আছো তুমি হৃদয়জুড়ে পর্ব-০১

0
4498

#আছো_তুমি_হৃদয়জুড়ে
#পর্ব_১
#জাফিরাহ_জারিন

“পাপা!!এইটা কি আমার নতুন মাম্মাম??”
ছোট্ট ৩ বছর বয়সী রিশান জিজ্ঞাসা করলো তার বাবাকে।কিন্তু তার বাবা কোনো উত্তর দিল না।নিজের ছেলেকে চুপ থাকতে দেখে ইলারা বেগম অর্থাৎ রিশানের দাদী রিশানকে বললো,
“হ্যা দাদুভাই।এইটা তোমার নতুন মাম্মাম।”
নিজের দাদীর কাছ থেকে সম্মতি পেয়ে ছোট্ট রিশান ছুটে গেল মিহির কাছে।মিহির কাছে গিয়ে মিহির কোলে উঠে বসলো রিশান।তারপর সে মিহিকে জিজ্ঞাসা করলো,
“আচ্ছা তুমি তো আমার নতুন মাম্মাম তাইনা??”
“হুম”,উত্তর দিল মিহি।
“তাহলে তুমি আমাকে অনেক অনেক আদর করবে তো??”
“অবশ্যই করব সোনা।”
“জানো আমার বন্ধুদের মাম্মামরা তাদেরকে কত্ত আদর করে।তাদেরকে খাইয়ে দেয়,ঘুম পাড়িয়ে দেয়,কিন্তু আমাকে তো দিদা ঘুম পাড়িয়ে দিত,খাইয়ে দিত।এখন থেকে তুমি দেবে তো মাম্মাম?? ”
“অবশ্যই দেব সোনা।কেন দেব না??”
“রিশান দাদুভাই!!এবার এসো মাম্মামকে আর পাপাকে ঘুমাতে দাও।”ইলারা বেগম বললো তার নাতিকে।
“না।আমি আজকে মাম্মাম আর পাপার কাছে ঘুমাবো।”মুখ ফুলিয়ে বললো রিশান।
“তা হয় না দাদুভাই। আজকে তুমি আমার কাছে ঘুমাও।কালকে তোমার মা-বাবার কাছে ঘুম এসো।কেমন??”
“ঠিক আছে”,ঠোট উল্টে জবাব দিল রিশান।তারপর রিশান আর ইলারা বেগম চলে গেলেন।রিশান আর ইলারা বেগম চলে যেতেই রিদিম এসে ধাম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।এরপর দরজার সাথে হেলান দিয়ে শান্ত দৃস্টিতে মিহির দিকে তাকালো।রিদিমের এই শান্ত চাহনি যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা খুব ভালো করেই জানে মিহি।একটা শুকনো ঢোক গিলে পরবর্তীতে আসা ঝড়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিল সে।
“একটা কথা পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি মিহি।তোমাকে আমি বিয়ে করেছি শুধুমাত্র রিশানের জন্য।রিশানের একজন মায়ের দরকার।আমার আমার মায়ের মতে রিশানের জন্য তোমার থেকে ভালো মা আর কেউ হতে পারে না।তাই শুধুমাত্র রিশানের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বিয়েটা করেছি।স্ত্রী হিসেবে তোমার প্রাপ্য সব অধিকারই তুমি পাবে।তবে “ভালোবাসা” নামক জিনিসটা কখনও আমার থেকে আশা করো না।আশা করি বুঝতে পেরেছো”।একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো রিদিম।যেন আগে থেকেই এসব বলার জন্য প্রস্তুত ছিল সে।কিন্তু তার এই কথাগুলো মিহির উপর যে কিরকম প্রভাব ফেলেছে তা শুধু মিহিই জানে।কোনোমতে নিজের কান্না আটকিয়ে ধীর গলায় উত্তর দিল সে,
“হুম।বুঝেছি।”
“গুড।বুঝতে পারলেই ভালো।”
এই বলে বিছানার একপাশে এসে শুয়ে পড়লো রিদিম।
“আলমারির ভিতরে কোলবালিশ আছে।শুয়ে পড়ার আগে কোলবালিশটা আমাদের মাঝখানে রেখে দিও।”
“আর কিছু বলবেন??”
“না”।
মিহি ধীরে ধীরে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল।এরপর রিদিমের কথামত আলমারির থেকে কোলবালিশ নিয়ে এসে তার আর রিদিমের মাঝে রেখে দিল।এরপর সে খাটের অপর পাশে শুয়ে পড়লো।কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না মিহির।তাই সে অন্যদিকে ফিরলো।খুবই সুক্ষ্মভাবে রিদিমকে পর্যবেক্ষণ করছে মিহি।ঘুমন্ত অবস্থায় কতটা মায়াবি লাগছে রিদিমকে।কি অদ্ভুত নিয়তি!!আজ থেকে ৫ বছর আগে যেই মানুষটার খুশির জন্য এই দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিতে হয়েছিল মিহিকে আজ সেই মানুষটাকেই নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে মিহি।একসময় এই মানুষটার ভালোবাসা চেয়েও পায় নি মিহি আর আজ এই মানুষটার ভালোবাসা পেয়েও পাচ্ছে না সে।আগামী দিনগুলোতে কি হতে চলেছে তা জানা নেই মিহির।তবে সে শুধু এটুকুই চায় যে এই রিদিম নামক মানুষটা তাকে একটু ভালোবাসুক।আর কিচ্ছু লাগবে না তার।
______________________________________
সূর্যের আলো এসে মুখের উপর পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল রিদিমের।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো সে।পাশে তাকাতেই মিহির ঘুমন্ত চেহারাটা চোখে পড়লো রিদিমের।ঘুমন্ত অবস্থায় অনেক আবেদনময়ী লাগছে মিহিকে।কিন্তু না,এইবার আর কারোর মায়ায় জড়াবে না রিদিম।একবার মায়ার বাধনে আবদ্ধ হয়ে নিজের সবকিছু হারিয়েছে সে।এখন শুধু তার কাছে রিশান আছে।তাই আরও একবার নিজেকে মায়ায় বেড়াজালে আবদ্ধ করে রিশানকে হারাতে পারবে না সে।তাই অতি দ্রুত মিহির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল সে।এরপর উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল সে।পানির শব্দ কানে যেতেই ঘুম ভেঙে গেল মিহির।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো সে।খেয়াল করলো রিদিম তার পাশে নেই।ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে।তার মানে রিদিম ফ্রেশ হতে গেছে।মিহি বিছানা থেকে নেমে খুব সুন্দর করে বিছানা গুছিয়ে রেখে দিল।হঠাৎ দরজায় কেউ নক করতেই মিহি নিজের মাথায় ঘোমটা টেনে নিল।তারপর গিয়ে দরজা খুললো।দরজা খুলতেই একজোড়া ছোট্ট কোমল হাত জড়িয়ে ধরলো তাকে।রিশানকে দেখে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিল মিহি।পরম মমতার সহিত রিশানকে কোলে তুলে নিল মিহি।রিশানের গালে একটা চুমু খেল সে।
“গুড মর্নিং মাম্মাম। ”
“গুড মর্নিং ডিয়ার।ঘুম কেমন হলো তোমার রিশান সোনা??”
“হুম ভালো।কিন্তু তোমাকে আর পাপাকে মিস করেছি।দিদা আমাকে তোমাদের কাছে আসতেই দিচ্ছিলো না।”
“সমস্যা নেই সোনা।আজকে তুমি আমাদের কাছেই ঘুমিও কেমন!!”
“ইয়েএএএ!!!আজকে অনেক মজা হবে।তুমি আমাকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে তো মাম্মাম?? ”
“অবশ্যই। আমার লক্ষ্মীসোনাকে আমি অনেক অনেক গল্প শোনাবো।”
“ইইইইইইই!!!কি মজা!!!” হাত তালি দিতে দিতে বললো রিশান।
রিশানকে এভাবে হাসতে দেখে খুব ভালো লাগছে মিহির।প্রথম যখন রিশানকে দেখেছিল ছেলেটার মন খারাপ ছিল।আজকে ওকে খুশি দেখে আনন্দ হচ্ছে মিহির।
“গুড মর্নিং পাপা।”
রিশানের কথা শুনে পিছে ঘুরলো মিহি।দেখলো রিদিম দাঁড়িয়ে আছে।মনে হচ্ছে এইমাত্র গোসল করছে।চুল থেকে এখনও টপটপ করে পানি পড়ছে।রিদিম একটা ব্ল্যাক কালার টাউজার আর গ্রিন কালার টি-শার্ট পড়ে আছে।দেখতে খুব সুন্দর লাগছে।আরও একবার নতুন করে এই মানুষটার প্রেমে পড়ছে সে।রিদিম এগিয়ে এসে মিহির কোল থেকে রিশানকে নিল।
“গুড মর্নিং মাই সন।ব্রেকফাস্ট করেছো??”
“নো পাপা।আমি তো আজকে মাম্মামের হাত থেকে খাবো।”
রিদিম একবার মিহির দিকে তাকালো।নিজের ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করছে মিহি।
“ঠিক আছে।তো চলো এখন ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসি।মাম্মাম ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে আসুক।”
“ওকে পাপা।”
এরপর রিদিম আর রিশান খেতে গেল।আর মিহি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল।
_______________________________________
কমিউনিটি সেন্টারে একে একে গেস্টরা আসতে শুরু করেছে।রিদিম সব গেস্টদেরকে স্বাগতম জানাচ্ছে।রিদিম একটা ব্লু কালার স্যুট পড়েছে।রিশানও নিজের বাবার সাথে মিলিয়ে ব্লু কালার স্যুট পড়েছে।বাবা-ছেলেকে দেখতে একদম একইরকম লাগছে।মিহি তো মুগ্ধ নয়নে রিদিম আর রিশানকে দেখছে।মিহি একটা ব্লু কালার লেহেঙ্গা পড়েছে।তাকেও অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে।আজ রিদিম ও মিহির বৌভাতের অনুষ্ঠান।খুব সুন্দর ভাবেই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো।রিদিমের ফ্রেন্ডরা তো মিহিকে নিয়ে প্রচুর জ্বালিয়েছে রিদিমকে।যদিও রিদিমের খু রাগ হচ্ছিল।কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে তাদের কিছুই বলে নি সে।একপর্যায়ে ফটোগ্রাফার তাদের দুজনের কাপল পিক তুলতে চাইলে কিছুতেই স্বীকার হয় নি রিদিম।কিন্তু পরে রিশান জোর করেছিল বলে রিদিম মিহির সাথে কাপল পিক তুলতে বাধ্য হয়।ফটো তোলার সময় অনেকটাই কাছাকাছি ছিল রিদিম আর মিহি।এমনটা হওয়ায় মিহির মনে এক আলাদা অনুভূতি হচ্ছিল।কিন্তু সেই অনুভূতিকে মনের মধ্যেই রেখে দিয়েছিল সে।
_____________________________________
বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষে নিয়ম অনুযায়ী রিদিম আর মিহিকে মিহিদের বাড়িতে যেতে হবে।তাদের সাথে রিশানও যাবে।
মিহিদের বাড়িতে,
নতুন মেয়ের জামাইকে সাদরে গ্রহণ করলেন মিহির মা মিনতি বেগম।নিজের মেয়ের জামাই এর আদর-যত্নে কোনো অংশে কমতি রাখলেন না তিনি।রিশানকেও একদম নিজের নাতির মতোই আদর করেছে মিহির মা-বাবা।খাওয়া-দাওয়া শেষে মিহির মা মিহিকে বললেন রিদিম ও রিশানকে নিয়ে মিহির রুমে নিয়ে যেতে।মিহিও মায়ের কথামত রিদিম আর রিশানকে তার নিজের রুমে নিয়ে গেল।কিন্তু রুমের সামনে যেতেই মিহির কানে এলো,
“নিজের জামাইকে এনেছিস ভালো কথা।তাই বলে নিজের সৎ ছেলেকেও আনবি!!”
চলবে…………………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে