আম সন্দেশ পর্ব-০৬

0
1119

#আম_সন্দেশ
#পর্ব_০৬
#রিমি_ইসলাম

এই গলার আওয়াজটা মারাত্মক এক ভাইরাস আমার জন্য। একটি নির্দিষ্ট ভাইরাস যা কেবল আমাকেই আক্রমণ করে। বারবার ভিন্ন পদ্ধতিতে। মারাত্মক! অসহ্য!

মাত্র চারপাশে ভালোমতো চোখ বুলিয়ে কাউকে পেলাম না। অথচ প্রভাত ভাই হঠাৎ দুম করে কোথা থেকে এলেন আমি জানি না। একটু ঘাড় কাত করতেই প্রথম চোখে পড়ল তাঁর চওড়া হাস্যজ্জ্বল ঠোঁটে। সব দাঁত বের করে হাসছেন। যেন তিনি বিশ্ব বিজয়ী।
আমি আতঙ্কিত হয়ে এক হাতের সাথে অপর হাত রগড়ে বললাম,

___’ আপনি কখন এলেন?’

প্রভাত ভাই দ্বিতীয় কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এক হাতে আমাকে টেনে নিলেন এবং মিশিয়ে নিলেন নিজেতে। আমার কপালে পড়ছে তাঁর উষ্ণ মাতাল প্রঃশ্বাস । তাঁর এক হাতের লম্বা আঙুলগুলো আমার কপালে পড়ন্ত এলোথেলো চুলে বিচরণ করছে। ক্ষণিকে হুট করে তিনি কি করে বসবেন কেউ জানে না। তাঁর আকস্মিক স্বভাবে প্রচন্ড আড়ষ্টতা আমার দেহে ভর করেছে। নড়তে পারছি না। কথা বলতে চাইছি, পারছি না। হঠাৎ প্রভাত ভাই বললেন,

___’ ভয় করছিস? হাবা টাইপ মেয়েগুলো একটুতেই আকাশ সমান ভয় পায়। এই যেমন তুই পাচ্ছিস। আমি কখনো তোকে বকেছি না মেরেছি, না লিমিট ক্রস করেছি? বল?’

এইবার তাঁর কথায় আমি নড়েচড়ে উঠলাম এবং নিজেকে সরানোর চেষ্টা করে বললাম,

___’ সবসময় তো বকতেই থাকেন। সহজভাবে কিছু বলেছেন কখনও?’

তিনি কতক্ষণ চোখ জোড়া পিটপিট করলেন। ঠোঁট জোড়া পলকা হা হয়ে গেল তাঁর। তারপর পরই চোখ দুটো আকারে ছোট করে নিয়ে আমাকে প্রায় হাল্কা হাতে ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলেন।

___’ বকা আর ভালোবাসার তফাৎ বুঝিস না বলেই এই কথা উচ্চারণ করতে পারলি। প্রচন্ড রাগ নিয়ে বলা কথাগুলোকে বকা বলে। বকা ক্ষোভ প্রকাশের একটা মাধ্যমও বটে। আর আমি তোর সাথে যা করি তা হলো ভালোবাসা, কেয়ার থেকে। এত সহজ গণিত কষতে কি তুই জীবন পার করে দিবি? যে মেয়েটা ঠুংকো ধমকেই কেঁপে ওঠে, তাকে বকবো আমি? তোকে চিনতে কি বাদ আছে আমার?’

চোখে দেখার চেয়ে কানে শোনা বাণীর ক্ষমতা বোধ হয় একটু বেশি-ই । এই মানুষটাকে দু’দিন থেকে দেখেও তাঁর প্রতি পজিটিভ কোনো কিছু ভাবতে পারিনি। তবে কি জানেন? এখন তাঁর কথাগুলো আমাকে ভেতরে গভীর নাড়া দিয়েছে। আমি তাঁকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছি।
মনের কোণের বেশ খানিকটা অংশ ইতোমধ্যে তাঁর কথায় বিশ্বাস করে নিয়েছে। আর যার এখনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, তারাও আর পারবে না বেশিক্ষণ এভাবে থাকতে। এত অবহেলা সহ্য করেও তাঁকে আমার থেকে দূরে রাখা সম্ভব হয়নি। ঠিক অদম্য উচ্ছ্বাসে চলে এসেছেন। কোনো ক্লান্তি নেই। হতাশা নেই। আমাকে পাবার যে তীব্র আকাঙ্খা তা দেখেই এতদিন গলে পড়া উচিত ছিল। তবে কেন পারিনি? বিস্ময়কর!

একটু জোর গলায় প্রভাত ভাই বললেন,

___’ কি ভাবিস এত? আমাকে তো না, তবে অন্য কেউ? শোন, আমি ফিল্মের হিরোর মতো ওসব স্যাক্রিফাইস টাইস করতে পারব না। তোকে আর যাকে তুই পছন্দ করবি, মেরে শ্মশান ঘাটে ফেলে আসবো। ‘

গতবার এই প্রশ্নটা একবার করতে যেয়েও ফেরত নিয়েছিলাম। এইবার আর চুপ করে থাকলাম না। জিজ্ঞেস করেই বসলাম।

___’ আচ্ছা, আপনি শুধু আমাকে শ্মশান ঘাটে ফেলে আসার হুমকি দেন কেন? বলবেন মেরে কবর দেব। একজন মুসলিমকে তো শ্মশানে নিতে হয় না।’

প্রভাত ভাই ভ্যাবলাকান্ত হেসে মাথার চুলগুলো খানিক আউলে ঝাউলে করছেন। হয়তো এ ধরনের ভিত্তিহীন প্রশ্নের কর্তা কখনো আমি হব তা ভাবেননি। একটু ভেবে বললেন,

___’ সবাই কথায় কথায় বলে; মেরে পুঁতে দেব, জিন্দা কবর দেব, জিন্দা লাশ বানিয়ে দেব। তাই আমি একটু এর মধ্যে ভিন্নতা আনতে……ইউ নো হোয়াট আই মিন?’

বলেই নির্লিপ্ত হাসলেন। যার অর্থ এইমাত্র বলা বাক্যগুলোতে তিনি নিজেই কনফিউজড। সত্যিই মারভেলাস ক্যারেক্টার একটা!

____
এর পরের দিন রাতের ঘটনা। সদ্য বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি। রাত বাড়ছে। আমার ঘুম ধরে না। তাই একটু দাদির সাথে গল্প করে এসেছি। গল্প করতে করতেই ঘুম চলে এলো। তৎক্ষনাৎ রুমে ফিরেছি। একটুও দেরি করলে ঘুমভাব আবার কেটে যাবে। তখনই তানিয়া এবং লিনা আপু এসে অনেকটা ঢোল পিটানোর মতো স্টিলের প্লেট আর চাচম নিয়ে হৈচৈ করে রুমে ঢুকলো। লিনা আপু প্লেটে চামচ বাজিয়ে শব্দ করছে। অন্যদিকে লিনা আপু এক হাত অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাড়িয়ে সেটাকে সায় জানাচ্ছে। আমি দু’ কানে আঙুল পুরে বসে পড়েছি। এদের বিপরীতে কিছু বলেও কোনো কাজ হবে না। তাই নির্বাক অত্যাচারিত দর্শক হয়ে সব সহ্য করছি।
এবার এক হাত তুলে তানিয়া আপু ইশারা করতেই লিনা আপু থেমে যায়।
তানিয়া আপু লিনা আপুর উদ্দেশ্যে বললো,

___’ তুই বল। ‘

লিনা আপু কেমন লাজুক হেসে বললো,

___ ‘ তুই আমার এক মিনিটের হলেও বড়
। তুই বলবি। ‘

এরূপ ওদের মাঝে কে বলবে কে বলবে না করে তর্ক শুরু হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারছি না ওরা কি বলা নিয়ে এত তর্ক করছে।
তাই সজোর চিৎকার করে উঠে বললাম,

___’ তোমরা থামবে একটু? আসলে কি ব্যাপার ঘটেছে পরিষ্কার করে বলো। লিনা আপু তুমি বলো।’

লিনা আপু নাটুয়া ভঙ্গিতে লজ্জা পেয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে বললো,

___’ ইশ, কিভাবে যে বলি,এখানে একজনের বিয়ে পাকাপোক্ত হয়ে গেছে?

___’ বিয়ে! কার? তোমার? তাইতো বলি লিনা আপুর এত লজ্জা কেন?’, কথাটা বলতেই লিনা আপু আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো।

___’ থাম, এত খুশি হস না। খবরটা আগে দিয়ে দেই। ‘

এ পর্যন্ত বলে লিনা আপু আবার একটু নাটকীয় কান্ড শুরু করলো। টেবিল থেকে একটা খাতা নিয়ে সেটা গোলগোল করে মুড়ে পাইপের মতো করে তাতে মুখ লাগিয়ে কোনো কিছু এ্যনাউন্সের ভঙ্গিতে বললো,

___’ শোনো ভাই ও বোনেরা, ওহ্ স্যরি। এখানে তো কোনো ভাই নেই। শোনো বোনেরা, আমাদের বাড়িতে বংশ পরস্পরায় বহু দিন থেকে চলে আসা রীতির প্রাচীর ভেঙে ফেলা হয়েছে। আত্মীয়ে আত্মীয়ে বিয়ের যে নিষেধাজ্ঞা ছিল সেটা বাবা আজ ভঙ্গ করেছেন তাঁর আদরের কন্যার মঙ্গলের কথা ভেবে। তিনি ঘোষণা দিয়েছে আগামী রোজ শুক্রবার তাঁর কনিষ্ঠ কন্যার সাথে তাঁর বোনের ছেলের বিবাহ। অর্থাৎ, সন্ধ্যার সাথে প্রভাত ভাইয়ের বিবাহ। এইবার সন্ধ্যা ঘুঘুর ফাঁদে পড়েছে। ‘

আজ সত্যি সত্যি আমার ভেতরের সাথে বাইরেও প্রচন্ড বজ্রপাত হলো। নিম্নচাপের দরুন ক’দিন থেকে থেমে থেমে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া বৈরাগী। সাথে বৈরাগী কপাল আমার। লিনা আপুর কথা যেমন বিশ্বাস করার অযোগ্য, তেমন ফেলে দেওয়ারও অযোগ্য।
ঘরে দু’ দুটো বড় মেয়েকে রেখে কোনো বাবাই তাঁর ছোট মেয়ের বিয়ে দেবেন না। তার ওপর প্রভাত ভাইকে এতদিন যখন না বলে এসেছেন। এখন তবে হ্যাঁ বলার প্রশ্ন আসে না।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। বাবা তাঁর বন্ধুর ছেলের আমার বিয়ে দেওয়ার কথা দিয়ে রেখেছেন। তাহলে সেকথার বাবা কি করবেন? ফেলে দেবেন?
শত শত প্রশ্নরা মাথায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আবার ছিটকে সরে যাচ্ছে কোনো উত্তর না পেয়ে।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে