তূর্যয়ের কথায়।হ্যারি মাথা চুলকানো অবস্থায় তূর্যয়কে বললো,
“দেখা যাক,মিশনে গিয়ে কি হয়।ধরো অনেক সময় আমরা ইঞ্জুর্ড থাকি।তখন আমাদের দুইজনকে নিজেরা সামলানো একটু কষ্ট হয়।ফার্স্ট এইড নিতে অনেক দেরী হয়ে যায়।কিন্তু রাণী থাকলে সাথে সাথেই আমাদের ফার্স্ট এইড দিতে পারবে। সো,ঠিক এই কাজেই তাকে রাখলাম আমি। যদিও তুমি অনেক স্ট্রং।তোমার ফার্স্ট এইড না লাগলেও আমার লাগবে।আমার কথা শেষ।আর কোনো কিছু শুনতে চাই না আমি।গাড়ি রেডি করছি।আমরা এক্ষুনি মিশনে বের হবো।সো হারি আপ, ব্রো।” হ্যারি কথাটা বলে রাণীর হাত ধরে বেরিয়ে গেলো সেই কেবিন থেকে দ্রুত। হ্যারি নিজেও জানে, হ্যারি রাণীকে কাজে রাখে জন্যে যেই বর্ণনা দিয়েছে,সেটি একদম বাজে ছিল।হ্যারি মনে মনে বলতে লাগলো,”কি পরিমান লাইয়ার তুই!যত্তসব ননসেন্স যা আসলো মাথায় মুখে সব বলেছিস তুই তোর ব্রোকে।তূর্যয় ব্রো যথেষ্ট স্ট্রং।তার কখনোই ফার্স্ট এইড এর দরকার হয়না।হাতে গুলি লাগলেও তূর্যয় ব্রো ইজিলি হ্যান্ডেল করতে পারে।কিন্তু,ব্রো অলয়েজ বাইরে থাকে।রাণীকে ব্রোয়ের জীবনে আনতে হলে দুইজনকে কাছাকাছি রাখতে হবে।তাই, রাণীকে মিশনে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।আমার সিস্টাকে সেখানে দেখে রাখার রেসপনসিবিলিটিও আমি নিলাম। গড,হেল্প আস।” হ্যারি মনে মনে প্রার্থনা করলো।
তূর্যয় নিজের কোমরের পেছনে গুলি নিয়ে নিলো। একটু আগে হ্যারির দিয়ে যাওয়া যুক্তি কোনো মতেই তূর্যয়ের মাথায় ঢুকছে না।তারপরও তূর্যয় হ্যারির সব কাজ,যুক্তি সবটাই মেনে নিলো। তাছাড়া,তূর্যয় সব সময় নিজের স্বার্থ হাসিল করে অন্যকে সাহায্য করে।তাই হয়তো, হ্যারি এই ভেবে রাণীর জন্যেও একই কনট্র্যাক্ট রেডি করেছে;এমনটাই ভাবছে তূর্যয়।তাই তো রাণীকে কাজে রাখার ব্যাপারটাতে হ্যারিকে কিছু বললো না সে।তূর্যয় মনে মনে ভাবছে,”ঐ মেয়েটা কোনো একটা সাহায্য চেয়েছিল।কিছুদিন যাক,এরপর আমি নিজেই মেয়েটা থেকে সব পরিষ্কারভাবে জিজ্ঞেস করে নিবো।সাথে মেয়েটাকে কেনো চেনা মনে হয়,এই ব্যাপারটাও আমি উদঘাটন করতে পারবো এতদিনে।মেয়েটাকে হেল্প করা হয়ে গেলে, এই চাকরিটা তাকে ছেড়ে দিতে বলবো।বুদ্ধিহীন একটা মেয়ে,কখন কি দুর্ঘটনা ঘটে যায় আল্লাহ্ জানে।যাক,এইসব ভেবে লাভ নেই।মিশনে ফোকাস কর তূর্যয়।পঞ্চাশ লাখ টাকার মিশন এটা।খুব ভালোভাবে শেষ করতে হবে।”
তূর্যয় নিজের সবকিছু চেক করে নিলো।পায়ের বুটে রাখা ধারালো ছুরিটাও ঠিক ভাবে নিয়ে নিলো সে।এরপর তূর্যয় বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে।
হ্যারি আর রাণী গাড়িতে আগেই উঠে পড়লো।আজকের মিশনে শুধু যাবে রাণী,তূর্যয় আর হ্যারি।তূর্যয়ের ধারণা,
