#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব২১( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripte
পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢোলে পড়েছে। থেকে থেকে প্রকৃতি তার ঠান্ডা বাতাস মেলে ধরছে। চারিদিক অন্ধকার হতে লাগলো। রাস্তা ঘাটে কৃত্রিম লাইট গুলো এক এক করে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। গাড়ির মধ্যে চিত্রা কে জাপ্টে ধরে আছে তুষার। কতক্ষণ ব্যাপি ধরে আছে জানা নেই। সময় টা যেনো থমকে গেছে। আশেপাশে যে অন্ধকার হয়ে আসছে সেদিকে তাদের খেয়াল নেই। হঠাৎ আকস্মিক গাড়ির হর্ণে তুষারের ভ্রম ভাঙে। আশেপাশে একবার চোখ বুলায়। চিত্রা গুটিশুটি হয়ে তুষারের শার্টের কলার এক হাত দিয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। তুষার চিত্রার চুলের ভাজে হাত ডুবিয়ে শীতল কন্ঠে বলে উঠে-
-“ যন্ত্রণা কমেছে?
চিত্রা চোখ মেলে তাকায়। বুকে মাথা রেখেই উপর নিচ মাথা ঝাকায়। যার মানে কিছুটা কমেছে।
-“ এভাবেই থাকবেন নাকি বাসায় ফিরবেন? রাত হচ্ছে।
চিত্রা চট করে মাথা তুলে সোজা হয়। আশেপাশে চোখ বুলোয়। অলরেডি অন্ধকার হয়ে এসেছে। ব্যাগ থেকে ফোন টা বের করে সময় দেখে নিলো। শুষ্ক ঠোঁট দুটো জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে কাচুমাচু হয়ে বলল-
-“ বাসায় ফিরবো আমি,একটু পৌঁছে দিন না।
তুষার সময় ব্যায় করলো না আর গাড়ি স্টার্ট দিলো।
-“ এসির পাওয়ার টা একটু কমিয়ে দিন না ঠান্ডা লাগছে ভীষণ।
তুষার এসির পাওয়ার একদম লো করে দিলো। চিত্রা সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে ফের চোখ বন্ধ করে ফেললো। তুষার আড়চোখে একবার দেখে নিলো।
-“ আপনার যন্ত্রণার কথাটা আমায় জানালেন না তো চিত্রা।
-“ বুকটা ফেড়ে দেখানো গেলে দেখিয়ে দিতাম। মুখ থেকে কথা গুলো বের হতে চাইছে না। শ্বাসরুদ্ধ করে তুলছে।
চিত্রা চোখ বন্ধ রেখেই কথাটা বলে। তুষার চিত্রার ডান হাতের উপর নিজের বা হাত রাখে।
-“ আপনার জীবনে আসাটা কি বড্ড দেরি হয়ে গেছে আমার?
চিত্রা চোখ মেললো। সিটে মাথা রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে স্মিত হেসে বলল-
-“ আপনি জীবনে আরো কয়েকটা বছর আগে আসলে জীবনটা এখনকার থেকে আরো সুন্দর হতো। আমার অনুভূতি গুলো পূর্ণতা পেত। আমার ভালোবাসা ভালো লাগার প্রথম পুরুষ হতেন আপনি।
তুষার গম্ভীর হলো। চিত্রার বা হাত উচু করতেই চোখ গেলো অনামিকা আঙুলে। কয়েকদিন আগে এই আংটি টা নিজ হাতে পড়িয়ে দিয়েছি। হাত টায় চুমু খেয়ে বলল-
-“ কাউকে ভালোবেসে ঠকে গেছেন মিস চিত্রা? যদি ঠকে থাকেন তাহলে শুকরিয়া আদায় করবেন দু রাকাআত নফল নামাজ পড়ে।
চিত্রা নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলো। পলকহীনভাবে তুষারের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ খারাপ লাগছে না?
তুষারের অকপট জবাব-
-“ একটু ও না।
-“ আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।
-“ কেনো? আপনার ভালোবাসার প্রথম পুরুষ হতে পারি নি সেজন্য?
চিত্রা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। তুষার ইশারায় চিত্রা কে কাছে আসতে বললো। চিত্রা কিছুটা তুষারের দিকে চেপে বসলো। তুষার নিজের কাঁধ দেখিয়ে সেখানে মাথা রাখতে বললো। চিত্রা বাধ্য মেয়ের মতন তুষারের কাঁধে মাথা রাখলো। তুষার গাড়ি চালাতে চালাতে বলল-
-“ কাকে ভালোবেসে ঠকে গেছেন সেটা আজ শুনতে চাই না। কোনো একদিন নিরালায় বসে আপনার দুঃখবিলাসের গল্প শুনবো কেমন?আর আমি আপনার ভালোবাসার প্রথম পুরুষ হতে পারি নি তো কি হয়েছে,শেষাংশে তো শুধু আমিই থাকবো৷ প্রথম পুরুষ, নারী যে কেউই হতে পারে কিন্তু শেষাংশে সবাই যেতে পারে না। আমি আপনার শেষাংশের উপসংহার। এই আমিতেই আপনার মুক্তি।
চিত্রা প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। চুপ রইলো। ঠিকই তো বলেছে,সবাই তো সূচনায় আসে কিন্তু উপসংহারে তো আর সবাই থাকতে পারে না।
তুষার চিত্রা দের বাসার সামনে গাড়ি থামায়। চিত্রা বাড়ির দিকে তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যায়। পেছনে ঘুরে তুষারের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ সাবধানে যাবেন।
তুষার মাথা নাড়ালো। কিয়ৎ ক্ষন চুপ থেকে বলে-
-“ নফল নামাজ টা মনে করে পড়ে নিবেন।
চিত্রা প্রশ্নাতীত হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-“ নফল নামাজ কেনো?
-“ ঐ যে তখন বললাম নফল নামাজ পড়ে শুকরিয়া আদায় করবেন।
-“ আচ্ছা পড়বো। আসি।
চিত্রা চলে গেলো। তুষার চিত্রার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
আজও সেই চায়ের টঙয়ের দোকানের সামনে বেঞ্চ টাতে বসে অপেক্ষা করছে রাতুল অধরার জন্য। অধরা তাড়াহুড়ো করে টঙের দোকানে এসে দাঁড়িয়ে অপরাধীর ন্যায় বলে-
-“ খুব কি অপেক্ষা করালাম আপনায়?
রাতুল স্মিত হেঁসে বলে-
-“ খুব একটা করতে হয় নি।
রাতুল গলা ছেড়ে দোকান দার কে বলল-
-“ মামা দুকাপ মালাই চা দিন।
ইশারায় রাতুল অধরাকে বেঞ্চে বসতে বললো। অধরা গায়ের চাদর ভালো করে জড়িয়ে ধরে বসে বেঞ্চ টাতে। দোকানদার দুকাপ চা রাতুল আর অধরার কাছে এনে বলে-
-“ এই যে মামা আপনাগো চা নেন।
রাতুল সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দিয়ে একটা কাপ উঠিয়ে অধরার দিকে বাড়িয়ে দেয়। অধরা চায়ের কাপ হাতে নেয়। রাতুল নিজের কাপ টা উঠিয়ে সেটায় চুমুক বসায়। চা খেতে খেতে রাতুল অধরাকে জিজ্ঞেস করে, –
-“ আপনার ফিউচার প্ল্যান কি অধরা?
অধরা চা খাওয়া থামিয়ে দিলো। দৃষ্টি আকাশ পানে রেখে বলল-
-“ অনেক পড়াশোনা করা।নিজের আলাদা পরিচয় গড়ে তোলা।
রাতুল ফট করে বলে উঠে –
-“ বিয়ে করার প্ল্যান নেই?
অধরা তপ্ত শ্বাস ফেললো। কাপে থাকা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল-
-“ জীবন কি একা চলে? চলে না তো। জীবনে চলার পথে একটা সঙ্গীর প্রয়োজন হয়। আর যেদিন মনে হবে মনের মত কাউকে পেয়ে গেছি সেদিন অবশ্যই বিয়ে করবো।
-” কেমন সঙ্গী চান?
-“ খুব সাধারন সঙ্গী চাই, নির্ভেজাল সহজসরল প্রকৃতির। যে রোজ নিয়ম করে একটু ভালোবাসবে আমায়।
-“ একটু না রোজ নিয়ম করে আপনায় অনেকটাই ভালোবাসবো মিস অধরা।
রাতুলের বিরবির করে বলা কথাটা অধরার কান অব্দি পৌঁছালো না।
-“ কিছু বললেন?
-“ হ্যাঁ, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
-“ হুম করুন।
-“ কখনও কাউকে ভালোবেসেছেন?
অধরা চুপ হয়ে গেলো। মুখে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। চশমা টা ঠেলে বলল-
-“ জ্বি।
মুহূর্তে মুখ খানা চুপসে যায় রাতুলের।
-“ খুব ভালোবাসেন?
-“ হুমম।
-“ বিয়ে করবেন নিশ্চয়ই তাকে?
-“ না।
রাতুলের মুখের এক্সপ্রেশন পাল্টে যায়।
-“ না কেনো?
-“ কখনও কি দেখেছেন বামুন কে চাঁদের নাগাল পেতে? সে হচ্ছে আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা হাজার লক্ষ তারার মাঝে এক চাঁদ। তাকে ছোঁয়া যায় না সেখানে ধরা তো দূর।
-“ নিজেকে এতো মূল্যহীন ভাবছেন কেনো? আপনি কারো কাছে এক মূল্যবান কোহিনূর।
-“ হয়তো।
-“ আচ্ছা চা তো শেষ। তবে বাসায় ফেরা হোক। আপনার ড্রাইভার এসেছে?
-“ না।
-“ আমি পৌঁছে দিয়ে আসলে কোনো সমস্যা হবে?
-“ না সমস্যা হবে না বরং উপকার ই হবে।
-“ আচ্ছা চলুন তাহলে।
-“ এই ছোট প্যাকেট এক কাপ কফি দাও তো।
তৃষ্ণা কফি খাচ্ছিলো। রাফিকে তার থেকে কিছুটা দূরে বসে কথাটা বলতেই আড়চোখে তাকায়। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলে-
-“ রান্না ঘরে গিয়ে দেখেন বেচে আছে হয়তো কফি। নিয়ে খান।
রাফি ভ্রু কুঁচকায়।
-“ আশ্চর্য তুমি গিয়ে আনতে পারছো না?
-“ আমি খাচ্ছি।
-“ আমিও তো খাবো।
-“ আমি কি আটকিয়েছি?
-“ আটকাও নি তবে এনেও তো দিচ্ছো না। বিয়ের পর স্বামী কফি খেতে চাইলে এভাবেই না করে দিবে মুখের উপর?
-” না গরম কফি এনে মুখের ভেতর ঢেলে দিব। সে শুধু গিলবে।
-“ আচ্ছা যাও যাও এখন কফি নিয়ে আসো৷ বিয়ের পরে কি করবে না করবে পরের টা পরে দেখা যাবে।
তৃষ্ণা তার আধখাওয়া কফির মগটা রাফির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে-
-“ কফিটা খেতে পারবেন?
-“ তোমার আধখাওয়া কফি টা আমি খাবো কেনো?
-“ ওয়াজ মাহফিলে যে হুজুর রা বলে শুনেন নি? আধখাওয়া কোনো কিছু খেলে মহব্বত বাড়ে।
-“ সেটা তো স্বামী স্ত্রী এর ক্ষেত্রে। কাজিনদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
মুহুর্তে তৃষ্ণার মুখের আকৃতি পরিবর্তন হলো। কফির মগটা শব্দ করে সেন্টার টেবিলে রেখে বলল-
-“ তো আমাকে হুকুম না করে আপনার ফরমায়েশ খাটার জন্য বিয়ে করে বউ নিয়ে আসেন চাচার ছেলে ভাই।
#চলবে?
#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব২২( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti
-“ তোকে না বললাম আজ ভার্সিটি যেতে না। রিয়াদ আর সিমি আসছে,তুই বাসায় না থাকলে বিষয় টা কেমন দেখায় বলতো?
চিত্রা ভার্সিটি তে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলো আর তখনই চয়নিকা বেগম কথাটা বলে উঠেন। চিত্রা একবার চয়নিকা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ওদের আসার জন্য কি আমার ভার্সিটির ক্লাস মিস দিতে হবে? এমনিতেই তো বিয়ের জন্য কয়েক দিন যেতে পারবো না।
-“ সেটা না হয় বুঝলাম কিন্তু আজকের দিন টা না যা। খুব তো আহামরি ক্ষতি হবে না।
চিত্রা বিরক্ত হলো। কাটকাট গলায় বলল-
-“ আমার যে কি ক্ষতি টা হবে তা যদি জানতে তাহলে আর এটা বলতে না। যাই হোক তোমার কথা রাখছি ভার্সিটি যাচ্ছি না।
চিত্রা রুমে চলে গেলো ব্যাগ নিয়ে। চায়নিকা বেগম রান্না ঘরে গেলে রিয়াদের জন্য রান্নার ব্যাবস্থা করতে।
চিত্রা রুমে এসে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে তৃষ্ণাকে জানিয়ে দিলো সে আজ ভার্সিটি যেতে পারবে না। তৃষ্ণা কথাটা শুনে সে ও বলে দিলো সেও আজ তাহলে যাবে না।
দুপুরের শেষ প্রহরে আহমেদ বাড়িতে রিয়াদ ও তার স্ত্রী সিমির আগমন ঘটে। সিমি সম্পর্কে চিত্রার মামা তো বোন আর রিয়াদ সম্পর্কে খালাতো ভাই। সিমি বাড়িতে ঢুকেই চয়নিকা বেগম কে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী হয়ে পড়ে। রিয়াদ চয়নিকা বেগমের সাথে কুশলাদী করে জিজ্ঞেস করে –
-“ চিত্রা কোথায়,আর খালু কোথায়?
চয়নিকা বেগম চিত্রার ঘরের দিকে ইশারা করে বলে-
-“ চিত্রা ওর রুমে আর তোর খালু সে তো তার কাজে।
-“ চিত্রা আপু এখনও রুম থেকে বের হলো না আমাদের দেখতে?
মন খারাপ করে কথাটা বলল সিমি। চায়নিকা বেগম হেসে বলেন-
-“ হয়তো ঘুমিয়েছে। তোদের গলার আওয়াজ শুনলে নিশ্চয়ই আসতো।
রিয়াদ আর সিমি কে তাদের জন্য রুম দেখিয়ে দেয়। রিয়াদ একবার চিত্রার রুমের দিকে তাকিয়ে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে চলে যায়।
চিত্রা ঘুমায় নি মূলত ইচ্ছে করেই রুমের দরজা বন্ধ করে বিছানায় থম মেরে বসে আছে। সে চাইছে না রিয়াদের মুখোমুখি হতে। এই ছেলের থেকে যথাসাধ্য দূরে থাকার চেষ্টা করবে চিত্রা।
প্রান্তিকের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে তুষার রাতুল। তুষার আজ রাতুল দের বাসায় গিয়েছিল। রাতুলের মা কে পার্সোনালি ইনভাইট করতে তার বিয়ের। যেহেতু হাতে বেশি সময় নেই,কিছু কাছের মানুষকে তুষার নিজে গিয়েই ইনভাইট করছে। রাতুলের মা রোমিলা বেগম তুষারের পছন্দ অনুযায়ী সব খাবার রেঁধেছিলেন। তুষার রাতুল আর রোমিলা বেগম তিনজনে দুপুরের ভোজন সেরে নেয়। টুকটাক আলাপচারিতা করে তিনটের দিকে চলে আসে। তুষারের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে রাতুল বলে উঠে –
-“ আমি যদি তোর কাছে কিছু চাই ফিরিয়ে দিবি আমায় তুষার?
তুষার ভ্রু কুঁচকায়।
-“ সাধ্যমতো চেষ্টা করবো যেনো না ফেরাতে হয়।
রাতুল স্মিত হাসে।
-“ সাধ্যের বাহিরে কিছু চাইবো না।
-“ তাহলে ফেরানোর প্রশ্নই আসছে না।
-“ ভরসা দিচ্ছিস?
-“ না আশ্বাস দিচ্ছি।
-“ তোর বিয়ে টা মিটে যাক তোর কাছে, না না তোদের কাছে একটা প্রস্তাব রাখতে চাই।
তুষার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে রাতুলের পানে চাইলো। কিছু একটা আন্দাজ করলো। বুঝতে পারলো কি পারলো না তা বুঝা গেলো না।
-“ আজ ভার্সিটি ছিলো না তোমার?
তৃষ্ণা কে এই দুপুরে বাসায় দেখে অবাক হয়ে বলে রাফি। মূলত তৃষ্ণার বাসায় ফিরতে বিকেল হয়। সেখানে আজ দুপুরে বাসায়। সকালে ব্যাবসার কাজে ভোরেই চলে যেতে হয় অফিসে। সেখানে আজ প্রচুর কাজ করতে হয়েছে সামির খাঁনের অবর্তমানে। কাজ শেষে টায়ার্ড হয়ে বাসায় ফিরতেই সোফায় তৃষ্ণা কে উক্ত কথাটা বলে। তৃষ্ণা রাফির ঘামার্তক মুখ টার দিকে একবার তাকিয়ে বলে-
-“ যাই নি ভাইয়া।
-“ কেনো?
-“ আমার ভাবি যায় নি তাই আমিও যাই নি ভাইয়া।
রাফি গলার টাই টা ঢিলে করতে করতে সোফায় বসে বলে-
-“ প্লিজ এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও না।
-“ জ্বি ভাইয়া এনে দিচ্ছি।
কথাটা বলে তৃষ্ণা রান্না ঘরে ঢুকে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি গ্লাসে ঢেলে সেটায় নরমাল পানি মিক্স করে রাফির সামনে ধরে বলে-
-“ নিন ভাইয়া আপনার পানি।
রাফি গ্লাস টা নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেয়ে নেয়। প্রান টা জুড়িয়ে গেলো রাফির। খুব তেষ্টা পেয়েছিল। খালি গ্লাস টা সামনে থাকা টেবিলটায় রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তৃষ্ণার দিকে। এতো সুন্দর করে তার কথা বলার ধরন মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। তার উপর যা বলছে কেমন বাধ্য মেয়ের মতো সব শুনছে।
-“ চাচি কোথায়?
-“ ভাইয়া মা তো লিনা আন্টিদের বাসায় গেছে ইনভাইট করতে।
-“ তুমি গেলে না যে? তোমার লিনা আন্টির ছেলে বোধহয় হা-হুতাশ করছে তুমি যাও নি বলে।
তৃষ্ণা লজ্জা পাওয়া মুখশ্রী নিয়ে বলে-
-“ একদম ঠিক ধরছেন ভাইয়া। তুর্য কেবলই ফোন করে হাহুতাশ করছিল ভাইয়া আমি কেনো গেলাম না সেজন্য। ভাইয়া আমার যাওয়া উচিত ছিলো তাই না বলুন?
-“ কি তখন থেকে প্রত্যেক লাইনে লাইনে ভাইয়া ভাইয়া করে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো ভ্যা ভ্যা করে চলছো ইডিয়েট।
রাফি আচমকা এক রাম ধমক দিয়ে বসলো তৃষ্ণা কে। তৃষ্ণা তার ত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলে-
-“ ভাইয়া আপনি তো আমার ভাইয়া লাগেন,আর বয়সেও বড়। তো আমি তো আপনায় ভাইয়াই ডাকবো তাই না? ছ্যাইয়া তো আর ডাকতে পারি না।
তুষার বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে বলে-
-“ ছ্যাইয়া না ডাকতে পারো প্লিজ ভাইয়া ডেকে মাথা গরম করিয়ো না।
-“ তাহলে কি নাম ধরে ডাকবো?বলবো এই রাফি শুনুন এভাবে?
এরমধ্যে তৃষ্ণার ফোন বেজে উঠে। তৃষ্ণা ফোনের স্কিনে তাকিয়ে হাসে। সেটা রাফির নজরে পরে। সন্দেহাতীত হয়ে বলে-
-“ কে ফোন দিছে?
-“ লিনা আন্টির ছেলে তুর্য।
-“ তুর্য না তোমার বয়সে বড়। ভাই কেনো ডাকো না?
-“ ধূরু কি বলেন তাকে কি আর ভাইয়া ডাকা যায়? ভাইয়া ডাকলে তার হার্টে ব্যাথা করে। আমি জেনেশুনে কারো হার্টে ব্যাথা দি না।
-“ এদিকে ক্ষণে ক্ষণে আমায় ভাইয়া ডেকে ডেকে হার্টের ভেতর জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছো আর বলছো জেনেশুনে ব্যাথা দাও না।
রাফি বিরবির করে কথাটা বললো । তৃষ্ণার কর্ণধার অব্দি পৌঁছালো না।
-“ কি বিরবির করছেন ভাইয়া?
রাফির চোখ মুখ শক্ত হলো
-“ কিছু না,আর একবার ভ্যা ভ্যা করে ভাইয়া ভাইয়া বলে কান ঝালাপালা করলে চড়িয়ে দিব গাল লাল করে।
-“ এক মিনিট হ্যাঁ ফোনটা না হয় কেটে যাবে। কথাটা বলে নেই ভাইয়া।
তৃষ্ণা ফোনটা রিসিভ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রাফি রাগান্বিত হয়ে তাকালো তৃষ্ণার পানে। তৃষ্ণার সেদিকে খেয়াল নেই। বাহিরে বের হয়ে বাগানের দোলায় বসে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে সালাম। তৃষ্ণা সালামের জবাব দেয়।
-“ কেমন আছো তৃষ্ণা?
তৃষ্ণা মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে-
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আপনি?
-“ এই তৃষ্ণা খাবার টা গরম করে দাও ক্ষিদে পেয়েছে খুব।
কথাটা বলতে বলতে রাফি এসে তৃষ্ণার সামনে দাঁড়ায়। তৃষ্ণা রাফির পানে তাকিয়ে বলে-
-“ ভাইয়া আপনি তো পোশাক পাল্টান নি। আগে ফ্রেশ হোন আর খাবার টেবিলেই আছে খেয়ে নিন। দেখছেন তো ইমপোর্টেন্স কথা বলছি।
রাফি সূচালো দৃষ্টি দিয়ে তৃষ্ণা কে পরখ করলো। ফোনটা কেঁড়ে কে’টে দিয়ে বলে-
-“ একটা মানুষের ক্ষুধার থেকে কথা বলাটা কখনই ইমপোর্টেন্স হতে পারে না।
তৃষ্ণা রাফির থেকে ফোন টা কেঁড়ে নিয়ে বলে-
-“ আমি কি খাবার ধরে বসে আছি নাকি খাবার সব লুকিয়ে রেখেছি। আপনার ক্ষুধা পেয়েছে গিয়ে খান।
-“ তুমি চলো বেড়ে দিবে। এ বাড়ির ছেলেরা কখনও খাবার নিজ হাতে বেড়ে খায় না এটা নিশ্চয়ই অজানা নয়।
-“ না এ বাড়ির ছেলেরা তো লাটসাহেব তারা কেনো নিজ হাতে ভাত বেড়ে খাবে। হাত তো লজ্জায় মিইয়ে যাবে ভাত বেড়ে খেলে যত্তসব।
কথাটা বলে হনহন করে চলে যায় তৃষ্ণা। রাফি তৃষ্ণার পেছন পেছন যায়।
-“ এড়িয়ে চলছো আমায়? কিন্তু এড়িয়ে চলে কোনো লাভের লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না।
চিত্রা সন্ধ্যা হওয়ায় রুম থেকে বের হয় মাগরিবের নামাজ টা পড়ে। এই সন্ধ্যা বেলায় সব সময় হালকা পাতলা নাস্তা করার অভ্যাস তার। আজ ও ব্যাতিক্রম হবার নয়। রুম থেকে বের হয়ে রান্না ঘরে আসে একটু নুডলস রান্না করতে। রিয়াদ বসা ছিলো বসার ঘরে। চিত্রা কে রান্না ঘরে আসতে দেখে। সিমি তখন রুমে ঘুমে ব্যাস্ত। রিয়াদ রান্না ঘরে ঢুকে,চিত্রা বলে এক কাপ কফি বানিয়ে দিতে। চিত্রা শুনেও না শোনার ভান করে নুডুলস টা রান্না করে বাটিতে ঢেলে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে হাক ছেড়ে তার মা’কে ডেকে বলে রিয়াদ কে যেনো কফি বানিয়ে দেয়।
রিয়াদের ইগো তে লাগলো। তখন শক্ত মুখে কথাটা বলে উঠে। চিত্রা রিয়াদের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টি নিয়ে বলে-
-“ হু আ’র ইউ ম্যান? কোনো প্রিন্স চার্মিং নাকি কোনো বিল গেটস যে আপনাকে ইগনোর বা এভয়ড করা যাবে না।
-“ ইউ নো হু আই অ্যা’ম ইউর।
-“ ইয়াহ আই নো। বোনের স্বামী দুলাভাই।
রিয়াদ চোখ টিপ দিয়ে বলল-
-“ দ্যাট’স লাইক অ্যা গুড গার্ল। রিমেম্বার শালি অর্ধেক ঘরওয়ালি ইউ নো?
চিত্রার ইচ্ছে করলো গরম নুডলস টা রিয়াদের মুখে চেপে ধরতে। রিয়াদ যদি ওর রিলেটিভ না হতো তাহলে এতক্ষণে চড়িয়ে গাল লাল করে দিত ফাজিল ছেলের।
চিত্রা আর ব্যাক্য ব্যায় না করে নুডুলস টা নিয়ে নিজের রুমে চলে আসে।
অধরা বেলকনি তে বসে ছিলো ইজি চেয়ারে। হাতে তার হুমায়ুন আহমেদের অপেক্ষা বই টি। বইটা মনোযোগ সহকারে পড়ছে সে। ছোট্ট একটা ছেলে স্বামী,শ্বাশুড়ি আর দেবর নিয়ে সুরাইয়ার ছোট্ট সংসার।সংসারে তেমন অভাব ছিল না। মাস শেষে পাওয়া বেতন দিয়ে বেশ চলে যেত।সুরাইয়ার ছোট ছেলের নাম ইমন।ইমনের বাবা একদিন অফিস করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।ইমনের বাবা হারিয়ে যাওয়ার আগে তাকে ইমনের মায়ের বলা হয়ে উঠেনি আর তাদের আলোকিত করে আরেকজন নতুন সদস্য আসতে চলেছে।এভাবে অনেকদিন কেটে গেল ইমনের বাবার খোঁজ নেই।কোনো পরিবারে শিশুর আগমন হলে মনে হয় যেন ঘর আলোকিত হয়, কিন্তু সুরাইয়ার মনে হয়েছিল সে আরও ঘর আঁধার করে দিয়েছে।সুরাইয়ার মনে এক ভ্রান্ত ধারনা জন্মালো এই ছোট্ট শিশুটিই নাকি তার বাবা হারিয়ে যাওয়া এবং সকল অশান্তির কারণ।ছোট্ট শিশুটির নাম রাখা হয় সুপ্রভা।কিন্তু এই সংসারের মায়ায় ছোট্ট মেয়ে সুপ্রভা নিজেকে আর বেশিদিন আষ্টেপৃষ্ঠে রাখতে পারিনি। ছোট সুপ্রভাকে যখন মা বললো তুই মরতে পারিস না!ছাদে গিয়ে লাফ দে।সুপ্রভা তাই করলো,মনে হচ্ছিলো বারবার বলি এই ভুলটা করো না!কিন্তু সেই ছোট্ট সুপ্রভা তাই করলো। অভিমানি ছোট্ট মেয়েটি জানল না, বুঝল না।এই পৃথিবীতে তার জন্যে কত ভালবাসাই না জমা ছিল।
সুপ্রভা যখন মারা গেলো, তখন অধরা খেয়াল করলো মনের অজান্তেই চোখের কোণে এক ফোঁটা জল জমেছে। এই নিয়ে চার থেকে পাঁচ বার পড়ে হয়ে গেলো অধরার হুমায়ুন আহমেদের অপেক্ষা বইটা। প্রতিবারই সুপ্রভার মৃত্যু অংশ টুকু পড়া কালিন তার চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। অধরার ভাবনাগুলো কেমন যেন প্রতিবার ঝাপসা হয়ে আসে। কতই না বিচিত্র মানুষের জীবন। লেখকের কয়েকটা কথা ভীষণ ভালো লেগেছে।
ঘর খুলিয়া বাহির হইয়া জোছনা ধরতে যাই
আমার ঘর ভর্তি চাঁন্দের আলো
ধরতে গেলেই নাই………..!”
হুমায়ূন আহমেদের ভাষ্যমতে,
পৃথিবী শূন্যস্থান পছন্দ করে না।
তিনি বলতেন,কিছু না কিছু,কেউ না কেউ
শূন্যস্থান পূর্ণ করে দেয় কিংবা দখল করে নেয়।
অধরা আনমনে আকাশ পানে তাকিয়ে বইটা বুকে জড়িয়ে বলল-
-“ আমার শূন্য স্থান ও একদিন পূর্ণ হবে। পৃথিবী নিজ দায়িত্বে পূর্ণ করবে সেই শূন্য জায়গা। আমি অধির আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করে আছি যে।
#চলবে?