#আমি_দূর_হতে_তোমারে_দেখেছি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৪
মাহমুদ আর মালিহার বিয়েটা খুব ধুমধামে হয়ে যায়। বিয়ে, বউভাত শেষে সবার বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিয়ের তৃতীয় দিন, সবাই যার যার বাড়ি ফিরে গিয়েছে। ইহান বাড়ির সবাইকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে পড়েছে। বিয়ে বাড়িতে তেমন ঘুম না হওয়ায় রায়া ফ্রেশ হয়ে এসেই ঘুমিয়ে পড়ে। বাহিরে বৃষ্টিও নামা শুরু করেছে। প্রবল হাওয়া বইছে। বারান্দার দরজার পর্দা এপাশ ওপাশ করে উড়ছে। বৃষ্টি আর বাতাস সবমিলিয়ে দারুণ একটা আবহাওয়া।
রায়ার ঘুম ভাঙতে ভাঙতে প্রায় সন্ধ্যা। বিছানায় বালিশের পাশে ফোনটা তখনও বেজে যাচ্ছে। ফোনটা হাতে নিয়েই দেখে তার মা কল করেছে। রায়া উঠে বসে। ফোন রিসিভ করবে ঠিক তখনই ইরিনা বেগম দৌঁড়ে রায়ার রুমে আসে।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ” রায়া তোর বাবা…”
রায়া উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে, ” বাবা কী?”
” তোর বাবা স্ট্রোক করেছে রায়া। হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”
রায়া সাথে সাথে ফোনটা রিসিভ করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,” মা, বাবার…”
ওপাশ থেকে রায়ার মা বলে ওঠেন, ” তোর বাবা স্ট্রোক করেছে রায়া। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আয়।”
রায়া যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। দুপুরের আগেই তো সবাই কত আনন্দ করতে করতে বাড়িতে ফিরলো। রায়ার বুক ভারি হতে শুরু করেছে। চোখে পানি টলমল করছে। ইরিনা বেগম এসে রায়াকে জড়িয়ে ধরতেই রায়া শব্দ করে কান্না করে দেয়।
কান্না করতে করতে বলে,” বড়মা, আমার আব্বুর এমন কেন হলো? আব্বুর কিছু হবে না তো? আব্বুর কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। আমার জন্য চিন্তা করতে করতেই হয়তো এমন হয়েছে তাই না?”
” কিচ্ছু হয়নি বোকা মেয়ে। চল আমরা বের হই। ইহান ওখানেই আছে, হাসপাতালে। ”
” বড়মা, দোয়া করো আমার আব্বুর যেন কিছু না হয়।”
সবার হাসপাতালে পৌঁছতে প্রায় আধাঘণ্টা লেগে যায়। রায়ার মা বাহিরে বসে বসে চোখের পানি ফেলছে। একটু দূরেই ইহান হয়তো কিছুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে পায়চারি করছে। রায়া দৌঁড়ে এসে মাকে জড়িয়ে কান্না করতে থাকে। ইরিনা বেগম পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির মানুষকে দেখে ইহানও সেদিকে এগিয়ে আসে। রায়া তার মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেই যাচ্ছে। রাবেয়া বেগম নিজেও কান্না করছেন।
ইহান কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে, ” প্লিজ এভাবে কান্নাকাটি কোরো না তোমরা। অযথা ভয় পাচ্ছ, কাকার তেমন কিছুই হয়নি। মিনি স্ট্রোক এটা, অযথা নিজেরা পরিস্থিতি জটিল কোরো না। কাকা যেন কিছুতেই না জানতে পারে যে তার স্ট্রোক হয়েছে। একটা মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত সুস্থ থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের রোগ বা অসুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত না জানে। কাকা তার এই বিষয়টা জানলেই চিন্তা করা শুরু করবে আর তার জন্য তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়বেন। প্রতিদিন টাইমলি থেরাপি নিলেই ঠিক হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। ডাক্তার বের হলেই সব জানতে পারবে, কান্না করবে না এভাবে এখানে। কিছু হয়নি উনার।”
কিছুক্ষণ পর দুজনের কান্না থেমে যায়। রায়া চোখেমুখে পানি দিতে চাইলে ইহান তাকে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে নিয়ে যায়। ওয়াশরুমের বাহিরেই একটা ছোট জায়গায় ওজু করার ব্যবস্থা করা। রায়া সেখানেই চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে নেয় একটু। রায়া ওখান থেকে বেরিয়ে আসলে ইহান পকেট থেকে রুমালটা বের করে রায়ার দিকে এগিয়ে দেয়।
রায়া নির্দ্বিধায় সেটা নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে,” কী হয়েছিল আব্বুর? বড় কিছু হবে না তো?”
” কিচ্ছু হবে না, চিন্তা করার কিছুই নেই।”
” কীভাবে বুঝলেন আব্বু স্ট্রোক করেছে? এর আগে তো কোনদিন এমন হয়নি।”
” তোর মা কল দিয়েছিল, আল্লাহ হয়তো সে কারণেই আমাকে কাজে বাড়ির সামনে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। আমি বাড়ির ওইটুকু পার হতেই ফোন বেজে ওঠে। কাকি কান্না করছিল। আমি জিজ্ঞেস করি যে কী হয়েছে। তখন তিনি কান্না করতে করতেই বলেন যে কাকা না ওয়াশরুম থেকে বের হতে গিয়ে ফ্লোরে পড়ে গিয়েছেন। বাম পা নিয়ে চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে, কথাও আটকে আটকে যাচ্ছে মুখে। আমি তখনই বাড়িতে ফিরে গিয়ে উনাকে নিয়ে বের হই। ভাগ্য ভালো থাকায় তাড়াতাড়ি গাড়িও পেয়ে যাই।”
রায়া রুমালটা ফিরিয়ে দিয়ে বলে,” ডাক্তার বলেছে বাবা স্ট্রোক করেছে? ”
” প্রাথমিক ধারণা থেকে বলেছে জাস্ট। এখনই হয়তো দেখে বের হবে। চল এগিয়ে যাই ওদিকে।”
” হুম।”
রায়া আর ইহান কেবিনের সামনে যেতেই দেখে ডাক্তার অলরেডি বেরিয়ে রাবেয়া বেগমের সাথে কথা বলছেন। ইহান তাড়াতাড়ি করে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।
ডাক্তার ইহানকে দেখেই মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, ” চিন্তার কোন কারণ নেই ইহান৷ আমি যেটা ভেবেছিলাম সেটাই। তবে আপনারা কেউ পেশেন্টের সামনে এসব নিয়ে আলোচনা করবেন না। পেশেন্টের সামনে অসুস্থতা নিয়ে আলোচনা করলে সেটার বাজে ইফেক্ট পড়বে তার ওপর। যতটা পারবেন তাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করবেন। আর উনি যেহেতু এলাকার চেয়ারম্যান, অনেক জটিল কাজ তাকে করতে হয়৷ অনেক বড় দায়িত্বের বিষয়। আমি বলব, আশেপাশের এত এত চিন্ত উনার মাঝে থাকলে আবারও এমন হওয়ার সম্ভাবনা আছে৷”
ইহান বলে,” তাহলে আমাদের করণীয় কী ডাক্তার?”
” যদি পারেন তাহলে উনাকে এসব থেকে বিরতি নিতে বলুন। আর তাছাড়া আপনি তো আছেন। চেয়ারম্যান শামসুজ্জামানের মতো আপনিও এখানকার মানুষের দায়িত্ব নিতে পারবেন আমরা জানি। উনার সবকিছু তো আপনিই দেখাশোনা করছেন।”
ইহান জোর করে নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,” না না ডাক্তার, আমি ধীরে ধীরে এসব থেকে বেরিয়ে আসছি। নিজে একটা বিজনেস করছি আপাতত। এসব নিয়েই এগুনোর ইচ্ছে আছে আর তাছাড়া দেখি কাকার চেয়ারম্যান পদের আর খুব একটা বেশি সময়ও তো নেই। এই সময়টা উনাকে আমি সাহায্য করব সবকিছুতে আগামীবার থেকে এসবে আর জড়াতে দেব না।”
” দেখুন যা ভালো হয় করুন। আমি আসছি তাহলে, আমার অন্য পেশেন্ট দেখতে হবে। চেয়ারম্যান সাহেব আপাতত আজকে রাতটা এখানেই থাকুক। আগামীকাল বাসায় নিয়েন৷ আপনারা গিয়ে দেখা করতে পারেন, কেউ উত্তেজিত হবেন না। কান্নাকাটিও করবেন না উনার সামনে, উনার কিছু হয়নি।”
” ঠিক আছে। আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়ালাইকুমুস সালাম। ”
সবাই কেবিনে ঢুকে দেখে শামসুজ্জামান সাহেব চোখের ওপর হাত দিয়ে চোখবুঁজে শুয়ে আছে। কারো উপস্থিতি বুঝতেই তিনি চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দরজার দিকে তাকান। সেখানে সবাইকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করতেই ইহান এসে ধরে তুলে বসিয়ে দেয়। রায়া গিয়ে পাশেই চেয়ার টেনে বসে।
শামসুজ্জামানের হাতটা ধরে বলে,” কেমন লাগছে এখন আব্বু?”
শামসুজ্জামান পিছনের বালিশটা একহাত দিয়ে ঠিক করে নিয়ে বলেন,” একদম ঠিকঠাক আছি। ডাক্তার বলছিল শরীরটা একটু দূর্বল তাই ওরকম হয়েছিল। তোরা কেউ এত চিন্তা করিস না মা।”
রুমের সবার সাথে কথাবার্তা হয় টুকটাক। শামসুজ্জামানের শারীরিক উন্নতি দেখে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সবাই। রাবেয়া বেগম কথা বলছিলেন এমন সময় ফোনটা বেজে উঠতেই ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই তার মুখের রঙটা পালটে যায়। তিনি ফোনটা হাতে রেখেই বলেন,” তোমরা কথা বলো, আমি একটু আসছি।”
রাবেয়া বেগম বাহিরে চলে গেলে রায়ার অদ্ভুত লাগে বিষয়টা। চিন্তা করতে থাকে, কে কল করল যার কারণে তার মা এখানে কথা না বলে বাহিরে চলে গেল!
ইহান এসে শামসুজ্জামান সাহেবের অন্যপাশে বসে কথাবার্তা বলতে থাকে। ইরিনা বেগমও বসে আছেন। বেশ কিছুক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও রাবেয়া বেগমকে আসতে না দেখে রায়া নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে বাহিরে আসে। বাহিরে আসতেই দেখে রাবেয়া বেগম কেবিনের দিকেই আসছেন। রায়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যান তিনি।
রায়া সন্দিগ্ধচোখে চেয়ে বলে,” কী হয়েছে আম্মু? কে কল করেছিল?”
রাবেয়া বেগম ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলে,” রাইয়ান। রাতের প্লেনের টিকেট কেটেছে। বারোটায় ফ্লাইট। একা আসছে না, তার বিদেশিনী বউকে নিয়ে আসছে। এবার কী হবে?”
” মানে! আম্মু শোনো, ও ওর বউকে নিয়ে আসছে আব্বু এমনিতেই অসুস্থ। এসব নিয়ে আবার বাড়িতে ঝামেলা হলে আব্বুর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে। সেসব তোর বাবা মুখে না বললেও মনে মনে মেনে নিয়েছে। আমি চিন্তা করছি তোদের ব্যাপারে।”
” আমাদের ব্যাপারে কেন?”
” তোকে আর ইহানকে নিয়ে।”
” তোমার ছেলে আমার সংসারের দিকে চোখ দিলে আমি ওর চোখ তুলে নেব আম্মু, মাথায় রেখো।”
রায়া ভেতরে চলে যায়। রাবেয়া বেগম গভীর চিন্তায় পড়ে যায়, এবার কী হবে!
#চলবে………