আজকের মিশন শেষ করতে হ্যারি আর তূর্যয় একাই শেষ করতে পারবে।তাই তারা আজ বাড়তি লোক নেয়নি।রাণী হ্যারির সাথে গাড়িতে বসে হেসে হেসে কথা বলছিল।তখনই তার চোখ আটকে গেলো তূর্যয়ের দিকে।রাণীর চোখ যেনো তার উপরই স্থির হয়ে গেলো।বাম সাইডের পকেটে হাত রেখে তূর্যয় অন্যদের সাথে কথা বলছে গাড়ির পাশে।অন্য হাতে তূর্যয় সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে।ভ্রু উঠিয়ে তার কথা বলার দিকেই রাণী অপলক তাকিয়ে আছে।রাণীর বুকটাও অল্প অল্প ধুকধুক করছে তূর্যয়কে দেখে।তূর্যয় গাড়ির দিকে উঠতে গেলেই,রাণী অন্য পাশের জানালার দিকে ফিরে গেলো।রাণী আর হ্যারির দিকে একটু তাকিয়ে তূর্যয় গাড়িতে উঠে গেলো। তূর্যয় সিগারেট হাত দিয়ে নিভিয়ে দিলো গাড়িতে উঠে।রাণী চুপ হয়ে আছে তূর্যয় গাড়িতে উঠার পর থেকেই।হঠাৎ সেই তূর্যয়ের টেবিলে রাখা সেই সুন্দর মেয়ের কথা তার মাথায় আসতেই রাণী হ্যারিকে ধীরে করে বললো,”এই জল্লাদ মানুষটার টেবিলের উপর একটা সুন্দর মেয়ের ছবি রাখা আছে।উনি কে?উনি কি পারেন না,আপনার হিংস্র ভাইয়ের বুকে একটু ভালোবাসার যোগান দিতে?” রাণীর এমন কথার উত্তর হ্যারি দেওয়ার আগেই তূর্যয় বলে উঠলো,”এই কথা বলার জন্যে, উনি এই দুনিয়ায় নেই।” রাণী অবাক হলো
তূর্যয়ের কথায়।রাণী মনে মনে ভাবলো,” অনেক ধীরে প্রশ্ন করেছিলাম, ভিনদেশী ভাইকে।তাও এই লোক সব শুনে গেলো?” পরক্ষণে হ্যারি রাণীকে বলে উঠলো,
“ছবির মহিলাটি তূর্যয় ব্রোয়ের মা।” কথাটা রাণীর কানে যেতেই রাণীর মন ধুক করে উঠলো।রাণীর চোখজোড়া বড় হয়ে গেলো হ্যারির কথায়।রাণী তার বুকে হাত রেখে ভাবছে,”তূর্যয়ের মা বেঁচে নেই?তাহলে সাবিনা উনার সৎ মা?আর আমি কিনা কতো কি বলেছি তূর্যয়কে!তূর্যয়ের মায়ের ছবি দেখে বোঝায় যাচ্ছিলো উনি তখন যুবতী ছিলেন।তাহলে কি তূর্যয় অনেক ছোট বয়সে নিজের মাকে হারিয়েছে?” রাণীর মনটা একদম নরম হয়ে এলো এই কথাগুলো ভাবতে গিয়ে।
চলবে….
#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা: সালসাবিল সারা
১৩.
রাণী ঘুমে কাবু হয়ে আছে গাড়ির ভেতর।অবশ্য গাড়িতে একা একা বসে রাণীর আর কি করারই বা ছিল!তূর্যয় আর হ্যারি মিশনে চলে গেলো অনেক আগেই।কিন্তু রাণীকে তূর্যয় নেয়নি সেই মিশনে। হ্যারিও তেমন জোর করলো না রাণীকে মিশনে যাওয়ার জন্যে।কারণ,আজ তারা শুধুই দুইজন এসেছে মিশনে।সেখানে তারা নিজেরা মিশন কমপ্লিট করবে! নাকি রাণীকে সামলাবে, এটা নিয়েই চিন্তায় ছিলো হ্যারি আর তূর্যয়ের ।আজকের সন্ত্রাসী পক্ষটাও বেশ পাকাপোক্ত ছিলো।কিন্তু তূর্যয়ের কাছে তাদেরও কম শক্তিশালী লাগলো,তাই তো সে শুধু হ্যারিকে এনেছে এই মিশনে। তবে,রাণীর মতো মেয়ের জন্যে এই সন্ত্রাসী দল অনেক বেশি ভয়ংকর হবে,
এমনটাই ধারণা করলো তূর্যয়।অগত্য,তূর্যয়ই হ্যারিকে জানিয়ে দিয়েছিল রাণী যেনো তাদের সাথে মিশনে না যায়। হ্যারি নিজেও ব্যাপারটা বুঝে তূর্যয়ের সাথে তাল মেলালো। ঐ দুইজন অনেক আগেই বেরিয়েছে মিশনে আর রাণী একাই থেকে গেলো গাড়িতে। গাড়ির ড্রাইভারকে তূর্যয় গাড়ি থেকে দূরে এক জায়গায় থাকতে বলেছে।গাড়ির চাবি তূর্যয় নিয়ে নিয়েছিল।কেনো যেনো,
রাণীর ব্যাপারটায় সবকিছুই অনেক সাবধানে করতে চায় তূর্যয়।যদিও কেনো সে এইসব চিন্তা করছে রাণীর জন্যে, এর উত্তর তূর্যয় নিজেও জানে না।গাড়ির একটা জানালা খোলা রেখে রাণীকে সবার শেষ সিটে বসতে বলে গাড়ি লক করে নিজেরা চলে গিয়েছিল মিশনে।রাণী বেচারা একা একা গাড়িতে বসে অনেক্ষণ কি করবে ভাবছিল।শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে করতেই রাণী ঘুমিয়ে গেলো।গুলির তীব্র শব্দে রাণীর ঘুম হালকা হয়ে এলো।সে ঐ হালকা ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,”কি এক চাকরি করছি,আমাকে কাজেই নেয়নি।এটা কোনো কথা? ঐ সন্ত্রাসী ভাইটাও আমাকে গাড়িতে আটকে রেখেছে। কোথায় ভেবেছিলাম দা গ্রেট সন্ত্রাসী তূর্যয়ের মারপিট দেখবো!কিন্তু এর কিছুই হলো না।শয়তানটা আমাকে গাড়িতে আটকে রেখেছে।তোর কখনোই ভা..ভালো হবে..” রাণী তার আবোল তাবোল কথা শেষ করতে পারলো না।এর আগেই সে আবারও ঘুমে তলিয়ে গেলো।রাণীর ঘুম এতটাই গভীর হয়ে গিয়েছে, সে বসা থেকে ধুপ করে গাড়ির সিটেই শুয়ে পড়লো।যার কারণে রাণীর ওড়না গায়ে থেকে ছুটে নিচে পড়ে গেলো।রাণীর সেদিকে কোনো হুঁশ নেই। সে ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের মধ্যেই, মাটির জিনিসপত্রের বড় একটা দোকানের মালিক হয়ে গেলো।এই স্বপ্ন দেখে মিটি মিটি হাসছে রাণী।
–
এই সন্ত্রাসী পক্ষ অনেক শক্তিশালী হলেও, তূর্যয়ের কাছে সেই সন্ত্রাসী দল যেনো কিছুই ছিল না। হ্যারি আর সে মিলে খুব সহজেই এই মিশনকে হাসিল করে নিয়েছে।হ্যারির মুখে হাসি থেমে নেই।প্রত্যেক মিশনে জয়লাভ করে হ্যারির এই হাসিটা দেখে যে কারোই মন গলে যেতে বাধ্য।তবে তূর্যয়ের মুখে হাসি নেই সব সময়ের মতো।তূর্যয় আর হ্যারি গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গলির ভেতর থেকে।এই সন্ত্রাসীদের আস্তানা ছিলো একটা বস্তি টাইপ গলির দিকে।তূর্যয় নিজের নাক চেপে ধরে হাঁটছে।ধুলাবালি আর ময়লার পঁচা গন্ধ তূর্যয়ের সহ্য হয় না।তূর্যয় চোখ মুখ কুঁচকে দ্রুত হাঁটছে।পেছন পেছনে হ্যারি নানা কথা বলে যাচ্ছে। তূর্যয় চুপ করে সব শুনে রয়েছে।মাঝে মাঝে মুখ চেপে হুঁ,হ্যাঁ করে যাচ্ছে তূর্যয়।গাড়ির কাছাকাছি আসতেই,হ্যারি “আমার সিসের কাছে যাচ্ছি আমি” কথাটা বলে দৌড় লাগালো।গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে হ্যারি দেখতে পেলো,রাণী সিটে হাত পা মেলে ঘুমিয়ে আছে।তার গায়ের ওড়নাটাও গায়ে নেই।সেদিক থেকে নজর সরিয়ে হ্যারি দ্রুত পেছনে ফিরে গেলো।তূর্যয়ের দিকে তাকালে হ্যারি দেখলো তূর্যয় ফোনে কথা বলছে দাঁড়িয়ে।হ্যারি তার দেশের আর বাংলাদেশের কম মেয়েকে অশালীন ড্রেস পড়া অবস্থায় দেখেনি।অনেক মেয়েকেই দেখেছে সে অশালীন কাপড়ে।কিন্তু রাণীর প্রতি এমন দৃষ্টি কোনোভাবেই যেনো হ্যারি দিতে পারছে না।হয়তো,রাণীকে নিজের বোনের মতোই জানে হ্যারি; সেই কারণে!হ্যারি কিছু একটা ভেবে তূর্যয়ের কাছে গিয়ে বলে উঠলো,”গাড়িতে বসো তুমি।আমি ড্রাইভারকে ডেকে আনছি।ড্রাইভার ফোন পিক করছে না।” হ্যারি আর থামলো না।দ্রুত পায়ে এগোতে লাগলো সামনের দিকে।তূর্যয় এইসব নিয়ে আর ভাবলো না কিছু।তূর্যয় জানে, হ্যারি বরাবরের মতোই বেশি চটপটে।তূর্যয় গাড়ির লক খুলে বসে পড়লো গাড়িতে।তার নজর আপাতত মোবাইলের দিকে।রাণী যে তাদের গাড়িতে আছে,এই কথাটি তূর্যয় ভুলেই গেলো।তূর্যয়ের সম্পূর্ণ মন এখন মোবাইলের ভেতরে।এর মধ্যেই রাণী ঘুমের ঘোরে বলতে লাগলো,”তুই একটা গুন্ডা।আর রাহেলা তুই একটা শয়তান কুটনি মহিলা।আল্লাহ্ তোদের দুইজনকে দেখিস কি করে। ঐ তূর্যয়কে তো আমি ভালো মানুষ বানাবই! উম, উম,রহস্য।সব রহস্য।” এমন আবোল তাবোল কথা শুনে তূর্যয় নিজের ভ্রু কুঁচকে নিলো।হঠাৎই তার মনে এলো এই গাড়িতে রাণী ছিল।তূর্যয় নিজের সিট থেকে হালকা উঠে পেছনের দিকে তাকালো।পেছনে তাকাতেই তূর্যয়ের মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হলো।রাণী তার হাত পা মেলে ঘুমিয়ে আছে।না আছে তার কোনো কাপড়ের ঠিক, না আছে গায়ে ওড়না!তূর্যয় বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,”ঐ মহৎ মানুষটা নিজের সিসের এই অবস্থা দেখে হয়তো পালিয়েছে! ভাবা যায় এইসব?অন্যর গাড়িতে এইভাবে হাত পা ছড়িয়ে কে ঘুমায়?মেয়েটার মনে কি ভয় নেই?আমরা অচেনা ছেলে!নাকি মেয়েটা আমাদের অনেক বেশিই বিশ্বাস করে!আমাকে বিশ্বাস না করলেও,মেয়েটা হ্যারিকে অনেক বিশ্বাস করে।তাই হয়তো এমন হাত পা ছড়িয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে।অদ্ভুত!” কথাগুলো ভাবতেই তূর্যয় রাণীর মুখের দিকে তাকালো।রাণীর ঘুমন্ত মুখটা একদম পবিত্র।তার উপর রাণীর ঠোঁটের পাশ দিয়ে অল্প ভিজে আছে।দ্রুত নিঃশ্বাস নেওয়ার কারণে রাণীর বুকটাও উঠা নামা করছে দ্রুত।তূর্যয়ের চোখজোড়া সেখানেই থেমে গেলো।অবাক হয়ে তূর্যয় একবার রাণীর শ্বাস উঠা নামা দেখছে, আরেকবার রাণীর ঘুমন্ত মুখ দেখছে।রাণীর এমন রূপের প্রতি তূর্যয় যেনো ডুবে গেলো।বুকটা কাঁপছে তূর্যয়ের।পূর্বে এমন কোনোদিন কোনো মেয়েকে দেখে তূর্যয়ের মনের অবস্থা এমন হয়েছে কিনা,মনে আসছে না তূর্যয়ের।হয়তো, হয়নি এমনটা তূর্যয়ের সাথে কখনোই।কারণ, এই অনুভূতি তূর্যয়ের কাছে একেবারেই নতুন লাগছে।তূর্যয়ের ঘোর যেনো কাটছেই না।তার মনে হচ্ছে,এই দুনিয়ায় শুধু সে আর ঘুমন্ত রাণী আছে।আর কেউ নেই।
অন্যদিকে, হ্যারি ড্রাইভারকে নিয়ে গাড়ির কাছে আসতেই গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে দেখলো; তূর্যয় রাণীর দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে।হ্যারির মনে আশার আলো জ্বলে উঠলো তূর্যয়ের অবস্থা দেখে। সে আবারও ড্রাইভারের হাত টেনে গাড়ির পিছে নিয়ে গেলো।ড্রাইভার অবাক হয়ে হ্যারিকে বললো,”আরে স্যার!আমরা গাড়িতে বসবো না?” ড্রাইভারের মুখ চেপে ধরে হ্যারি ধীর গলায় বললো,”ইয়াহ!আমরা তো গাড়িতেই বসবো।বাট,টেক সাম টাইম।লেট হিম ফল ফর হার।চুপ করে থাকো ড্রাইভার।” হ্যারি কথাগুলো বলে ড্রাইভারের মুখে হাত রেখেই গাড়ির ভেতরে উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু, গাড়ি পেছনের দিক থেকে সম্পূর্ণ কালো কাঁচে আবৃত থাকায় গাড়ির ভেতরে কি হচ্ছে সেটা আর দেখা হলো না হ্যারির। তবে, একটু আগের তূর্যয়ের অবস্থা দেখেই হ্যারি অনেক খুশি।হ্যারির মনে ধীরে ধীরে আশার আলো জ্বলতে লাগলো।
