#আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস
পর্ব – ১২
বর্ষা পেরিয়ে যাচ্ছে অল্প অল্প করে৷ শ্রাবনের শেষে প্রকৃতিতে কদমগন্ধা হাওয়ার দাপাদাপি। বেলা এগারোটার দিকেও আকাশে ভর সন্ধ্যে। গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলো তনিমা। পিচঢালা পরিচ্ছন্ন পথঘাট ভিজে, ঠিক যেন একটা আঁকাবাঁকা অজগরের মত দেখাচ্ছে। রাস্তা আজ ফাঁকা। নিতান্তই দরকার ছাড়া ঘরের বাইরে কেউ নেই৷ রাজশাহীর মানুষেরা বরাবরই শান্তি প্রিয়। অফিস আদালতের বাধ্যবাধকতার ভিড়ে জমে থাকা লোকগুলো ছাড়া, বাকিরা সুযোগ পেলেই ঘরে মুখ লুকাতে ভালোবাসে। তনিমাও তার ব্যতিক্রম নয়। আর অন্তুর ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। কি ঝড়, কি বৃষ্টি! কি দিন, অথবা রাত, সাদা পোশাকে তাকে চষে বেড়াতে হয় শহর। গত তিনদিন তার সাথে সঙ্গ দিয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়িয়েছে তনিমা নিজেও৷ লাবণ্যর বিষয়টি কয়েক মাস ধরে ভয়ানক কষ্টে দিচ্ছে তাকে। কিন্তু গত দুই দিনে যা তথ্য পেয়েছে, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে। কাল রাতে ঘুম হয়নি এক ফোঁটাও৷ শুধু মনে হয়েছে, এ সত্যটা না জানলেই বোধহয় ভালো হত। জীবন কি সত্যিই এত নিষ্ঠুর? স্বপ্ন মানেই কি মরিচীকা?
লাবণ্যদের বাড়ির সামনে গিয়ে হর্ণ দিতেই ড্রাইভার ছুটে এসে গেট খুলে দিলো। তারপর এগিয়ে এসে বললো,
– আপা, রাস্তায় গাড়ি সাইড করে রাইখেন। ভেতরে আজ জায়গা নাই। প্যান্ডেল হইসে।
তনিমা গাড়ি সাইড করে ভেতরে এসে ধাক্কা খেলো একটা৷ বিশাল ব্যাপার চারিদিকে। এলাহী কারবার যাকে বলে আর কি। গাড়ি বারান্দা থেকে বাগান পর্যন্ত বিশাল প্যান্ডেল করে মাদ্রাসার বাচ্চাদের বসানো হয়েছে। সবাই উচ্চস্বরে কোরআন তেলওয়াত করছে। বাগানের একপাশে মাটি খুঁড়ে চুলা বানোনো হয়েছে। বাবুর্চিরা বড় হাড়িতে নানান পদের রান্না করছে। বেশ কিছু লোকজন দূরে চেয়ার নিয়ে বসেছে। তাদের মাঝে চয়নের দিকে চোখ আটকে গেল তনিমার। তাকে দারুণ ঝরঝরে দেখাচ্ছে আজ। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পরেছে সে। ছিপছিপে সুন্দর শরীর । চুল গুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ফর্সা সুন্দর মুখটা, আজ আরো বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। ঠোঁটে তার হাসি নেই। কিন্তু গম্ভীরভাবটাও নেই। কেমন যেন নিষ্পাপ চোখ মুখ, টলটলে স্নিগ্ধতায় ভরা। ছেলেরা এত সুন্দর হয়, জানা ছিলো না তার। তবে তনিমার কাছে চয়ন বরাবরই আকর্ষণীয়। কিন্তু আজ যেন তার প্রতি অনেক বেশি দুর্দমনীয় আকর্ষনে চূর্ণ হয়ে যাচ্ছিলো সে। সেই সাথে বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক ঢেউ খেলে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন বিভ্রান্তিতে ডুবে যাচ্ছে। কিসের পিছে ছুটছে তনিমা? সত্য নাকি মিথ্যা? ভুল নাকি ঠিক? রহস্য উদঘাটনের নেশায় যদি ভুল কিছু করে বসে, নিজেকে কি কোনদিন ক্ষমা করতে পারবে?
– তনি মা, কখন এসেছো তুমি?
