#আমার_শহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৩
আমার ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস। তাই আজও তার ব্যাতিক্রম হলনা। আমি উঠে যেতেই দেখি জারিফ মাঝখানে রাখা কোল বালিশ টা আসটে পৃষ্টে ধরে ঘুমাচ্ছে। রাতে কোথায় ঘুমাব বুঝতে পারছিলাম না। তাই দাড়িয়ে পুরো ঘরটা দেখছিলাম। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম কোথায় কি প্রয়োজন। কোনটা কিভাবে বদলাতে হবে। “এই মেয়ে! ওভাবে দাড়িয়ে না থেকে শুয়ে পড়।“ ধমক শুনেই চমকে জারিফের দিকে তাকাই। বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। এভাবে কেউ ধমক দেয়। এই লোকটা কি ধমক ছাড়া আর কিছুই পারেনা। খুব কম সময় কথা হয়েছে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধু ধমক ই খেয়েছি। মাঝখানে কোল বালিশ টা রেখে বলল ”ও পাশে শুয়ে পড়।“ আমি কোন কথা না বলে শুয়ে পড়লাম। আবার ধমক খাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই।
জারিফ কিছুটা নড়ে উঠতেই আমি তাড়াতাড়ি করে ওয়াস রুমে ঢুকে গেলাম। তাকে যে এভাবে দেখছিলাম না জানি সেটা দেখে ফেলে আবার ধমক না দেয়। সেই ভয়ে চুপ করে দাড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে দেখি কেউ এখনো ঘুম থেকেই উঠেনি। পুরো বাড়ি নিসচুপ! কখন উঠবে কে জানে। সোজা রান্না ঘরে গিয়ে সব খুজে খুজে নাস্তা বানিয়ে রেডি করে নিলাম।সব কাজ শেষ করে গুছিয়ে নিতেই দরজায় চোখ পড়ল। আচমা খালা হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভ্রু কুচকে তাকাতেই বলল “ও মা! দেখ কাণ্ড। নতুন বউ কি করতাছে? এতো সকালে উঠছে।“ তার চিল্লাচিল্লি তে সবাই জেগে গেলো।
আমি ডাইনিং এ মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো দাড়িয়ে আছি। শাশুড়ি মা কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার শ্বশুর মশাই এসব দেখে মুখ টিপে হাসছে। “তুমি এভাবে কথা শুনবেনা। তোমার একটা ব্যাবস্থা করতে হবে। জারিফ ঘুম থেকে উঠুক। তারপর তোমার ব্যাবস্থা করবো” বলেই মা রেগে উপরে চলে গেলেন। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। তার হাসি দেখে আমি নিজেকে আটকাতে পারলাম না। আমিও জোরে শব্দ করে হেসে উঠলাম।
ডাইনিং টেবিলে থম্থমে পরিবেশ কেউ তেমন কথা বলছেনা। বাবা শুধু মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছেন। জারিফ আমার পাশে বসে খাবার টা মুখে তুলবেন এমন সময় “জারিফ” মায়ের ডাক শুনেই উনি চমকে উঠলেন। আমরা সবাই চমকে উঠলাম। “খাওয়া শেষ করে তুমি ফারিয়াকে নিয়ে আজি ভালো কলেজে ভর্তি করাবে।“ “আজই?” উনি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন। “হ্যা আজই।“ “ঠিক আছে মা। আমার এক বন্ধু নতুন কলেজ ওপেন করেছে। ওখানে ভর্তি করালে কেমন হয়?” বাবার দিকে তাকিয়ে বলল। “ভালই হবে। পরিচয় করিয়ে দিবে ভালো করে তাহলে এক্সট্রা কেয়ার নেবে।“ বাবা খেতে খেতে বলল। মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল “এই মেয়েকে আর বাড়িতে রাখা সম্ভব হচ্ছেনা।“ জারিফ মায়ের দিকে প্রশ্ন সুচক দৃষ্টিতে তাকালে তার দিকে তাকিয়ে মা বলেন “ সাংঘাতিক সব কাণ্ড ঘটায় এই মেয়ে। কত সকালে উঠেছে। একা একা সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে রেডি করেছে। আচমা কে কোন কাজ করতে দেয়নি।“ কথার মাঝেই ফোন বেজে উঠলো। মা ফোন ধরতে গেলেন। এবার বাবা আর আমি দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলাম।
জারিফ গাড়ি তে বসে একটু পর পর হর্ন দিয়েই যাচ্ছে। আর আমি এমন ভাবে এক এক করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে লাগলাম যেন শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছি। এক দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে বসলাম। পাশে তাকিয়ে গলা শুকিয়ে গেলো। জারিফ অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। “এতক্ষণ কি করছিলে? কখন থেকে হর্ন দিয়েই যাচ্ছি?” আবার সেই ধমক। কিন্তু এবার তো আমার পুরো দোষ। তাই মাথা পেতে নিয়ে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে “সরি!”। জারিফ আমার সেই চেহারা দেখে হেসে ফেলল। আমিও একটু হাসলাম।
প্রিনসিপালের রুমে বসে আছি। কি এক জরুরি মিটিং এ উনি ব্যাস্ত। কেউ একজন রুমে ঢুকে বলল “কি রে কখন আসলি?” জারিফ হাসি মুখে উঠে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল “এই তো একটু আগে।“ আমার দিকে তাকিয়ে বলল “এই বুঝি তোর পিচ্চি বউ।“ জারিফ পিছনে ঘুরে একটু আমার দিকে তাকিয়ে “হ্যা।“ লোকটা আমার দিকে আসতেই সাইফ ভাইয়া রুমে ঢুকে বলল “তোরা এসেছিস?” আমি এক গাল হেসে বললাম “তুমি জানতে আমরা আসব?” ভাইয়া আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল “হুম। জারিফ আমাকে ফোন করেছিলো।“ প্রিন্সিপ্যাল আসলেন রুমে। আমরা সবাই সালাম দিয়ে দাড়িয়ে গেলাম। উনি বসতে ইশারা করে চেয়ারে বসলেন। তারপর আমরা সব ফর্মালিটি শেষ করে বাইরে এলাম। সাইফ ভাইয়া বলল “কি রে পিচ্চি! কলেজে তো ভর্তি হয়ে গেলি। এখন?” “এটা তো আসলে একটা শাস্তি!” সাইফ ভাইয়া আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালেন। জারিফ সকালের সব ঘটনা তাদের শোনালেন। সব শুনে আমরা সবাই হাসতে লাগলাম। আমি আর সাইফ ভাইয়া এক পাশে দাড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম আর জারিফ শাওন ভাইয়ার সাথে অন্য পাশে দাড়িয়ে সিগারেট টানছিল। আমি ভ্রু কুচকে সেই দিকে তাকাতেই সাইফ ভাইয়া বলল “এসব ছেলেদের অভ্যাস। প্রায় প্রতিটা ছেলের এসব অভ্যাস থাকেই। এগুলা নিয়ে অশান্তি করাটা মোটেও শোভনীয় নয়।“ আমি সাইফ ভাইয়ার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালাম। সে আর কিছু বলল না।
কলেজে প্রথম ক্লাস আমি রেডি হচ্ছি। জারিফ এসে বলল “আমি নিচে আছি। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে এসো।“ আমি মাথা নাড়িয়ে রেডি হতে শুরু করলাম। আমি নিচে গিয়ে দেখি জারিফ গাড়িতে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে ফোন চাপছে। আমি গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালাম। সে খেয়াল করলনা। একটু শব্দ করলাম তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। উনি ফোন থেকে চোখ সরায়ে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার ভালো করে দেখে গাড়িতে গিয়ে বসলেন। আমিও তার পাশের সিটে গিয়ে বসলাম। কেউ কোন কথা বলছিনা। ইংলিশ গান বাজছে। ওনার বোধহয় পছন্দের কোন গান। কলেজের সামনে গাড়ি থামিয়ে আমাকে ইশারা করে নামতে বললেন। আমি নেমে যেতেই উনি গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন অফিসে। কি একটা মিটিং আছে। তার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আমি ক্লাস শেষ করে আসতে আসতে হাঁটছি। এমন সময় কয়েকটা ছেলে এসে আমাকে বলল “নাম কি তোমার?” আমি তাদের উদ্দেশ্য ভালো করে বুঝতে পেরে ভদ্র ভাবে বললাম “ফারিয়া।“ “ও! নতুন বুঝি?। “ ”জি।“ “বাসা কোথায়?” আমি সামনে তাকাতেই জারিফের গাড়ি দেখতে পেলাম। “আমার হাসবেন্ড অপেক্ষা করছে।“ বলেই সেই দিকে হাঁটা ধরলাম। সোজা এসে গাড়িতে বসে পড়লাম। জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে সামনে তাকালাম। জারিফ কিছু না বলে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট এর সামনে দাড়িয়ে গেলো। সামনে তাকিয়েই বলল “নামো।“ আমি কিছু না বলেই নেমে গেলাম। সে সামনে এগুতে লাগলো।আমি তার পিছু পিছু গেলাম। একটা টেবিলে গিয়ে বসে পড়ল। আমাকে ইশারা করে সামনে বসতে বলল। আমি বসে পড়লাম। ওয়েটার কে কফি দিতে বলল। আমি ভালো করে রেস্টুরেন্ট টা ঘুরে দেখছিলাম। এমন সময় আমার সামনে তুড়ি বাজিয়ে জারিফ বলল “এভাবে সং সেজে কলেজে গেলে ছেলেরা ডিস্টার্ব করবেই।“ আমি তার কথায় একটু লজ্জা পেলাম। আসলে আমি একটু বেশিই সেজে ফেলেছি। তা এখন বুঝতে পারলাম। তাই মাথা নিচু করে থাকলাম। ওয়েটার কফি নিয়ে আসলো। “কফি খাও।“ জারিফ বলল। আমি কফি তে চুমুক দিলাম। সামনে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম জারিফ আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
এতো সেজে গুজে কলেজে যাওয়ার কি আছে? এভাবে গেলে ছেলেরা ওকে প্রতিদিন ডিস্টার্ব করতেই থাকবে। আমাকে আগে নিজের ঘর ঠিক করতে হবে তারপর বাকিদের। ভাবতেই জারিফের মাথায় এলো ও এসব নিয়ে এতো অস্থির হচ্ছে কেন? আচ্ছা আমি সব কিছু এতো সহজ ভাবে মেনে নিলাম কেন? মা তো আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। তাহলে? তাহলে কি ওই ১ টা সপ্তাহে পিচ্চি টা আমার মনের কোথাও জায়গা করে নিয়েছে? তাই কি আমি সব কিছু এতো সহজ ভাবে নিলাম। এতো কেয়ার করছি তার প্রতি? ভাবতেই জারিফের চোখ ফারিয়ার উপরে আটকে গেলো। পিচ্চি টার মাঝে কিছু তো একটা আছে। এতদিন ভালো ভাবে খেয়াল করাই হয়নি। আজ তাকে অন্য রকম লাগছে। মায়াবি মুখটা।
বড় বড় চোখে হালকা কাজল কি যে মানিয়েছে। তার চোখের মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
সবাই খেতে বসেছে কিন্তু জারিফের কোন খবর নেই। মা আমাকে ডাকতে পাঠালেন। আমি গিয়ে দেখি উনি বারান্দায় দাড়িয়ে বাইরে দেখছেন। “জারিফ ভাইয়া। মা আপনাকে ডাকছেন।“ আমার কথা শুনে উনি এমন ভাবে তাকালেন যেন আমি মহা অপরাধ করে ফেলেছি। আমি তার দৃষ্টি বুঝতে পারলাম। কি আবার অপরাধ করে ফেললাম। ঠিকি তো বললাম। উনি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর আমার হাত ধরে বললেন “আমি তোমার কে হই? ভাইয়া!” এবার আমার হুশ ফিরল। আমি তাকে ভাইয়া বলেছি। লজ্জায় মাথা কাটা গেলো। আমি আমতা আমতা করে বললাম “মা…আ ডাকছে।“ উনি আমার আর একটু কাছে এসে বললেন “আমি কে হই?” লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। এভাবে কেউ জিজ্ঞেস করে! জানেই তো কে হয়। তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছে। এসব কথা কি মুখে বলা যায়। কেমন মানুষ উনি। যেন বুঝেইনা কিছু। আমি একটু সুযোগ বুঝে এক দৌড়ে নিচে চলে এলাম। আর জারিফ আমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল।
চলবে……