রাণীর দিক থেকে তূর্যয়ের ধ্যান ভাঙলো তার ফোনের ভাইব্রেশনে।তূর্যয়ের হাতে থাকা ফোনটা কাঁপছে।তূর্যয় ফোন কেটে দিয়ে দ্রুত রাণীর গায়ে ওড়না তুলে দিয়ে সোজা হয়ে বসে পড়লো।তূর্যয়ের মনে হলো, সে এক অন্যরকম সুন্দর দুনিয়া থেকে আবারও এক হিংস্রতম দুনিয়ায় চলে এলো।তূর্যয় নিজের হাত মুঠ করে নিয়েছে।হ্যারিকে ফোন দিলো সে সাথে সাথে। হ্যারি ফোন ধরতেই তূর্যয় চিল্লিয়ে উঠলো,”কই তুমি?ড্রাইভারকে ডাকতে এতক্ষণ লাগে?কি প্ল্যান করছো তুমি? তামাশা দেখতে ভালো লাগে তোমার?আসছো না কেনো এখনো?” হ্যারির কোনো শব্দ নেই।তূর্যয়ের চিল্লানো শুনলে হ্যারি নিজের মুখ ফুলিয়ে নেয়।এইযে এখনো তূর্যয়ের ফোন না কেটে হ্যারি নিজের মোবাইল কানে লাগিয়ে দ্রুত হেঁটে গাড়ির পাশে চলে এসেছে।সাথে ড্রাইভার এসেও নিজের সিটে বসে পড়লো।হ্যারি গাড়িতে উঠে বসলো তূর্যয়ের পাশে।হ্যারি নিজের মোবাইল পকেটে রেখে দিল।হ্যারিকে কথা বলতে না দেখে তূর্যয় আবারও ভারী গলায় তাকে বললো,”বাহ্!চুপ হয়ে গেলে কেনো এখন?বলো? কোথায় ছিলে এতক্ষণ?কাজের কি অভাব আছে আমাদের?এখন আবার মিটিং এটেন্ড করতে হবে না?সমস্যা কি?মুখ বন্ধ কেনো?” হ্যারিকে কিছু বলতে না দিয়ে ড্রাইভার গাড়ি চালানো অবস্থায় বলে উঠলো,
“আমিও উনাকে বলছিলাম,গাড়ির পিছে কেনো দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ।অথচ উনি আমার মুখটাই চেপে ধরে রেখেছিলেন।” ড্রাইভারের কথায় তূর্যয় চোখ ছোট করে তাকালো হ্যারির দিকে।আর হ্যারি আর ড্রাইভারকে বলে উঠলো,”শাট আপ!” তূর্যয় বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে হ্যারির দিকে।হ্যারি তার দিকে তাকাচ্ছে না দেখে তূর্যয় হ্যারির মাথায় হালকা চড় দিয়ে বললো,”মাইর দিয়ে একেবারে সোজা করে দিবো।কাজের প্রতি সিরিয়াসনেস নিয়ে আসো।এই মেয়েটা যেদিন থেকে এসেছে সেদিন থেকেই কাজের অবস্থা মাটি করছো তুমি।কি বুঝেছো?”হ্যারি নিজের মাথা ঝেড়ে তূর্যয়কে বললো,”আই অ্যাম অ্যাংরি উইথ ইউ।সো,আমি কথা বলবো না তোমার সাথে।তুমি আমাকে বকা দিলে আমার খুব কান্না আসে।” হ্যারির তীক্ষ্ণ কণ্ঠ শুনে
তূর্যয়ের একটু খারাপ লাগলো।কিন্তু,তূর্যয় বুঝতে পারছে রাণীর সেই অবস্থা দেখে হ্যারি তূর্যয়কে ইচ্ছে করেই রাণীর কাছে রেখে গিয়েছিল।তবে এইসব কিছুই তূর্যয় হ্যারিকে না বলে,তূর্যয় হ্যারিকে বললো,”যাও,তোমার সিস্টাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করো।কিন্তু তোমার সিস্টার তো বেহুঁশের মতো ঘুমাচ্ছে! হুহ,বকা শুনলে নাকি তার কান্না আসে!বাচ্চা ছেলে একটা।”তূর্যয় কথাগুলো বলে এইবার একটু স্বাভাবিক হলো।হ্যারি নিজের মুখ খোলার পূর্বেই পেছন থেকে রাণী বলে উঠলো,”আপনাদের মিশন শেষ?কে জিতলো মিশনে?” রাণী কথায় তূর্যয় আর হ্যারি দুইজনই পেছনে ফিরলো।রাণী নিজের ওড়না দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ জড়িয়ে রেখেছে।রাণী তার চোখ কঁচলে আবারও তাদেরকে বললো,”মুখ বন্ধ কেনো আপনাদের?ওহহ,হেরে গিয়েছেন বুঝি?সমস্যা নেই,
পরবর্তীতে জিতবেন ইন শাহ্ আল্লাহ্।” রাণীর কথায় তূর্যয়ের মেজাজ আরো বেশি খারাপ হলো।উল্টো পাল্টা কথা যেনো তূর্যয়ের জন্যে বিষ!আর এইখানে রাণী একের পর এক উল্টো কথা বলতেই আছে।রাণী আবারও কিছু বলার আগে তূর্যয় তাকে চিল্লিয়ে বললো,
“আরেকটা কথা বলবি তো,গাড়ি থেকে ফেলে দিবো।হ্যারি, কোথা থেকে এনেছো তুমি এই মেয়েকে?” তূর্যয়ের চিল্লানো শুনে হ্যারি আর রাণী দুইজনই চুপ হয়ে গেলো।তূর্যয় রেগে তার গাড়িতে রাখা সিগারেটের বক্স থেকে সিগারেট বের করে সেটি ফুঁকতে লাগলো।রাণী হ্যারির দিকে এগিয়ে হ্যারির কানে কানে বলতে লাগলো,”সত্যি কি এই সন্ত্রাসী আজ হেরে গিয়েছে?” হ্যারি মাথা নাড়িয়ে “না” দেখালো।হ্যারির উত্তর পেয়ে রাণী আবারও হ্যারিকে বললো,”তাহলে এই গুন্ডার মেজাজ খারাপ কেনো?কিছু কি হয়েছে?” রাণী কথাগুলো অনেক আস্তে বললেও তূর্যয়ের কানে সেগুলো ঠিকই গেলো।সে রাণীকে ধমকে বললো,”সাহস থাকলে আমার সাথে কথা বল!আর কি হয়েছে সেটি জানতে চাচ্ছিস?তো শুন।আমি তাশরীফ
তূর্যয়।আমি কখনো হারতে শিখিনি।আমি শুধু মারতে আর জিততে শিখেছি।” রাণী দমে গেলো তূর্যয়ের কথায়।তাও রাণীর মুখে থেমে নেই।সে তূর্যয়ের কথায় বলে উঠলো,”বেশি মারপিট শিখেছেন তাই তো এই অবস্থা।জল্লাদ একটা।” তূর্যয়ের মেজাজ প্রচন্ড বিগড়ে গেলো রাণীর কথায়।রাণী আর তূর্যয়, এই দুইজনের কান্ড দেখে হ্যারি নিজের কান চেপে ধরে বললো,”স্টপ!আমার কান ব্লাস্ট হয়ে যাচ্ছে।একটু পরেই আমার কান থেকে ব্লাড বের হবে।কিভাবে পারো তোমরা এতো ঝগড়া করতে! আই মিন হাউ?” রাণী আর তূর্যয় দুইজন চুপ করে গেলো।রাণী হ্যারির কাঁধে হাত রাখতেই হারি তাকালো রাণীর দিকে।রাণী এক কান ধরে ইশারায় “সরি” বললো হ্যারিকে।হ্যারি চোখ বুজে হাসলো রাণীর কথায়।যার অর্থ হ্যারি রাণীর সরি কবুল করেছে।এইদিকে তূর্যয় বাঁকা চোখে তাকিয়ে দেখছে ঐ দুজন পাতানো ভাইবোনের কান্ড।তূর্যয় মনে মনে ভাবছে,”কোথা থেকে কি হয়ে গেলো!এই মেয়ে আসলেই একটা উটকো ঝামেলা।মুখে তো তার লাগাম নেই বললেই চলে।আমার সামনেই যা তা বলতে তার একটুও ভয় লাগে না।যেখানে আমার সামনে বড় বড় মানুষ দাঁড়াতে ভয়ে কাঁপে।আর এই মেয়ে আমার সামনে বসে আমাকেই বাজে বকে যায়।কোনদিন রাগের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কি করে ফেলি আল্লাহ্ ভালো জানেন।চঞ্চল মেয়ে কোথাকার!” তূর্যয় কথাগুলো ভাবছে আর তার মোবাইলে কিসব করছে।এরমধ্যেই হ্যারি তূর্যয়কে বললো,”কুইন তো আমাদের সাথে আর যাবে না। ইটজ অলমোস্ট সন্ধ্যা সাতটা।মিটিং এ রাণীর কোনো কাজ নেই আশা করি।” তূর্যয় তার নজর মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে হ্যারির দিকে তাকালো।হ্যারির মাথার পেছনে সিটের উচু অংশে মাথা রেখে রাণীও তাকিয়ে আসছে তূর্যয়ের দিকে।মনে হচ্ছে দুইজনই খুব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে তূর্যয়ের উত্তরের।রাণীর চোখজোড়া কেমন যেনো নেশা লাগিয়ে দেয় তূর্যয়কে।রাণীর চেহারার দিকে আবারও বিলীন হয়ে যাওয়ার আগে তূর্যয় হ্যারিকে বললো,”তোমার সিস্টার তুমি জানো।একে কোথায় নিবে নাকি গলায় ঝুলিয়ে রাখবে।” হ্যারি হাসলো তূর্যয়ের কথায়। সে হেসে তূর্যয়কে বললো,”আমার সিস্টার একদিন তোমার অনেক কাছের মানুষ হয়ে যাবে।এটাই আমি বিলিভ করি।তখন তো আমার চেয়েও আমার সিস্টারকে তুমি বেশি লাভ করবে।” রাণী মুখ চেপে ধরলো হ্যারির,
“আস্তাগফিরুল্লাহ মিন জলেক! এইসব ভয়ংকর কথা বলবেন না, ভিনদেশী ভাই।আমার হার্ট দুর্বল। ঠুস করে কোনদিন মরে যায় আপনার এইসব কথা শুনে।এইসব কথা বলতে নেই।আল্লাহ্ কার কথা কখন কবুল করে নেন,এটা আল্লাহ্ ভালো জানেন।তবে আপনার এইসব কথা আর বলবেন না।আপনার ব্রো যেই মানুষ!অমানুষ একটা।উনার ভালোবাসা আমার লাগবে না।আর উনার কাছে মনই নেই,ভালোবাসবে কি মাথা দিয়ে?” হ্যারি অবাক হলো রাণীর কথায়। তূর্যয়ও হ্যারিকে বললো,”চড় খেয়েছো অনেক দিন হলো হ্যারি।বাজে কথা আরেকবার বলবে তো,উল্টো লটকিয়ে মাইর দিবো।শাট আপ বোথ অফ ইউ।কান নিয়ে যাচ্ছে আমার!” হ্যারি ভ্রু নাচালো তূর্যয়ের কথায়।অবশেষে তূর্যয়ের বকুনি খেয়ে দুইজনই চুপ হয়ে গেলো।রাণীর এতিম খানার সামনেই গাড়ি থামতে রাণী হ্যারিকে বিদায় জানিয়ে চলে এলো।
‘
এইভাবে তূর্যয়ের অফিসে রাণীর চারদিন কেটে গেলো।তবে এখনো রাণী তূর্যয়ের অতীত সম্পর্কে কিছুই জানতে পারলো না।তূর্যয়ের প্রতি রাণীর ঘৃণার পাশাপাশি,এক প্রকার আগ্রহ কাজ করে তার অতীত সম্পর্কে জানার।রাণী শুধু এতটুকুই জেনেছে তূর্যয়ের মা মৃত।এর পেছনের কারণটা জানতে রাণীর আরো গভীরে যেতে হবে তূর্যয়ের জীবনে।রাণী মনে মনে তূর্যয়কে ভালো মানুষ পরিণত করার পণ করেছে।যদিও রাণী জানেনা,এটা কখনো সম্ভব কিনা!কারণ তূর্যয়ের মতো হিংস্র মানুষকে ভালো মানুষে পরিণত করা,আর সমুদ্র থেকে পানির পরিমাণকে কম করার উদ্যোগ নেওয়াকে একই বলে মনে করে রাণী।
অন্যদিকে তূর্যয়! সে তো এখনো রাণীর সেই ঘুমন্ত মুখটার কথা ভুলতেই পারেনি।সারাদিনের হিংস্রতা,খুন,
মারামারি,মিটিং সব কিছুর পরে রাতে ঘুমোতে গেলে তূর্যয়ের চোখে বারবার ভেসে আসে রাণীর চেহারা।সেই চেহারায় যেনো লুকিয়ে থাকে রাজ্যের সুখ!তবে সকাল হতে হতে তূর্যয়ের মনের হিংস্রতা,তাকে রাণীর সেই ঘুমন্ত পবিত্র মুখটাও ভুলিয়ে দেয়।দিনদিন যেনো তূর্যয় আরো কঠোর থেকে কঠোর হচ্ছে রাণীর উপর।তবে হ্যারি প্রতিনিয়ত এই দুই জনের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক করে দেওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে।আজ তারা কোনো মিশনে যায়নি।বরং অফিসের টুকটাক কাজ শেষ করেই বাড়ি ফিরছে।প্রত্যেকদিন রাণীকে তারা গাড়ি করে নামিয়ে দেয় মমতা এতিম খানার সামনে।তারা কোনো মিশনে গেলে,মিশন থেকে ফেরার সময় সরাসরি সেইখান থেকেই রাণীকে এইখানে নামিয়ে দেয় তারা।আর তূর্যয়ের অফিসে কাজ থাকলে রাণী সন্ধ্যা সাতটার পরপরই অফিসের গাড়ি করে চলে যায় এতিম খানায়।অবশ্য এর কারণ একমাত্র হ্যারি। হ্যারি যখন রাণীর দায়িত্ব নিয়েছে তাই হ্যারি যেখানে যায় রাণীও সেখানে যায়।তাই তূর্যয়ের গাড়িতেও রাণীর চড়ার সৌভাগ্য হয়।নাহলে তূর্যয় ভেবে পায় না,যেখানে তার গাড়িতে সে কোনো মানুষকে উঠতে দেয় না। সেখানে রাণী দিব্যি ঘুরে বেড়ায় তাদের সাথে। মাঝে মাঝে এই জিনিসের প্রতি তূর্যয় বিরক্ত দেখাতে গিয়েও রাণীর মুখের হাসি দেখলে সে রাণী বা হ্যারিকে কিছুই বলতে পারে না।আজও অফিস থেকে হ্যারি আর তূর্যয় নামিয়ে দিলো রাণীকে।রাণী গাড়ি থেকে নেমে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হ্যারিকে বলে উঠলো,”ভিনদেশী ভাই!আপনি আমার ম্যাডামকে দেখতে চেয়েছিলেন না! ঐ যে দেখুন,আমার প্রিয় সালেহা ম্যাডাম।” রাণী সালেহার দিকে ইশারা করলো আঙ্গুল দিয়ে।সালেহা তখন এক লোকের সাথে কথা বলছিল এতিম খানার গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে।সালেহার নাম শুনে তূর্যয়ের বুক কেঁপে উঠলো।রাণীর আঙ্গুলের ইশারায় তাকাতেই তূর্যয়ের প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।কারণ,সে যেই সালেহাকে আশা করেছিল;সামনের মহিলাটি ঠিক সেই সালেহা।এতো বছর পর সালেহাকে দেখে তূর্যয়ের অস্থির লাগতে শুরু করলো।তূর্যয় ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো,”সালেহা মা!”
ছোট কাল থেকে, নাহ!শুধু ছোটকাল থেকে না তূর্যয়ের মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকেই সে তার সালেহা মাকে আর দেখতে পায়নি।শুধু তাই নয়,তার মায়ের মৃত্যুর দিনও তার প্রিয় সালেহা মাকে দেখেনি সে।তূর্যয়ের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মহিলা হলো এই সালেহা। সালেহার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ তার।সালেহাকে দেখেই অস্থির লাগতে শুরু করলো তূর্যয়ের।শুধু তাই নয়,একে একে তূর্যয়ের মনে আসতে লাগলো তার অতীতের কথা।তূর্যয় নিজের মাথা চেপে ধরে বলে উঠলো,”গাড়ি চালা।নাহলে আমি সবাইকে খুন করবো!নিয়ে যা আমাকে এইখান থেকে।খারাপ মানুষ এরা সবাই।আমাকে নিয়ে যা এইখান থেকে।” রাণী আর হ্যারি কথা বলা বন্ধ করে দিলো তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে। হ্যারি তূর্যয়কে জড়িয়ে ধরে ড্রাইভারকে বলে উঠলো,
“হাসপাতালের দিকে ড্রাইভ করো গাড়ি।ব্রো!ঠিক আছো? হঠাৎ অ্যাটাক উঠেছে কেনো তোমার?” রাণী আর বেশি কিছু শুনতে পেলো না।এর আগেই গাড়ি তার চোখের সামনে থেকে উদাও হয়ে গেলো।রাণী ভেবে উঠতে পারছে না,”হঠাৎ তূর্যয়ের কী হলো?উনি কাকে খুন করার কথা বলছিলেন?”
চলবে….