#আম_সন্দেশ
#পর্ব_০৯
#রিমি_ইসলাম
প্রভাত ভাইকে পাওয়া গেল আমার রুমের সেন্টারে দাঁড়ানো অবস্থায়। তাঁর বেশভূষা এলোথেলো। চুলে শাইনি ভাবের বদলে উড়ো খড়কুটো ভাব। দেখেই মনে হচ্ছে এই ছেলে ঘুম ভেঙে সোজা এখানে চলে এসেছেন। পরনে ঢিলে ট্রাউজার, কালো পাতলা শার্ট। প্রভাত ভাই পেছনে ঘুরে তাকাননি। পেছনে আমি ছটফট করছি তাঁর সাত সকালে এখানে আসার হেতু জানতে। আর তর সইছে না। কেন মানুষটা বোবা হয়ে আছেন?
পরক্ষণেই মুখ খুলে বললেন,
___’ তোর টেনশন শেষ। বলে দিয়েছি মামাকে, আমরা কোথাও যাচ্ছি না। নাউ হ্যাপি? হোপ সো! ‘
থমথমে কালো মুখে কথাগুলো বলতে গিয়ে বেশ কয়েকবার আঁটকে গেলেন তিনি। শুভ্র চেহারায় রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে। সাথে চেহারায় এক অমায়িক বিষাদের ছাপ। শুধুমাত্র একটা ট্যুর ক্যান্সেল করায় এত বেদনা! না জানি কত আশা বুকে বেঁধেছিলেন! তাঁর কষ্টের কিছু অংশ তড়িৎ এসে আমায় আঘাত হানলো। প্রচন্ড খারাপ লাগতে লাগল।
তিনি এবার দৃষ্টি দিলেন আমার দিকে। টকটকে লাল চোখে নির্ঘুমতার ছায়া। চোখে চোখ একবার মিলিয়ে সাথে সাথে সরিয়ে নিয়ে বললেন,
___’ কি দেখছিস ওভাবে? ‘
লাগামহীন মুখে বলে ফেললাম।
___’ আপনাকে।’
পরমুহূর্তেই হতবাক হয়ে চুপসে গেলাম। এই শব্দটা বলা কি খুব প্রয়োজন ছিল? এখন তিনি কি ভাবছেন আমার সম্পর্কে?
___’ দেখে নে ভালো মতো।আমার শখের ট্যুর ক্যান্সেল করিয়েছিস তো! দেখ তোর লাইফের ট্যুর কোথায় গিয়ে থামে। বি রেডি ফর মাই নেক্সট এ্যকশান।’
চমকে তাকালাম তাঁর দিকে। আবার কি ফন্দি এঁটেছেন? প্রভাত ভাইকে শার্টের হাতা গুটিয়ে আমার দিকে এগোতে দেখে কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এভাবে এগোচ্ছেন কেন? মারবেন নাকি? আমি পেছনে এক কদম দু’ কদম পিছাতে পিছাতে দেয়ালে ঠেকে আঁটকে গেলাম। আমার দৃষ্টিতে আরও ভয়ার্ত ভাব ফুটে উঠলো। এবার তো আর পথ নেই পালানোর! তিনি আমায় প্রচন্ড চমকে দিয়ে প্রশ্ন করলেন।
___’ তুই অন্য কাউকে পছন্দ করিস? সত্যি বলবি। ‘
তাঁর মুখে এমন কথা শুনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কাউকে পছন্দ! আমি প্রচন্ড ইনট্রোভার্ট প্রকৃতির মেয়ে। কারো সাথে ফ্রিলি মিশতে সময় লাগে। এক ঝটকায় কাউকে আপন করতে পারি না বলে অনেকেই আমাকে অহংকারী ভাবে। নিজেকে যেমন অন্য কারো সামনে উপস্থাপন করি না। তেমনি অন্যের ব্যাপারেও খুব একটা আগ্রহ দেখাই না। আমার জীবন সঙ্গী হওয়া কি চারটে খানেক কথা! সহজে কাউকে মনে ধরলে তো!
___’ আপনার কি হয়েছে? ঠিক আছেন? আমার ব্যাপারে এমন কিছু আছে যা জানেন না?’
___’ তাহলে সাদভী কে?’
ঝটকা খেলাম প্রচন্ড। মনে পড়লো, মাস খানেক আগে সাদভী নামক এক ছেলের থেকে পাওয়া প্রপোজালের কথা। যদিও সে রিজেক্টেড লিস্টে তৎক্ষনাৎ চলে এসেছিল। তবুও পিছু ছাড়েনি ছেলেটা পুরোপুরি। মাঝে মাঝে নক দেই। কথা হয়নি কখনো। কিন্তু এর কথা প্রভাত ভাইয়ের জানবার কথা না!
আমি মুখ খুলতে যাবো তার আগেই প্রভাত ভাই আমাদের মাঝের দূরত্ব শূন্যে মিশিয়ে দাঁড়ালেন। এক ইঞ্চি জায়গাও মাঝে অবশিষ্ট নেই। তাঁর হাত দুটো দেয়ালে আবদ্ধ । দৃষ্টি আমাতে নিবন্ধ। একে অপরের নিঃশ্বাস পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছি, গুণতে পারছি। অদ্ভুত মিশ্র এক অনুভূতি। মিশ্র বলছি কারণ একই সাথে খারাপ লাগছে আবার ভালোও লাগছে।
তিনি ঘনঘন জোরালো শ্বাস ফেলছেন। ধীরে ধীরে তার কপালের সাথে আমার কপাল এক করে বললেন,
___’ কিছু হয়নি। তবে ঠিক নেই। তোকে বুঝতে চাই। পাচ্ছি না বিধায় প্রচন্ড ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি। হুড়ুম করে কোনো কান্ড ঘটিয়ে ফেলবো মনে হচ্ছে। তোকে বড় কোনো শক দেওয়া প্রয়োজন। ‘
আমি কোনো কথা না বলে শুধু তাঁর কথা শুনে গেলাম। যে পরিস্থিতিতে রয়েছি, এভাবে দম আঁটকে আছে আমার। কথা তো দূরে থাক! ঠিক মতো শ্বাস-প্রঃশ্বাস ক্রিয়াও নিতে পারছি না। এতটা কাছে আসার সুযোগ না কখনো কেউ পেয়েছে আর না আমি কাউকে দিয়েছি। তিনিই প্রথম এবং হয়তো শেষও। দ্রুত তাঁর বুক ওঠা নামা করতে করছে। এক ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললেন,
___’ কখনো কোনো বেয়াদবি করিনি। তোকে পছন্দ করেছি, ডাইরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। আই নো তোর সময় লাগবে। আমাকে কতটুকু চিনিস! তাছাড়া আমি প্রথম থেকেই তোর সাথে উদ্ভট আচরণ করছি। তুই শকড্ আমি বুঝি। কিন্তু আমি সামান্য তম জায়গাও তোর মন কুঠরীতে নিতে পারিনি? পছন্দ করতে পারিসনি, ভালোবাসিস না মানলাম। তাই বলে বিশ্বাসের যোগ্যতা কি আমি রাখি না? একটা ট্যুর ই তো চেয়েছি। খারাপ কোনো টেনডেনসিতে না, তোকে আমার সাথে ইজি করতে। বুঝাতে যে আমি ছেলে এতটাও খারাপ না। তুই কি করলি? যাবি না বললি। ‘
এক টানা কথাগুলো বলে দীর্ঘ এক মিনিটের মতো বিরতি নিলেন। তারপর থেমে বলতে লাগলেন।
___’ কথা বলতে চাইলাম, এক শব্দে না বলে পার পেয়ে গেলি। আচ্ছা, কথা বললে কি তোর গায়ে ছিঁলে পড়ে যায়? আমার কথাগুলো তোর কাছে গরম তেল মনে হয়? সবসময় আমার থেকে দূরে থাকিস। ভাবিস কি নিজেকে? রাণী এলিজাবেথ? কোন অংশে কম যাই আমি? তুই আমার কেয়ারনেস দেখেছিস। আমার জিদ তোকে দেখাবো। আমার চরিত্রের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ তোকে আজ দেখাবো। মুহূর্তে তোর জীবন পাল্টে ফেলবো আমি। দেখবি? ‘
বলেই ঝটকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে টেনে ডাইনিংয়ে নিয়ে এলেন। সেখানে বাবা আর দাদি সোফায় বসা। মা রান্নাঘরে। তানিয়া আপু, লিনা আপু বিপরীত পাশের সোফায় বসে ফোনে মগ্ন। প্রভাত ভাই অল্প কেঁশে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে সবাই তাঁর দিকে তাকায়। তাঁকে আজকের মতো এতো সিরিয়াস কখনো দেখিনি।
___
বিয়ের কনে সাজে একবার নিজেকে দেখার ইচ্ছে পর্যন্ত জাগছে না। লিনা আপু আবেগে গলে ইতোমধ্যে রুম ছেড়েছে। তানিয়া আপু মাথার ওড়না ঠিক করে দিচ্ছে। তার চোখও অশ্রুসিক্ত। মুহূর্তে কি থেকে কি হয়ে গেল। প্রভাত ভাই শেষ মুহূর্তে এসে এভাবে বানের জলে ভাসাবেন বুঝিনি। বিয়ের শপিং করার মতো অবকাশ বা পরিস্থিতি ছিল না বলে আম্মুর বিয়ের শাড়িতেই আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে। ভাগ্যক্রমে শাড়ির সাথে মানানসই জুয়েলারিও খুঁজে পাওয়া গেছে।
মা এসে তাড়া দিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন বাইরে। বরবেশে অচেনা মানুষটাকে একবার দেখার আগ্রহ হলো না। মাথা নত করেই তাঁর পাশের জায়গায় গিয়ে বসলাম। কবুল বলার সময় জড় বস্তুর মতো তব্দা হয়ে ছিলাম। পাশের লোকটার ধাক্কায় সম্মোহনী ফিরে এলো। নিজেকে সামলে ঠোঁট নেড়ে মাত্র কবুল বলেই হুহু করে কেঁদে উঠলাম।
চলবে…..