আমার শহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-০৯

0
4352

#আমার_শহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৯
বারান্দায় মেঝেতে বসে পা লম্বা করে দিয়ে পড়ছিলাম। জারিফ আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। প্রচণ্ড রকমের নড়াচড়া করছে। তার কারনে আমি পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। একটু বিরক্ত হলাম। সেটা জারিফের চোখে পড়তেই সে উঠে দাঁড়ালো। ঘরে যেতে যেতে বলল “আমি ঘরে যাচ্ছি। পড়া শেষ হলে আসিও।” কথাটা শেষ হতেই আমি তার হাত ধরে ফেলি। উনি খুব অবাক দৃষ্টিতে একবার হাতের দিকে তাকালেন তারপর আমার দিকে।ভাবতেও পারেন নি আমি এমন কিছু করবো। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম “বিরক্ত হয়েছিলাম ঠিকি। কিন্তু যেতে তো বলিনি। বসে থাকেন এখানে।” সে আর কিছু না ভেবে আমার পাশে বসে পড়ল। সে সামনে তাকিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে। আমি তার চোখের দিকে তাক করে তাকাতেই দেখলাম সামনের বাড়ির ছাদে একটা মেয়ে কে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। আমি রাগ করে উঠে ঘরে গেলাম। জারিফ আমার পিছু পিছু এসে বলল “কি হল? পড়া শেষ?” আমি তার দিকে রাগ করে তাকিয়ে বললাম “আমি পড়ছিলাম তাই আমার পাশে বসতে বলেছিলাম। অন্য মেয়েকে দেখতে বলিনি।” সে একটু মুচকি হেসে বলল “আজ কাল ভালই খেয়াল রাখছ। ব্যাপার কি?” আমি আরও রেগে গেলাম। একটু চিৎকার কররেই বললাম “আপনার যা ইচ্ছা তাই করেন তাতে আমার কি?” কথাটা বলতে দেরি হল কিন্তু জারিফের আমার কাছে আসতে দেরি হলনা। দ্রুত আমার কাছে এসে দুই হাতে গাল চেপে ধরে আমার ঠোঁট নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো। বেশ কিছুক্ষন পর ছেড়ে দিয়ে আবার সেই আগের জায়গায় দাড়িয়ে আমার দিকে দেখছে।

আমার কাজে সে এতোটা অবাক হল যে লজ্জা পেলো না অনুভব করলো তাকে দেখে সেটাই বুঝতে পারছিনা। হা করে দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জা পেয়ে চোখ নামাতে ভুলে গেছে। আমি একটু শুকনা কেশে বললাম “যা ইচ্ছা তাই করতে বললে। করে ফেললাম।” তবুও সে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। এই বার আমার একটু ভালই অস্বস্তি হচ্ছে। এভাবে কেন তাকিয়ে আছে? মেয়েটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি? আমি ভাল করে বুঝার জন্য আবার তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার মুখে ফু দিলাম। এবার সে একটু বিরক্ত হয়ে সোজা রুমের বাইরে চলে গেলো। কি হল বুঝলাম না। বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো নাকি? যাই হোক ফিলিংস টা কিন্তু জোস ছিল।

একটু পর পর গাড়ির হর্ন বাজছে। জারিফ গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে। আমি রেডি হয়ে গাড়ির কাছে দাড়িয়ে গেলাম। একটু ভেবে পিছনে বসে পরলাম।তারপর জানালা দিয়ে বাইরে দেখলাম। সে মিররে আমাকে একটু দেখে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। আমি হাফ ছেড়ে একটু চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিছুক্ষন পর চোখ খুলে চারপাশে দেখেই আমার মাথা ঘুরায়। এটা তো আমার কলেজের রাস্তা না। তাহলে? কোথায় যাচ্ছি? “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?” আমি চিৎকার করে বললাম। জারিফ মিররে আমার দিকে একবার তাকাল। কোন কথা বললোনা। কিন্তু তার সেই চোখ দেখেই আমি বুঝতে পারলাম এটা আমার পিছনে বসার শাস্তি। আর কিছুই বললাম না। কারন কিছু বলেও এই মুহূর্তে কোন লাভ নেই। কিছুক্ষন পর গাড়ি দাড়াতেই আমি চারিদিকে দেখলাম। সামনে একটা বড় বিল্ডিং এর উপরে লেখা আছে জে আর গ্রুপ অফ ইন্ডাসট্রিজ। ভালো করে বুঝতে পারলাম এটা জারিফের অফিস। জারিফ গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দিলো। আমি নেমে তার দিকে তাকালাম। কিন্তু উনি আমার দিকে না তাকিয়েই সামনে হাটতে লাগলো। আমিও তার সাথে হেটে গেলাম। লিফটে উঠে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটু ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি। লিফট এসে ৮ তলায় দাঁড়ালো। বের হয়ে চারিদকে দেখছি আর জারিফের পিছনে পিছনে হাঁটছি। কিছুক্ষন হাটার পর জারিফের রুমে এসে পৌছালাম। রুমটা অনেক গোছানো। ঢুকেই মনটা ভরে গেলো। আমি চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখছি। তাতেই জারিফ আমার হাত টেনে তার চেয়ারে বসিয়ে দিলো। তারপর নিজে টেবিলে উঠে বসলো। কোন কথা বলছেনা শুধু তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ এভাবে থাকার পর আমি বিরক্ত হয়ে বললাম “কিছু বলছেন না কেন? আমাকে এখানে কেন এনেছেন?” উনি আমার কোন উত্তর দিলনা।গেট এ কেউ একজন নক করলো সে টেবিল থেকে নেমে দাড়িয়ে বলল “কামিং!” একজন মেয়ে ভিতরে ঢুকে বলল “স্যার আপনার মিটিং আছে। ক্লায়েন্ট অপেক্ষা করছে।” জারিফ খুব শান্ত গলায় বলল “আসছি। আর হ্যা ম্যাডামের জন্য আইস্ক্রিম আনতে বল।” তার কথা শেষ হতেই মেয়েটা চলে গেলো। উনি আমার দিকে ঘুরে চোখ লাল করে বললেন “আমি না আসা পর্যন্ত এক পাও নড়বে না।” আমি তার ভয়ে কিছু না বলে মাথা নাড়লাম শুধু।আমি ঘুরে ঘুরে চারিদিকে দেখছিলাম। এমন সময় সেই মেয়েটি আইস্ক্রিম নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঢুকেই আমার দিকে একটু হেসে বলল “ম্যাম আপনার আইস্ক্রিম। আর কিছু লাগলে বলবেন। স্যার আপনার খেয়াল রাখতে বলেছেন আর আপনার সাথে থাকতে বলেছেন।” “আপনার নামটা যেন কি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। “রিনি।” “আচ্ছা রিনি আপনি আমাকে আগে থেকে চেনেন নাকি আপনার স্যার বলার পর থেকে? ” সে একটু হেসে বলল “কি জে বলেন ম্যাডাম। আমাদের পুরো অফিসে আপনাকে সবাই চিনে। আর জানেন স্যার যে কত মেয়ের কাছ থেকে প্রপোজাল পেয়েছিল তা হিসেব করার মতো না। কিন্তু উনি যে আপনাকে বিয়ে করবে তা আসলে সবাই অবাক হয়েছে।” কথাটা শেষ করতেই জারিফ রুমে ঢুকল। জারিফ কে দেখে রিনি বের হয়ে চলে গেলো। রিনি বের হতেই উনি দরজাটা লক করে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার চাহুনি দেখে আমি একটু ঢোক গিললাম। আমি ভালো করেই বুঝতে পারলাম তার চাহুনি কি বলছে। আমার হাতের আইস্ক্রিম টা গলে পড়ে যাচ্ছিল সেদিকে আমার খেয়াল নেই। উনি বললেন আইস্ক্রিম টা শেষ কর। আমি এবার একটু সস্তি পেলাম। উলটা দিকে ঘুরে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে খেতে লাগলাম শেষ করে বাকি অংশ টা বিনে ফেলে দিলাম। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে উনি একটু সময় ও আমার থেকে চোখ ফেরান নি। আমি আবার তার দিকে তাকালাম। উনি একটু একটু করে এগিয়ে এলেন। তারপর আমার চুলের মুঠি ধরে আমার ঠোঁট আয়ত্তে নিয়ে নিলেন।অনেকটা সময় পর ছেড়ে দিলেন। আমি হাপাচ্ছি। কিন্তু আমাকে ছাড়লেন না। আমার কোমরে হাত দিয়ে আমাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলেন। আমি কিছুই বলতে পারছিনা। খুব অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। “তুমি যদি ভেবে থাকো যে আমার থেকে দূরে গিয়ে আমার অত্যাচার থেকে বেঁচে যাবে। তাহলে সেটা তোমার ভুল ধারনা। দূরে গেলে আরও অত্যাচার বাড়বে।” বলেই আমাকে ছেড়ে দিলো।আমি তার কাজে হা হয়ে গেলাম। কিছুই বুঝতে পারলাম না। শুধু মাথা নাড়ালাম। আমাকে হাত ধরে তার চেয়ারে বসে দিলো। তারপর একটা চেয়ার নিয়ে সামনে বসে পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে আছি।আমার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছেনা। আমার চেয়ার টা তার কাছে এনে বলল “আজ ২৪ ঘণ্টা তুমি আমার সামনে থাকবে।এটাই তোমার শাস্তি।” আমি কোন কথা না বলে মাথা নাড়ালাম।

আজ থেকে নিজের মাথা কে রেস্ট নিতে দিবো। আর কখনও বেশি বুঝতে যাবনা। কেন যে পন্ডিতি করে পিছনে বসতে গেলাম। কি দরকার ছিল। সবই তো সহ্য করছি আর একটু করলে কি হতো। নিজের উপরে ভীষণ রাগ হচ্ছে। খেতে বসে বিড়বিড় করে বকছি নিজেকে। ওনার খাওয়া শেষ। আমার জন্যই বসে আছেন। আমার খাওয়া শেষ হলে আমাকে নিয়ে তারপর ঘরে যাবে। আমার ধিরে ধিরে খাওয়া দেখে উনি রাগি চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম। উঠেই ওনার পিছু পিছু ঘরে গেলাম। ঘরে যেতেই উনি আমার কোমর ধরে টান দিয়ে আমাকে তার বুকের সাথে চেপে ধরলেন। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি ঘামছি। “আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে এতো ভয় পাচ্ছ?” তার ধমক শুনে এইবার আমার গ্যান হারানোর উপক্রম। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ওনার ফোন বেজে উঠলো। আমাকে ছেড়ে ফোন তুলতে গেলেন। আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম।খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে তাড়াতাড়ি বারান্দায় চলে গেলাম। কিন্তু সেখানেও রক্ষা হলনা। একটু পর উনি এসে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে গেলেন ঘরে। তারপর বিছানায় বসিয়ে দিলেন। গতদিনের মতো আজকেও এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলেন। আমাকে শুয়ে দিয়ে কম্বল উড়ে দিয়ে বারান্দায় চলে গেলেন। আমি বোকার মতো চেয়ে থাকলাম। তারপর ভাবলাম এখন ঘুমিয়ে জাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলাম।

আমি সিগারেট খেতে খেতে হাসলাম। আজ বেশ জব্দ হয়েছে মেয়েটা। আর জীবনেও আমার কাছ থেকে দূরে থাকার কথা ভাববে না। তারপর গিয়ে বরাবরের মতো তাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। সেও আমার বুকের ভিতরে ঢুকে শুয়ে ঘুমাল।

কিছুদিন পর আমার পরিক্ষা তাই আমি পড়াশুনা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আর জারিফও এখন অফিসে কম যাচ্ছে। আমার পড়াশুনায় খুব হেল্প করে। আমার খেয়ালও রাখে অনেক।আমার সব ছোট ছোট বিষয়ের উপরে খুব বেশি কেয়ার করে। এভাবে আমিও ধিরে ধিরে জারিফের উপরে অনেক টা নিরভর করে ফেলেছি। আমিও তার উপরে এখন চরম ভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। এভাবেই আমার পরিক্ষাও শেষ হয়ে গেলো। আর এই কয়দিনে জারিফের সাথে আমার সম্পর্কটাও অনেকটা ভালো হয়েছে। সকালে টেবিলে বসে নাস্তা করছিলাম। এমন সময় বাবা বললেন “ফারিয়ার তো পরিক্ষা শেষ হল। এখন ভালো জায়গায় ভর্তি হতে হবে। তুমি কি বল জারিফ?” “হ্যা বাবা। ও নিজেই ঠিক করুক কোথায় পড়তে চায়।” বলেই জারিফ আমার দিকে তাকাল। “আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাই বাবা।” আমি বলতেই বাবা বলল “বেশ ভালো কথা।তাহলে এখন সরকারি ভার্সিটিতে পড়বে নাকি বেসরকারি ভার্সিটি তে?” “আসলে বাবা আমি ওর উপরেই সব ছেড়ে দিতে চাই। ও যা চাবে সেভাবেই সব হবে।ওকে একটু ভাবার সময় দেই। ভেবে জানাবে ।” বলেই আমার দিকে তাকাল। আমার ভর্তি নিয়ে এই কথোপকথনের মাঝে কলিং বেল বেজে উঠলো। “আচমা দরজা টা খোল।” মা বললেন। আচমা খালা দরজা খুলে দিতেই মাঝ বয়সি একজন মহিলা আর তার সাথে একজন কম বয়সি মেয়ে প্রবেশ করলো। আমি খুব ভালো করে তাদের দিকে তাকালাম কিন্তু চিন্তে পারলাম না।
চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে