#আমার_বিষাদীনি
#উম্মে_হাফসা
#পর্ব_১১
রাদিফ ভাইয়ের ছোট মামার মেয়ে আদিবা এসে জানালো রাদিফ ভাই আমাকে ডাকছে। আমরা সবাই মিলে তখন ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছিলাম। আদিবা এসে কথাটা বলতেই সবার দৃষ্টি আমার উপর পড়লো। আমি কি করবো একটা ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে উঠে পড়লাম। আর আমি জানি রাদিফ ভাই থেকে এখন আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। দোতলায় উঠে রাদিফ ভাই এর রুমে যেই পা দিলাম ওমনি উনি দরজাটা চাপিয়ে দিলেন। দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বললেন,,
“তখন মিরাজের সাথে অমন হাসাহাসি করছিলি কেন?? শুধু সালাম দিলেই তো হতো। নেক্সট টাইমে যাতে আর না দেখি অন্য ছেলেদের সাথে হাসাহাসি করেছিস।”
আমি বললাম, “উনি নিজেই তো আমার সাথে কথা বলছিলো। আর আমি কই এত হাসাহাসি করলাম। শুধু সৌজন্যতার খাতিরেই একটা হাসি দিলাম। আচ্ছা ভালো কথা আপনি জেলাস হচ্ছেন??” বলে আমি মুচকি হাসি দিলাম।
রাদিফ ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,,
“অবশ্যই আমি জেলাস। আমার বউয়ের সাথে অন্য কেউ হাসাহাসি করে কথা বলছে আর তার সাথে আমার বউও তাল মেলাচ্ছে,, তাহলে অবশ্যই আমি জেলাস হবো”।
” আচ্ছা ঠিক আছে আর কোনো ছেলের সাথে কথাই বলবো না,,ইভেন কোনো কাজিন ভাইয়ার সাথেও না। কারণ আমার তো জামাই আছে।।আমি তার সাথে হাসাহাসি করবো” বলে আমিও রাদিফ ভাই কে জড়িয়ে ধরলাম।
“রাদিফ দেখতো আমাকে শাড়িতে কেমন লাগছে। আমি জানি আমাকে সুন্দ,,, বলেই মাথা উঠিয়ে তাকাতে সিনথিয়া রাদিফ আর তুবা কে অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখলো।
আমি সিনথিয়া আপুর কথা শুনেই ঠেলে রাদিফ ভাই থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। সিনথিয়া আপু আমাকে ধমকের সুরে বললেন,,
” তুবা, তুমি এইকগানে রাদিফের সাথে কি করছো?? তাও আবার রাদিফ কে দেওয়া রুমে”
“তো, তুবা এইখানে থাকবে না তো কোথায় থাকবে। আফটার অল আমরা হাসবেন্ড ওয়াইফ। তুই তো যেভাবে বলছিস যেন আমাদের দুজনের একসাথে থাকা অসম্ভব ব্যাপার” বলে রাদিফ ভাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সিনথিয়া আপুর দিকে চাইলেন।
সিনথিয়া আপু নাটক করার ভঙ্গিতে বললেন,,
“ও সরি আমি তো ভুলেই গিয়েছি তোরা স্বামী স্ত্রী। আসলে হয়েছে কি, তুবাকে দেখতে আসলে তোর স্ত্রীর মতো লাগে নাহ তো৷ মনে হয় তোর ছোট বোন” বলে সিনথিয়া আপু বিদ্রুপ হাসি দিলো।
“যেদিন আমার বেবি কোলে নিবি সেইদিন তুই নিশ্চিন্ত হবি যে তুবা আমার স্ত্রী,, তাই তো?? আচ্ছা যা তোকে খুব তাড়াতাড়ি ফুফি বানানোর চেষ্টা করবো” বলে রাদিফ ভাই ও সিনথিয়া আপুর দিকে বিদ্রুপ হাসি ছুড়ে দিলো।
আর আমি ওনাদের ঝগড়া দেখতে দেখতে বেক্কেল হয়ে গেলাম। তাই দুজন থেকে মুক্তি পেতে আমি বললাম,,
“আচ্ছা আমি যাই। মা মনে হয় আমাকে ডাকছে” বলেই আমি কোনোরকম বের হয়ে আসলাম।
_____________________
দুপুরে মাহাদ ভাই কে গোসল করানোর সময় সবাই রঙ খেলছে। একমাত্র আমি এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আমার দাদি আর রাদিফ ভাই এর নানুর সাথে। রাদিফ ভাই এর নানু তো এখন আমাকে তুবা থেকে ডিরেক্ট নাতবউ এর মধ্যে চলে এসেছে। সবাই যখন বললো এখন রং খেলা হবে রাদিফ ভাই তখনি আমার ফোনে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে
“এখন যদি তুই রং খেলিস তো তোর একদিন কি আমার একদিন। তোর শরীর দুর্বল। এখন দৌড়াদৌড়ি করলে নির্ঘাত উষ্ঠা খেয়ে পড়বি। সো, তুই রঙ খেলবি না।”
এই ম্যাসেজ দেখে তাই তখন থেকে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমাকে রঙ খেলতে বারণ করে উনি নিজেই রঙ খেলছে। আমি জানি উনি আমাকে মিরাজ ভাইয়ের জন্য রঙ খেলতে দিচ্ছে না। এসব যখন ভাবছি তখন দেখলাম সিনথিয়া আপু রাদিফ ভাই কে রঙ লাগিয়ে দিলো এবং ওনার হাতের অবশিষ্ট রঙ উনি নিজের মুখে লাগিয়ে নিলেন। কিন্তু দেখলাম রাদিফ ভাই এর কোনো হেলদোল নেই খুব সম্ভবত উনি সিনথিয়া আপু কে খেয়াল করেনি। রাদিফ ভাই কে মনে মনে বকাবকি করছি। আমাকে অন্য ছেলেদের সাথে মিশতে উনি সহ্য করতে পারে না আর নিজের বেলায় সাত খু*ন মাফ।
আসুক আমার কাছে আজকে তো বুঝিয়ে দেবো।
এসব ভাবছি তখন দেখলাম সিনথিয়া আপু আমার দিকে এগিয়ে আসতেছে। আমার কাছে এসে উনি বাকা হাসি দিয়ে বললো,,
“আরে তুবা, যে রঙ খেলছো না?! নাকি রাদিফ খেলতে দিচ্ছে না??”
আমি বললাম, “না আমার রঙ খেলতে ইচ্ছে করছে না” বলে আমি রাদিফ ভাই এর দিকে দৃষ্টিপাত করলাম।
সিনথিয়া আপু স্বান্তনার ভঙ্গিতে আমাকে বললো,,
“থাক মন খারাপ করো না। রাদিফ তোমাকে রঙ খেলতে দিচ্ছে না জানি আমি। আসলে ওর মনে কখন কি চলে কেউ বুঝতে পারে না। এই যে দেখো না খানিক্ষন আগেই আমার মুখে রঙ লাগিয়ে দিলো,, বলেই উনি আমাকে নিজের মুখে দেওয়া রঙ গুলো দেখলো। আর অস্ট্রেলিয়া তে তো আমরা একই ইউনিভার্সিটি তে। ও আমাকে মাঝে মাঝে অনেক জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায়। দাঁড়াও আমার ফোনে ছবি আছে” উনি নিজের ফোন
থেকে আমাকে কিছু ছবি দেখালো। দেখলাম এগুলো কোনো একটা কফি শপে তোলা।
এদিকে সিনথিয়া মনে মনে ভাবছে,,
“আমাকে অপমান করা,,না। এইবার বুঝবে রাদিফ যখন তুবা তোমাকে আস্তে আস্তে ভুল বুঝতে শুরু করবে”।
আমি রাদিফ ভাই কে ফোন দিচ্ছি। রিং হচ্ছে কিন্তু ধরছে না। কয়েকবার কল দেওয়ার পর কল ধরলো উনি। ফোন ধরে চারপাশে তাকিয়ে আমাকে দেখলো উনি। আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,,
” কি হয়েছে?? ফোন দিলি যে,,কোনো সমস্যা হয়েছে। নাকি শরীর খারাপ করছে??” বলে আমার কপালে হাত রাখলো।
আমি ঝাটা মেরে হাত ফেলে দিয়ে বললাম,,
“আমাকে রঙ খেলতে বারণ করে এখন আপনি নিজেতো দিব্যি রঙ খেলে যাচ্ছেন। এমন রঙ খেলছেন যে কে আপনাকে রঙ লাগালো না লাগালো সেইদিকে কোনো খেয়ালই নেই। সিনথিয়া আপু যে আপনাকে রঙ লাগালো আপনি সেটাও খেয়াল করেননি তাই না”
“জান এতো রাগ করছো কেন!! সত্যি বলতে সিনথিয়া যে আমাকে রঙ লাগালো আমি নিজেই খেয়াল করিনি। খেয়াল করলে কি আমাকে স্পর্শ করতে দিতাম” বলে রাদিফ ভাই আমার এক হাত জড়িয়ে ধরলো।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,,
“আচ্ছা সেটা নাহয় খেয়াল করেননি,,কিন্তু যখন দুজনে একসাথে বসে কফি খাচ্ছিলেন সেটাও কি খেয়াল করেননি??”
রাদিফ বুঝলো সিনথিয়া যে তুবা কে ঐ ছবি গুলা দেখিয়ে তুবা কে ভুল বুঝাতে চাইছে তাই তুবা কে বললো,,
“আমি জানি তুই কোনটার কথা বলছিস। ঐদিন সিনথিয়া নিজেই আমাকে কফির অপার করেছে আর ও নিজেই জোর করে ছবি গুলা তুলেছে। আসলে অস্ট্রেলিয়া থাকতে সিনথিয়া আমাকে প্রপোজ করেছে আমি একসেপ্ট করিনি। তাই আঠার মতো আমার পিছে পড়ে আছে।”
“আর কখনো আপনি ওনার সাথে কোথাও জাবেন না। আমার ভালো লাগে না”
“আচ্ছা যাবো না। আমার বউয়ের হুকুম বলে কথা”।
আর মনে মনে বললো, ” তোকে আমি দেখে নেবো সিনথিয়া। আমার বউকে ভুল বোঝাচ্ছিস। এর শাস্তি তোকে পেতে হবে। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি”।
______________________
হলুদের স্টেজ করা হয়েছে রাদিফ ভাই এর নানু বাড়ির ছাদে। সন্ধ্যার দিকে রাহা আপুরা এসেছিলো। আর সঙ্গে তো আপুর ননদের মেয়ে লামিসা আছেই। যখনি শুনেছে রাদিফ ভাই এসেছে বিয়েতে তখন থেকেই নাকি ও বিয়েতে আসার জন্য উতলা হয়ে আছে। এই মেয়েগুলো র জন্যও আমার জামাই রে কি করতাম আমি।
ছাদে মোটামুটি সেজেগুজে সবাই চলে গেছে। আমি আর সাবিহা এখনো রেডি হই নাই। সবাই কে সাজিয়ে দিতে দিতে নিজেরাই এখনো কিছু করলাম না। সাজানোর সময় লামিসার ন্যাকামি গুলাতে তো আমি আর সাবিহা অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। দুজনে কোনোরকম শাড়ি পড়েছি। আমি চুলগুলো হাত খোপা করে একটা বেলিফুলের মালা দিয়ে বেধে নিলাম। বেলি ফুলের মালাটা রাদিফ ভাই আদিবার দিকে আমার জন্য পাঠিয়েছে। হালকা একটু লিপস্টিক লাগিয়ে নিলাম আর চোখে কাজল,, ব্যাস আমি রেডি।
আমি আর সাবিহা ছাদে গিয়ে দেখলাম অলরেডি সবাই চলে এসেছে। দুজনেই একেবারে লাস্ট কর্ণারে দুইটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। বড় রা সবাই এক এক করে ছবি তুলছে মাহাদ ভাইয়ের সাথে। আমি আর সাবিহা শুধু সিনথিয়া আপু আর লামিসার কর্মকাণ্ড দেখতেছি। দুজনেই রাদিফ ভাইয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।
এতক্ষণে রাদিফ ভাইয়ের দিকে আমারচোখ পড়লো। আর আমি তো আড়চোখে শুধু রাদিফ ভাইকে দেখে যাচ্ছি। নীল কালারের পাঞ্জাবি টা ওনার ফর্সা ঘায়ে যেন দ্বিগুণ ফুটে উঠেছে। হাতে ঘড়ি,,পাঞ্জাবির হাতা গুটানো। বার বার চুল গুলো কে শুধু পেছনে ঠেলছে।
মনে মনে ভাবছি,, আমি করলেই যত দোষ। নিজে যে সেজেগুজে মেয়েদের সামনে ঘুরছে সেটা কিছু না।
পাশ থেকে এক মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলো,,
“তুমি মাহাদের কি হও”??
” আমি মাহাদ ভাইয়ের ফুফাতো বোন হই”
“আমি মাহাদের বন্ধুর মা হই”
আমি বললাম,, ও আচ্ছা। এরপর মহিলা আমার পুরা জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে নিলো। বাড়ি কোথায়,,কয় ভাই বোন,,বাবা কি করে,,কিসে পড়ি সব।
তারপর ভদ্রমহিলা আমাকে তার ছেলের ছবি দেখালো। বললো,,আমার ছেলে কলেজের টিচার। বিয়ের জন্য পাত্রী খুজছি। তোমার মতো যদি একটা লক্ষ্মী মেয়ে পেতাম!! আচ্ছা যদি কিছু মনে না কর তোমার বাবার নাম্বার টা দাওতো।
যেই আমি ভদ্রমহিলা কে কিছু বলতে যাবো তখন শুনলাম পেছন থেকে কে যেন রাদিফ ভাই এর নাম্বার দিচ্ছে। পেছন ঘুরে দেখলাম রাদিফ ভাই!! উনি উনার নাম্বার ভদ্রমহিলা কে দিয়ে সৌজন্য হেসে আমার দিকে দাত চেপে বললো,,
“আমরা তো এখন ওকে বিয়ে দেবো না। ও এখনো অনেক ছোট তো,,তাই না বুঝে আপনাকে এতক্ষণ ওর পরিচয় বলছে। আপনি কিছু মনে করবেন না। ওকে যদি কেউ বিয়ে করতে চায় তাহলে ওর স্বামী সব কিছু শেষ করে দিবে” বলে আমাকে টেনে ধরে অন্য পাশে নিয়ে আসলেন।
আর ভদ্রমহিলা তো বেক্কেল বনে গেছে।
[দেরি করে দেওয়ার জন্য দুঃখিত]
চলবে……..