#আম_সন্দেশ
#পর্ব_০৩
#রিমি_ইসলাম
দোতলা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে প্রভাত তাকালো। পাশে বসে থাকা গাম্ভীর্য পূর্ণ মেয়েটার দিকে। এক হাত ভাঁজে তার উপর অন্য হাতের কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। মুখ রাগে অস্বাভাবিক ফোলা। প্রভাত গাড়ি থেকে নেমে আদেশ করল।
___’ গাড়ি থেকে নেমে আই। পৌঁছে গেছি।’
আমি তাকালাম না। কথা শুনবার প্রয়োজন বোধটুকুও করলাম না। ভোরের আলো ফুটতে আর দেরি নেই। বাবা, মা নামাজের জন্য উঠে আমাকে জাগাতে গিয়ে দেখবে আমি নেই। খালি ঘর হন্যে হয়ে খোঁজ করবেন। তারপর এক পর্যায়ে সন্দেহের দানা মনে উঁকি দিবে। এরপরের ঘটনা আমার কল্পনাতীত।
আবার তাঁর তেজি গলার হুংকার।
___’ রাত পার হলে নামবি বলে পণ করেছিস? দ্রুত আই। কোলে নিতে হবে?’
বলা বাহুল্য শেষ বাক্যটা শুনে আর বসে থাকা সমীচীন বলে মনে হয়নি বিধায় নেমে পড়ি। হুট করে দেখা যাবে কোলে নিয়ে ফেলেছেন। এমতাবস্থায় ফুপি দেখলে এ বাড়িতেও তান্ডব পড়বে। তখন দুই বাড়ির তান্ডবে আমি পিষ্ট হবো, মাঝে থেকে সুযোগ লুফে নিবেন প্রভাত ভাই।
একতলা টপকে সোজা দোতলায় উঠে এলাম। যতদূর জানি একতলায় থাকেন ফুপিরা। দোতলা কার জন্য বরাদ্দ তা সঠিক বলতে পারব না। ওপরে এসে দরজার লক খুলে প্রভাত ভাই তাঁর একটা হাত সামনে প্রসারিত করে দিলেন। এর ভাবার্থ আমাকে প্রথম ভেতরে ঢুকতে হবে। নিদ্রাহীন এক রাতের পর কথায় শক্তি অপচয়ের মতো ধৈর্য্য যথারীতি হারিয়েছি। তাই যান্ত্রিক রোবটের মতো তাঁর কথা মেনে ভেতরে চলে যাই। তারপর ধাড়াম করে দরজা বন্ধের জোরালো শব্দে পেছনে ঘুরে তাকানোর অবকাশ টুকু পেলাম না। তার আগেই আমার দুই হাত তার বাহুডোরে চাপা পড়ে গেল। পেছন থেকে এত জোরে চেপে ধরলেন যে নড়তে পারছি না। মুহূর্তে মাথায় টোকা দিয়ে আবার ছেড়ে দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
___’ বেশি বাড়াবাড়ি কিছু ভাবিস না। ভেতরে চল। তোকে তোর ঘর দেখাব।’
বিজ্ঞ চোখে তাকিয়ে কোথাও ফুপা বা ফুপিকে না দেখে বললাম,
___’ ফুপিরা কোথায়? ‘
প্রভাত ভাই হাঁটা থামিয়ে পেছনে না ঘুরে বললেন,
___’ নিচে। ‘
___’ তাহলে আমরা ওপরে এলাম কেন? ‘
___ কারণ ওপরতলার পুরোটা জুড়ে আমার রাজত্ব। তুই হবি আমার রাজ্যের রাণী। তোকে তো আমার রাজ্য ভ্রমণই প্রথম করাবো তাই না? এরপর রাজা রাণীর রাজ্য ভ্রমণে বেরোব। দ্রুত পা চালা। তোর পা কি ছোট ছোট, এত আস্তে হাঁটিস কেন?’
তাঁর প্রতিটা কথায় খোঁচা দেওয়া স্বভাব। বিরক্তি নিয়ে তাঁর সাথে একটা রুমে এসে ঢুকলাম। সমস্ত ঘরময় সৌখিনতার ছাপ স্পষ্ট হলেও বেশ নোংরা। মেঝেতে চকলেটের প্যাকেট থেকে শুরু করে টুকরো টুকরো কাগজ, হাত ঘড়ি পড়ে আছে। বিছানার চাদর একপাশে ঝুলে পড়েছে। নাক ছিটকে বলি,
___’ বড় বড় বুলি বলা মানুষ এত নোংরা, ছিঃ! ‘
প্রভাত ভাই হন্তদন্ত হয়ে পুরো রুম গোছাতে আরম্ভ করলেন। মেঝেতে পড়ে থাকা আবর্জনা গুলো ডাস্ট বাকেটে ফেললেন। বিছানা গুছালেন নিজ হাতে। তারপর হাত দিয়ে বিছানা ঝেড়ে বললেন,
___’ এবার বস। আর বলে রাখি, আমাকে খবরদার নোংরা বলবি না। একরাতের রাগের বশত রুম আউলা ঝাউলা করেছি। ভাগ্যক্রমে আজকেই তোর আসা পড়েছে। আমি প্রচন্ড পরিচ্ছন্ন শ্রেণীর মানুষ। ‘
লম্বা হাই তুলতে তুলতে তাচ্ছিল্য টেনে বললাম,
___’ হ্যাঁ, দেখতেই পেলাম তার নমুনা। ‘
ফনা তোলা সাপের মতো ফুসে উঠে এক প্রকার তেড়ে এলেন। তারপর আমার দু’গাল তাঁর বুড়ো এবং তর্জনী আঙুল দ্বারা চেপে ধরে দাঁত কটকট করে বললেন,
___’ তুই আমার সাথে মিসবিহেভ করেছিলি । মনে পড়ে? প্রচন্ড রগরগে মাথায় বাসায় ফিরেছি। বিদেশের তিন বছরের জীবনে কেউ আমাকে ইগনোর করেনি৷ তুই করেছিস আর করছিস এখনো। রাগ কোনোভাবে কন্ট্রোল হচ্ছিল না। তাই বসে থেকে তোকে মুখের উপর যেগুলো বলতে পারিনি সেগুলো এক একটা কাগজে লিখেছি আর ছিঁড়ে নিচে ফেলেছি। চকলেট খেতে খেতে লিখছিলাম তাই….. ঘড়ির কাঁটা ঘরের ওপর ঘর ঘুরে সময় বাড়িয়ে তুলছিল। এদিকে আমার অস্থিরতা কমছিল না দেখে ওই ব্যাটাকে আছাড় মেরেছি। ব্যাটারী বোধ হয় গেছে। বুঝলি ব্যাপারটা এবার?’
গোটা একটা দিন একটা রাত শেষে প্রথমবার আমি তাঁর দিক ভালোমতো যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে তাকালাম। সাদা বিলেত ফেরত বলায় আপনারা জল্পনায় প্রথমেই এক সাদা বাঁদরকে নিশ্চয়ই ভেবে নিয়েছেন? অবশ্যই। ইনি সাদা চামড়ার অধিকারী এতে কোনো দ্বিমত নেই। তবে কি জানেন, বিদেশে থাকলেও আমাদের দেশ আর বিদেশি মানুষের চামড়ায় বিস্তর তফাৎ থাকে। প্রভাত ভাইয়েরও আছে। তিনি গাঢ় ফর্সা। একটু সাদা আর হলুদ রঙের মিশেল রয়েছে চামড়ায়। পুরো ক্লিন সেভ না। ক’দিন আগে ছাঁটাই করা দাড়ি পুনরায় মাথা চেড়ে গজে উঠছে। মুখে ধারালো ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ। উচ্চতা সঠিক করে বলা দায়। তবে তার লম্বত্বের জন্য আমাকে বেশ মুখ উঁচিয়ে কথা বলতে হয়।
তিনি এখন নাক উঁচিয়ে কপালে তিনটি বক্র রেখা ফেলে আমায় দেখছেন। একটু থতমত খেলাম। সাথে সাথে চোখ নিচে নামালাম। এভাবে তাঁকে দেখছিলাম বলে কি যাতা না ভেবে বসেন! কিন্তু সেরকম কিছুই তিনি বললেন না। মুখখানা সরল করে বললেন,
___’ জাস্ট আ মিনিট। আমি নিচে যাবো আর আসব। তুই গোটা ফ্ল্যাট ঘুরে দেখ। কোথাও কোনো চেঞ্জ আনার প্রয়োজন আছে কিনা, এইসব দেখে আমাকে জানাবি। ওকে?’
প্রভাত ভাই চলে যেতে কতক্ষণ অনড় বিছানায় ঠেস মেরে বসলাম। তারপর কি মনে করে মেঝেতে পড়ে থাকা প্রতিটা কাগজ উঠিয়ে একে একে পড়তে লাগলাম। সবটা পড়ে হাসতে হাসতে আমার নাজেহাল অবস্থা। আপনারাও একটু শুনুন।
” টিনটিনে বেহুডা মেয়ে…..আমাকে রুম থেকে তাড়িয়ে দেয়? বিয়েটা হোক, প্রতিদিন একবার লাফি মেরে ওকে ঘর থেকে তাড়িয়ে এ অপমানের শোধ তুলব।”
” অসম্ভব বাজে লাগছিল ওকে দেখতে। নাক কুঁচকে ভোতা করে রেখেছিল। বোকা একটা ছাগল!”
” বিয়ের কথা বলতেই চোখগুলো তালের মতো বড় বড় করেছিল। চোখের মনিটা লাগছিল তালের আঁটি। গিলে টুপ করে খেয়ে ফেললে কি হতো?”
” হাবা একটা, রাতে একবার ঘুমালে তো মরা লাশ হয়ে থাকিস শুনলাম। তোকে একদিন শ্মশানে নিয়ে ছাড়ব। তারপর তোর চিৎকার দেখবো।”
” রাতেই একটা শিক্ষা পাওয়া উচিত তোর সন্ধ্যা। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারব না নয়তো। তোকে কিডন্যাপ করে বিয়ে করে বাসর করে তবে ছাড়ব। তারপর একঘন্টা নদীর পানিতে চুবিয়ে গোসল করাবো। শাস্তি শাস্তি আর শাস্তি! উফ, শান্তি! ”
” হা হা হা, তানিয়া আর লিনাও আমার সাপোর্টে। আমি আসছি। তোকে দারুণ সারপ্রাইজ দেবো। ”
একটা মানুষের কতটা মাথা খারাপ হলে এমন আজেবাজে চিন্তা নিয়ে ঘুরে আমার জানা নেই। পুরো একটা মিস্টেরিয়াস ক্যারেক্টার!
চলবে………