আমার শহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-১৪

0
3403

#আমার_শহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৪

হঠাৎ করেই জারিফ আজ ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তার কাজ নাকি এখনো বাকি আছে। আমি তাকে বারবার জিজ্ঞেস করলেও সে কোন উত্তর দেয় না। কিন্তু আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ বুঝতে পারছি তার চেহারায় চিন্তার ছাপ। কারন টা সে কিছুতেই আমাকে বলছেনা।আমরা পৌঁছে গেলাম। বাসায় ঢুকতেই মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ধরে বললেন “সব ঠিক হয়ে যাবে।” তার কথার মানে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি তার পিছনে দাড়িয়ে থাকা সবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম একবার করে। সবার চেহারা অনেক মলিন তা ভালভাবে বুঝতে পারছি। আমি জারিফের দিকে তাকাতেই সে বলল “ফারিয়া আমাদের হসপিটাল যেতে হবে এখনি।” কথাটা শুনেই বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। “হসপিটাল কেন?” সে আমার দিকে করুন ভাবে তাকিয়ে বলল “আগে চল। নাহলে দেরি হয়ে যাবে।” তার কথা শুনে এবার আমার আরও ভয় করতে লাগলো। আমরা দেরি না করে গাড়িতে উঠে বসলাম। কিছুক্ষন পর হসপিটাল পৌঁছে গেলাম। গিয়েই দেখি সেখানে ফুপা ফুপু সাইফ ভাইয়া সবাই দাড়িয়ে আছে। চার পাশে চোখ বুলিয়ে দেখি বেঞ্চের এক কোনায় আব্বু চোখ বন্ধ করে বসে আছে। আব্বুকে দেখে আমার বুকের ভিতরে আবার মোচড় দিয়ে উঠলো। আমি দৌড়ে গিয়ে আব্বুর পায়ের কাছে বসতেই আব্বু চোখ খুলে আমাকে দেখলেন। তারপর আমাকে দেখেই ধরে কাঁদতে লাগলেন। “কি হয়েছে আব্বু?” আমি খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম। কাঁদতে কাঁদতে বলল “তোর মা…।” আব্বুর কথাটা শেষ না হতেই ওপাশ থেকে ডাক্তার বের হয়ে বললেন “সরি। আমরা ওনাকে বাচাতে পারিনি।” কথাটা শুনেই সবাই কাদতে শুরু করে দিলো। চারিদকে চোখ বুলিয়ে দেখছি কি হচ্ছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। বড় বড় চোখে সবার দিকে তাকিয়ে আছি। আব্বু কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেলো। আমি দাড়িয়ে সব কিছু দেখছি। জারিফ আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমি তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। সে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। একটা রুমে গিয়ে দেখি সাদা কাপড়ে ঢাকা কেউ একজন শুয়ে আছে। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে তার মুখের কাপড় উঠিয়ে দেখি আম্মু। আমি সেন্স হারিয়ে ফেলি।

ফারিয়ার আম্মু স্ট্রোক করে মারা গিয়েছে অনেকদিন হয়ে গেলো। কিন্তু ফারিয়া এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। ঠিক মতো কারও সাথে কথা বলেনা।একা একা থাকে। ঠিক মতো ভার্সিটিতেও যায়না। বিষয়টা হয়ত সে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। খুব কষ্ট পেয়েছে।অফিস থেকে ফিরে দেখি সে অন্ধকার ঘরে মেঝেতে বসে আছে। আমি তার কাছে গিয়ে বসে বললাম “মন খারাপ?” আমার কথা শুনে সে চমকে উঠলো। হয়ত অন্য মনস্ক হয়ে ছিল। কিছু না বলে শুধু মাথা নেড়ে না বলল। বলেই উঠে যেতে লাগলো। আমি ওর হাত ধরে উঠে ওর সামনে দাঁড়ালাম। ওর একটু কাছে গিয়ে বললাম “কি হয়েছে আমাকে বল?” “কিছু হয়নি।” আমার উপরে বিরক্ত হয়ে কিছুটা চেচিয়ে কথাটা বলল। আমিও তার হাতটা ছেড়ে দিলাম। তাকে আর বিরক্ত করতে চাইনা। সে চলে গেলো। আমি একটুখন দাড়িয়ে থেকে ওয়াশ রুমে চলে গেলাম।

স্নিগ্ধ সকালের আলোর সাথে ঠাণ্ডা হাওয়া। বেশ ভালো লাগছে। দূর আকাশে সূর্য উঠছে লালা আভা নিয়ে। আমি নিশ্চুপ দাড়িয়ে দেখছি। কিন্তু এসবের কিছুই আমার মন ছুঁতে পারছেনা। নিজেকে কেমন অসহায় লাগছে। এমন সময় জারিফ হাপাতে হাপাতে কোথা থেকে আসলো। আমি শব্দ পেয়ে তার দিকে ফিরে তাকালাম। তাকাতেই দেখলাম সে অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বুঝতে না পেরে তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালাম। সে এগিয়ে এসে আমার সামনে দাড়িয়ে বলল “এতো সকালে একা একা ছাদে কি করছ? কাউকে কিছু না বলে এখানে এসেছ কেন?” “কিছুনা” বলেই মাথাটা নিচু করে নিলাম। সে আমার আর একটু কাছে এসে দাড়িয়ে গেলো। তারপর আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি তার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলাম। সে আমার হাত ধরে আমাকে তার সামনে এনে দাড় করাল। খুব শক্ত করে হাত ধরার কারনে আমি খুব ব্যাথা পাচ্ছিলাম। কিন্তু সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। সে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকালাম। কিন্তু তার চোখে তাকিয়েই থমকে গেলাম। রাগ নেই। আছে কষ্ট আর এক রাশ অভিমান। “তুমি কি নিজেকে মৃত ভাবছ। তোমার আচরণ তাই বলছে। প্রতিটা মানুষের জীবনে কষ্ট থাকে। কেউ প্রকাশ করতে পারেনা আর কেউ করে। কিন্তু সব কিছুর পরেও বাকি মানুষ দের কথা ভাবতে হয়।এটা একজন জীবিত মানুষের দায়িত্তের মধ্যে পড়ে। তার আশে পাশের মানুষের উপরে কোন আচরনের কি প্রভাব পড়বে তা ভাবতে হয়। কিন্তু তুমি তো এসবের বাইরে। তোমার মাঝে কোন অনুভুতি নেই। থাকলেও সেটা প্রকাশ করার ভাষা তুমি জাননা। তুমি কারও কথা ভাবনা। কারও কষ্ট তোমাকে ছুঁতে পারেনা। সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এতো দিনেও আমি তোমার মনে এতো টুকু জায়গা করে নিতে পারিনি যাতে আমার কষ্ট তুমি অনুভব করতে পার। আমি ব্যর্থ।” কথা শেষ করেই জারিফ আমাকে ছেড়ে দিয়ে নিচে নেমে গেলো। কথা গুলা সে খুব স্বাভাবিক ভাবে বললেও আমার মনে দাগ কেটে গেলো। আমি তার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছি। দু চোখ বেয়ে পানি আপন মনে গড়িয়ে পড়ছে। আমি নিচে বসে পড়লাম। সত্যিই তো আমি জারিফের কথা ভাবিই নি। ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট পেতে দেখলে কত কষ্ট হয় তা যেন জারিফের শেষের কয়েকটা কথা ভালো করে বুঝিয়ে দিলো। কিভাবে সহ্য করেছে জারিফ। আমি তো পারছিনা। আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না।চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম।

জারিফ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। আমি তার সামনে দাড়িয়ে আছি। সে একবারও আমার দিকে তাকালনা। রেডি হয়ে নিচে চলে গেলো। আমিও তার পিছু পিছু নিচে গেলাম। কিন্তু সে নিচে গিয়ে বলল “আম্মু আমার ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে। আমি অফিসে যাচ্ছি।” “খেয়ে যা বাবা।” “না আম্মু দেরি হয়ে যাবে।” বলেই বেরিয়ে গেলো। আমি তার পিছনে দাড়িয়ে থাকলাম। এক বার আমার দিকে তাকালনা। মা আমার দিকে তাকিয়ে দেখল। আমি তার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই আমার চোখের পানি বাধ মানলনা। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। মা আমাকে সামলিয়ে নিয়ে বললেন “জারিফের সাথে ঝগড়া হয়েছে বুঝি?” আমি মাথা নেড়ে না বললাম। “তাহলে?” “অভিমান করেছে।” বলতেই মা হেসে ফেললেন। আমিও হাসলাম। আমার হাসি দেখে উনি বললেন “এভাবে সব সময় হাসবে। মন খারাপ করে থাকলে দেখতে ভালো লাগেনা।” আমি মাথা নেড়ে ওনার কথায় সম্মতি দিলাম। উনি আবার মাথায় হাত দিয়ে বললেন “তাহলে এখন বরের অভিমান ভাঙ্গার মিশন শুরু কর।” আমি ওনার কথা বুঝতে পেরে একটু হেসে রান্না ঘরে চলে গেলাম। জারিফের পছন্দের খাবার রান্না করে আমি অফিসে নিয়ে যাব। তাই তাড়াতাড়ি করে রান্না করতে শুরু করলাম। মা এসে একবার দেখে গেলো। সব কিছু জারিফের পছন্দ মতো আমাকে বলে দিয়ে গেলো। আমি খুশি মনে রান্না করছি আর ভাবছি জারিফ কি এগুলো খাবে। একটু ভেবে নিজে নিজেই বলে উঠলাম “খাবেনা মানে খেতেই হবে।আমিও দেখি কিভাবে না খেয়ে থাকে। আমার অনুভুতি আছে আর সেটা প্রকাশ ও করতে পারি।”
চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে