#আড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঠি
#১১তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
একটা বিকট আওয়াজ হলো। পি*স্তল থেকে গু*লি ছুঁড়লে এরকম আওয়াজ হয়। কিন্তু প্রফেশনাল কি*লার যারা তাদের পি*স্তলে সাইলেন্সার লাগানো থাকে। তখন আর আওয়াজ হয় না। ফৌজিয়া তো আর প্রফেশনাল কি*লার না। সে হয়তো কয়দিনের জন্য এই পি*স্তল ভাড়া করেছে অথবা কিনেছে।তাই এইসব সম্পর্কে তার তেমন ধারণা না থাকারই কথা।
ফৌজিয়া যখন গু*লি করলো তখন পি*স্তলের সাউন্ড হবার সঙ্গে সঙ্গে আমি বুকে হাত দিলাম। কোথায় বিঁধেছে বুলেট খুঁজে দেখছি।বুলেট যদি বুকে বিঁধে তবে তো ব্যথায় এতোক্ষণে মরে যাবার কথা। বুকের ক্ষত থেকে গলগল করে রক্ত বেরুবার কথা। কিন্তু এরকম তো কিছুই হচ্ছে না! অবাক করা কান্ড! এও কি সম্ভব যে বুলেট বুকে বিঁধে গেল আর কোন ক্ষত হলো না। রক্ত বেরুলো না।ব্যথা হলো না!
আমার দম আটকে আসছে। মৃত্যুর ভয়ে শরীর ঘেমে চুপসে গেছে। কিন্তু আমি তখনও চোখ খুলছি না। ভয়ে।চোখ খুললাম ফৌজিয়ার কন্ঠ শুনে। সে বললো,’ তপু, তোমার চোখ খুলো।’
আমি তার কথার সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুললাম না।চোখ খুললাম আরো খানিক পর। ভয়ে ভয়ে।
তারপর মিটিমিটি করে তাকাতেই দেখলাম ফৌজিয়া পি*স্তল হাতে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে পি*স্তলের বাট দিয়ে আমার মাথায় চাটি মেরে বললো,’ তোমার ডান পাশে তাকাও।’
আমি ভয়ে ভয়ে তাকালাম ডান পাশে। ওখানে একটা ডাউস সাইজের মূর্তি রাখা। কোন দেব- দেবীর মূর্তি না। দেব -দেবীর মূর্তি দেখলেই চেনা যায়। কিন্তু এটা কার আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। কিন্তু কিছুটা পরিচিত মনে হচ্ছে এই চেহারা। ফৌজিয়া যে পি*স্তল আমার দিকে তাক করেছিল আর আমি ভেবেছিলাম সে আমায় গু*লি করবে এটা ভুল ভেবেছিলাম। সে আমায় গু*লি করেনি। সে গু*লি করেছে মূর্তিটাকে।মূর্তিটার বুক ফাঁকা হয়ে পেছন দিকে চলে গেছে বুলেট। মূর্তির বুকে ফাঁকা হয়ে যাওয়া জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখান থেকেই।
ফৌজিয়া তার মুখটা এবার আমার মুখের কাছে নিয়ে এলো এবার। একেবারে কাছে। তারপর ফিসফিস করে বললো,’ ভয় পেয়েছো তপু?’
আমি বললাম,’ না।ভয় পাবো কেন? ভয় পাওয়ার কি আছে? ভয় পাইনি একদম।’
ফৌজিয়া বললো,’ আচ্ছা। তাহলে একটা গু*লি করি তোমায়। তোমার বুকে। এই যে এখানে
কেমন? ‘
আমার বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে স্পর্শ করে বললো সে।
তারপর পি*স্তলের নলটা ওখানেই বুকের উপর ঠেকালো।আমি তখন থরথর করে কাঁপতে শুরু করলাম। আমার মুখ থেকে ভয়ে গোঁ গোঁ একটা আওয়াজ বেরুতে লাগলো। এছাড়া আর কিছু বলতে পারছিলাম না উচ্চারণ করে।
ফৌজিয়া হা হা হা করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,’ এই তোমার সাহস তপু? চেক করে দেখো প্যান্ট ঠিক আছে কি না!’
ওর দিকে আর তাকাতে পারছি না। কিন্তু মনে মনে বলছি, আরেব্বাবা, এ কি মানুষ নাকি আজরাঈল!
ফৌজিয়া বললো,’ আচ্ছা তপু বল তো এই মূর্তিটার শিল্পী কে? মানে এটা কে বানিয়েছে?’
আমি বললাম,’ জানি না তো আমি। আমি কিভাবে বলবো?’
ফৌজিয়া এবার আমার সঙ্গে রাগ দেখালো। এবং জীবনে প্রথমবারের মতো সে আমার সঙ্গে নোংরা ভাষায় একটা কথা বললো।বললো,’ তুমি কোন বালটা জানো তাহলে তপু?’
এরপর ফৌজিয়া নিজ থেকেই বললো,’ সরি! মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বকা দিয়ে ফেলছি। এখন শুনো, এই মূর্তির শিল্পী আমিই।আমিই এটা দীর্ঘ সময় নিয়ে তৈরি করেছি।বড় যত্ন করে তৈরি করেছি।যেন নিখুঁত হয়। কিন্তু এই নিখুঁত আর নিজের তৈরি এই মূর্তিটার কাছে প্রতিদিন সকাল এবং সন্ধ্যায় আমি যাই।কেন যাই জানো?’
আমি বললাম,’ কেন যাও?’
ফৌজিয়া বললো,’ থুথু ফেলতে।রোজ দুইবার করে থুথু ফেলে আসি এর মুখে।’
আমি ফৌজিয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম। কিছুই বুঝতে পারছি না। সে একটা এতো বড় মূর্তি তৈরি করেছে।আর রোজ এটার মুখের উপর সকাল -সন্ধ্যা দুইবার করে থুথু ছিটিয়ে আসে। কেন?
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’ মূর্তি তুমিই তৈরি করেছো, আবার তুমিই এর মুখে থুথু ফেলে আসো। কেন? কেন করো এটা?’
ফৌজিয়া বললো,’ এক কাজ করো। তুমি মূর্তিটার কাছে যাও আগে। একেবারে কাছে। মুখটার কাছে। গিয়ে দেখ তো চিনতে পারো কি না এটা কোন অশূরের মূর্তি! ‘
আমি বসা থেকে উঠে আস্তে আস্তে মূর্তিটার কাছে গেলাম। প্রথমে মোটেও বুঝতে পারছিলাম না।চেনা যাচ্ছিলো না। কিন্তু সময় নিয়ে যখন ভালো করে লক্ষ্য করলাম, তখনই বুঝতে পারলাম, এই অশূর আর কেউ না। আমার অপু ভাইয়া। এই মূর্তি অপু ভাইয়ার।
আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে আছি তখনও। মূর্তির কাছে।যেন আমি হঠাৎ করেই নড়তে ভুলে গেছি। চলতে ভুলে গেছি।যেন আমার সময় থমকে গেছে। ভাবনা, চিন্তা সব, সবকিছু থেমে গেছে।
ফৌজিয়াও হেঁটে হেঁটে এখানে এলো। তারপর তার পায়ের এক আঘাতে মূর্তিটাকে দূরে ছিটকে ফেললো। দূরে ছিটকে পড়ে গিয়ে মাটির মূর্তি ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। ফৌজিয়া এবার মূর্তির ভাঙাচোরা টুকরো গুলোর পাশে বসে একটা টুকরো তার হাতে নিলো। তারপর হাতের চাপে ভাঙা টুকরোটা একেবারে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফুঁ দিয়ে এর শুকনো ধুলো গুলো উড়িয়ে দিয়ে দু’ হাতে লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,’ তপু, আমি কোনদিন কাউকে হ*ত্যা করিনি। কোন প্রাণীকেই না।মশা তো ক্ষতিকর প্রাণী। কিন্তু একটা মশাও হ*ত্যা করিনি আমি।সত্যি বলছি। আল্লাহর কসম। এই যে তোমার অপি ভাবী আমার কাছে গিয়েছিলো তার গর্ভপাত করাতে। তোমার কি ধারনা, আমি তাকে এই কাজ করতে দিয়েছি? উঁহু। দেইনি। তোমার কাছে এমনিই মিথ্যে বলেছি। তার গর্ভে এখনও তার সন্তান আছে।আমি তাকে বুঝিয়েছি।আমি বলেছি, এই সন্তান শুধুই তোমার। তোমার পরিচয়েই এই সন্তান বড় হবে। বেড়ে উঠবে। এই সন্তানকে তুমি মানুষ করে গড়ে তুলবে।ও যদি ছেলে হয় তবে একে শেখাবে নারীদের সম্মান করতে। ওকে বলবে, নারীরা দেবীর মতো। দেবীদের অসম্মান করলে ধ্বংস হয়ে যেতে হয়! আর মেয়ে হলে ওকে একজন পৃথীলতা ওয়াদ্দেদার করে গড়ে তুলবে। বীরাঙ্গনা করে গড়ে তুলবে। যেন খারাপ পুরুষেরা ওকে দেখলেই ভয়ে শিউরে উঠে।অপি ভাবী বুঝেছে। সে আমার কথা মেনে নিয়েছে।
এখন তো বুঝলে আমার এইটুকু বয়সে আমি কোন অপরাধ করিনি। কোন হ*ত্যা টত্যা কিচ্ছু করিনি। কিন্তু আজ করবো। শুধুমাত্র একটি হ*ত্যা। একটি নি*র্মম হ*ত্যা। কিভাবে করবো জানো? ‘
ফৌজিয়ার কথা শুনে ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে আমার।আমি ভীষণ তেষ্টায় কাশতে লাগলাম। ফৌজিয়া নিজেই ফ্রিজের কাছে গিয়ে একটা পানির বোতল নিয়ে এলো। তারপর তা আমার হাতে দিয়ে বললো,’ খাও।গলা ভেজাও।’
আমি বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে সবটুকু পানি শুষে নিলাম। তারপর বললাম,’ কিভাবে হ*ত্যা করবে? কিভাবে?’
ফৌজিয়া হাসলো।বললো,’ কিছু কিছু পুরুষ আছে যাদের বিশেষ অঙ্গটি তাদের অমানুষ বানিয়ে দেয়। অসামাজিক বানিয়ে দেয়।বন্য জানোয়ার বানিয়ে দেয়।আমি যাকে হ*ত্যা করবো,সেও এরকম একটা জানোয়ার।আমি সবার আগে তাকে ঘরের পিলারের সঙ্গে বেঁধে ফেলবো। তারপর জীবিত পুরুষটির ওই খারাপ অঙ্গটি কেটে ফেলবো। সে নিশ্চয় তখন ভয়ে চিৎকার করবে। আমার কাছে জীবন ভিক্ষা চাইবে। কাঁদবে। আকুতি মিনতি করবে।আমার তখন কি যে আনন্দ হবে তপু! তখন আমি আনন্দে চিৎকার করে গান গাইতে থাকবো। রবীন্দ্রনাথের গান। আমার সবচেয়ে প্রিয় গান –
” আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে
যাব না
যাব না গো, যাব না যে
থাকব পড়ে ঘরের মাঝে
যাব না গো, যাব না যে
থাকব পড়ে ঘরের মাঝে
এই নিরালায়
এই নিরালায় রব আপন কোণে
যাব না এই মাতাল সমীরণে। ”
বলে ফৌজিয়া আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো টেবিলের কাছে। তারপর টেবিলের ড্রয়ার খুলে আমায় চকচকে ঝকঝকে নতুন স্বচ্ছ চা*কুটি দেখালো। তারপর বললো,’ এই যে এটা দিয়ে।বুঝলে?’
এরপর এক অদ্ভুত ঘটনা করলো ফৌজিয়া। এই যে এতো রাগী ফৌজিয়া।এতো সাহসী ফৌজিয়া।যে খানিক আগেই মূর্তিটার বুক বিদীর্ণ করে ফেললো গু*লির আঘাতে। তারপর পায়ের আঘাতে খন্ড বিখন্ড করে দিলো মূর্তিটি। তারপর চা*কু দেখালো আমায়। এরপর এসব রেখে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো ফৌজিয়া। সে আমার পায়ের কাছে এসে বসলো।যেন আমি এক দেবতা আর সে পুজোর ফুল। তারপর আমার হাত দুটো মুঠো করে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,’ তপু, কোনদিন তোমায় বলা হয়ে উঠেনি। কোনদিন আমি বলতে পারিনি।সত্যি সত্যি আমি তোমায় ভালোবাসতাম। পাগলের মতো ভালোবাসতাম। ভালোবাসতাম বলেই তো দেখতে না, স্কুল জীবনে তোমার সঙ্গে কিভাবে ছায়ার মতো মিশে থাকতাম? দেখতে না, লজ্জা শরম সব ভুলে গিয়ে কিভাবে দিনের পর দিন তোমাদের বাসায় চলে যেতাম তোমার সঙ্গে! আচ্ছা তপু, ভালোবাসা কি বিরাট বড় পাপ নাকি? ভালোবাসলে কি নরক লাভের চেয়েও বড় কোন শাস্তি পেতে হয় এই পৃথিবীতে?
‘
#চলবে