#আলো_আঁধার
~আঁখি দেব তৃপ্তি
জন্মের পূর্বেই বাবা মা মেয়ের নাম ঠিক করে ফেলেছিলেন আলো। ঘর আলো করে রাখবে সে। কিন্তু সেই কন্যাই তাদের জীবনে আঁধার হয়ে আসবে তা তারা ভাবেন নি কল্পনায়ও!
এক ভরা অমাবস্যার রাতে জন্ম হলো মেয়েটির। গায়ের রং অমাবস্যার আঁধারের মতোই কুচকুচে কালো। মেয়ের বাবা মেয়ের মুখ দেখে শিউরে উঠলেন। এটা তার মেয়ে? না এ হতে পারে না। মেয়েকে কোলে না নিয়েই মুখ ফিরিয়ে হাসপাতালের বাইরে চলে গেলেন তিনি।
বিজয় মজুমদার পেশায় একজন আইনজীবী আর উনার স্ত্রী তনিমা মজুমদার একজন গৃহিণী। ২ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছিল। তারপর থেকেই সুখের দাম্পত্য। প্রথম সন্তান মেয়ে হবে জেনে জন্মের আগেই তাকে নিয়ে তৈরি করে ফেলেছিলেন অনেকগুলো স্বপ্ন। মেয়ের নাম ঠিক করে সেই নাম খোদাই করে বিভিন্ন শখের জিনিস পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছিলেন তারা। কিন্তু এ কী হয়ে গেল তাদের সাথে? এটা তো হওয়ার ছিল না!
তনিমার গায়ের রং দুধে-আলতা আর বিজয়ও মোটামোটি ফর্সা। তাহলে তাদের মেয়ে কী করে এতো কালো হতে পারে। এ নিয়ে অনেকক্ষণ ধরেই কথা বার্তা
বলে যাচ্ছেন তনিমার শাশুড়ী। যে তনিমাকে উনি গতকাল পর্যন্তও অনেক যত্ন করেছেন আজ তার দিকেই চাইছেন তীক্ষ্ণ চোখে। উনার মনে সন্দেহের বীজ বুনতে শুরু হয়েছে। এ বাচ্ছা আসলেই কী বিজয়ের নাকি…
শাশুড়ীর কথা শুনে তনিমা ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে। মেয়ের মুখ এখনো দেখেনি সে। দেখার সাহসও করতে পারছে না। কিন্তু মায়ের মন সন্তানকে কাছে না টেনে কতোক্ষণ থাকবে? অবশেষে কাঁদো কাঁদো গলায় শাশুড়ীকে বললো-
” ওকে আমার কাছে একটু দিন মা।”
শাশুড়ী বিদ্রুপের ভংগিমায় বাচ্চা এনে তনিমার কাছে দিতে দিতে বললেন –
“দেখো কেমন মেয়ের জন্ম দিয়েছো।”
মেয়ের দিকে তাকিয়ে জোরে কেঁদে উঠলো তনিমা। এ কী দেখছে সে? এতো কালো কীভাবে হলো তার মেয়ে। এরকম কালো বাচ্চা কখনো দেখেনি সে। বাচ্চাটিও মায়ের সাথে সাথে জোরে কাঁদতে শুরু করলো।
৪ দিন পর মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরলো তনিমা। বাচ্চাকে দেখার জন্য প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনরা আসতে চাইলে তনিমার শাশুড়ী কাউকেই বাচ্চা দেখতে দিলেন না। বলে দিলেন বাচ্চা অসুস্থ। ডাক্তার বলেছে ১ মাস যাতে বাচ্চাকে বাইরের ধুলা- ময়লা, রোগ জীবানু সবকিছু থেকে দূরে রাখা হয়। আর বাচ্চার আশেপাশে বেশি লোক সমাবেশ না করা হয়। তারপর বাচ্চা সুস্থ হয়ে গেলে না হয় দেখতে আসবেন সবাই।
তনিমার শাশুড়ীর কথায় বাচ্চা দেখতে চাওয়া বাদ দিলেও অন্যান্যদের মধ্যে কৌতুহল বেড়ে গেল। কী এমন রোগ হলো যে বাচ্চাকে দেখাও যাবে না! বাঙালী মাত্রই সমালোচনা প্রেমী। যেকোনো বিষয়ে প্রয়োজনের অধিক কৌতুহল ও সমালোচনা তাদের বৈশিষ্ট্যে মিশে গেছে। তাই এ বাচ্চা নিয়েও ক্রমশ কৌতুহল ও সমালোচনা বাড়তে শুরু হলো।
তনিমার শাশুড়ী তনিমা ও বাচ্চাটিকে বাসার বাইরে তো দূরের কথা বারান্দায়ও বের হতে দিতেন না। বাচ্চাটিকে নিয়ে বন্ধী জীবন কাটানো শুরু হলো। তনিমার স্বামীও কেমন গা ছাড়া ভাব নিয়ে চলাচল করে। তনিমার সাথে তেমন কথা বলে না। নিজের মেয়েকেও কোলে নেয় না। তাহলে কী সেও তার মায়ের মতো সন্দেহ করতে শুরু করেছে যে বাচ্চাটির জন্মের মধ্যে কোনো রহস্য রয়েছে। এ তার নিজের মেয়ে না!
মেয়েটির নামকরণের দিন তনিমা তাদের আগের ভাবা নামটিই রাখতে চাইলে বাধা দিলেন শাশুড়ী। তিনি বললেন-
“কুচকুচে কালো মেয়ের নাম নাকি হবে আলো! আরও মানুষ হাসাতে চাও নাকি? এর নাম তো অন্ধকার হওয়া উচিত। ”
“এমন করে কেন বলছেন মা। ও তো আপনারই নাতনি। গায়ের রং কালো হয়েছে এখানে আমার কী দোষ বলুন তো। শুধু সুন্দর হলেই নাম আলো রাখা যাবে নয়তো না এমন কোনো কথা আছে কী?”
“আমার নাতনি নাকি অন্য কিছু কে জানে। বলি কালোর ও তো একটা ধরণ থাকে। এমন কুচকুচে কালো বাচ্চা আর কারো হতে দেখেছো?”
তনিমা আর কিছু বললো না।নিরবে চোখের জল ফেললো। কিন্তু মেয়ের নাম আলোই রাখলো সে। এতে লোকে যা বলার বলবে তাতে কিছু যায় আসে না তার।
কথায় আছে ফুল ফুটলে তার সুভাস লুকিয়ে রাখা যায় না। তেমনি মেয়েটিকেও বেশিদিন ওরা সবার থেকে আড়াল করে রাখতে পারলো না। একদিন পাশের বাসার একজন মহিলা কিছু একটা জিনিস নেবার জন্য তনিমার কাছে আসলো। তনিমা তখন ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল আর বাচ্চাটিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল তার রুমে। সবগুলো দরজা খোলা ছিল। শাশুড়ী ভিজা কাপড় রোদে দিতে ছাদে গিয়েছিলেন। তাই পাশের বাসার মহিলা কাউকে ডাকা ছাড়াই ঘরের ভিতর ঢুকে এলেন তারপর সোজা চলে গেলেন তনিমার রুমে। তারপর যা ঘটলো তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না তনিমা।
বাচ্চাটিকে দেখে ওই মহিলা এমনভাবে চিৎকার দিয়ে উঠলেন যে আশেপাশের সকল লোকজন দৌড়ে তনিমাদের বাসায় চলে এলো আর বাচ্চাটিকেও দেখে ফেললো। হঠাৎ এমন চিৎকারে কেঁদে ঘুম থেকে উঠে গেল বাচ্চাটি।
অনেক লোকজন ঘিরে রেখেছে মেয়েটিকে আর নানান কথা বলে যাচ্ছে। তনিমার শাশুড়ী আগুন চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না তনিমা। কেউ কেউ বলছে বাচ্চাটি মানুষ না কোনো পিশাচের বাচ্চা, অশুভ। আবার কেউ কেউ তনিমার চরিত্র নিয়েও কথা তুলছে। বাচ্চাটি যে কেঁদে যাচ্ছে সেদিকে কারো লক্ষ্য নেই। এসব সহ্য করতে না পেরে তনিমা অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে পড়ে গেলো।