#আমার_শহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
সূচনা পর্ব
লেখক- এ রহমান
“তোমাকে এই বিয়ে করতেই হবে। আমি কোন কথা শুনতে চাইনা। এই মেয়েকেই আমার ঘরের বউ বানাতে চাই। এটা শুধু আমার না তোমার বাবারও সিদ্ধান্ত। তোমার বাবা আসছেন আজ রাতে।“ কথাগুলো ঘর ভর্তি মানুষের সামনে জারিফ ভাইয়াকে তার আম্মু বলল।
জারিফ ভাইয়া বোকার মতো দাড়িয়ে তার মায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে দেখে আছে। “এতো কথা বলার পরও আম্মু তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়ছেনা। কি যে দেখেছে এই মেয়ের মধ্যে। এই মেয়েকেই তার বউ বানাতে চায়। আর আম্মুর জেদ তো কখনই এরকম ছিলনা। তাহলে এই একটা বিষয় নিয়ে আম্মু কেন এরকম করে জেদ করছে। তাছাড়া ফারিয়ার বাড়ির লোকজনও তো তেমন রাজি না। তারা তাদের মেয়েকে আরও পড়াতে চায়। সবে মাত্র এস এস সি পাশ করেছে। আল্লাহ !! এতো ছোট একটা মেয়েকে আমি কিভাবে বিয়ে করি। আম্মু কেন বুঝতে পারছেনা।“
“আম্মু আমার কথাটা শুনো। ও তো অনেক ছোট। তাছাড়াও সবাই চায় ও আরও পড়াশুনা করবে।“
“তো আমি কখন বলেছি যে সে পড়বে না। অবশ্যই পড়বে। আমি ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ওকে ভালো কলেজে ভর্তি করাবো। আমি জানি সে খুব ভালো ছাত্রি। আর বারবার ওকে এভাবে ছোট বলবে না। ভুলে যেওনা আমার বিয়ের সময় আমিও এতো টুকু ছিলাম। আর এভাবেই তোমাকে মানুষ করেছি ।”
কিন্তু আম্মু…
কোন কিন্তু না জারিফ। আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নাও। তোমার বাবা রাতেই চলে আসবে। আমরা তখন এসব নিয়ে কথা বলব।“
“আম্মু তুমি ফারিয়াকে জিজ্ঞেস করেছো ? ওর মতামত কি জানতে চেয়েছ ?”
“শোন জারিফ ! ফারিয়া অমন মেয়ে না। ওর পরিবার যা সিদ্ধান্ত নেবে ও তাই মেনে নিবে। ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। এখন তোমরা ছোটরা এই ঘর থেকে বাইরে যাও। আমি বড় দের সাথে কথা বলতে চাই।”
আমি বাইরে এসে বারান্দায় চেয়ারে বসে পড়লাম। “ এই মেয়ে তুমি ভিতরে কোন কথা বললে না কেন ? ” আচমকা জারিফ ভাইয়ার ধমক শুনে চমকে উঠলাম। আমি যে বড়দের মাঝে কথা বলিনা এতদিনে সে হয়ত সেটা বুঝে গেছে। তবুও আমাকে এভাবে ধমকাচ্ছে।
“ও কিছু বলবে সেই সাহস ওর নেই। ও বড়দের মাঝে কথা বলেনা। কখনই আমরা ওকে এটা করতে দেখিনি।“ আমি কিছু বলার আগেই সাইফ ভাইয়া বলল।
সবাই কিছুক্ষনের জন্য চুপ হয়ে গেলো। জারিফ ভাইয়া শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো বোঝার জন্য আমি কি ভাবছি।
১ সপ্তাহ আগে তারা গ্রামে এসেছিলো বেড়াতে। সাইফ ভাইয়ার বন্ধু জারিফ ভাইয়া। সাইফ আমার এক মাত্র ফুপুর ছেলে। দুজনি বিদেশ থেকে পড়া শেষ করে এসেছে। তাই গ্রামে বেড়াতে এসেছে। কিন্তু এই এক সপ্তাহেই জারিফ ভাইয়ার মা আমার মধ্যে কি এমন দেখলেন যে আমাকেই তার ছেলের বউ করতে চান। আব্বু আম্মু কেউই বিষয়টাকে ভালো ভাবে দেখছেন না। তবে এখানে ফুপাজির সম্মতি আছে তাই কেউ মুখ ফুটে কিছুই বলছেন না। কারন ফুপাজিকে আব্বুরা ৩ ভাই খুব সম্মান করে। ওনার কথায় কেউ কখনও অমত করেনি।জারিফ ভাইয়ার বাবা আর ফুপাজি খুব ভালো বন্ধু। তারা দুজনেই আসছেন আজ রাতে আমার বিয়ের কথা বলতে। তারা আসার পর যদি সব ঠিক থাকে তাহলে আজ রাতেই আমাদের বিয়ে হবে আর কাল আমরা ঢাকায় চলে যাব। এটা ভেবেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন খা খা করে উঠলো। আমি তো গ্রামেই বড় হয়েছি। শহরে কখনও যাব তা ভাবিনি। আমি এবার এস এস সি তে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি। তাই পরিবারের সবাই আমাকে পড়াতে চায়। আমিও পড়তে চাই। কিন্তু এরকম কিছু হবে তা আমি ভাবিনি।
আমি পাশে ঘুরে তাকাতেই দেখলাম একটা ইটের টুকরো সোজা জারিফ ভাইয়ার দিকে আসছে। আমি ঝড়ের গতিতে জারিফ ভাইয়াকে এক ধাক্কা দিলাম। কিন্তু এমন কিছু হবে তা আমার ধারনা ছিলোনা। ধাক্কার টাল সামলাতে না পেরে শুধু জারিফ ভাইয়া না আমিও তার উপরে পাশে থাকা চৌকির উপর পড়ে গেলাম। আমার দুই হাত তার বুকের উপর। আমি পুরোটাই তার উপরে ভর দিয়ে শুয়ে আছি। সে দুইহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে আছে। আমি তার বুকের ধুকধুকানি শব্দ শুনতে পাচ্ছি। হাতের উপর থেকে চোখ সরিয়ে তার চোখে তাকাতেই আমার শরীর কেঁপে উঠলো। মুহূর্তেই ঘেমে যাচ্ছি। আমি উঠে দাঁড়ালাম। সাইফ ভাইয়া আর সীমা আমাদের কাছে এসে বলল “তোরা ঠিক আছিস তো?” আমি কিছু বলতে পারলাম না। আমার মুখে কথা আঁতকে গেছিলো। আমি আর সেখানে দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। এক দৌড়ে ঘরে চলে এলাম। কেমন জানি একটা অনুভুতি। আগে কখনও এমন হয়নি তো। তাহলে আজ কেন এমন হল। আমি তো সবার চোখে তাকিয়ে কথা বলি। তখন তো আমার এরকম শরীর কাপেনি কিংবা গরমে ঘেমেও যাইনি। তাহলে এখন কেন এমন হচ্ছে।
“ তুই ঠিক আছিস তো? ”সীমার কথায় বাস্তবে আসলাম।
“ হ্যা। ঠিক আছি। ” “ যেভাবে তার গায়ের উপরে পড়ে গিয়েছিলি আমি তো ভাবলাম আবার ফিট হয়ে গেলি না তো। তোর তো আবার অন্যের গায়ে পড়ার একদম অভ্যাস নাই। ” ফিক করে হেসে দিলো।
“ কি সব বলছিস? আর গায়ে পড়া মানে কি? ” আমি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলাম।
সীমা হতাশ হয়ে বলল“ জারিফ ভাইয়ার কপালে খুব দুঃখ আছে রে। এই জন্যই হয়ত সে তোকে বিয়ে করতে চাচ্ছেনা। তোকে বিয়ে করলে প্রেম করা শেখাতেই তার রোমাঞ্চ করার মুড চলে যাবে। ”
তার সব কথা না বুঝলেও রোমাঞ্চ করার কথা বুঝতে আমার কষ্ট হলনা। সীমার কান ধরে বললাম
“ খুব পেকেছিস। সাইফ ভাইয়া আর ফুপিকে বলব তোর বিয়ের ব্যাবস্থা করতে? ”
দুজন মিলে হাসতে লাগলাম। সীমা সাইফ ভাইয়ার বোন আর মানে ফুপুর মেয়ে। সেও আমার সাথেই এস এস সি পরিক্ষা দিয়েছে।
আমরা ছোটরা সবাই বসে গল্প করছিলাম। এমন সময় সাইফ ভাইয়া এসে বলল “ বাবা এসেছে। সবাইকে ঘরে যেতে বলল। ” বুকের মাঝে কেমন ধক করে উঠলো। হাত পা অসাড় হয়ে গেলো। হাটতে পারব কিনা জানিনা। তবুও দাড়িয়ে গেলাম। ফুপাজি ডেকেছে যেতেই হবে। বড় বড় ধাপ ফেলে চলে গেলাম ঘরে। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি। ফুপাজি আমাকে দেখতে পেয়ে উঠে এসে আমার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়ে জারিফ ভাইয়ার বাবার পাশে বসিয়ে দিলেন। আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। সবাই চুপচাপ আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।
“ এই মেয়ের জন্য তুমি তোমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছ। ” জারিফ ভাইয়ার মা তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
কয়দিন আগে আমরা ঘুরতে গিয়েছিলাম পুকুর পাড়ে। সবাই বসে গল্প করছিলো। অন্যমনস্ক হয়ে দাড়িয়ে ছিলেন জারিফ ভাইয়া। আমি কি মনে করে তার দিকে তাকাতেই দেখি উনি একদম পুকুরের ধারে এসে গেছেন। একপা এগলেই পড়ে যাবেন। আমি দৌড়ে গিয়ে তার হাত টেনে ধরি। উনি পাশে থাকা গাছটা আক্ড়ে ধরেন। সবাই ছুটে আসে। আনটি তো ভয়ে প্রায় কেদে দেয়। সবাই নিজেদের মতো ঘটনা টা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। নিজে বেঁচে যাওয়ার চেয়ে আমার ওনাকে বাঁচানোটাই ওনাকে বেশি আশ্চর্য করে। আমরা সবাই বাড়ি চলে এলে উনি আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কিভাবে বুঝতে পেরেছিলাম উনি পড়ে যাচ্ছেন। আমি সেই কথার কোন উত্তর দিতে পারিনি। কারন আমিও জানতাম না কিভাবে বুঝতে পেরেছি।
অনেক রাত ধরে অনেক কথা চলল। কথার পিঠে কথা। আমি তাদের কথা শুনতে শুনতে হাপিয়ে উঠেছি। অবশেষে ফুপাজি আব্বুর হাত ধরে বলল “ ভাই জান আপনার মেয়ের আমি কোন ক্ষতি হতে দিবনা। আপনি নিশ্চিন্তে জারিফের হাতে মেয়েকে তুলে দেন। আমি কথা দিচ্ছি জারিফ খুব ভালো ছেলে। ও আপনার মেয়েকে খুব ভালো রাখবে। ”
আব্বু ফুপাজির কথা শুনে বসে পড়ল। মাথা নিচু করে একটু চিন্তা করে বলল “ তুমি যা ভালো মনে কর তাই কর। মেয়ের দায়িত্ব আমি তোমার হাতে তুলে দিলাম। ”
চলবে।