#আম_সন্দেশ
#পর্ব_০১
#রিমি_ইসলাম
___’ বল কাল রাতে তুই আমাকে ফোন করে কত প্যানপ্যান করলি..’ আমাকে বিয়ে করুন ভাইয়া প্লিজ আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আরও কত কি! সব বলব সবাইকে? এখন মেরে নদীতে ভাসাবো যদি বিয়েতে না করেছিস তো!’
আমি পাশে দাঁড়ানো সদ্য বিলেত ফেরত সাদা চামড়ার মানুষটাকে বিস্ময় নিয়ে দেখছি। লাল ঠোঁটে চওড়া হাসির দমক। দৃষ্টি আমাতে গিয়ে স্থির। প্রভাত ভাইয়ার কথায় বড় ফুপির মুখ হা হয়ে গেল। নিজের ছেলের মুখে এমন কথা শোনার জন্য মোটেও তিনি প্রস্তুত ছিলেন না।
এক সপ্তাহ ও হয়নি তাঁর আসা। আমাদের বাসায় তো আজই প্রথম এলেন আর এসেই এমন প্রস্তাবে সবাই রেগে গেলেন। প্রভাত ভাইয়া আবারও বললেন,
___’ আমি সন্ধ্যাকেই বিয়ে করব। মামা আপনি রাজি থাকলে ভালো, না থাকলেও কিছু করার নেই। কারণ এ বিয়েটা হচ্ছেই। তাছাড়া সন্ধ্যারও এ বিয়েতে মত আছে। বলো সন্ধ্যা?
কথাটা বলেই আমায় ইশারায় চোখ টিপে সম্মতি জানানোর হুকুম তলব করলেন। এদিকে বাবা, মা, ফুপি আর দাদির চোখ থেকে আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে। আমাদের বংশে আত্মীয়ে আত্মীয়ে বিয়ের নীতি এ যাবৎ নেই। কখনো হবেও না। তবুও কেন যে প্রভাত ভাইয়া এমন করছেন জানি না।
আমি দৃঢ় চিত্তে বলি, ___’ হি ইজ লায়িং বাবা। সব মিথ্যা বলছেন। আমি তাকে পছন্দ করি না আর বিয়েও করতে চাই না। ফুপি বিশ্বাস করো আমি এসবেই কিছুই জানি না। ‘
ফুপি রাগে ফুসে গটগট করে বললেন,
___’ কোনো মেয়ে নিজ থেকে না এগোলে ছেলে কিভাবে এগোয়? সন্ধ্যা তুই এভাবে আমাদের বংশের নাম ডুবাবি তা স্বপ্নেও ভাবিনি। ‘
এবার বাবা হুংকার ছেড়ে বললেন, ___’ তা কতদিনের সম্পর্ক তোমাদের? দুই পাঁচদিনের নিশ্চয়ই নয়?’
বাবার কথায় প্রভাত ভাইয়া মুখে কাঠিন্য এনে বললেন, ___’ জেনেই যখন গেছেন তখন আর কিছুই গোপন করে লাভ নেই। আনুমানিক পাঁচ/ছ ‘ মাসের মতো হবে। অনেক আগে থেকেই আমাদের কথা হতো। ‘
ডাহা মিথ্যা কথা! আমি জীবনেও তাঁর সাথে দেখা বা কথা বলিনি। জল যে তিনি আরও কত ঘোলা বানাবেন আল্লাহ জানে। সবাই টগবগে মস্তিষ্কে হনহন করে সেখান থেকে হেঁটে চলে গেলেন।
এবার আসি পরিচয় পর্বে,
আমি মেহরিন নাহার সন্ধ্যা। আর ওই বাঁদরটা আমার ফুফাতো ভাই। বড় ফুপির ছোট ছেলে। আমি ফুপির একমাত্র ভাই জবাব আহেল খানের তিন কন্যার সর্ব কনিষ্ঠ কন্যা। পড়াশোনা অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ। আমার পরিবারে বাবা মা, আমি, দুইবোন আর দাদির বাস। প্রথম দিকে দাদির একমাত্র আদরের দুলালি আমি থাকলেও প্রভাত ভাইয়া আসার পর থেকে বুঝলাম আমার ধারণা পুরো ভুল। দাদির চোখের মনি ওই বাদরটা।
তিন বছর আগে প্রভাত ভাইয়া উচ্চ ডিগ্রী অর্জনের জন্য বিলেত গিয়েছিলেন। এরপর থেকেই তাঁর সাথে আমাদের কারো যোগাযোগ নেই। দেশে থাকতে তিনি যে খুব ঘন ঘন আমাদের বাসায় আসতেন তাও না। বছরে দু ‘একবার ভুলে ভালে তাঁর মূল্যবান চরণ এ বাসায় পড়ত। মূল্যবান বলছি কারণ দাদির ভাষ্যমতে প্রভাত ভাইয়া মহামূল্যবান হিরের খনি। এমন খনি নাকি জগতে মেলা ভীষণ দায়।
_____
___’ এই বাঁদর! তুই যে সন্ধ্যারে পছন্দ করিস আগে বলবার পারতি না? ওর তো বিয়া ঠিক।’
রওশন আরা বেগমের কথায় খুব একটা হেলদোল হলো না প্রভাতের। সে বিছানায় গা মেলে হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাতে ধরা আপেলে মাঝে মধ্যে ছোট্ট একটা কামড় দিয়ে চলেছে। বিয়ে ঠিক হওয়া না হওয়ায় যেন তার কোনো যায় আসে না।
___’ নানু, সন্ধ্যাকে ডাকো না! দেখতে ইচ্ছে করছে। আহা, কি সুন্দর বোকা বোকা মুখটা। দেখলেই আদর করে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। বানিয়েছ একটা নাতনি। লাক্ষে একটা!’
প্রভাতের কথায় নানু জিভে আলতো ফোঁড়ন কেটে ওর গায়ে একটা চড় কষে বললেন,
___’ বিলেত ফেরত পোলার মুখে লাগাম নাই। বেহুদা পোলা! সন্ধ্যা পড়তে বসছে আসতে পারব না। আর তোরে যে এখনও তোর মামা এ বাড়িত রাখছে শুধু আমার মুখের দিক চাইয়া বুঝছস? নাইলে কবকার বাইর কইরা দিতো। ‘
___’ সন্ধ্যার রুম তো সেই আগেরটা আছে তাই না? সোজা গিয়ে হাতের বামের শেষ রুমটা? দাঁড়াও আমি দেখা করে আসি।’
রওশন আরা বেগম আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না।
___
___’ নক-নক! ইজ এনিওয়ান দেয়ার? ইওর হবু বর ইজ হেয়ার। মে আই কাম?’
মাথার উপর দিয়ে সব গেছে। পড়ার ছলে বই হাতে থাকলেও এখনও নিচে ঘটে যাওয়া তড়িৎ ঘটনাগুলোই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। পড়া গোল্লায় গেছে। এরই মাঝে দরজায় পুনরায় ওই আপদকে দেখে রাগ কম ভয় হলো বেশি। এত কান্ড ঘটিয়ে এবার সোজা রুমে চলে এসেছেন! আল্লাহ মালুম বাবা দেখলে ভুলভাল কিছু ইঙিতে না সোজা আজই বিয়ে পড়িয়ে বাড়ি থেকে বিদেয় করে!
আমার পারমিশনের তোয়াক্কা না করেই ভেতরে ঢুকে খুব চেনা ভঙ্গিতে ড্রেসিং টেবিল সংলগ্ন চেয়ারটা টেনে নিয়ে খাটের পাশে আমার মুখোমুখি বসলেন। তারপর গালে হাত রেখে বেয়াহার মতো দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ এভাবে থেকে বললেন,
___’ উফ এত নড়িস কেন বল তো? একদম নড়বি না। স্ট্রেইট বসে থাক। দেখতে দে ভালোমতো। তোর কোতায় কি পরিবর্তন এসেছে। তোর থুতনিতে ওটা কি রে দেখি?
থুতনির উপর হাত রাখতে চায়তে ঝট করে সরে বসলাম। বেহায়াপনার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছেন তিনি। একে বেশি লাটে ওঠালে চলবে না। উনি বিরক্ত হয়ে হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে বিছানার শক্ত কাঠে আঘাত করে বললেন,
___’ এই হাতটা সরিয়ে দিলি তো তাই শাস্তি দিলাম। তুই আমাকে চিনিস না। কতদিন এভাবে দূরে সরাবি? আমার প্রেমে তোকে পড়তেই হবে। বিয়ের আগেই হোক কিংবা পরেই।
কড়া কয়টা কথা শুনিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কি বলে শুরু করব বুঝছি না। একটু মুখে বিরক্ত নিয়ে এসে বললাম,
___’ আপনি আমার তিন বছরের বড় না হলে এখনই একটা থাপ্পড় মেরে বিদায় করতাম। ফুপির ছেলে বলে ছেড়ে দিতাম না। আপনাকে আমি বিয়ে করব না। তাছাড়া দাদির মুখে নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনেছেন আমার অলরেডি বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এসব ত্যানাপরা বৃথা চেষ্টা না করে দেশে ভালো দেখে একটা মেয়ে খুঁজে বিয়ে করে ফেলুন।’
___’ চুল টানলে মাথা আসে। ঘাড় টানলে মাথাসহ কোমর অব্দি আসে। আর তোকে টানলে পুরো তুইই আসবি। মোদ্দা কথা, তুই আমাকেই বিয়ে করবি৷ সোজা না হলে জোর করে। ‘
আমি সত্যিই অতিষ্ঠ। আর কোন বাক্যে বোঝাব! অশ্রাব্য গালিতেও বোঝ হয় এই লোকের মাথায় সুবুদ্ধি হবে না। তাঁর টর্চারে মনে হচ্ছে নিজেই বসে বসে গলা ফাটিয়ে কেঁদে মনকে হাল্কা করি। নিরাশ গলায় বললাম,
-‘ আচ্ছা আপনি আমাকে দেখেননি। সেই তিন বছর আগেই শেষ দেখা। হঠাৎ আমাতে কি এমন দেখলেন আর দেখলেনই বা কিভাবে? আজই না আমাদের বাড়িতে প্রথম এলেন?’
প্রভাত ভাই একটু বিজ্ঞের মতো আমাকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
-‘ কই তোর চেহারা এই তিন বছরে আহামরি কিছু বদলায়নি। তাছাড়া দেখার ইচ্ছে থাকলে দূর দেশে বসেও দেখা যায়। সব বলবো। অপেক্ষা কর। বিয়েটা আগে হোক।’
-‘ রাবিশ! কক্ষণো না। বিয়ে করব না।’
কথাটা মুখ ফসকাতে দেরি কিন্তু তাঁর আক্রমণে দেরি নেই। উনি এক টানে আমায় কোলে বসিয়ে গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে আবার ধাক্কা মেরে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। ঘটনা এত আকস্মিক ঘটলো যে আমার বোকা বনে কতক্ষণ কাটিয়ে দিলাম।
___
___’ হাবা টা ঘুমিয়ে গেছে?’
প্রভাতের এহেন কথায় তানিয়া আর লিনা ফিক করে হেসে দেয়। ওদের ফোন লাউড স্পিকারে। তানিয়া আবার একটু সন্ধ্যার রুম থেকে ঘুরে এসে বললো,
___ ‘ মরে লাশ হয়ে গেছে। এখন সারাদিন কেউ ধাক্কালেও জাগবে না। যা করার এই সময়েই করুন। পরে চান্স পাবেন না ভাই।’
___’ আসছি তবে।’
লাইন কেটে যেতেই তানিয়া আর লিনা একে অন্যের দিকে তাকায়। রাত একটা। বসে থেকে এবার পায়চারি করতে লাগল তানিয়া। অপেক্ষার পালা কি যে যন্ত্রণা! সময় নাকি বহমান অথচ অপেক্ষার বেলায় এসে আর বহমান না থেকে সহমান হয়ে যায়।
ঘড়ির কাঁটা ঠিক একটা বিশে পৌঁছাতে জানালা দিয়ে ঠুকঠুক আওয়াজ পেল ওরা। তারপর দুম করেই প্রথমে একজোড়া পা সমেত
পুরো মানুষটা এসে ঘরে ঢুকলো। প্রভাতকে দেখে ওরা দুই বোন হেসে উঠলো। চুলগুলো ভেজা এলোমেলো। গায়ে ফিনফিনে এক শার্ট। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। ওদের হাসতে দেখে প্রভাত ধমকের সুরে বললো,
___’ হাসি লাগে না? বৃষ্টির মধ্যে কখনো কোনো মিশনে গিয়েছ, যাওনি তো? তাহলে বুঝবে কি করে? প্রচন্ড বৃষ্টি। সাথে ছাতা নেই। ভিজবোই তো। তার উপর মাথায় এক্সট্রা প্রেশার। আচ্ছা এখন বলো তোমাদের বোন জেগেছে না ঘুমে?’
লিনা মুখ টিপে হেসে আবার থেমে গিয়ে বললো,
___’ চিন্তা নেই। ভোরের আগে ওর ঘুম ভাঙে না। কি করতে হবে বলুন।’
___’ আপাতত ওর রুমের বাইরে পাহারায় থাকো। কেউ আসলে সংকেত প্রেরণ করো।’
ওরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। প্রভাত বিড়ালী পায়ে সন্ধ্যার রুমে ঢুকে পড়ে। দরজা ভেজিয়ে বিছানার কাছে যেয়ে কতক সময় থমকে থাকে। বোকা মেয়েরা আসলেই সুন্দরী হয়। কথাটা যথার্থ। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে নিজ মনে আওড়াতে থাকে, ‘ নো প্রভাত, এভাবে ওকে দেখতে থাকলে ভোর হয়ে যাবে। এদিকে কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না। সময় নষ্ট করিস না। টাইম ইজ ভেরি ভ্যালুয়েবল।’ তারপর দাঁড়িয়ে বিছানায় এক হাঁটু মুড়ে দুই হাত প্রসারিত করে আলগা হাতে তুলে নেয় সন্ধ্যাকে। শক্ত হাতে এবার বাহুডোরে চেপে মিশিয়ে নেয় বুকের মাঝে। মুচকি হেসে ওর কপালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ায় প্রভাত।
____
ঘুমের ভেতর মনে হলো উঁচু থেকে পড়ে যাচ্ছি কোনো খাদে। ঠিক এমন একটা অনুভূতি নিয়ে জেগে উঠতেই এক গগন ফাটানো চিৎকার করে উঠলাম। আমি ছিলাম আমার নিজের রুমে আরামদায়ক বিছানায়। ভুল হচ্ছে। স্বপ্ন দেখছি বোধ হয়। কারণ এখন আমি যা দেখছি না বাস্তব হতেই পারে না। আমি একটা ব্রিজের সিমেন্টের রেলিঙের উপর শুয়ে আছি। আমার শরীরের দু’পাশের বেশিরভাগ জায়গা রেলিঙের দু’পাশে বেরিয়ে আছে। হয় পড়লে সোজা পানিতে নয়তো পড়বো পাঁকা সড়কে। একদিকে পড়লে ডিরেক্টর ওপরওয়ালার কাছে। কারণ সাঁতার জানি না। জানলেও একবার পানিতে পড়লে কোনো সাঁতারই তেমন কাজে দেয় না। অপরদিকে রাস্তায় পরলে মাথা, কোমর দুটোই ফাটবে।
এমন পরিস্থিতিতে আমাকে কে এনে ছেড়ে দিলো? দয়া মায়া বলে কিছুই নেই মানুষের? জীবনে গুরুতর কোনো শত্রুর সম্মুখীন হয়নি তবে হঠাৎ কোন শত্রুর আবির্ভাব!
চলবে……