তনিমা চট করে চোখ ফেরালো৷ লাবণ্যর বাবা এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। এই মানুষটা তনিমাকে ভিষণ ভালোবাসে। নিজের মেয়ের মতোই। সেই কোন ছোটবেলা থেকে পরিচয় লাবণ্যর সাথে। তখন থেকেই এই মানুষটার সাথে পরিচয়৷ আংকেল বলে ডাকা মাত্রই তিনিও হাসি মুখে ডেকে উঠতেন, “তনি মা”। আজ তাকে দেখে ভেতরে ভেতরে মুচড়ে উঠলো সে। কি অবস্থা মানুষটার। চোখ মুখ বসে গেছে একদম। বয়স যেন এক ধাক্কায় দশ বছর বেড়ে গেছে। ভিষণ বৃদ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। সন্তানের শোকে একজন বাবার এমন রূপান্তর মেনে নেওয়া সহজ নয়।
– আমি এলাম এইমাত্র আংকেল। লাবণ্য কোথায় আছে?
– যাও, ঘরেই আছে। তোমার আন্টিও আছে। সকালে বোধহয় তোমাকে ফোন দিয়েছিলো তোমার আন্টি। আসলে লাবণ্যকে সামলানো খুব কঠিন হয়ে গেছে। সে কারো কাছে থাকে না। তোমার আন্টি একা একা পারছে না একদম। আজ তো অনেক কাজ বাসায়।
তনিমা অভয় দিলো,
– আমি আছি তো আংকেল। আমি দেখছি। আপনি চিন্তা করবেন না।
ঘরের ভেতরে ঢুকে একটু সচকিত হলো তনিমা। ৮-১০ জন মহিলা বসে আছে ড্রয়িং রুমে। প্রত্যেকের আপাদ মস্তক বোরখায় ঢাকা৷ কেউ কেউ বসে কোরআন তেলওয়াত করছে। কেউ কেউ দোয়া পড়ছে অনবরত৷ তাদের পাশ কাটিয়ে লাবণ্যর ঘরে ঢুকলো সে। ঘরটা আজ সুন্দর করে সাজানো। জানালা জুড়ে নতুন সাদা পর্দা। বেড কভার, কুশন কভার সব ধবধবে সাদা। ডান পাশের ছোট টেবিলে চিনামাটির ঘিয়ে রঙের ফুলদানি। তাতে এক আটি রজনীগন্ধা ফুল৷ ঘরময় সে ফুলের সুবাস। মিষ্টি স্নিগ্ধতা ভেসে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। কিন্তু এই সুন্দর আবহাওয়া বেশিক্ষণ থাকলো না। লাবণ্যকে ধরে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন তার মা। চকিতে হতভম্ব তনিমা। কি অবস্থা হয়েছে তার। আজ যেন একটু বেশিই খারাপ দেখাচ্ছে। স্বাস্থ্য ভাঙছে অনেকদিন থেকেই৷ আজ চোয়াল থেকে গলার হাড় পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে তার। চোখ দেখে মনে হচ্ছে, কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে এখুনি৷ তনিমা নিজের ব্যাগ ফেলে রেখে দৌড়ে গেল তার কাছে। বললো,
– আন্টি আমি ধরছি তনিমাকে৷ কি অবস্থা ওর আজ!
– না! না! তোমাকে ধরা লাগবে না। আমি পারব।
লাবণ্যর মা হাত নেড়ে থামালেন তাকে। তনিমা দাঁড়িয়ে পড়লো। তিনি একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে লাবণ্যকে শুইয়ে দিলেন বিছানায়। তারপর তনিমার দিকে ঘুরে বললেন,
– মামনি, তোমাকে সকালে কল করেছিলাম। তুমি রিসিভ করোনি।
– আসলে আন্টি, আমি খেয়াল করিনি একদম। ফোন চার্জে দেওয়া ছিলো। আর আমিও একটু ব্যস্ত ছিলাম।
– আচ্ছা, সমস্যা নেই৷ ঘরটা খেয়াল করেছো?
তনিমা আরেকবার ঘরের চারিদিকে খেয়াল করলো। লাবণ্যর ঘর জুড়ে তার বইয়ের প্রচ্ছদগুলো বাঁধায় করে টাঙানো ছিলো৷ এখন একটাও নেই৷ দেওয়াল পুরো ফাঁকা৷
– ঘর সাজানো সুন্দর হয়েছে আন্টি।
– উহু! সুন্দরের কথা বলিনি। জানোই তো, আজ কেন এত আয়োজন। একটায় কারণ আমার বাড়ির উপর থেকে কালোছায়া দূর করা। ড্রইং রুমে যারা বসে আছে, তারা সব নাম করা মানুষ। সকলে কুরআনের হাফেজ। উনারা বলেছেন, আজ বাড়িতে, বিশেষ করে এই ঘরে কালোর কোন চিহ্ন রাখা যাবে না। তাই সব পালটে দিয়েছি।
তনিমা খানিকটা আড়ষ্ট হলো। নিজের পোশাকের দিকে তাকালো একবার। তার পরনে কালো-গোলাপির কম্বিনেশনের সিল্কের সালোয়ার কামিজ। কুচকুচে কালো ওড়নার উপর, দারুণ সুন্দর গোলাপি কাজ। যদিও সে একদম এইসব মানে না। বুঝতে পারছে, আন্টি যা বলছে তা সম্পূর্ণ কুসংস্কার। তবুও তাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করছে না।
লাবণ্যর মা সাথে সাথে বুঝে নিয়েছে। বললো,
– সমস্যা নেই৷ আমি লাবণ্যর একটা ড্রেস আলমারি থেকে বের করে দিচ্ছি। এটা পালটে নাও কেমন? ও আর তোমার গড়ন তো প্রায় একই ছিলো। পোশাক ফিটিং হবে তোমার। এখন ওর পোশাক গুলো ওর নিজেরই হবে না৷ দেখছো, শরীরটা?
লাবণ্যর মা চোখ মুছতে মুছতে উঠে পড়লেন। লাবণ্য তখনও বিছানায় পড়ে আছে। ঝিম ধরে। চোখ বন্ধ। তনিমা যখনই আসে, তখনই ঝিম ধরে পড়ে থাকে সে৷ নাহলে ঘুমিয়ে থাকে। কতদিন যে কথা বলে না ওর সাথে। ভিষণ কান্না পাচ্ছিলো তনিমার। একটা সময় নিজের কথাগুলো লাবণ্যর সাথে শেয়ার না করলে তার খাবার হজম হতো না। সব কিছু তাকে বলা চায় ই চায়। আর এখন, কত কিছু বুকে চেপে রাখতে হয়। অন্তুর সাথে প্রায় সবই শেয়ার করে সে। কিন্তু তবুও মানুষের কিছু কথা থাকে, যা বেস্ট ফ্রেন্ড ছাড়া কাউকে বলা যায় না। না বলতে পারলে হাসফাস লাগে। বুকের উপর মনে হয় পাথর চাঁপা। যার জীবনে বেস্ট ফ্রেন্ড নেই, সে এই অনুভূতি বুঝবে না!
——————————————————
শহর ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে এক নির্ঝঞ্ঝাট গ্রামে তৈরি হয়েছে প্রত্যাশা নামের প্রবীণ আশ্রম কেন্দ্র। এক কথায় যাকে বলে বৃদ্ধাশ্রম। কিছুক্ষণ আগেই আরেক পশলা বৃষ্টি ঝরে গেছে৷ আশ্রম কেন্দ্রটি গ্রামের এক কোনে অবস্থিত। দারুণ সুন্দর জায়গা। বিশাল এলাকার উপর গড়ে তোলা এই আশ্রমটি মূলত ধণী, বিলাসী, কিন্তু একাকী মানুষের আবাস স্থল। অন্তু গাড়ি নিয়ে গেটের কাছে এসে দাঁড়ালো৷ বিশাল এক সবুজ গেটের ফাঁকফোকর দিয়ে ভেতরের চমৎকার সৌন্দর্য চোখে পড়ছে। গেটের কাছে লেখা আছে নো স্মোকিং জোন। অন্তু গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েস করে ফুসফুস নিকোটিনের ধোঁয়া পূর্ণ করে নিলো৷ তনিমা পাশে থাকলে ভালো লাগে তার। তবে সমস্যা একটায়৷ সিগারেট সে সহ্য করতে পারে না৷ তার পাশে যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ তাকে এক প্রকার উপোস করেই থাকতে হবে। সিগারেটের ধোয়া কুন্ডলী বানিয়ে ছাড়তে ছাড়তে অন্তু ফোন বের করে চেক করলো৷ অফিসের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তার উত্তর পাঠালো। তারপর আজকের কাজের সিডিউলে চোখ বুলিয়ে নিলো একবার। এখানে কি কি করতে হবে, তার একটা লিস্ট তনিমা করে পাঠিয়েছে কাল রাতে। মেয়েটা আসলেই জিনিয়াস। এমন একটা মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চলেছে, এ নিয়ে সূক্ষ্ম একটা গর্ববোধ সবসময় কাজ করে তার। তনিমার কথা মতো লেখক আগন্তুক আর প্রত্যয় এদের দুইজনই তার সন্দেহের তালিকায়। প্রথমে সে আর তনিমা দুজনই ভেবেছিলো এই খুনের সাথে প্রত্যয় জড়িত। মোটিভ একটায়, তার নিজের এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ার। তবে ভাবনা থেকে পরে সরে এসেছে৷ শুধু মাত্র পরকীয়া প্রধান হলে প্রথম মৃত্যুটা মল্লিকার হতো। অনিন্দিতার না। আর দ্বিতীয়ত, মৃত্যুর জন্য এক গাদা নয়নতারা ফুলের দরকার পড়ত না। মৃত্যুর আরো অনেক সহজ পদ্ধতি আছে। এত ঝামেলায় কে যাবে? হুম, যেতে পারে সেই, যার এর পেছনে লাবণ্যকে ফাসানোর মোটিভ আছে। তনিমার কথা মতো সেটা লেখক আগন্তুক ছাড়া আর কেউ নয়। কয়েক বছর ধরে সামান্য তফাতে জনপ্রিয়তার রেটিং এ লাবণ্যর পেছনে তার অবস্থান। এই সামান্য তফাৎ টা ভাঙতে পারেনি সে৷ তাই যশ, খ্যাতির লোভে সে অন্য পথ অবলম্বন করেছে। প্রত্যয়ের মাধ্যমে সে ধ্বংস করতে চেয়েছে লাবণ্যর লেখক স্বত্তা। এক ঢিলে দুই পাখি আর কি! এখন মৃত্যুটা যদি শুধু মল্লিকার হতো, তাহলে পাবলিকের মনে সন্দেহ তৈরি করা কঠিন হতো৷ কিন্তু পর পর দুটো মৃত্যু পাবলিক খাবে ভালো, এই ছিলো তার পরিকল্পনা। কিন্তু এই আগন্তুক কে? সেখানেই বড় প্রশ্ন। আগন্তুককে সেরার সেরা এওয়ার্ড প্রোগ্রামে দেখে চমকে উঠেছিলো তারা দুজনই। কেন যেন মনে হয়েছে, একে তারা চেনে। আবার চেনেনা। কেমন যেন আলো আঁধারীর মতো এক মানুষ। সেই এওয়ার্ড প্রোগ্রামের পর কেউ তাকে আর দেখেনি। একজন মানুষও তার ঠিকানা জানে না। ফোন নাম্বার জানে না৷ সে শুধু মাত্র মেইলের মাধ্যমে প্রকাশকদের সাথে যোগাযোগ করে। তনিমার কথা হলো যেভাবেই হোক, আগন্তুকের এই রহস্য উদঘাটন করতেই হবে।
তারপর থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দুজনে। অন্তু পরের কয়েকদিন তার প্রতিটি প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করেছে। সাধারণত কেউই তার ব্যাপারে কথা বলতে চায়নি৷ লেখকের পক্ষ থেকে নাকি নিষেধ আছে। কিন্তু নিজের পুলিশি আইডি কার্ড দেখাতেই সুড়সুড় করে এক একজন যা জানে সব উগলে দিয়েছে। তাদের কথার সারমর্ম এই, আগন্তুকের সাথে তাদের কখনো ফোনে কথা হয়নি, কোনদিন দেখা হয়নি। একটা বইমেলাতেও তিনি কোন স্টলে সামান্য সময়ের জন্য উপস্থিত হননি। তিনি পান্ডুলিপি প্রকাশককে পাঠান মেইলে। আর নিজের রয়্যালটি নেন একাউন্টের মাধ্যমে। প্রকাশকরা একাউন্টে এমাউন্ট পাঠিয়ে দেন। ব্যাংকে সে একাউন্টের খোঁজ নিতে গিয়ে বিশাল এক ধাক্কা খেল অন্তু। অদ্ভুত ব্যাপার। আগন্তুকের ব্যাংক একাউন্ট কোন পুরুষের নামে নয়। সে একজন নারী। তেষট্টি বছর বয়সের সেই নারীর স্থায়ী ঠিকানা এই প্রত্যাশা বৃদ্ধাশ্রম।
(চলবে)