আপন মানুষ পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
3171

#আপন_মানুষ
#৪র্থ_এবং_শেষ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



অবনীর খিলখিল হাসির শব্দে আমার ঘুম ভাঙলো।ঘুম ভেঙে দেখি মা আমার শিউরে বসে আছেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ততক্ষণে আমার সারা শরীর ঘেমে একসার। বিশ্বাস করতে পারছি না কিছুতেই যে এটা আমার স্বপ্ন ছিল!আমি কাঁদছি ‌। হাউমাউ করে কাঁদছি।আর ভাবছি, বাস্তবতা যদি এরচেয়ে খারাপ হয়! ভয়াবহ হয়!
মা বললেন, ‘খারাপ স্বপ্ন দেখছো ?’
আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,’জ্বি মা।’
‘কী দেখছো?’
‘দেখেছি অবনীকে বিয়ে করে বাসায় নিয়ে এসেছে রবিন।আর ওরা আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছে এখান থেকে।’
মা বললেন,’পারবে না।ওই মাগীকে আমি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো!’
মা খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।যেন সত্যি সত্যি ওরা আমায় তাড়িয়ে দিতে আসছে !

দুপুর দুপুর অত্যাধিক টেনশন করার কারণে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। কিছুতেই হুঁশ ফিরছে না।মা সঙ্গে সঙ্গে এম্বুলেন্স ডেকে আমায় হসপিটালে নিয়ে গেলেন।

তারপর যা ঘটলো-

জ্ঞান ফিরলো আমার বিকেল বেলা।জ্ঞান ফেরার পর চোখ খুলেই দেখি অবনী আমার এক পাশে বসে আছে।ওর গায়ে সেই স্বপ্নে দেখা শাড়ির মতো একটা শাড়ি।হাতে সেই সুন্দর বালা। গলায় মুক্তোর মালা।আর ও পাশে রবিন বসা।আমি ওদের দেখেই চিৎকার করে উঠলাম।অবনী আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো।আমি বললাম,’নেমকহারাম মেয়ে, তোকে আমি খুন‌ করে ফেলবো!ছাড় আমার হাতটা।’
অবনী কিছু বলতে চাইলো এর আগেই আমি ওর গাল খসে একটা চড় বসিয়ে দিলাম।
অবনী আমার হাত তার গালের কাছে নিয়ে ধরে কান্নাভেজা গলায় বললো,’দে আরো চড় দে।যতো ইচ্ছে মার।’
তারপর তার গলার কাছে আমার হাত উঠিয়ে নিলো।বললো,’নে।মেরে ফেল আমায়।খুন কর।তোর ইচ্ছে পূরণ কর।’
রবিন তখন ধমক দিলো।বললো,’রাখো। তোমাদের নাটক এখন এসব বন্ধ রাখো।এটা নাটকের সময় না!’
এরপর রবিন বাইরে থেকে যাকে ডেকে নিয়ে এলো তাকে দেখে আমার কলিজা শুকিয়ে গেলো!ও তো সজীব। যার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়। কিন্তু আমার বাবা মা ওর কাছে বিয়ে দেয়নি।সজীবদের আর্থিক এবং বংশীও অবস্থা ভালো নয় বলে। আমাকেও সেদিন মেনে নিতে হয়েছিল সবকিছু। কারণ বাবা আমায় ভয় দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন,আমি যদি সজীবের সাথে সম্পর্ক রাখি তবে তিনি মারা যাবেন!

অবনী আমার কাছে ফিসফিস করে বললো,’আমি কী করে বলতাম এটা তোকে?বললে তুই কষ্ট পেতি। কিন্তু আমি কী করতাম বল? বেচারা তোর থেকে পাওয়া শোক কিছুতেই ভুলতে পারছিলো না।ওর শোক ভুলাতে গিয়ে কীভাবে যে আমি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম! তারপর গোপনে বিয়েও করে ফেললাম।গোপনে বিয়ে করার কারণ হলো, ভেবেছিলাম তোকে জানাবোই না কিছু।আরো দিন গেলে পরে জানবি। তখন তুই সহজেই বিষয়টা মেনে নিতে পারবি! তাছাড়া রবিন ভাইয়াকে আমি নিষেধ করেছিলাম তোকে জানাতে!এই জন্য সেও তোর কাছে বিষয়টা ক্লিয়ার করেনি!’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’গোপনে বিয়ে করেছিস তো হঠাৎ পালিয়ে গেলি কেন?’
‘পালিয়ে যাইনি।একটা সমস্যা হয়ে গিয়েছিল। সজীবের ভালো চাকরি হয়েছে।টাকা হয়েছে এখন। এই লোভে তার ছোট চাচা জোর করছিলো তার মেয়েকেই যেন সজীব বিয়ে করে। এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে আমার ওখানে যেতে হয়েছিল। এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে তার পরিবার ওখানে আমায় বরণ করে নেয়!’
‘তো মা যে বললো ওসব?তোরা ঘরের দরজা বন্ধ করে–?’
অবনী কিছু বলার আগেই রবিন হেসে ফেললো। হেসে বললো,’ঘরের দরজা ঠিকই বন্ধ ছিল।আর মা যা সন্দেহ করেছিলো ঘরের ভেতর ঠিক তাই হয়েছিলো। কিন্তু ঘরের ভেতর আমি ছিলাম না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’তাহলে কে ছিল ঘরের ভেতর?’
‘সজীব। ওদের গোপন বিয়ের পর থেকেই সে এখানে আনাগোনা করতো। তুমি বাসায় না থাকলেই আমি তাকে ফোন করে আনতাম!’
আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
আমি এবার বললাম,’রবিন শুনো,মা না তোমার বাবাকে নিয়ে একটা নোংরা কথা বলেছেন এটা কী সত্য?’
রবিন বললো,’ওই যে বুয়ার সাথে–‘
আমি বললাম,’হু।’
রবিন হেসে ফেললো। কিন্তু হাসির পর একটু গম্ভীরও হলো। এবার গম্ভীর মুখেই সে বললো,’বাবা পবিত্র মানুষ ছিলেন।তার চরিত্রে কালিমা লেপন ঠিক হবে না।মার এটা ভুল ধারণা। আসলে মা সকল পুরুষদেরই ভয় পান এবং বিশ্বাস করতে পারেন না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’কেন?’
রবিন বললো,’ছোট বেলায় মাকে তার যে মামা সবচেয়ে বেশি আদর করতো সেই মামাই কিশোরী কালে তাকে প্রথম ধর্ষন করে।মা এই কথাটা আজ অবধি কাউকে বলেননি। শুধু আমার এক খালা জানতেন। কারণ সেই খালাও মার এই মামার হাতেই তার সতীত্ব হারিয়েছিলেন। আমার এই খালাই আমার কাছে সব খুলে বলেছেন। এরপর থেকেই মার এই সমস্যা। তিনি কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেন না!’
রবিনের কাছ থেকে এমন একটা কথা শুনে ঘেন্নায় আমার মুখে থুথু জমে উঠলো।আর কেবল মনে হতে লাগলো,এই পৃথিবীর নারীরা কী কোনদিন মুক্তি পাবে না।তারা কী কোনদিন পুরুষের অধীনত্ব কাটিয়ে তাদের পাশাপাশি দাঁড়াতে পারবে না?তারা কী এই কথা বলতে শিখবে না, পুরুষ তুমিও যেমন মানুষ আমিও তেমন মানুষ। তুমি আমার চেয়ে বড় নও আর আমিও তোমার চেয়ে ছোট নয়।
আর পুরুষেরাও কী কোনদিন পুরুষ থেকে মানুষ হয়ে উঠতে পারবে না?
আমি ভাবি। ভেবে কূল পাই না!

সজীব আসে এবার আমার সামনে।ওর ঠোঁটে আলতো হাসি।এই হাসির ভেতরেও কেমন যেন বিষাদ!কেমন যেন কান্না!
আমারও চোখ ছলছল করছে। বুকের ভেতর কেমন ব্যথা হচ্ছে।চিন চিন করা ব্যথা। অনেক দিন আগে ভুলে গিয়েছিলাম আমি সজীবকে। আর রবিনকে কাছে টেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু সজীবকে কী আসলে ভুলা হয়েছে আমার? কিংবা সজীব আমায় ভুলতে পেরেছে?
বোধহয় না। একটুও না। ভালোবাসা হয়তোবা এমনই। আপনি চেষ্টা করবেন ভুলে যেতে।ভান করবেন ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু ভুলতে পারবেন না। একদিন না একদিন আপনার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটার চুমুর স্পর্শে মনে পড়বে ঠিক আপনার হারিয়ে ফেলা মানুষটার ঠোঁটের কথা!

—সমাপ্ত—

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে